আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ভারতে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

অশোক ভট্টাচার্য


ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নতুন কোনো শ্রেণি নয়। উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনকালে বোম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ শহরগুলিকে কেন্দ্র করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। পরে ক্রমেই অন্যান্য শহরেও এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। এদের বলা হয়ে থাকে 'শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি'। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ও সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। স্বাধীনতার আগে ও অব্যবহিত পরে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির শুধু অংশগ্রহণই নয়, ছিল এক নেতৃত্ব দানকারী ভূমিকাও।

স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, সরকারি, বে-সরকারি ও অ-কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে। ১৯৮০-র দশকে আর্থিক গতিবৃদ্ধি বা মোট উৎপাদন বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে এই শ্রেণির বিস্তারের গতিবৃদ্ধিও শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়কালে, যেখানে ভারতে গড় আর্থিক গতিবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৫০%-এর নিচে, ১৯৮০ সালের পর থেকে সেই হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে গড়ে ৫% হারে। ১৯৯১ সালে নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতির যুগে আমাদের দেশের আর্থিক গতিবৃদ্ধির হার গড়ে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭-৮%। একই সাথে তাল মিলিয়ে প্রসারিত হতে থাকে নগরায়ন। একদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি, আর্থিক গতিবৃদ্ধি, নগরায়নের সম্প্রসারণ, অন্যদিকে একটি অংশের মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং তরুণ প্রজন্মের মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি। পূঁজিবাদী পথে শিল্প উৎপাদনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, ফলে বৃদ্ধি পায় অ-কায়িক শ্রমজীবি মানুষের সংখ্যাও। শুধু সরকারি ক্ষেত্রে নয়, বে-সরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগ-ও ঊর্দ্ধমুখী হতে থাকে এই সময় থেকে আমাদের দেশে। নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী অর্থনীতির যুগের এই বিকাশের সাথেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি - যার সাথে স্বাধীনতা পূর্ব বা স্বাধীনতা উত্তর মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে রয়েছে এক বিরাট পার্থক্য।

(২)

এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব আমাদের দেশের শ্রেণি ও সামাজিক কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিণত হচ্ছে এক উপভোক্তা শ্রেণিতে - যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থের যোগান থাকায় বাজারে অতিরিক্ত চাহিদারও সৃষ্টি করছে। যা পুঁজিবাদী আর্থিক নীতির পথে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের ভারতে এই মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা ৫০-৬০ কোটির মধ্য যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চাইতেও বেশী। অন্যদিকে ভারতে নগরায়নের বৃদ্ধির হার অনেক উন্নত বা উন্নয়ণশীল দেশ থেকে কম হলেও, সংখ্যার দিক দিয়ে নগরায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারতের স্থান দ্বিতীয়, চীনের পর। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের ৫৫% মানুষ বসবাস করে শহরে বা নগরে। ভারতে বর্তমানে এই সংখ্যা ৪০ কোটিরও বেশী এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা ৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং গ্রাম থেকে শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যা এই সময়ে বেশী হবে। নগরায়ন সম্প্রসারিত হবে শহরতলিতে এবং এমনকি গ্রামাঞ্চলেও। ফলে আমাদের দেশের নগর জীবনে যেমন পরিবর্তন হবে, তেমনই পরিবর্তন ঘটবে গ্রামীণ জীবনেও। অর্থনীতি ও উৎপাদনের গতি-প্রকৃতিরও এক পরিবর্তন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো বৃদ্ধি পাবে। যার মধ্য দিয়ে যেমন নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তেমনি বৃদ্ধি পাবে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাও। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের ৬০% মানুষের গড় বয়স ৩০ বছরের কম।আমাদের দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেক অংশের গড় বয়স ২৫ বছরের নিচে।

(৩)

কার্ল মার্কসের মতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মুলতঃ রয়েছে দুটি শ্রেণি। একটি পুঁজিপতি বা মালিক শ্রেণি - যাদের উৎপাদন সম্পর্ক বলা হয়ে থাকে, অন্যটি সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণি - যাদের বলা হয় উৎপাদিকা শক্তি। এরা নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করে মজুরীর বিনিময়ে। 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'তে এর মাঝে আরেকটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে, যারা পেটি বুর্জোয়া। এরা একটি অন্তর্বর্তী সমাজ, ছোট ছোট উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক, ছোট ছোট ব্যবসা বাণিজ্যেরও মালিক। যদিও উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর বেশী বেশী ভাবে নির্ভরশীল হওয়া শুরু করে। এই নব্য উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কায়িক শ্রমিকদের পরিবর্তে অ-কায়িক শ্রমিকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থেকেছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তী শ্রেণির। যারা পেশাজীবি, উচ্চপদের মাসিক বেতনভূক, যারা স্বনিযুক্ত ও শিক্ষিত। যাদের আয় মালিকদের চাইতে কম, আবার কায়িক শ্রমিকদের চাইতে বেশী। এরাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যদিও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কোনো একক (sigular) শ্রেণি নয় - তার রয়েছে অনেক ভিন্নতা (pluralistic)। মধ্যবিত্ত শ্রেণির লক্ষ্য থাকে সমাজে সমগোত্রীয় (homogeneous) ভাবে কর্তৃত্ব সৃষ্টি করার। নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্মের সাথে তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশও জড়িত - একথা বলা যায়। পুরাতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাথে এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু গুণগত পার্থক্য রয়েছে।

(৪)

ভারতের এই মধ্যবিত্ত সমাজ কোনো একটি একমাত্রিক গোষ্ঠী নয় - বহুমাত্রিক। এর মধ্যে রয়েছে অনেক বিভিন্নতা। সাধারণভাবে এরা উচ্চাভিলাষী এবং উদারীকরণ অর্থনীতির সমর্থক। আবার যারা গরীব তাদের লক্ষ্যও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের ব্যয়ে তাদের সামর্থ্য যত কমই থাকুক না কেন, তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরাজি শিক্ষার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকে। এরা মনে করে এইভাবে তারাও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে। আমি পরে কয়েকটি উদাহরণ ও তথ্য-পরিসংখ্যান সহযোগে বোঝাবার চেষ্টা করব, নয়া উদারীকরণ অর্থনীতির এই যুগে কীভাবে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৯-৯০ সালে গরীব বা নিম্ন আয়ের মানুষের হার ছিল শহরাঞ্চলে ৩৭.২৪%, ১৯৯৮-৯৯ সালে গরীবদের হার হ্রাস পেয়ে হয় ১৮.৯৬%। গড়ে দারিদ্র কমেছে ১৫%। যদিও হ্রাসের হার শহর থেকে গ্রামে বেশী। অন্যদিকে একই সময়ে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের হারও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই সবটা নিয়ে ১৯৯৮-৯৯ সরালে শহরে বসবাসকারী প্রসারিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের হার ছিল ৪৭.২৮%। গ্রামেও এই হার ১৪.২১% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তা হয়েছিল ২৫.৮১%। যদিও বর্তমানে এই মধ্যবিত্ত মানুষের হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৫০%-এর বেশী মানুষ উচ্চ জাতের, তারা অ-কায়িক শ্রমিক বা কর্মী, মাসিক বেতনভুক। এদের আবির্ভাব আদিবাসী, তফশিলি জাতি, দলিত সম্প্রদায়ের সামাজিক গুরুত্বকে হ্রাস করে থাকে। নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, আমাদের দেশের শ্রেণি ও সামাজিক কাঠামোর যেমন পরিবর্তন করে দিচ্ছে, তেমনই নির্বাচনী রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন করে দিচ্ছে। দুর্বল করছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও শ্রেণি সংগ্রামকে। বাড়ছে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতি সমর্থনের প্রবণতা এই শ্রেণির ভোটদাতাদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনোত্তর বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে তা দেখা যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষাগুলিতে দেখা যাচ্ছে, গত দুই দশক ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোটদাতাদের ভোট প্রদানের হার গরীবদের ভোট দান থেকে বেশী হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, গ্রাম এবং শহর - সবক্ষেত্রেই। এমনকি তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যেও ভোটদানে অংশগ্রহণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিপূর্বে আমার একটি নিবন্ধে দেখিয়েছি, কীভাবে সোস্যাল ইজ্ঞিনিয়ারিং-এর মধ্য দিয়ে উল্লিখিত ভোটদাতাদের ভালো অংশের ভোট বিজেপির পক্ষে পড়েছে সমসাময়িক নির্বাচনগুলিতে।

(৫)

বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংজ্ঞায়িত করলেও, সাধারণভাবে আয় ও ভোগের ভিত্তিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সামাজিকভাবে এবং দেশের গণতন্ত্রীকরণের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে প্রভাব বিস্তারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই শ্রেণির মধ্যে চিন্তার বিভিন্নতার বৈশিষ্ট আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নব্য উদারীকরণ অর্থনীতির যুগে এই ভিন্নতা আরও প্রকট এবং বৈচিত্রপূর্ণভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত, তা থেকে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রূপান্তরের গতিও বাড়ছে আজকের ভারতবর্ষে। এই রূপান্তরের পথে, জীবনযাত্রার উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ও জীবন-যাপনের পরিবর্তন সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীরভাবেই রেখাপাত করছে। আবার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণের প্রত্যাশা না মেটার ফলস্বরূপ অসন্তোষও বৃদ্ধি পাচ্ছে এই শ্রেণির মানুষদের মধ্যে। আজকের সময়ে নব্য মধ্যবিত্তরা বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে একদিকে চায় - জীবিকাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি। আবার সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ যেমন, দলিত বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে তাদের কাছে ন্যায় বিচার, সমতা, সামাজিক সম্মান, ভাগিদারী, প্রতিনিধিত্ব মূলক অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলি জীবিকার ইস্যুর মতই অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নব্য মধ্যবিত্তের বিকাশে আর্থিক গতিবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের উৎপাদনব্যবস্থা উপর জীবিকার নির্ভরতার বদলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক সময়ে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে কৃষিক্ষেত্রের ভূমিকা ছিল সব চাইতে বেশী। আজ তা কমতে কমতে পৌঁছেচে তলানিতে (১২-১৩%)। কর্মসংস্থানে কৃষির অবদান ৮.৬% কমেছে। অন্যদিকে উৎপাদনভিত্তিক শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৪.২% ও ৪%। অন্যদিকে অর্থনীতিতে বাড়ছে পরিষেবা ও উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পের অবদান। কর্মসংস্থানের উৎসের পরিবর্তন মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই বদলে অনুঘটকের কাজ করছে। নয়া উদারনীতির এই যুগে আয় বাড়লেও কমছে সামাজিক সুরক্ষা। বাড়ছে বৈষম্য। সংগঠিত ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্র। ফলে কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত মানুষদের যতটুকু বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে তা হচ্ছে মূলতঃ অসংগঠিত ক্ষেত্রে। লগ্নীপুঁজির বিকাশের এই যুগে আর এক দল মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে যারা কোনো উৎপাদনের সাথে যুক্ত না থেকে, অর্থাৎ কোনো সম্পদ সৃষ্টি না করে হঠাৎ করে সম্পদশালী হয়ে যাচ্ছে। তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তে পরিণত হচ্ছে। এরা শহর ও শহরতলীতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের ভাষায় এরা আত্মসাৎকরী (Rent seeker)। Rent seeking বা আত্মসাতের মধ্য দিয়ে হঠাৎ করে এরা বিত্তশালী হয়ে উঠছে। শহর বা শহরতলীতে বাংলাদেশের মতো আমাদের রাজ্য তথা আমাদের দেশে এরাই রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে থাকে। বাংলাদেশে মৌলবাদী অর্থনীতি সৃষ্টির পিছনে রয়েছে এই Rent seeker-দের বড় ভূমিকা। উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি সমাজ বা রাষ্ট্রের মোট বিত্ত বা সম্পদ বৃদ্ধি করে। কিন্তু Rent seeking-এর ভূমিকা সমাজে ঠিক উলটো। তাদের নিজেদের সম্পদ বা বিত্ত বৃদ্ধি পায় কোনো উৎপাদন না করে, বিত্ত হস্তান্তর করে। এসব তারা করতে পারে রাষ্ট্র, সরকার ও শাসক রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে। এতে রাষ্ট্রের বিত্ত বা সম্পদ বৃদ্ধি পায় না। একটি ছোট উদাহরণে আসা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে আজ যত পূজো কমিটি, সামাজিক সংস্থা, মসজিদ কমিটি ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে, তাদের মাথায় কিন্তু কোনো বিশিষ্ট জনেরা থাকছে না। থাকছে কিছু হঠাৎ করে ধনী হওয়া মানুষরা, যাদের মাথায় সরকার ও রাজনৈতিক দলের হাত থাকে। যারা খুব সহজেই এই সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের অনায়াস লব্ধ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে।

(৬)

আবার, আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখনও যত অ-কায়িক কর্মীরা আকর্ষণীয় উচ্চপদ, যেমন, ব্যাঙ্ক, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থা, নির্মাণ শিল্প, সরকারি বা আধা-সরকারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চপদে বহাল রয়েছে বা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে, তা মূলতঃ উচ্চ বর্ণ বা উচ্চ জাতের মানুষেরাই। অন্যদিকে, আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে যারা পিছিয়ে রয়েছে তারা মূলতঃ আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তফশিলি জাতি ও উপজাতি অংশের মানুষেরা এবং এদের মধ্যে মধ্যবিত্তে রূপান্তরের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম - উচ্চ জাতের তুলনায়। গত কয়েক দশকে সরকারি, আধা-সরকারি বা কর্পোরেট ক্ষেত্রে উচ্চস্তরের পদ যা সৃষ্টি হয়েছে বা পূরণ হয়েছে, নিচু স্তরের পদ সৃষ্টি বা পূরণ সেভাবে হচ্ছে না। এই সমস্ত ধরনের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এমনকি, শ্রেণি কাঠামোর ওপরও। অন্যদিকে নগরায়নের প্রসারে বাড়ছে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এছাড়া, আর্থিক গতিবৃদ্ধি, মানুষের আয় বৃদ্ধির ফলে গ্রাম ও শহরতলিতেও নব্য মধ্যবিত্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বাজারে চাহিদা ও উপভোগের বৃদ্ধি হচ্ছে। আবার নব্য মধ্যবিত্তের জীবনশৈলীর পরিবর্তনের দরুন বাজারে নতুন নতুন চাহিদারও সৃষ্টি হচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মানুসারে এই পরিস্থিতিতে লাভবান হচ্ছে দেশ-বিদেশের পুঁজিপতি শ্রেণিরাই। ধান্দার ধনতন্ত্রে বাড়ছে লগ্নীপুঁজির দাপট। আগেই উল্লেখ করেছি সম্পদ সৃষ্টি না করেই কিছু মানুষ সম্পদ বা বিত্তশালী হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদীরা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে, সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে এবং গণতন্ত্রের চতু্র্থ স্তম্ভ মেইনস্ট্রীম মিডিয়াকে কব্জা করে, অর্থের বিনিময়ে সাময়িক ভাবে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা তুলছে। সমাজে জনবিন্যাসের পরিবর্তন, জমির ব্যবহারের পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, তার সাথে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ, প্রসার ও সমাজে তাদের ক্রমবর্দ্ধমান প্রভাবকে কাজে লাগিয়েই এই ফসল তুলছে আজকের ভারতে দক্ষিণপন্থী দলগুলি।

আমাদের দেশে নব্য মধ্যবিত্তরা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে। এরা শহরে ও গ্রামে নিজেদের পছন্দের ও নিজেদের শ্রেণির মানুষদের দ্বারা স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন কব্জা করতে চায়। শহরগুলিতে ওয়ার্ড কমিটির সাংবিধানিক রূপরেখাকে নস্যাৎ করে, সব ধরনের নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও মতামতের তোয়াক্কা না করে, রেসিডেন্সিয়াল কমিটি বা আবাসন কমিটি গঠন করে। গরীব শহরবাসীদের বাধ্য করে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে শহরতলিতে বা দূরের গ্রামে তাদের বাসস্থানের স্থানান্তর করতে। এরা বস্তি উচ্ছেদ করে বহুতল নির্মাণের পক্ষে। স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শহর ও শহরতলির জনবিন্যাসের বদল ঘটিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন হচ্ছে। তারও প্রতিফলন ঘটছে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে।

আবার নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতি, কৃষি থেকে উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পের চিরায়ত রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক শোষণ এবং যৌথ সামাজিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে মুনাফার মাত্রার বৃদ্ধি ঘটাতে চায়। দুর্বল করতে চায় ধ্রুপদী সর্বহারার সংখ্যা ও শ্রেণি ভিত্তিকে। এর ফলে শ্রেণি সংগ্রামের দুর্বলতার সুযোগে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে সামনে এনে এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ সৃষ্টি হয়েছে আজকের ভারতবর্ষে।

সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-অর্থনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে থাকে। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রের যেমন আছে অর্থনৈতিক ভিত্তি, আবার তেমনি আছে তার রাজনৈতিক সারবত্তা। এর সাথেই যুক্ত পাশ্চাত্ত্য দেশগুলির মতো ভারতেও রাজনীতির দ্বি-মেরুকরণ।