আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

রাম কা নাম বদনাম না করো!

রঞ্জন রায়


বিগত জুন মাসের মাঝামাঝি, ধরুন ১৩ই জুন থেকে ১৭ই জুন, দিল্লিতে একটি প্রেস কনফারেন্স নিয়ে তোলপাড় কাণ্ড। আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং এবং উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী পবন পান্ডে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কিছু জমির রেজিস্ট্রির কাগজ ও অন্য দস্তাবেজ দেখিয়ে অভিযোগ করেছেন যে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট রাম মন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া জনতার চাঁদার পয়সা নিয়ে নয়ছয় করছে। জমি মাফিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ২ কোটির জমি ১৮ কোটিতে কিনেছে। ওঁদের অভিযোগ - যে জমিটি ১৮ই মার্চ, ২০১৭ তারিখের সন্ধ্যে ৭টা ১০ মিনিটে ২ কোটিতে রেজিস্ট্রি হল, সেটাই ঠিক পাঁচ মিনিট পরে ১৮ কোটিতে বিক্রি হয় কী করে? আঙুল তোলা হল সোজা ট্রাস্টের জেনারেল সেক্রেটারি চম্পত রায়ের দিকে, যিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে। তাঁর জন্য সঞ্জয় সিং ব্যবহার করলেন 'চান্দাচোর' অপশব্দটি। (১)

বললেন - সাহস থাকলে আমার নামে মানহানির মামলা করুক, বা আমাকে মিথ্যে অভিযোগের দায়ে জেলে ভরে দিক। আমার কাছে দস্তাবেজ দলিল সব আছে। আমি ভয় পাইনা।

ট্রাস্টের বক্তব্য

পরের দিন ১৫ তারিখে প্রেস বিবৃতি জারি করে চম্পত রায় বললেন - এসব রাম মন্দির নির্মাণে বাগড়া দেওয়ার ষড়যন্ত্র। আমাদের লেনদেন পারদর্শী। জমির মালিককে ১৭.৫০ কোটি টাকা আগাম ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনলাইন ট্রান্সফার করা হয়েছে। কাজেই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আর গত ৯/১১/২০১৯ তারিখে সুপ্রীম কোর্টের রায় রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে যাওয়ার পর থেকে এখানে জমির দাম খুব বেড়ে গেছে। আমরা বাজার দরের থেকে অনেক শস্তায় কিনেছি। পাঁচ মিনিটের তফাতে আলাদা দামে রেজিস্ট্রি হয়েছে তাতে কী হোল? আসলে এই জমির বিক্রির এগ্রিমেন্ট হরিশ পাঠক ও কুসুম পাঠক ২০১৯ সালে ২ কোটি টাকায় করেছিলেন। তাই ১৮ মার্চে জমির দালাল সেলিম আনসারি ও রবিমোহন তিওয়ারিকে ২ কোটিতে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তখন আমরা পাঁচ মিনিট পরে বাজার দরের থেকে কম টাকায় ১৮.৫ কোটিতে কিনে নিই। আমরা সব কাগজপত্র দেখে জমিটির বর্তমান মালিক কে তা খতিয়ে দেখে নিয়ে তবেই রেজিস্ট্রি করেছি।

সাংবাদিকেরা বললেন যে, ওখানে ঐ জমির দাম সরকারি রেট অনুযায়ী (রেভিনিউ অফিসের কাগজ অনুযায়ী) ৫.৮০ কোটির বেশি নয়। তখন উনি বললেন আশপাশের জমির বাজার দর অনেক বেশি। উনি ভাল করে জেনে নিয়ে তারপর বলবেন। আর মন্দির থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে জমি কেনার উদ্দেশ্য হিসেবে উনি বলেন যে, ট্রাস্ট ওখানে ভক্তদের জন্যে নিবাসস্থান বা ধর্মশালা বানাবে। (২)

এরপর বিভিন্ন চ্যানেলে উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্যের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হল যে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়েছেন - এর মধ্যে কোনো সন্দেহজনক কিছু নেই, আর কী চাই? হুমকি দেওয়া হল যে ট্রাস্ট সঞ্জয় সিংয়ের বিরুদ্ধে ১০০০ কোটি টাকার মানহানির মোকদ্দমা করবে।

কেঁচো খুঁড়তে সাপ?

১৬ জুন নাগাদ সঞ্জয় সিং আরেকটি দস্তাবেজ এনে দেখালেন যে, ঠিক এর পাশের জমিটি ট্রাস্টের তরফে চম্পত রায় সেই দিনই, মানে ১৮ই মার্চ বিকেলে কিনেছেন ৮ কোটি টাকায়। তাহলে চম্পত রায় মিথ্যে কথা বলছেন, পাশের জমিটি উনি সেদিনই এর অর্ধেকের চেয়ে কম দামে কিনেছেন। এবং দুটো দস্তাবেজেই সাক্ষীর জায়গায় সই করেছেন অযোধ্যার বিজেপি মেয়র হৃষীকেশ উপাধ্যায় ও ট্রাস্টের মেম্বার ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনিল মিশ্র। তার মানে ট্রাস্ট ভালো করেই ওখানে জমির বাজার দাম সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। এর তদন্ত হওয়া উচিত। (৩)

ট্রাস্টের থেকে আর কোনো পালটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।কিন্তু এই শেষ নয়। নিউজ লন্ড্রি চ্যানেলের রিপোর্টাররা দস্তাবেজ পেশ করল যে, ট্রাস্ট মন্দিরের লাগোয়া সরকারের খাস জমির একটি টুকরো অযোধ্যার মেয়র হৃষিকেশ উপাধ্যায়ের ভাগ্নে দীপনারায়ণ উপাধ্যায় গত ফেব্রুয়ারিতে ২০ লাখ টাকায় কিনে ১১ মে তারিখে ২.৫ কোটি টাকায় মন্দির নির্মাণ ট্রাস্টকে বিক্রি করেছে। এবং এই জমিটি ‘নজুল’ মানে সরকারের খাস জমি, যা কেনা বা বিক্রি করা যায় না।

যদিও আগে সমস্ত চ্যানেলে এবং ইন্টারভিউয়ে বলা হচ্ছিল যে ট্রাস্ট ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিংয়ের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলা করবে, কিন্তু পরপর তিনটে জমির সন্দেহজনক কেনাবেচার দলিল আসার পর ট্রাস্ট, বিজেপি, ইউপি সরকার বা আর কেউ এ নিয়ে কোনো প্রকাশ্য বিবৃতি দেননি বা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। চম্পত রায়ের মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে।

সঞ্জয় সিং ২৬ জুন তারিখে ফের সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জানালেন যে, উনি নিজে দস্তাবেজী প্রমাণ সহ প্রধানমন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে চিঠি লিখে সিবিআই ও ইডি’র তদন্ত দাবি করেছেন, কিন্তু তিনদিন অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর না পাওয়ায় ভাবছেন যে আদালতের কাছে গিয়ে জনতার ধার্মিক আস্থার দান নিয়ে নয়ছয় করার ব্যাপারে তদন্তের দাবি করবেন। (৪)

আসুন, আমরা ব্যাপারটি একটু তলিয়ে দেখি।

২.০ অভিযোগের সাতকাহন

২.১ অভিযোগ কার বিরুদ্ধে?

অযোধ্যা রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের এবং তার জেনারেল সেক্রেটারি চম্পত রায়ের বিরুদ্ধে। এই ট্রাস্ট সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত এলাকায় রামজন্মভূমি মন্দির নির্মাণের জন্য ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে গঠন করে। এর ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জন হল কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা মনোনীত। এর চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি নৃপেন্দ্র মিশ্র, এবং তার জেনারেল সেক্রেটারি হলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট চম্পত রায়। ভারত সরকার এই ট্রাস্টকে রামজন্মভূমি মামলার ২.৭৭ একর সমেত মোট ৬৭ একর জমি দান দিয়েছে। ট্রাস্ট মন্দির নির্মাণের জন্য জানুয়ারি ২০২১শে জনতার কাছে দান দেওয়ার আহ্বান করে। লক্ষ্য ছিল ১০০০ কোটি টাকার, কিন্তু জনগণের দানে ঝুলি ২০০০ কোটি টাকাও ছাপিয়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে। ট্রাস্ট বলছে মন্দিরের ভিত নির্মাণ অক্টোবর ২০২১ নাগাদ পূর্ণ হবে।

২.২ কোন কোন জমি কেনাবেচা নিয়ে অভিযোগ?

তিনটে জমি।

প্রথম অভিযোগ মন্দির থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রেলস্টেশনের কাছে গ্রাম বাগ-বিজৈসীতে একটি ভুখন্ডের পাঁচটি গায়ে গায়ে লাগা টুকরো কেনা নিয়ে। সেগুলোর খতেন নম্বর হল - ২৪২/১, ২৪২/২ এবং ২৪৩, ২৪৪ এবং ২৪৬। এদের মালিক কে? হরিশ ও কুসুম পাঠক - স্বামী-স্ত্রী।

অভিযোগ হল এই দু’জন গত ১৮ই মে তারিখে সন্ধ্যে ৭.১০ মিনিটে শেষ তিনটি টুকরো নম্বর ২৪৩, ২৪৪ এবং ২৩৬ দুই জমির দালাল সুলতান আনসারি এবং রবিমোহন তিওয়ারিকে বিক্রি করে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে এবং এরপর ওরা দু’জন ওই একই জমিন - যার ক্ষেত্রফল হল ১.২০৮ হেক্টর - শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের জেনারেল সেক্রেটারি চম্পত রায়কে ৭.১৫ মিনিটে রেজিস্ট্রি করে দেয় ১৮.৫ কোটি টাকার বিনিময়ে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ মিনিট পরে জমির দাম ২ কোটি থেকে বেড়ে ১৮.৫ কোটি হয়ে গেল?

অথচ একই জমির বাকি দুটো টুকরো, অর্থাৎ ২৪২/১, ২৪২/২, যার ক্ষেত্রফল ১.০৩৭ হেক্টর ওই ১৮ই মে তারিখেই ট্রাস্টের তরফে চম্পত রায় কিনেছেন সোজা মালিক হরিশ পাঠক ও কুসুমের কাছ থেকে, এবং ৮ কোটি টাকায়। রেভিনিউ সার্কেলের হিসেবে টুকরো জমিটির দাম হয় ৪.৯৭ বা ৫ কোটি টাকা। এখানেও ট্রাস্ট কিনল সরকারি দরের চেয়ে অনেক বেশি টাকায়। (৫)

এবার দুটো প্রশ্নঃ
১) যদি ধরে নিই যে বাস্তবিক বাজার দর সরকারি দামের চেয়ে অনেক বেশি। তাহলেও একই জমির গায়ে গায়ে লাগা দুটো অংশ - একটা ২৪২ নম্বর, অন্যটা ২৪৩, ২৪৪, ২৪৬ নম্বর - ট্রাস্ট একই দিনে এত আলাদা আলাদা দামে কিনল কেন? দুটোর আয়তনে খুব সামান্য তফাৎঃ

জমির টুকরো নম্বর জমির ক্ষেত্রফল (হেক্টর) ট্রাস্টের ক্রয় মূল্য তারিখ
২৪২ ১.০৩৭ ৮ কোটি টাকা ১৮-০৩-২০২১
২৪৩, ২৪৪, ২৪৬ ১.২০৮ ১৮.৫ কোটি টাকা ১৮-০৩-২০২১
মোট ২.২৪৫ ২৬.৫ কোটি টাকা -


গায়ে লাগা দুটো জমি, ০.১৭১ হেক্টর জমি বেশি হওয়ায় দাম দু'গুণের বেশি! একই দিনে।

২) দুটো রেজিস্ট্রিরই সাক্ষী হলেন অযোধ্যার বিজেপি মেয়র হৃষীকেশ উপাধ্যায় ও ট্রাস্টের মেম্বার ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনিল মিশ্র। তাহলে ট্রাস্ট গায়ে লাগা দ্বিতীয় জমিটি সোজা কম দামে পাঠক দম্পতির থেকে না নিয়ে কেন মাঝখানে দালাল ঢুকিয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে কিনল? আর পাঠক দম্পতিই বা কেন প্রথম টুকরো ট্রাস্টকে ৮ কোটিতে বিক্রি করে পরের সামান্য বেশি জমিটি মাত্র ২ কোটি টাকায় জমির দালালকে বিক্রি করল? তাহলে গল্পটা কী? সেটা বুঝতে গেলে জানতে হবে জমির মালিক পাঠক দম্পতির বিশেষ পরিচয়?

২.৩ কে এই হরিশ ও কুসুম পাঠক?

হরিশ ও কুসুম পাঠক বর্তমানে অযোধ্যা আদালত এবং ক্যান্টনমেন্ট পুলিশের স্টেশনের চোখে ২০১৬ সাল থেকেই ফেরার। এদের বিরুদ্ধে চিটফান্ডের মাধ্যমে তিন জেলার লোককে ঠকানোর দায়ে পুলিশ কেস চলছে। বারাবাঁকি, ফিরোজাবাদ এবং সন্ত কবীর নগর থানায় এদের নামে এফআইআর আছে। ২০১৬ সাল থেকে এরা আদালতে হাজির হচ্ছে না। পালিয়ে যাওয়ায় আদালতের নির্দেশে এদের সম্পত্তি জব্দ হয়েছে। এদের গাড়িটি আজও অযোধ্যা ক্যান্টনমেন্ট থানার আঙিনায় রোদ-জল-ধূলো খাচ্ছে। অযোধ্যা পুলিশ এদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, পাচ্ছে না।

অথচ ১৮ই মার্চ, ২০২১ তারিখে এই অপরাধী ফেরার দম্পতি এসে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টকে সোজাসুজি এবং দালালের মাধ্যমে স্টেশনের কাছে পেয়ারাবাগান জমি বিক্রি করে নেট ১০ কোটি টাকা কামিয়ে আবার গা ঢাকা দিল, অথচ ট্রাস্টের সেক্রেটারি ও সদস্য এবং শহরের মেয়র সাক্ষী হয়ে তাদের সাহায্য করলেন?

২.৪ এই জমিটির আসল মালিক কে?

এখন সমস্ত দস্তাবেজ থেকে এটা স্পষ্ট যে ২৪২ থেকে ২৪৬ এই গোটা জমিটির (ক্ষেত্রফল ২.২৪৫ হেক্টর) আসল মালিক ওয়াকফ বোর্ড, এবং এটা নিয়ে কোর্টে কেস চলছে, তাই ২০১১ থেকে কুসুম ও হরিশ পাঠক জমিটি বেচতে পারেনি। এটি ১৯২৪ সালে হাজি ফকির ওয়াকফ বোর্ডকে দান করে দেন। বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের তরফ থেকে ওয়াহিদ আমেদ দেখাশুনো করছে। 'নিউজ লন্ড্রি' ছবি তুলে দেখাচ্ছে যে জমিটিতে একটি বোর্ড লাগানো আছে, যাতে ওয়াকফ বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে হাজি মোহম্মদ ফারুকের নাম ও ফোন নম্বর - ৬৩৮৮৬৭০৪৭৫ দিয়ে জমিটি কাউকে কিনতে বারণ করে ব্যাপারটা জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। (৬)

তাহলে কিসের ভিত্তিতে ট্রাস্ট ভক্তদের শ্রদ্ধার দানের পয়সা দিয়ে এই ফেরার ঠগ পাঠক দম্পতির থেকে জমি কিনল?

২.৫ কহানী মেঁ নয়া টুইস্ট? নজুল জমি কেনাবেচা?

এবার তিন নম্বর জমির গল্প। গত ২০শে ফেব্রুয়ারি মেয়রের ভাগ্নে দীপনারায়ণ উপাধ্যায় বর্তমান রামমন্দির নির্মাণ ক্ষেত্র থেকে ৩০০ মিটার দূরে একটি জমির টুকরো, ক্ষেত্রফল ৮৯০ বর্গমিটার, পূজারী দেবেন্দ্রপ্রসাদ আচার্যের থেকে ২০ লাখে কিনে নেয় এবং ১১ই মে তারিখে ট্রাস্টকে ২.৫ কোটিতে বিক্রি করে। মজার ব্যাপার হল, বিক্রির দস্তাবেজে জমির স্ট্যাটাস, অর্থাৎ এটি প্রাইভেট ল্যান্ড নাকি নজুল, তার কোনো উল্লেখ নেই, বিক্রেতা দীপনারায়ণ উপাধ্যায়ের প্যান নাম্বারের উল্লেখ নেই। তাহলে কী করে রেজিস্ট্রি হল? চম্পত রায়, অনিল মিশ্র ও হৃষীকেশ উপাধ্যায়েরা তো সব ভাল করে বাজিয়ে নিয়ে তবে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। (৭)

এ’ব্যাপারে মেয়র হৃষীকেশ উপাধ্যায় ‘আজ তক’ চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন। জমি রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার এসবি সিং ও অযোধ্যার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অনিল ঝা 'দৈনিক ভাস্কর'-এর প্রতিনিধির সামনে মুখ খুললেন না। বিজেপি’র মুখপাত্র সিদ্ধার্থনাথ সিং মুখ খুললেন না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র বিনোদ বনসাল প্রথমে বললেন - যার মনে হয় গন্ডগোল আছে সে কাগজপত্তর নিয়ে আদালতে যাক, সেখানে ফয়সালা হবে।

যখন বলা হল, আদালতে যাওয়ার কী দরকার? বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ট্রাস্ট রেভিনিউ অফিসে গিয়ে রেকর্ড দেখলেই তো চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়, তখন উনিও চুপ মেরে গেলেন। কারণ 'ইন্ডিয়া টুডে' বলছে যে, রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের সাইটে এই জমিনটির স্ট্যাটাস ‘নজুল’ বা সরকারি খাস দেখাচ্ছে।

এর তদন্ত হবে না?

'নিউজ ইউনিক' পোর্টালের ২৬ জুনের সৌমিক ভট্টাচার্যের রিপোর্ট বলছে - মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই জমিটির স্ট্যাটাসের ইতিহাস খুঁজতে আমলাদের লাগিয়েছেন। সবাই হন্যে হয়ে খুঁজছে জমিটির ইংরেজ জমানা থেকে রেকর্ড, অর্থাৎ কবে থেকে নজুল, কার কাছে লীজ, নজুল স্ট্যাটাস আদৌ রিনিউ হয়েছিল কিনা, হলে কবে ইত্যাদি। কিন্তু অন্য জমিটি? যার রেজিস্ট্রি ১৮ই মার্চ ফেরার দম্পতির সঙ্গে হয়েছিল? আর মানি ট্রেইল? অর্থাৎ দানের টাকাগুলো কার হাত দিয়ে কার কাছে গেল?

২.৬ তদন্ত কে চাইছে?

প্রথমে এই অস্বস্তিকর অবস্থা এড়াতে শাসকদল - সমর্থক চ্যানেলের অ্যাঙ্কররা প্রশ্নকর্তাকে ধমকাতে লাগলেন? আপনি কী ট্রাস্টকে চাঁদা দিয়েছেন? নইলে আপনার ওদের টাকা ওরা কী করছে সেটা প্রশ্ন করার অধিকার নেই। আপনি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বিরোধীদলের প্রচারের ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

কথাটা কী ঠিক? তাহলে তো বিজয়ী প্রার্থীকে যদি আমি ভোট না দিয়ে থাকি তাহলে আমার কি তাঁর কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার নেই?

সে যাই হোক, এতসব কাগজপত্র বেরিয়ে পড়ায় এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

যেমন,

অযোধ্যার হনুমানগড়ী মন্দিরের মোহন্ত রাজু দাস এবং রামললা মন্দিরের প্রধান পূজারী সত্যেন্দ্র দাস বলছেন তদন্ত হোক। অভিযোগ অসত্য হলে মিথ্যা অভিযোগের দায়ে সঞ্জয় সিং-এর বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকার মানহানি মোকদ্দমা হবে। সত্যি হলে দোষীরা কড়া শাস্তি পাক।

নির্বাণী আখড়ার মোহন্ত ধরম দাস, দিগম্বর আখড়ার সুরেশ দাস, নির্মোহী আখড়ার সীতারাম দাস সিবিআই তদন্তের দাবি করে বলেছেন ট্রাস্ট সরকার বানিয়েছেন রামজন্মভূমি মন্দির নির্মাণের জন্যে, লোকে তার জন্য চাঁদা দিয়েছে। জমি কিনে হোটেল বানানোর অধিকার ওদের কে দিয়েছে? (৮)

৩.০ সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল?

১. আম আদমি পার্টির এমপি সঞ্জয় সিং ট্রাস্টের দ্বারা জমির কেনাবেচা নিয়ে যেসব দলিল দস্তাবেজ প্রেসের সামনে হাজির করেছেন তার সত্যাসত্য বা অথেনটিসিটি নিয়ে কেউ সন্দেহ করেননি - না ট্রাস্টের প্রতিনিধি, না বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিজেপির প্রতিনিধি।

২. আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে ট্রাস্ট যে তিনটে টুকরো জমি কিনেছে তার মালিকানা হক সন্দেহজনক। মন্দিরের কাছের জমিটি প্রথম নজরে নজুল, যা কেনা বেচা যায়না । আর স্টেশনের কাছে পেয়ারাবাগানের জমিটি ওয়াকফ বোর্ডের, যার জন্য ২০১১ থেকে যতবার ফেরার ঠগ দম্পতি ওটি আলাদা আলাদা লোকের কাছে বেচতে গেছে, আদালতের আপত্তিতে আটকে গেছে।

৩. ধর্মশালা বা হোটেল বানাতে চেয়ে ট্রাস্ট কি তার সুপ্রীম কোর্ট বা ভারত সরকার প্রদত্ত ম্যান্ডেট বা অধিকারের বাইরে কাজ করছে না?

৪. মন্দিরের কাছে সরকারের খাস জমিটি কী করে অযোধ্যা শহরের বিজেপি মেয়রের ভাগ্নে দীপনারায়ণ উপাধ্যায় দশ লাখ টাকায় কিনে ট্রাস্টকে ২.৫০ কোটি টাকায় বেচতে পারে?

ক্ষমতাসীন দলের লোক হলে ভূ-মাফিয়াদের রামনামের আড়ালে ভক্তদের দানের টাকা নিয়ে নয়ছয়! এদের জন্য কি দেশের আইন প্রযুক্ত হবে না?

এই জন্যেই তদন্ত হওয়া উচিত, সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ভারত সরকার দ্বারা গঠিত ট্রাস্ট কোনো বে-আইনি কাজ করছে কিনা সেটা জানতে চাওয়া সব নাগরিকের অধিকার। তাই আমরাও চাইব নিরপেক্ষ তদন্ত হয়ে সত্যিটা বেরিয়ে আসুক।

● নোটঃ

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে রামজন্মভুমি ট্রাস্টের জমি কেনা নিয়ে এই বিবাদ মিডিয়ার নজরে আসার পর গত জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চিত্রকূটে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের পাঁচদিনের সমীক্ষা বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়। 'নিউজ ইউনিক' ও 'দৈনিক ভাস্কর'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী তাতে ট্রাস্টের জেনারেল সেক্রেটারি চম্পৎ রায়কে নিজের পক্ষ পেশ করতে বলা হয়। শোনা যাচ্ছে তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যা সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বদের বিশেষ সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু সামনে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আপাতত তাঁকে দায়িত্ব থেকে না সরিয়ে যথাস্থিতি বজায় রাখা হয়েছে। (৯)

কিন্তু আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিং-এর চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যাননি। এক হাজার কোটি টাকার মানহানি মোকদ্দমার হুমকি আপাতত শীতঘুমে।


তথ্যসূত্রঃ
১) সঞ্জয় সিং, মনীশ সিসোদিয়া এবং পবন পান্ডের ১৩ ও ১৪ জুনের সাংবাদিক সম্মেলন।
২) ইন্ডিয়া টুডে, ১৫ই জুন এবং প্রেস কনফারেন্সের ভিডিও।
৩) সঞ্জয় সিং, প্রেস কনফারেন্স।
৪) সঞ্জয় সিং, প্রেস কনফারেন্স।
৫) ইন্ডিয়া টুডে, ১৭ই জুন, ২০২১।
৬) নিউজ লন্ড্রি এবং নিউজ ২৪ চ্যানেল।
৭) ইন্ডিয়া টুডে, ১৭ই জুন, ২০২১।
8) দি প্রিন্ট, ১৯শে জুন, ২০২১।
৯) নিউজ ইউনিক ও দৈনিক ভাস্কর, ১২ জুলাই, ২০২১।