আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কাদামাটির হাফলাইফ

ইমানুল হক


আমাদের গ্রামে বিশ শতকের সাত দশকে এমনকী আটের দশকের মাঝ পর্যন্ত দুর্গার মূর্তি আসতো না, পূজা হতো না, ভোরে লোকে মহালয়া শুনতো না, কিন্তু অষ্টমী পালন করতো ঘটা করে। 'হিন্দু' বাড়ির লুচি, ছোলার ডাল, আর চিনির সিরা বা বাড়িতে বানানো দুধের ক্ষীরে ছিল 'মুসলিম' বাড়ির ছেলের সমানাধিকার।

যতোদিন গ্রামে থেকেছি, মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো অষ্টমীতে সকাল দুপুর বিকেল রাতে বাড়িতে খাইনি। একটার পর একটা নিমন্ত্রণ। দুর্গাপূজা ছিল না, কিন্তু বিজয়ার কোলাকুলি, প্রণাম, বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারকেল নাড়ু সংগ্রহ ছিল। আমার হাতে একটু বেশি নাড়ু জুটতো অন্যদের তুলনায়। যদিও সবশেষে একসঙ্গে সমান ভাগ করে বারোয়ারিতলায় বসে ভাগ করে খাওয়া হতো। নারকেল নাড়ুর সঙ্গে ঘুগনির অনুপ্রবেশ নয়ের দশকে। যখন গ্রামে শহর ঢুকল। প্রেসার কুকার এলো। মাটির হাঁড়ি সরতে আরম্ভ করল।

ইদে কোনো হিন্দু বাড়ির স্কুল পড়ুয়া ছেলে বাড়িতে খায়নি। এ-বাড়ি সে-বাড়ি চলছে সিমুই-লাচ্চা দুপুরে মুরগির মাংস-ভাত খাওয়া। বকরি ঈদে সকালেই নিমন্ত্রণের পাট মিটতো। গোরু জবাইয়ের আগে বা বাড়িতে গোরুর মাংস ঢোকার আগে। যদিও দু-একজন ছিলেন যাঁদের গোমাংস খাওয়ার কিংবদন্তী এখনো আছে। এক ব্রাহ্মণসন্তান একাই পাঁচ কিলো গোমাংস সাবড়ে দিতেন। গ্রামে এই নিয়ে কোনো কথা কোনোদিন ওঠেনি।

বিজয়ার সন্ধ্যায় নাড়ু সংগ্রহের মতো সবে বরাতে যুবকের দল আলো আঁধারের সুযোগ নিয়ে ফকির সেজে রুটি মাংস হালুয়া সংগ্রহে বের হতো। গিয়ে সুর করে বলতো, আমরা ফকির মিসকিনের দল দুটো রুটি গোস্ত যদি দাও। সবাই বুঝতেন কারা এসেছেন, বুঝেও না বোঝার ভান করতেন। আমাদের এলাকার মানুষ খুব রসিক। রসিকতা কথায় কথায়।‌ মহিলারা মজা করে বলতেন, এমন ফকির পেলে জামাই করি। কলেজ পড়ুয়ারাও থাকতো সেই দলে। দিদিমা ঠাকুমারা ঠাট্টা করতেন, একজন ফকিরকে নিকে করার সাধ। মিটবে? কবে বসবে বলো নিকের আসরে।

সাধারণ বিয়ে-শাদি। পুনর্বিবাহ-নিকে।

● ● ●
আমাদের একটা বৈঠকখানা ছিল। বলা হতো দহলিজ/ দলিজ, খানকা ঘর। পুরানো লোকরা বলতেন, হেকিম সাহেবের কাছারি। দুটো কাছারি ছিল। একটা বেনে/বামুনপাড়ায়। অন্যটা আমাদের বৈঠকখানায়।

হেকিম সাহেব আমাদের পূর্বপুরুষ। জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বিচারক হিসেবে সুনাম ছিল। হাতে রূপো দিয়ে বাঁধানো কাশ্মীরি লাঠি নিয়ে ঘুরতেন। লোকে বলতো, হেকিম সাহেবের হাকিমতি বিচার। লেয্য বিচার। হাকিম সাহেব শৌখিন মানুষ। একটা দশ বিশ খানা গাঁয়ে আলোচনার যোগ্য কাছারি বানিয়ে ছিলেন। খড়ের বদলে পাট দিয়ে দেওয়াল তৈরি। খড়ের চাল। কিন্তু চালের নীচের কাজ বেত দিয়ে।‌ ঘরের দেওয়ালের পালিশ করিয়েছিলেন ডিমের লালা দিয়ে। আর কাঠের কাজ ছিল দেখার মতো। অজস্র শিল্পকর্ম।‌ পাঙ্খাপুলার ছিল। ঝাড়বাতি লাগানোর আংটা দেখেছি। প্রতিটি খুঁটি দামি কাঠের। তাতে কোথাও একজন উল্টো হয়ে ঢাক বাজাচ্ছে। কোথাও নাচছে। গাইছে। এমন সব ছোটো ছোটো শিল্পকর্ম। দেওয়াল ছিল এত চওড়া, জানালায় দু-তিনজন বাচ্চাকে পাশাপাশি শোওয়ানো যেতো। ওই বৈঠকখানা ঘরের বারান্দায় সবে বরাতের রাতে রুটি মাংস হালুয়া সংগ্রহের পর খেতে বসতো যুবকের দল। আমরা ছোটোরা তো কালীপুজোর মতো ধানি-পটকা, কালি-পটকা, সাপবাজি, আর দোদোমা ফাটানো নিয়ে মশগুল। আর ছিল মজার ফুলঝুরি।

তখন গ্রামে শীতে সাতটা আর গ্রীষ্মে আটটায় ঘুমপরী নামতো। সবাই ঘুমে কাদা। খালি স্কুল পড়ুয়ারা রাত ন'টা দশটায় ঘুমোতে যেতো। আমার বাবার ফেরার কোনো সময় ছিল না। পার্টি করে তাস দাবা খেলে কিংবা যাত্রা নাটক গানের মহলা দিয়ে রাত বারোটা একটা। নিজের ভাত নিজেই বেড়ে নিতেন।‌ মাকে জাগাতেন না। ভয়ে অথবা ভালোবাসায়। অবশ্য মা উঠে পড়তেন। আমিও জেগে উঠতাম। বাবার হাতের দু'মুঠো খাবার ছিল আমার পাওনা। আমি খাটে শুয়ে শুয়েই খেতাম।

তো, কথায় কথায় দূরে চলে এসেছি। ফিরে যাওয়া যাক গ্রামের তরতাজা যুবকের দলের কাছে। কী করছে দেখি তাঁরা। তাঁরা আয়েস করে বসেছে আমাদের বৈঠকখানার বারান্দায়। বারান্দা বলা ভুল, বলা উচিত দাওয়া/উসারা।বসে ভাগ বাটোয়ারা করছে। হাসি ঠাট্টা চলছে। কাকে দেখে বেশি দিয়েছে। মোটামুটি সব ঘরের মাংসই বড়ো পাত্রে জমা হতো। দু'একজন মহিলার রান্নার এতো খ্যাতি ছিল, সেজন্য আলাদা পাত্র নিয়ে যেতো।

সাইফুল চাচার নানির রান্না ভোলার নয়। ব্রাহ্মণ সন্তানটি দাবি করতেন, তাকে দেখেই বেশি মাংস দিয়েছে।‌ অতএব তার বেশি প্রাপ্য। আরেকজন ছিলেন, তিনিও হিন্দু ঘরের সন্তান। কিন্তু গোমাংস খেতেন না। চালের আটার রুটি আর হালুয়া খেতেন। হালুয়া ছিল ছোলার ডালের সুজির। আর ছিল ক্ষীর। নারকেল দিয়ে। পায়েস বলতেন না মুসলিমরা। বলতেন ক্ষীর। শুক্রবার দুপুরে অনেকেই মসজিদে ক্ষীর পাঠাতেন নানা মানত করে। হিন্দু মুসলমান সব ঘরের ছেলেরাই সেই ক্ষীর হাতে নিয়ে চেটে চেটে খেতো।

লক্ষ্মী পূজায় তপশিলি জাতির মানুষের এলাকা পণ্ডিত পাড়ায় থিয়েটার করতো তরুণের দল। অধিকাংশই জন্মসূত্রে মুসলিম। সরস্বতী পূজা হতো কেবল জুনিয়র হাইস্কুলে।‌ সেখানকার ৮০ ভাগ পড়ুয়া 'মুসলিম'। জন্মসূত্রে গ্রামের ৬৫ ভাগ মুসলিম। ৩৫ ভাগ হিন্দু।

গ্রামের পশ্চিমদিকে পশ্চিম থেকে নিয়ে আসা আদি বাসিন্দা সাঁওতালদের বাস। ১৯০৭-০৮-এ গ্রামে কলেরায় বহু মানুষ মারা যাওয়ার পর দুটি ঘটনা ঘটে। এক আদি বাসিন্দাদের জায়গা দিয়ে বসতি স্থাপন করে দেন হেকিম সাহেব। খেতমজুর কমে গেছে মহামারীতে। আর ভোলা সরকার নামে এক কায়স্থ সন্তানের উদ্যোগে কলেরার দেবী ওলাইচণ্ডীর মূর্তি পূজা শুরু করেন হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে মিলে।

এর কয়েক বছর পর শুরু অপেশাদার তথা অ্যামেচার যাত্রা এবং মেলা। যাত্রার ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ শিল্পী জন্মসূত্রে 'মুসলিম'। আজও গ্রামের প্রধান উৎসব ঈদ বা দুর্গাপুজো নয়, মাঘ মাসের ১৯ তারিখে ওলাইচণ্ডী পূজায় মেলা ও যাত্রা।

সব বাড়িতে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসবে। মেলাতলায় গিয়ে ছেলে মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বন্ধু খুঁজবে। কলকল করবে। আগে মেলা চলতো একদিন। যাত্রা দু'রাত কম করে। একবার সাত রাত টানা হয়েছিল। সব অ্যামেচার। খালি ওরিজিন্যাল বা ফিমেল আসতো বাইরে থেকে। যন্ত্রশিল্পী পোশাক এবং ওরিজিন্যাল আনতো হতো ভাড়া করে।

আমার বাবা ছিলেন যাত্রার পোকা। এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা না করা সত্ত্বেও কুকুরা, পাষণ্ডা, বাদুলিয়াসহ বহু এলাকায় তাঁর পরিচয় ছিল মাস্টারমশাই। কারণ যাত্রার প্রশিক্ষণ দিতেন। তিন দিনের জন্য গিয়ে পনের দিন কুড়ি দিন পর ফিরতেন।

দুর্গাপূজা শুরু হলো আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে।দুর্গাপূজায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ নিছক দর্শকের হয়ে উঠল। তার আগে দুর্গাপূজা না থাকলেও দশমীর দিন আদি বাসিন্দা তথা সাঁওতাল পুরুষ রমণীরা ধামসা মাদল নিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হতেন। পুরুষদের মাথায় থাকতো ময়ূরের পালক। মেয়েদের পরনে ডুরে শাড়ি। প্রথমে আসতো আমাদের বাড়ি। সেখানে নাচ গান করে চাল ডাল আলু তেল মশলা ও পয়সা নিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘোরা।

চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে হতো শিবের গাজন। গাজনের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ ও চাল সংগ্রহ করার রীতি ছিল। 'বাবা বুড়ো শিবের জয় হোক' বলে শিবসাধক গন্তা বেনে আমাদের বাড়িতে প্রথম আসতেন। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির গড়ার দাবি এবং তার জন্য ৩১ অক্টোবর ১৯৮৯ শিলাপূজার নামে ইটপূজা হল।

একটু ফাটল গজাল।

কেমেস্ট্রিতে অনার্স এক বিদ্যালয় শিক্ষক আওয়াজ তুললেন, গাজনে মুসলমানদের চাঁদা নেওয়া হবে কেন?উল্টোপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এক শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, মুসলমানদের শিবপূজায় চাঁদা দেওয়া কতোটা জায়েজ? বারোয়ারিতলা ছিল আগে ওলাইচণ্ডীতলা। এখন দুর্গাও অধিষ্ঠিত। শীত গ্রীষ্ম আমরা শিব মন্দিরে আড্ডা দিতাম। শিব মন্দির ভাঙা পড়ল। পাকা ঘর হলো। তাতে রেলিং দিয়ে অবাধ প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো।

বর্ষায় মসজিদের বারান্দা/সামনের জায়গা ছিল ছেলে ছোকরাদের আশ্রয়। সেটাও ঘেরাও হল। প্রবেশ নির্দিষ্ট হলো। এখনও আমার গ্রামের মতো ধর্মনিরপেক্ষ গ্রাম খুব কম দেখেছি। তবু এই সব ঘটনা মনে পড়ে।

● ● ●
এখন ছেলেমেয়েরা খেলে না সেইভাবে মাঠে। মোবাইলে গেম খেলে। দোকানে আজও আড্ডা বসে। মূলত চল্লিশ প্লাস। তাদের চিন্তায় চালসে না পড়লেই মঙ্গল।

পুনশ্চঃ ১৬ বছরের গ্রাম জীবনে অষ্টমীতে কয়েকশো নিমন্ত্রণ পেয়েছি।

৪০ বছরের শহরের জীবনে সপ্তমীতে একবার। বর্ধমানে প্রতি বছর শতখানেক ভাইফোঁটা। কলকাতায় ২৮ বছরে শূন্য। শেষজীবনে তাই কোনো গ্রামে ফিরতে চাই। কাদামাটির জীবনে।