আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

এলোমেলো কথা

প্রণব বিশ্বাস


পুজো বা শারদ উৎসব এসে পড়লেই মন আর স্মৃতি অতীতচারী হয়ে উঠতে চায়। আমার ফেলে আসা শৈশব-বাল্য-কৈশোর এসে ভিড় করে স্মৃতি সরণীতে। বয়স হলে অতীতের সবকিছুই ভালো বলে মনে হওয়ার একটা বদ অভ্যাস হয়তো আছে বয়স্ক মননের। হয়তো এর সত্যতাও কিছু কম নয়। তবু স্মৃতির টান তো উপেক্ষার নয়। সেই স্মৃতিই যেন বলে আমাদের বিস্ময় হারিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি।

গত প্রায় দু'বছর ধরে গোটা পৃথিবীকে ত্রস্ত করে রেখেছে অতি অতিক্ষুদ্র এক ভাইরাস। 'জঙ্গি' নামের অতি ভয় সঞ্চারী তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এই মারণ ভাইরাস। সরকারি বয়ান মানলে এ পর্যন্ত করোনার বলি গোটা পৃথিবীতে ৪৮,৫২,৬৯০ জন, দেশে ৪,৫০,১২৭ আর এ রাজ্যে ১৮,৮৮২ জন। এই মারণ ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তিনটি বিষয়ে জোর দিচ্ছেনঃ সর্বদা মাস্ক পরে থাকা, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা আর নিয়মিত স্যানিটাইজার বা সাবানে হাত পরিশ্রুত রাখা। করোনার দুটি ঢেউ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কাবু করে ফেলেছে দেশ ও পৃথিবীর অর্থব্যবস্থাকে। চাকুরি বা রোজগার হারানো মানুষের পরিসংখ্যান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। জীবন যাপনের অপরিহার্য জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের দিনযাপনের অসহায়তা অকল্পনীয়। আর বিজ্ঞানীরা বলছেন এসব নিয়মবিধি অমান্য করলে করোনার তৃতীয় ঢেউ এসে সবকিছুই লন্ডভন্ড করে দিতে পারে।

এরকমই এক আবহাওয়াতে এ-রাজ্যে এসে পড়েছে উৎসবের মরসুম। আর আমরা উৎসবকে মত্ততায় পর্যবসিত করতেই অভ্যস্ত হয়েছি। উন্মত্ততার গ্রাসে এসে পড়লে উৎসব আর উৎসব থাকে না। এরাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই উৎসব যেন উন্মত্ততারই নামান্তর। সংবাদপত্রের শিরোনাম ও প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে 'করোনার আরাধনা'র বিস্তৃত বিবরণ। রাজ্যে 'কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক'-এর উপদেষ্টা চিকিৎসক বলছেন, "কালীপূজোর সময় ঝাঁকে ঝাঁকে শ্যামাপোকা আলোর টানে তার ওপর যায় এবং অবশ্যম্ভাবী মরে যায়। এবার পুজোর মণ্ডপ ও আলোর দিকে ছুটে যাওয়া মানুষকে দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরাও সংক্রমণের আগুনে আত্মাহুতি দিতে ছুটে চলেছেন।" প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, ‘কিছু মণ্ডপে দুপুর থেকেই' তিল ধারণের জায়গা ছিল না। দূরত্ববিধি মানার চেষ্টাতো দূর, অধিকাংশেরই মুখে দেখা যায়নি মাস্ক। এক দর্শনার্থীর মন্তব্য, "দূর থেকেই এই মণ্ডপের আলো দেখা যায়। ওই টানেই ছুটে এসেছি। এত গরমে মাস্ক পরে থাকা যায়?..."।প্রতিবেদনে আরো পড়ছি "এই পুজোর ভিড় নিয়ে আগের দিনই ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।... এমনকি, এত উঁচু মণ্ডপ তৈরির এবং তাতে লেজার আলো লাগানোর অনুমতি দমকল বা পুলিশ দিল কী করে, তা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি।" মুখ্যমন্ত্রী কি বিপদ সংকেতটা একটু দেরিতে পেলেন? কেমন যেন মনে হয় এতদিন রাজ্য সরকারের একটা নীরব প্রচ্ছন্ন অভয় ও প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত ছিল এই হুজুগ প্রিয়তায়। এখন প্রতিটি বড়ো পুজোর প্রধান খুঁটি রাজ্যের কোনো না কোনো মাননীয় মন্ত্রী। তাঁদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের ফলে কর্পোরেট ও ব্যবসায়িক সহায়তায় প্রতিটি পুজোর বাজেটই কল্পনার অতীত। এত টাকার জোগান পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রত্যেককে ঠেলে দিচ্ছে। দলে, মন্ত্রীসভায় পরস্পরের যে নীরব বিরোধ তা যেন সূত্র হয় এই পুজো আয়োজনে, ভক্তিহীন আড়ম্ভরের দেখনদারিতে। এখান থেকেই শুরু হয় চমকে দেওয়ারও প্রতিযোগিতা। কে কতটা চমক সৃষ্টি করতে পারেন তারই যেন উৎকট এক প্রদর্শন। তার ওপর রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে পুজো আয়োজনে সরকারি অনুদান (যা ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকারকেই মিথ্যা প্রমাণ করে), বিদ্যুতের নিঃশুল্ক সরবরাহ (গৃহস্থ বিদ্যুৎ মাশুলের নিয়মিত বাড়বাড়ন্তে নাজেহাল)। জনসাধারণের করের টাকায় এই বারোয়ারি হুজুগকে প্রশ্রয় দেওয়ার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বড়োরকমের কোনো উদ্যোগ না-থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ার হাল্কা টীকা-টিপ্পনীতেই বিষয়টা আটকে থাকছে।

সমরেশ বসুকে তরুণতর এক লেখক একবার বলেছিলেন তাঁর আর কোনো কিছুতেই বিস্ময় নেই। বিস্মিত সমরেশ বসু আঁতকে উঠে বলেছিলেন বিস্ময় না-থাকলে তুমি লিখবে কী করে? আমাদের সমাজ মননে বিস্ময়ের জায়গা ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে চমক, তাক লাগানো। যে জনমন্ডলী উন্মাদের মতো মণ্ডপে মণ্ডপে নিয়মবিধির তোয়াক্কা না করে ছুটে চলেছেন তাঁরা খুঁটিয়ে কেন ভালো করে প্রতিমাটুকুও দেখছেন না, দেখছেন লেজার আলোর চমক আর ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের ভাসমানতা। পরের দিন জানতে চাইলে তার বিবরণ দিতে তো তো করে শুধুমাত্র চমকটুকুর কথাই বলবেন। বাড়ির ছোটোদের (যেসব বাড়ি বক্তৃতা বা লেখার আড়ালে আমাদের মনের গভীরে আছে) যে খেলনাই দেওয়া হোক না কেন তারা আর বিস্মিত হয়না। কেননা তার ঝুলিতে এতরকমের চমক জাগানো খেলনা রয়েছে যে নতুনতর চমক না-থাকলে সে আর খুশি হতে পারছে না। শিশুটিকে দোষারোপ করে তো লাভ নেই, আয়নার সামনে তো নিজেকেই দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিমননে সেই সাহসটুকুই আর অবশিষ্ট নেই। কবিতায় পড়েছিলাম 'জল দিয়ে লজেঞ্চুস/এক রকম ঘুষ।' এখন আমরা সন্তানকেও ঘুষে বশে রাখতেই সচেষ্ট থাকি। তাই হরেকরকম খেলনা, নিত্যনতুন পোশাকের বাহার, সব কিছুই চমক লাগানো। সত্যজিৎ রায়ের 'Two' মনে পড়ে যায়।

শুরু করেছিলাম ছেলেবেলায় ফিরে যাওয়ার কথা দিয়ে। কথায় কথায় কতদূর সরে এসেছি। খুব ছোটোবেলা যে-পাড়ায় কেটেছে তার খুব কাছাকাছি ছিল তিনটি সর্বজনীন। এদিকে-ওদিকে তিন-চার পা বড়োজোর। তার মধ্যে বড়টি ছিল বেশ নামী পূজো। সেখানে প্রতিমা তৈরি শুরু করার সময় থেকে বিস্ময় জাগিয়ে একতাল মাটি কেমন করে একটা সম্ভ্রম জাগানো প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়ে যেত সে বিস্ময় যেন এখনো চোখে লেগে আছে। এখানেই শেষ নয়। কতদিন জুড়ে চলত কাপড়ে বুনোট দিয়ে মণ্ডপের অলঙ্করণ। কাপড়ের বুননে গড়ে ওটা আলপনার কতো বিচিত্র কারিগরি। কোনো বিশ্বখ্যাত জিনিসের আদল নয়, খাঁটি এক শিল্পের সমাহার। বড়ো বড়ো পুজোর মধ্যে নিশ্চয়ই তখনও নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু সে নিজস্ব শিল্প সম্ভারের প্রদর্শনীতে, প্রতিমায়, মণ্ডপে, আলোকসজ্জায়। মৃদু আলোর রংবাহারি চোখকে আরাম দিত, কখনও চমকে যেতে হয়নি। আর ছিল বিসর্জনের মিছিল। প্রতিটি ক্লাবের নিজস্ব ব্যান্ড, পোশাকের রকমারিত্ব, সুরের মূর্ছনা আর দুই সারির মিছিল কখনো কখনো সর্পিল ভঙ্গিতে এক হয়ে যেত। কী করে যে হত ভেবে পেতাম না তখন।

পাড়া বলে এক পরম আশ্রয় এক আত্মীয়তার মধ্যে আমাদের বড়ো হওয়া। বিজয়ায় বাড়ি বাড়ি প্রণাম করতে যাওয়া, নারকেল ছাঁচে তোলা আশ্চর্য স্বাদের ক্ষীরের সন্দেশ, কুচো নিমকি আর 'এলোঝেলো' নামের ভারী সুন্দর একটি মিষ্টি। সবই মা-কাকীমা-মামীমাদের হাতে তৈরি। দোকান থেকে কিনে খাবার নয়, পরিশ্রমে, পরিকল্পনায় আর নিপুণ শিল্পীত ভঙ্গিতে তৈরি বাড়িরই খাবার। বড়োরা পরস্পর কোলাকুলি করতেন। পাড়াতুতো জ্যাঠামশাই, কাকাবাবু, মেশোমশাইদের কখনো অনাত্মীয় ভাবার কথা মনে যে আসেনি শুধু তাই নয় তাঁদের বকুনি, তিরষ্কার, প্রশ্রয়, ভালোবাসা সবই যেন ছিল অনিবার্য। পাড়ার দিদি-বউদিদের বড়ো দল হয়তো বা পনেরো-কুড়ি জনের, একসঙ্গে সিনেমা দেখতে চলেছেন এ-দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। তখন পুজোয় নতুন ছবির মুক্তি পাওয়া, দল বেঁধে সিনেমায় যাওয়া আর ঝালমুড়ির অমৃত স্বাদেই পূর্ণতা পাওয়া যেত। আর ছিল পুজোর গান, পুজো প্যান্ডেলে বাজত লাউড স্পিকারে, বাজত অনুরোধের আসরে। গায়ক নয় শিল্পীর গান। তার টানও কম ছিল না।

দিন একরকম থাকে না, সময় এসে সব পালটে দেয়, পুরোনো দিনের কথা বললে নতুনদের মনে হতে পারে বড়ো নস্টালজিক। এখানে সেইসব ভালোর কথাই মনে এলো যেগুলো আমাদের জীবনে প্রচ্ছন্নভাবে একটা শিল্পীত অন্তঃসত্তা তৈরির সহায়ক ছিল। ভালোর গভীরে চোরাস্রোতও নিশ্চয়ই ছিল, তার সবটা আমাদের বালক চোখে ধরা পড়েনি, স্মৃতিতেও নেই তেমন করে। বেশ খানিকটা বড়ো হয়ে দেখেছি পাড়ার পুজো নিয়ে পল্লীবাসীর ঐকান্তিক আগ্রহ, ঝগড়াঝাঁটি, তুমুল বিবাদের পরেও দল বেঁধে চাঁদা তোলা, প্রতিমা নিয়ে আসা, বিসর্জনের আয়োজনে পাড়ার লোকের আন্তরিক অংশগ্রহণ। এখন হলপ করেই বলতে পারি পাড়ার পুজো এখন মন্ত্রী ও কর্পোরেট আশ্রিত। দু-চারজন মাতব্বরের একান্ত অধিকারে, অনেকক্ষেত্রেই পল্লীবাসীকেও কার্ড দেখিয়ে নিজের বাড়ি পৌঁছতে হয়, পুজো আয়োজনে তাঁরা নিতান্ত এক দর্শক।

এতসব কথার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের একটি কথা ফিরে ফিরে মনে আসে। বঙ্কিম প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘...উৎসব যথা দুর্গোৎসবাদি। জিজ্ঞাসা করি এই হতভাগ্য অন্নক্লিষ্ট, হট্টগোলে ব্যতিব্যস্ত বঙ্গসমাজে এতটা উৎসবের কি প্রয়োজন আছে?' এতদিন আগে বঙ্কিমচন্দ্র যে প্রশ্ন তুলেছিলেন তার কোনো উত্তর কি একবিংশ শতাব্দীর একুশটা বছর অতিক্রম করেও আমরা দিতে পারব?

একটু তলিয়ে ভাবলে আমাদের মনেও কি প্রশ্ন ওঠার কথা নয় যে সত্যি কি দুর্গোৎসব বাঙালির জাতীয় উৎসব? হিন্দু বাঙালির কথা ভাবলেও আমাদের তো মনে রাখতে হয় নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের কথা। যাদের সাড়া অনেক বেশি লৌকিক দেবদেবীর আরাধনায় আর ব্রতপার্বণে। আর বাংলা ভাষা যাঁদের মাতৃভাষা তাঁদের কথা বললে এই সারসত্য তো না-মেনে উপায় নেই যে এর মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যায় অধিক। তাহলে বাঙালির জাতীয় উৎসব দুর্গোৎসব হয় কী করে?

ঈদকে আমরা কোল দিইনি, বিবেকানন্দ নিজেকে যাঁর দাসানুদাস মনে করতেন সেই বুদ্ধের কথা আমরা মনে রাখিনা। (হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ভাবতেন এমন এক বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপনের কথা যেখানে উন্মুক্ত আকাশের নীচে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সারারাতব্যাপী অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে গাইবেন বা বাজাবেন রবিশঙ্কর, আলী আকবর, বড়ে গোলাম আলি আর ভীমসেন যোশী, বিসমিল্লা খান ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়।) খ্রীষ্টোৎসবের কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আমাদের যাপন মানায় মহামতি যীশু নেই, আছে বড়োদিনের উশৃঙ্খল হৈ-হল্লা।

এখনো কি আমরা নিজেদের দিকে একবার তাকাব না?