আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ননী ভৌমিকের অগ্রন্থিত গল্প

বিপ্লব বিশ্বাস


জন্মশতবর্ষে কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে স্মরণ করা হয়তো একটা ছুতো; আবার এই ছুতোকে ধরেই ফিরে পেতে হয় হারানো ঐতিহ্য, তাকে হাজির করতে হয় সেইসব পাঠকের সামনে যাদের কাছে অধরা ছিলেন সেই আশ্চর্য - অমল মানুষটি তথা সান্দ্র কলমচি। এখানে কলমিক চলাচলই মূল কেননা যাঁকে এই বিশেষ বর্ষে স্মরণ করছি তাঁর সাহিত্য সৃজনের গুটিকয় অগ্রন্থিত গল্প নিয়ে আমার এই উৎসর্জিত প্রতিবেদন।

তিনি ননী ভৌমিক, বেশির ভাগ পাঠক বিশেষত আজকের প্রজন্ম তাঁকে চেনেন না; আর ভাসাভাসা আগ্রহীজনেদের কাছে তিনি 'ধুলোমাটি' বা 'ধানকানা'র রূপকার। হয়তো সামান্য কয়েকজন পড়েছেন আর সিংহভাগই বই দুটির নাম শুনেছেন। তবুও অনুল্লেখে মানহানি হয়, তাই...

যারা জানেন তারা তো কিছুটা নয়তো অনেকটাই জানেন, কিন্তু যাদের কাছে তিনি ধুমধূসর তাদের সামনে ননী ভৌমিকের জীবনগতির বক্রয়ানা সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও উপস্থাপন করা প্রয়োজন। কারও সৃজন- ফসল চিনতে হলে তার সৃজকের প্রবাহিত জীবনের সঙ্গে সাঁতরে যেতে হয়। নইলে সংযোগ অপ্রতিষ্ঠ থেকে যায়। ১৯২১ সালের ১০ই নভেম্বর বীরভূম জেলার সিউড়িতে জন্মলাভ করে পথচলায় রংপুর, কলকাতা হয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে যিনি খানিকটা বাধ্য দীর্ঘবাসান্তে ফুরিয়ে গেলেন ১৯৯৬ সালের ২০শে (মতান্তরে ১৮ই) ডিসেম্বর আর পথিমধ্যে সাহিত্যসেবক হিসেবে আগ্রহী পাঠকদের জন্য কতটুকু কী রেখে গেলেন তার বলস্বী পরিচয় পাওয়া নিবন্ধের খাতিরেই দরকার।

তাঁর সৃজনের পর্যুপ্তি একেবারেই ঈর্ষণীয় নয়, বাজারি হিসেবে নয় তেমন উল্লেখ্যও। সাকুল্যে লিখেছেন একটিমাত্র উপন্যাস যা 'ধুলোমাটি' নামে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় আর তিরিশ বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সুবাদে ১৯৮৯ সালে পঃ বঃ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কারের লজ্জারুণ প্রদান তথা লেখকের একমাত্র সরকারি স্বীকৃতি। গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত মিলিয়ে তাঁর গল্পসংখ্যা ৫৪টি (আরও থাকতে পারে এক দু'টি)। কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ, শিশুকিশোর গল্প, 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'মস্কোর চিঠি' আর মস্কো- বাসকালীন সময়ে ১৯৬৯-এ উজবেকিস্তান ভ্রমণের অমিত অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা 'মরু ও মঞ্জরী'। তাঁর প্রকাশিত চারটি গল্পগ্রন্থ অজ্ঞাত পাঠকের সামনে তুলে ধরে বলি, প্রথম 'ধানকানা' (১৯৪৭), দ্বিতীয় 'আগন্তুক' (১৯৫৪), তৃতীয় 'পূর্বক্ষণ' (১৯৫৭) ও চতুর্থ তথা সর্বশেষ 'চৈত্রদিন' প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে।

এই সামান্য তথা অসামান্য বিস্ফোরক পুঁজি নিয়ে ননী ভৌমিকের সৃজনশীল লিখনযাত্রা যার পরিসর ১৯৪৩-৪৪ থেকে শুরু করে ১৯৫৭ অব্দি; ঠিক তাঁর অনুবাদের কাজ নিয়ে মস্কো যাত্রার প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত। এই কাল-পর্যায়ে ননী যে প্রতিবাত প্রতিবেশের মাঝ দিয়ে গিয়েছেন সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর ও তজ্জনিত সাধারণ নিরন্ন মানুষের হাহাকার তথা দেশভাগজনিত দেশভিখারিদের অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় তাঁর অভিজ্ঞতায় আমর্ম চারিয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এইসব তিক্ততাকে পাথেয় করেই তাঁকে সৃজনপথে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। এ এক মানবিক বাধ্যবাধকতা যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে কলমচর্চা তাঁর কাছে ছিল না-মঞ্জুর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ননী ছিলেন তৎকালিক কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী এবং সেই সূত্রেই প্রথমে 'জনযুদ্ধ' ও পরে 'স্বাধীনতা' পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। গোপাল হালদারের সঙ্গে যুগ্মভাবে 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ পর্বের উত্তাল সময়কে সঙ্গী করে তাঁর রচিত প্রথম গল্পগ্রন্থ 'ধানকানা' প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের মার্চে, স্বাধীনতার প্রাক- মুহূর্তে এবং তখন থেকেই তাঁর সাহিত্যিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। এর ঠিক এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। যাই হোক, এই দুর্মদ সময়প্রবাহে তাঁর সবেমাত্র উপন্যাস তথা গল্পলিখন চলতে থাকে, হতে থাকে প্রকাশিতও যার উল্লেখ আগেই করেছি। এরমধ্যেই ১৯৫৭ সালে পার্টির উদ্যোগ তথা নির্দেশে অনুবাদকর্মের কাজ নিয়ে ননীকে মস্কো যেতে হয় ও প্রখ্যাত 'প্রগতি প্রকাশনী'তে যুক্ত হতে হয়। এই স্থানান্তর তথা কর্মান্তর তাঁর মৌলিক সৃজনের সাবলীল গতিপথ প্রমাণিতভাবেই রুদ্ধ করে দেয় এবং তাঁর জীবনের পথও খেবড়ো হয়ে থুবড়ে পড়ে, পাকদণ্ডী বিমর্ষতায়। মস্কো বাসকালীন তাঁর মৌলিক সৃজন - বন্ধ্যা সময়ে তিনি অবিরাম তরজমার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এভাবেই তাঁর জীবনে এল রুশ স্ত্রী সভেতলানা (শ্বেতলানা!) ও একমাত্র পুত্র দমিত্রি যার রহস্যাবৃত অকালপ্রয়াণ দম্পতির মনপ্রাণ একদম গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। যাই হোক, এরমধ্যেই সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, 'প্রগতি প্রকাশনী'র বন্ধ্যাদশা ইত্যাকার নানান আঘাতে খিন্ন ননী যখন অতীতচারিতায় মগ্ন তখনই 'আজকাল' পত্রিকায় ১৯৯২ সালের ৯ই জুলাই ননী - সুহৃদ অরুণ সোম লিখলেনঃ 'চোখের সামনে দেখতে পেলাম 'ধুলোমাটি', 'ধানকানা'র লেখক নিজেই ট্র্যাৃজিক উপন্যাসের নায়ক হয়ে অন্তিম দিন গুনছেন প্রবাসে। আশঙ্কা হচ্ছে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রতি আমাদের চরম ঔদাসীন্যের আরও একটি নজির ননীদাকে দিয়ে দেখাতে না হয়। এ ঘটনাটি হবে আরও করুণ, কেননা ঘটে চলেছে প্রবাসে।... ওঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে এখনও হয়তো সারিয়ে তোলা সম্ভব।... প্রবাসে দৈবের বশে অঘটন ঘটে গেলে খেদ থেকে যাবে আমাদের সকলেরই। তাঁকে সাহায্য করতে হলে করা দরকার এখনই - আজই - আগামীকাল সে সুযোগ নাও আসতে পারে।'

প্রকৃতই সে সুযোগ আমরা গ্রহণ করিনি। এরপর সাড়ে চার বছর কেটে গেলে অসুস্থ, বিধ্বস্ত ননী ভৌমিকের জীবনদীপ নিভে গেল সেই প্রবাসেই, ১৯৯৬ সালের ১৮ই (মতান্তরে ২০শে) ডিসেম্বর। জীবিত ও প্রয়াত দুই ননীকেই আমার স্বভাবসুলভ ঢঙে বিস্মৃত হলাম। পিটিআই তাঁর প্রয়াণ-খবর দিলেও কোনও ভারতীয় দৈনিকে পরদিন সে দুখ-খবর ছাপা হল না। অথচ তা প্রকাশ পেল বাংলাদেশের সংবাদপত্রসমূহে কৃতজ্ঞতাপরবশ হয়ে যার উল্লেখ করেছিলেন অপর ননী - সুহৃদ হায়াত মামুদ। এরপর ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখে 'আজকাল'-এ বেরলো 'ননী ভৌমিক মস্কোয় প্রয়াত'। এ বড় নিষ্ঠুর কৌতুক!

এবারে ননী ভৌমিকের লিখন-বৈশিষ্ট্যে আসা যাক। প্রথমেই বলি খেবড়ো জীবনের পাকদণ্ডী পথে চলাচল করলেও তাঁর অন্তর্গত চারিত্রিক রোমাঞ্চন তাঁর গদ্যে স্পষ্ট তথা কাব্যিক ঢঙে প্রকটিত। অধিকাংশ গল্পেই তাঁর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রজন্মের বিরোধ, বিশ্বাসের সংকট বা বদল এ সমস্ত অতিক্রম করে বিশ্বাসের যে প্রত্যয়ী স্থাপনার কথা বলা হচ্ছিল তা আমাদের দেশে তখন নতুন। আর এগুলো জাগতে থাকে অর্থনৈতিক মন্দার সময় থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে। বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আস্থাশীল ননী মনে করতেন প্রকৃতই সাহিত্যে আকাট বাস্তবকে প্রতিফলিত করাই আসল বাস্তববাদ। ম্যাক্সিম গোর্কির মতানুসারে তিনিও মনে করতেন, কাহিনি রচনা করতে হলে সত্য ঘটনাসমূহ থেকে নির্যাস গ্রহণ করে তাকে একটি চিত্রকল্পে নিহিত করতে হবে। আর সেখান থেকেই বাস্তববাদের পথানুসন্ধান মিলবে। কিন্তু সত্য ঘটনাবলি থেকে গৃহীত ভাববস্তুর সঙ্গে আমরা যদি হাইপোথিসিস অনুসারে কাঙ্ক্ষিত ও সম্ভাব্য কিছু যুক্ত করি যাতে ভাবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকল্পও বর্ধিত হয় তাহলে পাই রোমান্টিসিজম। এটাই উপকথা অর্থাৎ কাহিনির ভিত্তিমূল। এর ফলে বাস্তবতা সম্পর্কে এমন এক বিপ্লবী মনোভাব সৃষ্ট হয় যা কার্যক্ষেত্রে বিশ্বে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।

এই বিশ্বাস তথা সূত্রানুসারে, এখানে উল্লেখ্য, ননী ভৌমিক 'ইউলিসিস', ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' - এই উপন্যাসত্রয়কে ন্যাচারালিজম বা স্বাভাবিকতাবাদের একঘেয়ে, অতিকথিত জঞ্জাল বলে অভিহিত করেছিলেন। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা ছিল ননী ভৌমিকের লব্ধ বিশ্বাস।

বিংশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে কল্লোলীয় যুগের যে ঘোর আবর্তন তা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করে সাধারণ অবস্থানে আঁকার অমল নিষ্ঠায় যে সব কলমচি ব্রতী ছিলেন ননী ভৌমিক তাঁদের অন্যতম। এর সঙ্গে মিশেছিল উক্ত শতকের চতুর্থ দশকের মার্কসবাদের অলঙ্ঘনীয় প্রভাব যেখানে তাঁর রোম্যান্টিক বিপ্লবী চিন্তায় আচ্ছন্ন মননে মিশে গিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবোধ। টানটান জীবনবোধের সঙ্গে একাকার হয়েছিল এক দরদি সমাজবিজ্ঞানীর সংকল্পনা। তাঁর রচিত আখ্যানবৃত্তে তাই বারংবার ফিরে এসেছে দাঙ্গা, তেভাগার উচ্চণ্ডতা, নিষ্ঠুর দেশভাগ ও তজ্জনিত দেশভিখারিদের অরুন্তুদ সমস্যা। সামসময়িকতার ক্ষতচিহ্নিত দুর্ভর লাঞ্ছনা, নিম্নবর্গীয় মানুষের বাঁচন-লড়াই, তাদের বিভোল স্বপ্ন - সব উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে যেখানে দিনবদলের স্বপ্ন আর শুভবোধে আস্থা মিশে গেছে বলস্বী একাত্মতায় - চলিষ্ণু মানবজীবনে আজও যা পরিবর্তনের কথা বলে।

এই প্রেক্ষিত তথা আলোচনীয় প্রবন্ধের শিরোনামা মাথায় রেখে আমি ননী ভৌমিকের চারটি অগ্রন্থিত সংসৃষ্ট গল্প পাঠকের সামনে রাখতে চাই। না, ঠিক গল্প নয়, সে সবের মাঝ থেকে উঠে আসা আখ্যানকারকে তুলে ধরাই আমার অমল উদ্দেশ্য - অজ্ঞাত পাঠকের সামনে।

প্রথম গল্প 'অর্ডার' যা বেরিয়েছিল পরিচয় পত্রিকার ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায়। সম্ভবত ছেচল্লিশের তেভাগা আন্দোলনের আবহে নির্মিত এই গল্প। সাংবাদিকতার দায়ভার মাথায় নিয়ে তাঁকে উত্তরবঙ্গে যেতে হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ভাগচাষীদের সমর্থনে তিনি লিখলেন এই দুর্মদ আখ্যান। তেভাগা আন্দোলনকে ঢিট করার জন্য উত্তর বাংলার এক অখ্যাত জেলার মহকুমা ও থানা এলাকায় নানান জায়গা থেকে আসা পুলিশ অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি জমায়েত হল। চাষারা গোলমাল জুড়েছে। নবাবপুরের জোতদার সরমে আলির বাড়িতে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে। হানাদার বাহিনী প্রস্তুত - দলে আছে দশাসই চেহারার হাওড়ার মজিদ যার এই উত্তরবঙ্গীয় জংলা দেশ পছন্দ নয়। সে কলকাতার দাঙ্গা দেখেছে, সে অভিজ্ঞ, অভিজাত। সে দাঙ্গাকারীদের শায়েস্তা করতে চাইলেও অর্ডার না হলে গুলি চালাতে পারে না। এখানে তার কম্যান্ডিং অফিসার স্থানীয় থানার ছোটো দারোগা। পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় বিট সেপাই আর চৌকিদারের দল। তারা সব এরপর লক্ষ্যস্থল 'ডাকাতের গাঁ'-এর দিকে ধাওয়া করল। জংলা পথে হাঁটতে হাঁটতে মজিদ গুণ্ডা, বদমাস, ডাকু হন্যে হয়ে খোঁজে। পায় না। আসলে তারা এসেছে মূল পাণ্ডা লালমাধবের খোঁজে যে চাষীদের খেপিয়ে তুলেছে। জাতধর্ম নির্বিশেষে সকলেই সামিল। অথচ গ্রাম শুনশান। সেখানে বাড়িয়ে দেওয়া হিসেবে সত্তর মণ ধান মিলল এবং তা নিয়ে 'বুঝ সাবুঝ হল নিজেদের মধ্যে'। পুরো গ্রাম জনশূন্য কেন জানতে চাইলে চৌকিদার বলল, 'পালি গিছে সবাই'। লালমাধবের বাড়ি পুড়ে ছাই। গ্রামে কেউ আছে কি না, চৌকিদার হেঁকে জানতে চাইলে মজিদের লাথি খাওয়া কুকুরটাই অন্তিম আর্তনাদ করে মাত্র। পুলিশের ধারণা আন্দোলনকারীর দল সব জঙ্গলে লুকিয়ে গেছে। লড়াইয়ের আয়োজন বৃথা ভেবে মজিদ বিমর্ষ হয়। এরমধ্যে এক অন্ধকে খুঁজে পায় তারা কিন্তু তার কাছ থেকে কোনও উত্তর পায় না। মজিদ হুকুম পেয়ে তাকে বন্দুকের নল দিয়ে খুঁচিয়ে দিলে সে ক্যাঁক করে থেমে যায়। বীরপুঙ্গবের দল যখন হতাশ-ক্লান্ত ঠিক তখনই গাঁয়ের পশ্চিম টারি থেকে একটা মেয়ের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ কানে আসে। সে লালমাধবের বউ, লুকিয়ে থাকা অবস্থা থেকে যাকে ধরে এনেছে পাহারাদার রামসুরত যার সম্পর্কে কেউ বলছে, 'আস্ত ঘোড়া আছে শালা।' এ থেকে স্পষ্ট হয়, বউটার ইজ্জত নিয়েও টানাটানি হয়েছে। যাই হোক, এর সূত্র ধরেই একে একে বেরিয়ে আসে গাঁয়ের অন্যান্যরা যাদের লেখক বলছেন, 'এক অদ্ভুত জনতা। 'তাদের' 'দেশী বিটি ছোঁয়া'কে এভাবে ধরে আনায় খুশি নয় চৌকিদার। সে দুর্বল আবেগে দারোগার সামনে কেঁদে ফেললে বিরক্ত দারোগা মজিদকে শাস্তি দিতে হুকুম দেয়; মজিদও তা যথারীতি পালন করে। এরপর 'উদ্ধার' হওয়া ধান সরমে আলির বাড়ি পৌঁছে যায়। বউটা বেনজর পড়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর রামসুরত তাকে হিঁচড়ে নিয়ে আসে যার 'পরনের বুকনিটা ধস্তাধস্তিতে খসে খসে যাচ্ছে বুক থেকে' আর এক হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে যুবতী বউটা। লালমাধবের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত কেউ কেউ বউটিকে উলঙ্গ করে দেবার টিপ্পনী কাটছে। এরপর সেই 'অদ্ভুত জনতা'র একটি দল তাদের বুভুক্ষু, কুৎসিত দেহাবয়ব নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির সামনে খাড়িয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠল - কেন তাদের ঘরের বউয়ের গায়ে হাত পড়ল, কেনই বা তাদের কষ্টের ধান কেড়ে নেওয়া হল - এ নিয়ে তারা শান্ত অথচ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে লাগল; বিনিময়ে পেল রাষ্ট্রের গুলি কেননা ওদের দেখে দারোগার মনে হল আবহাওয়া কেমন 'অপ্রাকৃত' হয়ে উঠেছে; 'হতচ্ছাড়া দুর্বল লোকগুলোর মুখেচোখে একটা নির্বোধ মরীয়া ষড়যন্ত্র থমথম' করছিল। অথচ যে মজিদের হাত নিশপিশ করছিল সে হুকুম পেয়েও 'ট্রিগার টানতে পারল না'। পারল না অন্য সেপাইরাও। কোথাও কি তাদের মধ্যে সহমর্মিতা জেগে উঠল! যাই হোক, এরপর দারোগা নিজেই কাজ সম্পন্ন করল। ভয় পেয়ে সব মিলিয়ে গেলে এগিয়ে এল সেই অন্ধ যে তীব্র আক্রোশে বলতে লাগল, 'চোখে বালি ছুঁড়ি দাও।... কানা করি দাও ওঁয়াদের চোখ। হামার নাকান কানা করি দাও বালু দিয়া...'। রাষ্ট্রশক্তির কাছে অসহ্য ঠেকল এই ঝাঁঝ। প্রথমে দারোগা তারপর মজিদ নিশানা করে পেড়ে ফেলল এই তথাকথিত অক্ষম অথচ শক্তিধর মানুষটিকে।

সন্ধ্যায় পুলিশ ক্যাম্পে খানাপিনার জোর আয়োজন। তার মধ্যেও যেন শ্মশানের শান্তি বিরাজমান। মজিদ অন্ধটাকে গুলি করে ঠিক যেন স্বস্তিতে নেই। দারুণ শীতেও ঘর্মাক্ত সে অনেকটা আত্মপ্রসাদ লাভের ঢঙে সঙ্গী নরেনকে বলছে, 'অর্ডার হলে গুলি করতে হবে জরুর। না হলে নিমকহারামি হবে।' এরই বিপ্রতীপে যে ঘটনা ঘটল তা রাষ্ট্রশক্তির কাছে চমকপ্রদই নয়, চরম অপমানজনকও বটে। এসে দাঁড়িয়েছে সেই চৌকিদার যে শুধু আবেদন-নিবেদনই করেছিল। এখন তার চেহারা ভিন্নতরঃ 'খালি গা... নীল পাগড়ি আর ফ্যাকাশে নীল জামাটা গা থেকে খুলে একটা পোঁটলা বানিয়েছে।' তারপর ক্রন্দনরত আক্রোশে সেই পোঁটলা এক সিপাহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'রাখি দেন তোমরা এগুলা।' এই বলে প্রতিবাদী সে 'ধানকাটা শীতার্ত মাঠের ভেতর দিয়ে খালি গায়ে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে গেল কোথায়।' নীরব, নির্বিণ্ণ অথচ বাঙ্ময় প্রতিবাদ জানিয়ে গেল এই নাম না জানা 'অপর'।

যদিও ননী ভৌমিকের অপরাপর কিছু গল্পের মতো এখানে নারীশক্তির ভূমিকা একেবারেই সবল নয় তবুও লালমাধবের ধর্ষিতা বউ যেন চাষিদের কেড়ে নেওয়া অধিকারের প্রতীক হিসেবে খাড়িয়ে যায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই গল্প তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হলেও নিম্নবর্গের প্রতিবাদী চেতনা কেমন যেন ম্যাটমেটে, প্রতিরোধের ধারণা বিষয়ক অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন - এক চিরাচরিত পিষ্ট স্বভাবের প্রতিরূপ হিসেবে ধরা দেয়। তবুও দ্বিবিধ বিপ্রতীপতায় গল্পের নামকরণ সার্থক বলেই মনে হয়।

আমার পরবর্তী আলোচ্য গল্প 'বড়োবাবু ছোটোবাবু' যেটি প্রাগুক্ত সালে একই পত্রিকার শারদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। এ গল্পের বিষয় আমাদের চিরপরিচিত, পুলিশ-দস্যু-চোরাকারবারির যে অশুভ আঁতাত তারই মজাদার উপস্থাপন। আমরা সেলুলয়েডে দেখি, দেখি বাস্তবত; তবে এখানে যেটা নতুন তা হল চাপে পড়ে সরকারি পুলিশ ধানের চোরাকারবারি এক বন্ধুকে কবজায় আনতে গিয়ে নিজেরাই পড়ে যায় মহা ফাঁপড়ে। থানার বড়বাবু-ছোটোবাবুকে নিয়ত ঘুষ দিয়ে বশে রাখা জটাধারী ধরা না দিয়ে বিপদে ফেলে দেয় দারোগাবাবাদের। তাকে গিলে খাওয়া উর্দিধারীদের শেষ পর্যন্ত গ্রাস করে সে অমলিন মজা পায়। আর তার এই কাজে থানার রাইফেল জুগিয়ে সহায়তা করে বড়বাবুর নিষ্কর্মা ছেলে। এভাবেই জটাধারী শেষতক সমঝে দেয় যে সে কেঁচো নয়, কেঁচো বড়বাবু আর ছোটোবাবু। গল্পের বর্ণনাগত ভাষা ব্যবহার বেশ চমকদার তথা যথাযথ। দুই দারোগার চেহারাগত বিবরণও কাহিনির হাড়মজ্জার সঙ্গে মানানসই। সরকারি তথা প্রশাসনিক আধিকারিক দুর্নীতিযুক্ত সিস্টেম তৈরি করে কীভাবে সে দুর্ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে যায় - এ গল্পে তা জেনে সৎ পাঠক অবশ্যই তৃপ্ত হবেন, ঠিক যেমন হয়েছেন গল্পকার নিজে তাঁর অন্তর্গত নীতিবোধকে প্রতিফলিত করে। এও তো এক ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যান এবং প্রকৃত শিল্পের অনুসারী তা।

আমার তৃতীয় আলোচ্য গল্প 'বস্তির ছেলে'ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে 'স্বাধীনতা' পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায়। সম্ভবত স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কাছাকাছি সময়ের এই গল্পে রাগ বা পবিত্র ক্রোধ বিশেষ অর্থবহ যা ধুয়া হিসেবে বারবার গল্পের অভিঘাত নির্মাণ করেছে। আখ্যানটি এইরকমঃ এক অবাঙালি মুসলিম দুঃস্থ ছেলে সেয়ানা গাঁ-তুতো চাচার সঙ্গে কলকাতায় এসেছে রোজগারের সন্ধানে; উঠবে হয়তো খিদিরপুর, মেটিয়াব্রুজ বা নারকেলডাঙ্গার প্রথাগত বস্তিতে। সেখানে 'প্রতিদিন এমনি কত ছেলে আসে রোজগার করতে, আর কোথায় হারিয়ে যায়'। চটকলে ছুটি হলে শ্রমিকের দল অন্ধকারে হেঁটে আসে; 'কেমন চুপ করে হাঁটে। গামছা দিয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে ফেলে আর চুপ করে হাঁটে। 'মনে হয় এমন নীরবতার মাঝে কোথাও হিংস্র, অপারগ ইচ্ছা ক্রিয়াশীল থাকে। বস্তির দুর্বল পুরুষেরা আধবেলা কাজ করলেও 'শয়তান' ছেলেগুলো এক কারখানায় ফাঁকি দিয়ে অন্য কারখানায় খাটতে চলে যায়। তারাও সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে কিন্তু 'কথা বলে না, কেমন গুম হয়ে থাকে। রাগ করে। কার ওপর রাগ করে কে জানে!' আবার 'রাগ করে মাঝে মাঝে কাজ ছেড়ে পালায় ওরা'।

এখানেই এক বস্তি-বালক চায়ের দোকানে কাজ করে - দিনরাত এক করে। তাই সেও একদিন কাজ ছেড়ে পালায়। মা-বাবা বকাবকি, মারধর করে 'কিন্তু ছেলেটা কাঁদল না। আর কেমন গুম হয়ে রইল। ভেতরে ভেতরে রাগ হল খুব। কিন্তু কার ওপর রাগ হল কে জানে!' সে আবার হোটেলে আঠারো ঘন্টার কাজ নেয়। ইতোমধ্যে কারখানার মালিক মজুরদের মাইনে কমায় কিংবা জবাব দেয়। বস্তির ছেলেরা কর্পোরেশনের জঞ্জাল থেকে ছেঁড়াছুটো কুড়োয়, দুটো পয়সার আশায়। তাদের এই অসহায়তার এমন বিদ্রুপাত্মক বর্ণনা গল্পকার দিয়েছেন 'যেন গাছতলায় পাকা আম কুড়োচ্ছে তারা।' একজনের আব্বা কাশীপুর বন্দুক কারখানায় কাজ করত। লড়াই ফুরিয়ে গেলে তারও কাজ চলে গেল। এও এক বিপ্রতীপ অসহায়তা। বস্তির ছেলেদের এমনই হাল সব। 'কিন্তু কেমন যেন বদরাগী সবাই। শুধু বুঝতে পারে না কার ওপরে রাগ করবে।' মধ্যে মাঝে যখন বুঝতে পারে তখন হরতাল করে, একজোট হয়ে মালিকদের জব্দ করতে চায় আর তাতে কাজও হয়।' তখন দশ বছরের একটি বস্তির ছেলে যা বলে তার ওপরে কিন্তু কথা বলার সাহস থাকে না কোটিপতি বুড়ো মানুষেরও। 'নিঃস্ব মানুষের সঞ্চিত রাগ কিছুটা প্রশমিত হলেও ফুরিয়ে যায় না। এই রাগের প্রসঙ্গে লেখক একটি ঘটনার উল্লেখ করেন যা সে বছরের বারোই ফেব্রুয়ারি ঘটেছিল এবং 'স্বাধীনতা' পত্রিকায় তা বেরিয়েছিল। আজমীরী নামে এক বস্তির ছেলে বড় রাস্তার মোড়ে ইংরেজরা গুলি চালাচ্ছে জেনে ছুটে যায়। উদ্দেশ্য, 'সারা জীবনের রাগ এইবার মিটিয়ে নেবে বাচ্চা আজমীরী।' সে ঢিল হাতে ছুটে যায়। স্বাভাবিকভাবেই চার পাঁচটা বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দেয় দলের সর্দার কিশোর আজমীরীর রাগী দেহটি। তার জন্য আসে না কোনও অ্যাম্বুলেন্স। সঙ্গীরা তাকে ঠেলাগাড়িতে তুলে মহল্লার দিকে এগোয় আর গুম হয়ে থাকে - 'সে রাগ তাদের এখনও যায়নি - তুষাগ্নির মতো জিইয়ে রেখেছে সব - আগামীতে কাজে লাগাবে বলে।'

ননী এ গল্পে শ্রেণি-সংগ্রাম আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে একই আসনে বসিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের ক্ষেত্র-ভিন্নতা থাকলেও লক্ষ্য কিন্তু একমুখী। সেখানে জিইয়ে রাখা ক্রোধাগ্নিই একমাত্র আয়ূধ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে চিরকাল।

এই পর্বে আমার শেষ আলোচনীয় গল্প 'আরো একবার' যা 'মুখপত্র'র শারদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল ১৩৬১ বঙ্গাব্দে। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে ক্রমাগত উচ্ছিন্ন, উৎপাটিত, তাড়িত মানুষের বিষণ্ণ আখ্যান এই গল্পে গ্রথিত। মূলত তৎকালিক পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হিন্দু চাষি, শাঁখারি, মৎস্যজীবী, বামুন-কায়েত যাদের বিহারের কোনও এক অনুর্বর ডাঙ্গাযুক্ত ক্যাম্পে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল তাদেরই নিষ্করুণ চলাচলের অস্থির চালচিত্র এই গল্প যা প্রচলিত দেশভাগের কাহিনি থেকে ভিন্নমাত্রায় বর্ণিত। এমনই একদল তথাকথিত উদ্বাস্তু হাওড়া স্টেশনে নেমেছে যাদের মুরুব্বি যোগীন্দর। সে এদের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসনের চেষ্টায় রত। আপাতত এইসব ভাসন্ত মানুষের কাছে খড়কুটো হল এই স্টেশনের বিচিত্র-চরিত্র প্লাটফর্ম। ভিনগাঁয়ের, ভিনপেশার মানুষগুলো এখন একই মানদণ্ডে অবস্থিত যাদের সঙ্গেকার সম্পত্তি হল পোড়া কড়াই, অ্যালুমিনিয়ামের টুকরো, মাটির হাঁড়ি, কিছু বেখাপ্পা বিহারি লকড়ি, ছেঁড়া ন্যাতা আর চট। বিনা টিকিটের আনাড়ি যাত্রীদের দেখে রেলবাবুরা কিছুই বলে না। স্টেশনের লোহার রেলিঙের গায়ে ওরা আস্তানা গড়ে নিয়েছে। ওদের মধ্যে যুবক বিমলই হয়তো হাইস্কুলের উঁচু ক্লাসের দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল কোনও এক দিন। সে খানিক তিক্তসুরে বলে, 'কতবার। বুঝছনি যোগীন্দরদা, এইবার লয়্যা সাতবার...।' যোগীন্দর নিরুত্তর থাকলেও পুরুত বামুন মধু পণ্ডিত, যার জাতকাজের পাট চুকে গেছে বহুদিন আগেই 'নিরুত্তর থাকে না। তার 'একটা পৈতে আর অভ্যস্ত নামের শেষে তাৎপর্যহীন উপাধিটা শুধু কোনোক্রমে বজায় থেকে গেছে আজো।' সেই মধু পণ্ডিত একই কথা প্রায় ধুয়া আকারে আউড়ে যায় গল্পভর আর তা হলঃ 'এখানে কৈল থাকার জো নাই কইয়া দিলাম! গুটাইয়া বাটাইয়া বসছ তো এখন। কিন্তু কইয়া দিলাম...।' কোনও এক অভিজ্ঞ আশঙ্কায় কথাটা তাকে পেয়ে বসে যেন। সীমাবদ্ধ প্লাটফর্মের বাইরে নিষ্ঠুর ইস্পাতের হাওড়া ব্রিজ আর তার নিচ দিয়ে বয়ে চলা কল্লোলিনী গঙ্গা - এই 'কলকাতা রয়েই গেছে নিষ্প্রাণ, ঠান্ডা, অপরিচিত ভয়ানক' - কেননা সেখানে এদের কোনও ঠাঁই নেই। ক্যাম্প-পালানো মানুষগুলোর জন্য সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই, তাই ডোল, রিলিফ কিছুই পায় না তারা। স্টেশনে অস্থায়ী আস্তানা জুটিয়ে নিলেও পেটের জোগাড় হয় না। গল্পকার যথার্থই বলছেন, 'নিষ্ক্রিয় নিরুপায় পুরুষগুলো বসে থাকে প্যাঁচার মতো।' স্টেশন চত্বরে ঝইঝামেলা, গালিগালাজ চলে। অসহ্য লাগলে 'দুর্বোধ্য পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় জবাব দেয়।' এর মধ্যেই কখনও কখনও ওরা কাছের পোস্তাবাজার থেকে অখাদ্য আনাজপাতি কুড়িয়ে আনে; মধু পণ্ডিত একই সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে করতে হনহনিয়ে হেঁটে চলে - 'কোন অনন্তযাত্রার পথে কে জানে!' তার ছোট্ট মেয়ে বীণা খেলনাপাতির সংসার সাজিয়ে বসে। বাস্তবচিত্রের কাঠিন্যকে নকল করে পুতুলদের বকাঝকা করে, খাওয়ায় দাওয়ায়। মধু খেপে গিয়ে মেয়ের খেলনাপাতি এলোমেলো করে দিতে চায় আর তাকেও বলে, 'বসছ তো খুব গুটাইয়া বাটাইয়া, কিন্তু থাকার জো নাই...।' তবুও থাকতে হয়!

ইতোমধ্যে যোগীন্দর আর বিমল কাগজের অফিসে, মন্ত্রীদপ্তরে হতাশ ঘোরাঘুরি করে। দলেরই এক বুড়ি বিধবা 'জাগে, ঘুমোয়, জাগে'। ছেলেছোকরার দল 'চুপি চুপি কয়লা কুড়োয়, মার খায়, মার দেয়'। কখনও যাত্রীদের সামনে আনাড়ির মতো হাত পাতে। লেখক এখানে বুঝিয়ে দেন, ভিক্ষা করারও একটা শিল্পিত প্রয়াস থাকতে হয়। এভাবেই অজান্তে তারা ভিখিরি বনে যায়। বীণা তার পুতুলদের যখন বলে, 'বাত খাইবা না? বাত?' তখন মধু পণ্ডিতের চোখমুখে অক্ষম হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ে... 'দশ দিন বারো দিন চোদ্দ দিন... হাঁপিয়ে ওঠে প্রতীক্ষা।' চতুর্দিকে বিশৃঙ্খল বিবর্ণতার মাঝে বীণার খেলনাপাতির সংসার জমে ওঠে। গড়ে ওঠে এক অবাস্তব স্বপ্নিল বাস্তবতা যেখানে পুতুলদের কাজের অন্ত নেই। তারা ট্রেনে চাপে, ক্যাম্পে যায়, ধান পোঁতে, পিঁড়ি পেতে খেতে বসে। এভাবে তাদের সম্পদও বেড়ে ওঠে। নিষ্করুণ বাস্তবতার সমান্তরালে এই নকল জীবনের সম্পন্নতা - রচনা গল্পকারের এক উত্তরিত প্রতিভাস কিংবা স্বপ্নময় বিভাব; এবং এখানেই এ জাতীয় অন্যান্য আখ্যান থেকে ননী ভৌমিকের এই গল্প পৃথক। আসল সংসার প্রেতপুরী হয়ে উঠলেও বীণার এই নকল সংসার রঙে রসে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মধু পণ্ডিতও ভিক্ষে করতে শুরু করে। শাঁখারিদের বোকা বউটা নেমে যায় আরও নিচে।

ছন্নছাড়া এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন যোগীন্দর খবর দেয় পুলিশ দিয়ে স্টেশন পরিষ্কার করা হবে। রণশ্রান্ত বিমল বলে, 'সাতবার আস্তানা গাড়ছি যোগীন্দিরদা... অহন আটবারের পালা...। ' অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা - উল্লাসে মধু চেঁচিয়ে বলে, 'কী যোগীন্দর, কছিলাম না' আর ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়ের ফুরিয়ে আসা ছেলেখেলাটার দিকে।

ভোররাতে পুলিশ আসে, বুট আর রুলের খোঁচায় সবাইকে জাগিয়ে স্টেশন ছাড়তে হুকুম দেয়। বাইরে লৌহদানব হাওড়া ব্রিজ 'এক গ্রাস থেকে যারা ছাড়া পাবে সে অজীর্ণদের গ্রাস করার জন্য... অপেক্ষা করে আছে।' মধু ক্ষ্যাপা চিৎকার করতে করতে মেয়ের নির্বোধ খেলনাপাতি গুছোতে থাকে। আকস্মিকভাবে মধু পণ্ডিতের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোনও এক অলীক শক্তিবলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া গোটা দলটা রুখে দাঁড়ায় - মাজা-সাট খাওয়া ফণাধর সাপ যেমন একবার অন্তত ফণা বাঁকিয়ে ঘুরে তাকায় তেমনই, গল্পকার বলছেন, 'স্তব্ধ প্রেতায়িত স্টেশনটাকে ক্ষেপিয়ে তুলে চেঁচিয়ে ওঠে যোগীন্দির - 'যামু না আমরা! যামু না, কেউ যামু না! আরো একবার রক্ত না দিয়া যামু না!'' এভাবেই আহত প্রতিরোধে অসন্নত ঢঙে উত্তরিত হয় এই ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যান।

জানি না, এই সামান্য আলোচনায় কতটুকু ধরা গেল স্বরাট ননী ভৌমিককে! তবুও তাঁর পরাক্রান্ত অথচ সুবেদী মনন - বিষয়ে যে সূচনা-সূত্র দেওয়া গেল তাতেই বিষঙ্গাক্রান্ত হবেন মনস্বী পাঠক, তাঁকে জানতে আগ্রহী হবেন - এ আমার উপাত্ত বিশ্বাস।

______________________________
তথ্যঋণঃ গৌতম অধিকারী সম্পাদিত 'কথারূপ' পত্রিকার 'ননী ভৌমিক সংখ্যা' ১ ও ২।