আরেক রকম ● নবম বর্ষ বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২১ ● ১-১৫ কার্তিক, ১৪২৮
সম্পাদকীয়
শারদ শুভেচ্ছা এবং
বঙ্গের শরৎকাল। তীব্র গরম, অবিরাম বর্ষার পরে আকাশে সাদা মেঘের আগমন মাটিতে সাদা কাশফুল, গাছে শিউলির ডালি। প্রতি বছরের মতন এই বছরও প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু এই বছর অন্য বছরের তুলনায় ভিন্ন। অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ, লকডাউন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, বন্যা এবং অতিবৃষ্টি পেরিয়ে অসংখ্য মানুষের জীবন দুর্বিষহ হওয়ার পরে এল শারদোৎসব।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিগত দুই বছরের গৃহবন্দী জীবনের থেকে মুক্তি চাইছিল। তাই এই শারদোৎসবে যেন মানুষ সমস্ত বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন উৎসবের উন্মাদনায়। কিন্তু এই উন্মাদনা কি উৎসব? গোটা শহরের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ ছাপিয়ে গোটা শহরের আকাশ, তার পারিপার্শ্ব সবটাই এখন বিজ্ঞাপনে মোড়া। আমাদের সহ-নাগরিক বহু মানুষের কাজ চলে গেছে। বহু মানুষ প্রিয়জন হারিয়েছেন, বহু মানুষ অসুস্থ, আয় কমে গেছে বহু লোকের। তবু, এত কিছুর মধ্যেও আনন্দ তো করতেই হয়। কিন্তু সেই আনন্দের মধ্যে কি আমরা আমাদের সহ-নাগরিকদের ক্ষোভ-দুঃখ-যন্ত্রণার প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছি? তাদের হাত ধরার চেষ্টা করছি? নাকি ওমুক নেতার তমুক প্যান্ডেল দেখার জন্য ছুটে চলেছি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে। এই ছুটে চলার পরিণতি যে ভয়ংকর হতে পারে, করোনার আগমনীতে পর্যবসিত হতে পারে, তা জেনেও না জানার নেশায় ছুটে চলেছি আমরা। কেন?
একটি ইংরেজি কথার সংক্ষেপ, ‘ফোমো’ - ফিয়ার অফ মিসিং আউট। কোনো কিছু ঘটছে যার আমি সাক্ষী থাকতে পারছি না, এই ভয়কেই বলা হয় ‘ফোমো’। অমুক প্যান্ডেলে তমুক থিম হয়েছে, বন্ধুরা ছবি দিচ্ছে ফেসবুকে, আমি সেখানে না গেলে যেন কিছু হারিয়ে ফেলছি। এই তাড়নায় ছুটে চল সেখানে, যেখানে চলেছে বেসামাল ভিড়, যেখানে আছে আমি এবং আমার মোবাইল ক্যামেরা। ছবি তুলে ফেসবুকে দিলেই শান্তি নামে বুকে। আমরা আসলে বেঁচে রয়েছি অনলাইন দুনিয়ায়। বাস্তব দুনিয়ায় আমরা অফলাইন। অফলাইন থেকে অনলাইনে উত্তরণই হল আনন্দ। এই বিশ্বাসে আমাদের বাস্তব যাচ্ছে গুলিয়ে। করোনাকে করছি তুচ্ছ, মোক্ষ হয়ে উঠছে পুজোর উন্মাদনা।
অবশ্যই মানুষ কীভাবে আনন্দ করবেন, তা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু সর্বজনীন বিপদের সামনে পড়ে মানুষ যখন যৌথভাবে মত্ততায় মেতে ওঠেন তখন কিছু কথা বলতেই হয়। এই সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লিখিত বঙ্কিমচন্দ্রের কথাই আমাদের কথা হিসেবে তুলে ধরতে হয়, ‘...উৎসব যথা দুর্গোৎসবাদি। জিজ্ঞাসা করি এই হতভাগ্য অন্নক্লিষ্ট, হট্টগোলে ব্যতিব্যস্ত বঙ্গসমাজে এতটা উৎসবের কি প্রয়োজন আছে?’
আমরা মনে করি প্রয়োজন হয়ত আছে। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ছে যে মানুষ তার প্রয়োজন রয়েছে বিশ্রামের, আনন্দের। প্রত্যহ যে যন্ত্রণা জীবনকে বিদ্ধ করে তার বাইরে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে কিছু সময়কে জীবনের গতানুগতিকতার বাইরে রেখে আনন্দ উপভোগ করার। উৎসব মানুষকে সেই অবকাশ দেয়। এই অবকাশের আনন্দে মেতে উঠুন সবাই। কিন্তু কৃত্রিমতার বাইরে, কর্পোরেট-নেতা-মন্ত্রীদের তৈরি করে দেওয়া ‘পুজোর আনন্দের’ সংজ্ঞা অতিক্রম করে মানুষের যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শৈল্পিক তার বন্দনায় নিজের প্রিয়জনকে নিয়ে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আরেক রকম আনন্দে মাতুন। এই আশা আমরা করব।