আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কোভিড অতিমারি ও আমরা

সুজিত পোদ্দার


কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস যেভাবে সারা পৃথিবীর মানুষকে সংক্রমণের মুখোমুখি এনে দিয়েছে, এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। অতীতে ফ্লু, প্লেগ, কলেরা, গুটি বসন্ত ইত্যাদি রোগের সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু অতীতের বিভিন্ন সংক্রমণের সঙ্গে, বর্তমানের করোনা ভাইরাস যে দ্রুত গতিতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে এর তুলনা বিরল, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম চীনদেশের উহান প্রদেশে এই সংক্রমণ প্রথম দেখা দেয় বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে এই রোগ প্যান-এশিয়া ভারত এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আরম্ভ করে, ইউরোপ আমেরিকার সর্বত্র সমান ভাবে ছড়াতে থাকে। করোনা আতঙ্কের কথা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের কাছে এখন খুবই চেনা কথা। বিশেষতঃ ২০২০ সালের প্রথম ভাগে এই আতঙ্ক প্রবল আকার ধারণ করে। ঘরে ঘরে যে আজ সুস্থ মানুষ, কাল এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর কোনো নির্দিষ্ট চিকিংসা নেই। নিজের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার বলে সংক্রমিত মানুষ হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফিরে আসে অথবা পরিবারের সকলের চোখের আড়ালে চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। এই আতঙ্ক বড়লোক গরীব সর্বস্তরের সকল দেশের মানুষকে সমানভাবে গ্রাস করতে থাকে। নিজেকে রোগের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথ নির্দেশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা - নিজেকে গৃহবন্দী করো। মানুষে মানুষে মেলামেশা বন্ধ করো। নিজেকে নিজের পারিবারিক পরিবেশে পরিচ্ছন্ন রাখো।

এই অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অন্যান্য দেশের মতো ভারত সরকারও দেশের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, কলকারখানা, হাটবাজার, দোকানপাট, যানবাহন, স্কুল-কলেজ সবরকমের কাজকর্ম বন্ধ করে গোটা দেশকে নজিরবিহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেয়। এর ফলে কর্মসূত্রে ভিন্ন রাজ্যে থাকা বহু শ্রমিক মারা যায়। অনেকেই কর্মহীন হয়। এবং কিছুদিনের মধ্যে গৃহহীনও হতে থাকে। গোটা দেশ মার্চ ২০২০-র শেষভাগে এই অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী পায়ে হেঁটে প্রাণ বাঁচানোর দায়ে ঘরে ফেরা শুরু করে। অনেকে পথেই প্রাণ হারায় অনিদ্রা এবং অনাহারে। বহু মানুষ কষ্ট স্বীকার করে পরিবারের কাছে ফিরেও আসে।

মার্চ ২০২০-র শেষ ভাগ থেকে সারা দেশের মতো এই রাজ্যেও সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করে বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ এবং দন্ডণীয় অপরাধ ঘোষণা করা হয়। দিনের কিছু সময়, দোকান বাজার খোলার ব্যবস্থা ছিল। শহরের বাঙালি ভদ্রলোকদের এই পরিস্থিতি একেবারেই অসহনীয় করে তোলে। সাংসারিক জীবনে এই প্রথম, দৈনন্দিন গৃহকর্ম অর্থাৎ রান্নাবান্না, রান্নার সামগ্রীর জোগান, ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ এককথায় ঘরগেরস্থালির সব কাজ নিজের হাতে করতে হয়। রান্না করা মানে, মাছ সবজি কেনার পর কেটেকুটে রান্নার উপযোগী করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করা। তারপর খাবার টেবিলে পরিবেশন করা এবং খাওয়াদাওয়ার পর খাবার টেবিল পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে এঁটো থালাবাটি, রান্নার বাসনকোসন ধোয়ামোছার কাজ সবই পরিবারের সদস্যদেরই সামলাতে হয়েছে। এর পর আছে ঘর পরিষ্কার করা, জামা কাপড় কাচা শুকিয়ে গুছিয়ে রাখা; এইসব কাজ করার জন্য অল্প পয়সা খরচ করলেই কাজের লোক পাওয়া যেত এতদিন। কিন্তু এখন ওরাও গৃহবন্দী। ওদের পরিবারের সবাই কর্মহীন। কাজের লোকের পরিবারের প্রায় সকলেরই কমবেশি কাজ বন্ধ। মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবশ্য বিশেষ হেরফের হয়নি। আপিসকাছারি, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও আয়ের পথ বন্ধ ছিল না। যাদের স্থায়ী চাকুরি, তাদের আয় নিশ্চিত। কিন্তু কাপড় কেচে রান্নায় সহায়তা করে, ঘর পরিষ্কার করে কতদিন জীবন চলে? কিন্তু ভয় অতিমারির, এই সংক্রমণের কবলে পডলে ফেরা অনিশ্চিত, মৃত্যু নিশ্চিত না হলেও। প্রাণের ভয়ে মানুষ জেলখানার বন্দী জীবন বাধ্য হয়েই মেনে নেয়।

পরিবারের দৈনন্দিন কাজে যেমন গৃহকর্তা বাবুমশায় আনকোরা ছিলেন তেমনি গৃহিনীও সুদক্ষ ছিলেন এমনটা বোধ হয় বলা যায় না। বহুদিন কাজের লোক নির্ভর সংসার জীবন চালানোর ফলে পরিবারের মহিলারাও বিপদের সম্মুখীন হন। কিন্তু সুখের বিষয় এর ফলে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়নি। অবস্থার চাপে স্বামী-স্ত্রী কাজের ভাগাভাগি করে নেয়। অধিকাংশ পরিবারে মহিলা দাঁড়িয়ে রান্না করার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। পারিবারিক অন্য সব কাজ নানাভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হবে। একজন পরিচিত কবি ফোনে জানতে চাইলেন কেমন কাটছে জীবন। কিছু কায়িক পরিশ্রমের দায় স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু কবিমশায় মজা করে জানালেন, আমি গিন্নীকে বলেছি বাসন মাজার দায়িত্ব আমার। আর বাজারও করে দেবো। স্ত্রী মেনে নেন। আর একজন বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদধারী, যাকে দেখেছি জল খাওয়ার প্রয়োজন হলে হুকুম দিতে। তিনি সগর্বে জানালেন, আমি খুব ভালো ঘর মুছতে পারি। আমার বাড়িতে তখন গত দু'মাস শুধু ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়, মোছার কথা ভাবাই হয়না। এরকম অনেক সুখ-দুঃখের ইতিহাস জড়িয়ে আছে অতিমারি কবলিত কলকাতার ঘরে ঘরে।

শুধু বাঙালি মধ্যবিত্তের কথা একরকম বলা যায়। কিন্তু দেশের অন্য রাজ্যের উচ্চস্তরের নেতা, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী উচ্চবিত্তরা যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের অবস্থাও কি করুণ হয়নি? কত ব্যবসায়ী, আমলা মাসে ১৫/২০ দিন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন কর্মসূত্রে। আর এখন বিদেশ ভ্রমণের কোনো সুযোগ নেই। দেশের মধ্যে ঘোরাঘুরির কিছু সুযোগ দেখা দিচ্ছে ধীরগতিতে। কিন্তু দীর্ঘ দেড় বছর, ১৭/১৮ মাস ধরে বন্দী হিসাবে ঘরে বসে সময় কাটাতে হয়েছে। ওদের ব্যস্ততা কোভিডের ভয়ে উবে গেছে। তুলনায় গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, পরিযায়ী অবস্থার থেকে ঘরে ফিরে কিছুদিন পর আস্তে আস্তে কিছু কাজ জোগাড় করে নিয়েছে। কেউ সব্জি ফেরি করছে আবার কেউ চাষবাস আরম্ভ করেছে। অনেকের হয়তো পুরোনো কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার ডাক এসেছে। জীবন অতিমারির মুখোমুখি হয়েও একইভাবে শ্রমনির্ভর থেকেছে। যারা পুরোনো কাজ ফিরে পায়নি ওরাও নিজের মত পরে কিছু কাজ করছে, হয়তো আয় আগের তুলনায় কম। স্বনির্ভর শ্রমজীবী এই অংশের মানুষকে দেখে বলা যাবে না, বাঙালি কর্মবিমুখ বা শ্রমবিমুখ। আজকাল যারা চাষের কাজের সঙ্গে যুক্ত ওদের অনেকেই সারা বছর কম বেশি কাজের ব্যবস্থা জোগাড় করে নেয়। ধান, পাট, আলু ইত্যাদি চাষ বাদ দিয়েও আজকাল বাড়ির আশেপাশের জমিতে সহজে সবজি চাষ, ফুলের চাষ, এলাকা বিশেষে ফলের চাষও করা যায়। তরমুজ, মৌসাম্বি এইসব চাষও করা যায়। চাষীরা চাষ করে আবার নিজেরাই বাজারে এনে বিক্রি করে।

শ্রমজীবী মানুষের তুলনায় বাঙালি মধ্যবিত্ত যুব সমাজের অবস্থা এই অতিমারির ধাক্কায় অনেকটাই অনিশ্চিত। প্রথমত লেখাপড়া গত দু'বছর যাবত গৃহবন্দী অবস্থায়। ১৮ বছরের ছেলে ঘরে বসে প্রস্তুতি দিয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। পড়াশুনো স্কুলের মতোই ঘরে বসে চলেছে। এই অবস্থার পৃথিবীতে এর আগে কেউ কখনো মুখোমুখি হয়েছে বা শুনেছে বলে জানা যায়নি। তারপরও ওদের একদিন কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে চাকরির সন্ধানে বের হতে হবে। কোথায় চাকরি? চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ উন্নয়নে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আমাদের রাজ্যের চেহারা যেরকম হয়ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের যুব সমাজের অবস্থাও অনেকটা একইরকম। কিন্তু পৃথিবীর সবদেশের চিত্র কি একই রকম? প্রথমে দেখতে হবে কোভিড-১৯-এর মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কীভাবে এর মোকাবিলা করেছে। এই অতিমারি অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর অল্প দিনের মধ্যেই পৃথিবীর প্রায় সব দেশে মহামারী থেকে অতিমারির রূপ নেয়। এর অন্যতম কারণ ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের চীনের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেশি এবং যাতায়াতও প্রতিনিয়ত। এই কারণেই এই রোগ দ্রুত চীন থেকে অন্যদেশে সহজে ঢুকতে পেরেছে। চীন কিন্তু ওদের বজ্রকঠিন নিয়ম জারি করে অল্পদিনের মধ্যেই এই মারণ রোগের প্রসার রোধ করতে সক্ষম হয়। শুধু চীন দেশেই নয়, জাপান এবং ইন্দো-চায়নার অন্যান্য দেশ কোরিয়া, ভিয়েতনাম সর্বত্রই এই রোগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা এশিয়ার অন্যান্য দেশে এবং ইউরোপ, আমেরিকায় গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সদিচ্ছার অভাবে। ২০২১-এর প্রথমভাগ থেকে এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর থেকে আস্তে আস্তে অন্যান্য দেশেও রোগের প্রসার নিম্নগতি হতে থাকে। ২০২১-এ একসময় দৈনিক সংক্রমণ আমাদের দেশে ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু এখন মূলত প্রতিষেধকের জোগান বৃদ্ধির ফলে দৈনিক সংক্রমণ আমাদের দেশে ২০ হাজারের আশেপাশে থাকছে।

অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু প্রতিষেধক নয়, প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই মানুষের সচেতনতাই মানুষকে, সমাজকে দেশকে রক্ষা করতে পারবে। কোভিড সংক্রমণের প্রথম ঢেউ ২০২১ সালের মার্চ মাসে কিছুটা প্রশমিত হলে আমাদের দেশের সরকার নিজের সাফল্যের জন্য উল্লাস প্রকাশ করেছিল। এরপর এক মাসের মধ্যে সংক্রমণ দৈনিক ৪ লক্ষে পৌঁছে যায়। কেরালায় এই বছর ওনাম উৎসবের আগে সংক্রমণ প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু ওনামে বিধিনিষেধ কিছু শিথিল হওয়ায় করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এখনও দেশের দৈনিক সংক্রমণের অর্ধেকই কেরলে হচ্ছে। কিন্তু কেরালা সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতার ফলে সংক্রমণ বাড়লেও মুত্যুর হার খুবই সামান্য ছিল এবং এখনও আছে। আমাদের শারদীয় উৎসবের সময় কেরালার অভিজ্ঞাতা অবশ্যই মনে রাখা দরকার। একবার দৈনিক সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী হলে একে নিয়ন্ত্রণে আনা ভীষণ কঠিন। তাই, আমাদের সকলের সমাজ সচেতনতাই উৎসবের আনন্দকে নিরানন্দে পরিণত করবে না।