আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

লুইস গ্লিকঃ মিথ ও মানবতার কবি

গৌতম সরকার




পুরান আর কবিতার গাঁটছড়া চিরন্তন। কোনো সময় কবিরা পুরানের কাহিনি সেঁচে পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন তাঁদের কবিতার কুটির, সাজঘর, অট্টালিকা, আবার কখনও কখনও পুরান কাহিনী বংশ পরম্পরায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে মুখে মুখে এবং লেখ্য রূপে চলে আসে কবিতায়, গানে, ছড়ায়। যুগে যুগে কিছু কিছু কবি-সাহিত্যিক থাকেন যাঁরা এই পুরান-কবিতার মেলবন্ধনের বুনোটটি তাঁদের রচনায় সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। আসলে কোনো প্রেক্ষিতকে নিজের লেখায় নিজের করে মিলিয়ে নিতে হলে ভালোমন্দ সব ঘটনার ঘাত ও আঘাতে কবি বা সাহিত্যিককে আগে বিদ্ধ ও ঋদ্ধ হতে হয়। রবার্ট গ্রেভস ১৯৪৮ সালে বলেছেন, ‘‘No poet can hope to understand the nature of poetry unless he has had a vision of the naked king crucified to the lopped oak, and watched the dancers, red-eyed from the acrid smoke of the sacrificial fires, ...with a monotonous chant of ‘kill! kill ! kill !’ and ‘Blood! blood! Blood’!’’

অর্থাৎ, যন্ত্রণার দহন এবং যন্ত্রণাদানকারীদের নারকীয় উৎসব দর্শন, উপভোগ, আঘাত, আভোগ, বিশ্লেষণ, অসহায়তা, অক্ষমতা, আক্রোশ সবকিছু স্বচ্ছ এবং সৎভাবে গ্রহণ করার প্রাথমিক শর্ত পালন করতে পারলেই একটি কবিতাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনের বিচারসভায় প্রেরণ করা সম্ভব হবে। এই কিছু করতে না পারার যন্ত্রনা, অসহায় দাঁড়িয়ে থেকে একটি মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার আঘাত, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু মানুষরূপী জানোয়ারের নারকীয় তাণ্ডব দর্শন একজন কবিকে কাঁদায়, হতাশায় বিদ্ধ করে; সেই কান্না, আক্রোশ আর যন্ত্রনা থেকে জন্ম নেয় কবিতা। অর্থাৎ কাব্যের আরেক শর্ত অনুযায়ী কবিকে নিজেকেও অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ী আমেরিকান কবি লুইস গ্লিক সেই কঠিন কাজটি যোগ্যতার সাথে করতে সমর্থ হয়েছেন, অন্তত নোবেল অ্যাকাডেমির সদস্যদের তাই ধারণা।

নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া প্রসঙ্গে সুইডিশ অ্যাকাডেমির নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স অলসনের বক্তব্য, ‘‘গ্লিকের অসামান্য কাব্যভাষা ও দার্শনিক সৌন্দর্য্যবোধ ব্যক্তিসত্তাকে সার্বজনীন করে তোলে।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘গ্লিকের ভাষ্য মধুর এবং আপসহীন। প্রতিটি কবিতায় নিজের বক্তব্যকে প্রাঞ্জল করার তীব্র ইচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে, আর সেটা তিনি অনায়াসে করেছেন হাস্যরস আর কৌতুকের সংমিশ্রনে।’’

গ্লিকের লেখায় তিনটি ভুবন ধরা পড়ে- এক, পারিবারিক জীবন, দুই, বৌদ্ধিক বিভা আর তিন, সূক্ষ্ম বোধজ্ঞানের বিচ্ছুরণ। তাঁর অনন্য কাব্যকণ্ঠ এবং নিরাভরণ সৌন্দর্য্যবোধ তাঁর একের পর এক কাব্যগ্রন্থগুলিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেখানে তিনি ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-যন্ত্রনা, সাফল্য- ব্যর্থতার কথাগুলো বসার ঘর, শোওয়ার ঘরের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন করতে চেয়েছেন। ৭৭ বছর বয়সী কবি ১২ টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন, লিখেছেন কবিতা বিষয়ক বেশ কিছু প্রবন্ধ। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্লিকের সব সৃষ্টিতেই আছে স্পষ্টবাদীতা। সত্যকে আড়াল করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। নিজের পারিবারিক জীবন এবং পরিবারের মানুষদের সাথে সম্পর্কের রসায়ন ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। পুরাণ আর শাস্ত্রীয় মোটিফ থেকে প্রেরণা নিয়ে সেই সব ব্যক্তিগত উপলব্ধিগুলোকে সার্বজনীন করে তুলেছেন কবি।

লুইস গ্লিকের পূর্বপুরুষরা ছিলেন হাঙ্গেরির অধিবাসী। তিনি ছিলেন ড্যানিয়েল গ্লিক এবং বিয়েত্রেস গ্লিকের জ্যেষ্ঠা কন্যা। লেখাপড়া করেছেন নিউইয়র্কের ব্রংক্সভিলির সারাহ লরেন্স কলেজ এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। শৈশবে অ্যানারেক্সিয়া নার্ভালসা রোগে দীর্ঘদিন ভুগেছিলেন, সাতবছরের বেশি সময় ধরে থেরাপি চালাতে হয়েছিলো। সেইসব অসুস্থ মেদুর দিনগুলির কথাও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। গ্লিক তাঁর রচনায় যন্ত্রণা, আকাঙ্খা আর প্রকৃতিকে নিয়ে নিরন্তর ছেঁড়াকাটা করেছেন। বিশেষতঃ বিষণ্ণতা আর একাকীত্ব বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। পুরাণ, ইতিহাস আর কাব্যের যুগান্তর মেলবন্ধনের সৌকর্ষে তিনি পেরিয়ে গেছেন সমসাময়িক কবি- সাহিত্যিকদের। বিশ্বের তাবড় তাবড় সাহিত্যিকদের সাথে ( যেমন, কানাডিয়ান লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউড এবং জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি) তাঁর নাম ছিল মনোনয়নের দীর্ঘ তালিকায়, কিন্তু অ্যাকাডেমির তরফে তাঁকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মূল কারণ হলো তাঁর ‘কাব্য এককের সাথে বিশ্বজনীনতার গভীর সংযোগ স্থাপন।’

নোবেল অ্যাকাডেমির দাবি অনুযায়ী গ্লিকের রচনার নিরাভরণ সৌন্দর্য্যের সন্ধান পেতে গেলে তাঁর কাব্য সমুদ্রে অবগাহন করতেই হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। যেখানে কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রতিভাত হয়েছে বঞ্চিত প্রেমিক, নিরাশ্রয় বিধবা, পঙ্গু, অস্থির পারিবারিক সম্পর্কগুলো, কী এক অসহায় আক্রোশে তারা নিরন্তর নির্যাতন ভোগ করে চলে। তাঁর প্রথমদিকের লেখাগুলিতে সিলভিয়া প্লাথ এবং রবার্ট লোয়েলের প্রভাব দেখা যায়, যেটি তিনি অনায়াসে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ- দ্য হাউস অন মার্শল্যান্ড। এখানে গ্লিককে অনেকটাই নিজের মত করে পাওয়া যায়, ভাষা হয় অনেক ঋজু, বক্তব্য অনেক স্পষ্ট। জীবনের সন্ধানে অন্ধকার দেখে থমকে গেলে চলবেনা, ভয় পেয়ে প্রত্যাবর্তন কখনোই নয়, বরং অপেক্ষা অনেক বেশি ইতিব্যঞ্জক। এই কাব্যগ্রন্থের ‘মেসেঞ্জার’ কবিতায় তিনি বলছেন,

‘‘You have only to wait,
They will find you.
The geese flying low
Over the marsh
glittering in back water...
They will find you...’’

 
একটা অদ্ভুত অপার্থিব কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ায় কবিতার চরাচর জুড়ে, বহুদূর থেকে প্রতিধ্বনিত হতে থাকা দৈববানী ...যে কণ্ঠস্বরে মানবিক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যে কণ্ঠস্বর অপেক্ষার শেষে জিতে যাওয়ার আশ্বাস বাণী শোনাচ্ছে। কবিতাটি শেষ হচ্ছে এই পরামর্শ দিয়ে...

‘‘You have only to let it happen;
that cry- release, release- like the
moon
wrenched out of earth and rising
full in its circle of arrows
until they come before you
like dead things, saddled with flesh,
and you above them, wounded and dominant.’’

এখানেই গ্লিক অনন্য, স্বতন্ত্র। বিশ্ব যখন আগ্রাসী লোকরঞ্জনবাদের বিষাক্ত থাবা ও বীভৎস চিৎকারের মধ্যে খাবি খাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আমাদের যুদ্ধ পরিহারের কথা বলছে, আর আন্তরিক কণ্ঠস্বর মানুষের অন্তরের বাণী শোনার আর্জি জানাচ্ছে। কবিতায় বিশ্বজনীন চেতনার প্রতিফলন ঘটানো একজন কবির স্বপ্ন। আর সেই আকুতি যদি অন্ততঃ একটি মানুষেরও মানবিক জাগরণ ঘটাতে পারে, সেটাই একজন কবির আরাধনা। পারিবারিক জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো কী ভীষণ জীবন্ত হয়ে বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে, পড়তে পড়তে মনে হয় আমার বা পাশের বাড়ির ঘটনা। এরকমই একটা কবিতা - দ্য ফ্যান্টাসি

শোনো,আমি তোমাকে বলছিঃ প্রতিদিন মানুষ মরছে। আর এটা মাত্র শুরু।
প্রতিদিন জানাজায় নতুন বিধবা জন্ম নিচ্ছে, নতুন এতিম,
তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে,
এ নতুন জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে,
তারপর ওরা যায় কবরস্থানে, ওদের কেউ কেউ প্রথমবার...

তারপর সবাই বাড়ি ফিরে যায়, যা হঠাৎ দর্শনার্থীতে পরিপূর্ণ।

******

মনে মনে সে চায় তারা সবাই চলে যাক
সে কবরস্থানে ফিরে আসতে চায়
ফিরে আসতে চায় সেই রোগীর ঘরে, হাসপাতালে,
সে জানে এটা সম্ভব নয়।
কিন্তু তার একমাত্র আশা -
পেছনে ফিরে যাবার ইচ্ছা, অল্প পেছনে -
অতদূর না যে বিয়ে পর্যন্ত বা প্রথম চুম্বন।

(অনুবাদঃ এম সানাউল হক নিলয়)
 
গ্লিকের রচনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে যন্ত্রনা, আকাঙ্খা আর প্রকৃতি। তবে হতাশের দলে কখনও নাম লেখাননি। নাইন- ইলেভেনের মর্মান্তিক ঘটনা তাঁকে জীবনে গুটিয়ে ফেলার পরিবর্তে যাপন করতে উৎসাহিত করেছে। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্য কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’-এর বিখ্যাত কবিতা ‘স্নোড্রপস’-এ তিনি শীতের পরে জীবনের অলৌকক প্রত্যাবর্তনের বর্ণনা দিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা ‘The Untrustworthy Speaker’-এ একটি ফুলকে বলছেন,
‘‘Don’t listen to me; my heart’s been broken...
Whatever/returns from oblivion returns/to find a voice.’’

পাঠককে টেনে ধরে রাখে, মাকড়সার জাল বিছানো থাকে ছত্রে ছত্রে। গ্লিক নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি কবিতায় খুঁজে ফেরেন - ‘‘the sound of an authentic being’’, এবং একধরনের ‘‘immediacy, volatility that give poems that achieve it paradoxical durability.’’ তাই যুদ্ধ, ধ্বংস, সন্ত্রাস সবকিছুর মধ্যেও তাঁর কাব্যে প্রেম শাশ্বত। সেই বিশ্বাসের অনুরণন ঘটে ‘সুখ’ কবিতায়।

সুখ

দুজনে শুয়ে আছে রাত্রির কোলে
সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে আছে দুজন মানুষ।
ভোর খুব কাছে,
এইবার ওদের ঘুম ভাঙবে
মাথার কাছে লিলি জাগছে ফুলদানিতে
সূর্যের আলো ওদের পানপাত্রে তৈরি -
এখনই চুমুক দেবে।
পুরুষটি পাশ ফিরল, কোমল স্বরে ডাকল সঙ্গীকে
পর্দাটা দুলে উঠল, গেয়ে উঠল পাখিদল
নারীটি এবার পাশ ফিরল, আর তার সর্বাঙ্গ
তপ্ত হলো সঙ্গীর নিঃশ্বাসে।
চোখ খুললাম আমি...
সূর্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়
আমি তোমার মুখের দিকে তাকালাম,
আয়নায় দেখতে পেলাম আমাকেই,
আমরা স্থির; শুধু সূর্যটা আমাদের
যেতে থাকল পেরিয়ে,আলো ছড়াতে ছড়াতে।

(অনুবাদঃ ফারহানা আনন্দময়ী)

ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা লুইস গ্লিক ব্যক্তিগত জীবনে দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে টেঁকেনি, একবছরের মাথায় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সম্পর্ক ভাঙার সেই দাহ ফুটে উঠেছে ‘মেডোল্যান্ডস’ গ্রন্থের কবিতার ছত্রে ছত্রে। আবার বাবার মৃত্যুর কথা লেখা আছে ‘আরারাত’ কাব্যগ্রন্থে। এরপর তিনি সাহিত্যিক জন ড্রানকে বিয়ে করেন, তাঁদের একটি পুত্রসন্তান আছে। প্রথম দুই কাব্যগ্রন্থের পর গ্লিক বেছে নিলেন পুরাণ এবং ইতিহাস। কবিতায় উঠে এসেছে গ্রেটেল এবং জোয়ান অব আর্কের কথা। গ্রেটেল পৌরাণিক কাহিনির অধিকার সচেতন নারীবাদী এক চরিত্র। আর জোয়ান অব আর্ক হলেন ফ্রান্সের রক্ষাকর্ত্রী, যিনি অসম এক যুদ্ধে ফরাসিদের অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিলেন। ব্রিটানিয়া ডটকমে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সম্পাদক লী বলেছেন - পরের বইগুলোতে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের যে অভিযোজনা গ্লিক ঘটিয়েছেন তা ক্রমেই কল্পনাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবের ‘ডিসেন্ডিং ফিগার’ কাব্যগ্রন্থের ‘দ্য ড্রাউনড চিলড্রেন’ কবিতাটির উল্লেখ করা যেতে পারেঃ

You see, they have no judgement
So it is natural that they should drown,
first the ice taking them in
And then, all winter, their wool scarves floating behind them
as they sink
until at last they are quiet
And the pond lifts them in its
manifold dark arms.

পাঠক স্তব্ধ হয়ে যায়। কবিতায় ভাষা সারা শরীরে কাঁপুনি ধরায়। কোন পরিপ্রেক্ষিতে কবি বলে ওঠেন ‘it is natural that they should drown’! নাকি শিশুগুলিকে যখন নারকীয় পুকুর তার নোংরা হাত দিয়ে অতল অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর কলম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে কালো থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছে ! কবিতায় বারবার প্রেমজ কিংবা পারিবারিক সম্পর্কগুলো যখন উঠে এসেছে সেখানেও দেখতে পাওয়া যায় একজন ‘ডমিন্যান্ট’, অন্যজন ‘রিসেসিভ’। বোনেদের মধ্যেকার সম্পর্ক বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘one is always watcher/one is dancer’, যৌনতার সম্পর্কে ‘ A woman exposed as rock/has this advantage/she controls the harbor’, আবার বন্ধুত্বের বেলায়, ‘Always in these friendships/one serves the other, one is less than the other’s’.

প্রফেসর গ্লিকের সাম্প্রতিক কালের লেখাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘A Village Life’, যেখানে তিনি একটি কাল্পনিক গ্রামের স্বপ্ন এঁকেছেন। কবিতাগুলো উঠে এসেছে সেই গ্রামে বসবাসকারী পশু,পাখি,মানুষ এমনকি কীটপতঙ্গের মুখ থেকে। অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা গ্লিকের কাব্যের অন্যতম দুই মাধ্যম। এই কাব্যগ্রন্থেও আছে অন্ধকার মৃত্যু, তারপর জন্ম, আবার মৃত্যু আবার জন্ম .....কিন্তু সবই বড় শীতল, হতাশায় ঘেরা, জয়ের আনন্দ কোথায়! মানুষ এখানে কল্পনায় বাঁচে, সেই ফানুস যখন তখন চুপসে যায়, তারপর পড়ে থাকে চাপ চাপ অন্ধকার, কালো কালো রক্ত, আর কিছু স্তব্ধ চোখমুখ। কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকের কবিতায় এক কৃষকের উপলব্ধিঃ
In the window, the moon is hanging over the earth,
meaningless but full of messages.
It’s dead, it’s always been dead,
but it pretends to be something else, burning like a star, and convincingly so that you feel
sometimes
It could actually make something grow on earth.
If there’s an image of the soul, I think
that’s what it is.
I move through the dark as though it were natural to me,
as though I were already a factor in it
Tranquil and still, the day dawns
On market day, I go to the market with my lettuces.

নোবেল পুরস্কার জুরিগণ তাঁর কাব্যগ্রন্থ - ‘দ্য ট্রায়াম্ফ অফ অ্যাকিলেস’ এবং ‘আরারাত’ উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘‘She addresses almost brutally straightforward images of painful family relations; and her deceptively natural tone is striking with no trace of poetic ornament.’’ ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া প্রথম গ্রন্থটিতে বিশুদ্ধ পুরাণ, রূপকথা এবং বাইবেলের মতো অনিবর্চনীয় বিষয়গুলি উঠে এসেছে। এই মাধ্যমগুলো জায়গা করে নিয়েছে পরের কাব্যগ্রন্থ ‘আরারাত’-এও। এই কাব্যে পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে তাঁর যে অনুসন্ধিৎসু নিরীক্ষা, এবং সৎ এবং নির্ভীক স্বীকারোক্তি অনেক সমালোচকেরও প্রশংসা অর্জন করেছে। বলা হয়েছে, আত্মানুসন্ধানে তিনি যে সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তাঁর জন্য কোনোও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আলোচকরা তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছেন আত্মজৈবনিকতার সঙ্গে ধ্রুপদী মিথের গূঢ় আন্তঃসম্পর্ক। অনেকেই তাঁর লেখায় রাইনের মারিয়া রিলকে এবং এমিলি ডিকিনসনের উত্তরাধিকারকে খুঁজে পান। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, গ্লিক পশ্চিমি বিশ্বের মূলধারার কবিতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি।

এককথায় লুইস গ্লিক একজন দৃঢ়চেতা সাহিত্যিক, যিনি সবসময় নিজের সৃষ্টির কাছে সৎ এবং সাত্ত্বিক থাকার চেষ্টা করেছেন। তাই একজন শল্য চিকিৎসকের দক্ষতায় অনায়াসে ফালা ফালা করতে পেরেছেন সম্পর্কের আলো-অন্ধকার দিকগুলো। এরকম একটি কবিতা ঘুমপাড়ানি গান। অসাধারণ অনুবাদ করেছেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক প্রফেসর অনুরাগ দাস। এখানে কবি কাটাছেঁড়া করেছেন আমাদের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ মা-কে; কবিতাটা এইরকমঃ

ঘুমপাড়ানি গান

আমার মা একটা কাজে খুব দড়ঃ তার
ভালোবাসার মানুষদের পাঠিয়ে দিতে
অন্য লোকে।
কচিকাঁচাদের, শিশুদের- যাদের সে
দোল খাওয়াত, ফিসফিসিয়ে বা মৃদু
গলায় গেয়ে। আমি সঠিক জানি না
আমার বাবার সঙ্গে সে কী করেছিল;
যাই করে থাকুক, আমি নিশ্চিত সে
ঠিক কাজই করেছিল।
এটা, সত্যিই, একই কথা,
একজন মানুষকে ঘুমের জন্যে প্রস্তুত
করা, বা মৃত্যুর জন্যে। ঘুমপাড়ানি গান -
গানগুলো বলে
ভয় পেয়ো না মোটে, এ বলেই সেগুলো
মায়েদের হৃদস্পন্দনকে
শব্দান্তরিত করে।
একথায় জীবিতরা ধীরে জুড়িয়ে আসে,
শুধু মুমূর্ষুরা পারে না, তারা
নাকচ করে।
মুমূর্ষুরা লাট্টুর মতো, বা যেন তারা
জাইরোস্কোপ -
এত জোরে তারা পাক খায় মনে হয়
স্থানু।
তারপর তারা চূর্ণ হয়ঃ আমার মায়ের
হাতদোলায়,
আমার বোন তো ছিল পরমাণুর মেঘ,
কণার...এই যা আলাদা।
একটা শিশু যতক্ষণ ঘুমন্ত, ততক্ষণই
পূর্ণ।
আমার মা মৃত্যু দেখেছিল; সে আত্মার
অবিভাজ্যতা নিয়ে কিচ্ছুটি
বলেনি।
সে ধারণ করে ছিল একটি শিশুকে
একটি বৃদ্ধকে, যেভাবে অন্ধকার ক্রমে
তাদেরকে ঘিরে শক্ত হয়ে ওঠে, শেষে
পরিণত হল মাটিতে।
আত্মাও তো অন্য বস্তুদেরই মতোঃ
কেন সে অপরিবর্তনীয় থাকবে,
একটাই আদলে পড়ে থাকবে আটকা,
যখন চাইলেই মুক্ত হতে পারে?

(অনুবাদঃ অনুরাগ দাস)

কবিতাটির মধ্যে যে জীবন দর্শনের কথা বলা হয়েছে, প্রতিটি ছত্রে ছত্রে দার্শনিক দাঢ্যের পরিমিতি ছড়ানো; ভাবনার অভিনবত্ব এবং শানিত দর্শন দেখে পাঠকেরা আশ্বস্ত হন, নোবেল পুরস্কারটি ঠিক জায়গাতেই গেছে। তাঁর কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের আরেক অধ্যাপিকা ডঃ শম্পা মিত্র বলেছেন, ‘গ্লিকের অনুভূতির জগৎটা একদম অন্যরকম। খুব চেনা আবার খুব অচেনা। মননপ্রধান হলেও হ্রদয় না দিয়ে উপলব্ধি করা যাবে না বলে মনে হয়েছে। প্রকৃতি একেবারে অদ্ভুত। স্বভাবিকতাবাদ নয়, অভিব্যক্তিবাদও নয়। স্বতন্ত্র সত্ত্বাও নয়। আমাকে নিয়ে যায় বিষণ্ণ, মেদুর, কারুণ্যহীন অথচ অপ্রতারক এক প্রকোষ্ঠে।’

‘‘Gluck is a master not of scenes but of scene setting.’’

তিনি আকাশের ক্যানভাসে ছবি আঁকেননি, আকাশটাই এঁকেছেন ; বাস্তবের পাথুরে জমিতে ফসল ফলিয়েছেন। আলোর ছবির সাথে তো সবাই কমবেশি পরিচিত, তিনি অন্ধকারকে চিনিয়েছেন। মানুষের মধ্যেকার লাভ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য পেরিয়েও যে একাকিত্বের জগৎটা থাকে, সেই শীতল গ্রাসে সংজ্ঞা হারিয়ে না ফেলে সেটাকে তিনি উদ্‌যাপন করতে শিখিয়েছেন। মুখোসের আড়াল থেকে জীবনকে দেখলে জীবনও তোমার কাছে সার্কাসের রঙচঙে পোশাক পরে গায়ের ফাটা চামড়া, ক্ষুধার্ত পেট, রোগে ভোগা শীর্ণ চেহারা ঢেকে হাজির হবে। সত্যিকে মেনে নিয়ে মানবিক ধর্ম পালন জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, পশুপাখি, কীট পতঙ্গ, মানুষ সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখায়, আর প্রতিবাদ করতে শেখায় অশুভ শক্তি এবং অচলায়তনের বিরুদ্ধে। তাঁকে আরও বুঝতে গেলে তাঁকে আরও বেশি জানতে হবে, তাঁর সৃষ্টি আরও বেশি পড়তে হবে, তাহলেই বোঝা যাবে সাহিত্যের বিশ্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি সেরা সাহিত্যিকের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে।


তথ্যঋণঃ ইন্টারনেট