আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

জন লে কারের রাজনৈতিক চেতনাঃ এক রহস্যানুসন্ধান

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়




“It seems to me that he’s more some kind of international gangster with a license to kill. He is neither a spy, nor a mystique... a man entirely out of the political context’’

১৯৬৬, প্রায় তেরো বছর ব্যাপী দক্ষিণপন্থী টোরি দলের শাসন শেষ হয়ে তুলনামূলক ভাবে বামপন্থী লেবার পার্টি সদ্য ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ব্রিটেন ধীরে ধীরে মজে উঠছে এক ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায়। এই লেবার পার্টির আমলেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির আদলে তৈরি হয়েছিল ‘National health service’, সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিক পেয়েছিলেন আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি। অথচ বছর পনেরো পর দেখা যাচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যর পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কনজিউমার গুডস; ভালো বাড়ি, ভালো গাড়ি, অফুরন্ত ভোগ্যপণ্যর প্রতি মোহ গাঢ় হচ্ছে আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পারেও। উত্তাল ষাটের দশকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত উচ্চাশা ক্রমেই সমার্থক শব্দ হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর এহেন প্রেক্ষিতে জেমস বন্ডের থেকে বড় ব্রিটিশ ব্র্যান্ড আর কেই বা হতে পারে? অফুরন্ত পৌরুষ, অবাধ যৌনতা, অবিরাম দুনিয়াদারির আরেক নাম জেমস বন্ড। হলিউড সেই ব্র্যান্ডকে নিয়েই বাষট্টি থেকে পয়ষট্টি, এই শেষ চার বছরে প্রায় চারশ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে।

সেই বন্ডকেই বিবিসির ইন্টারভিউ-এ নস্যাৎ করে দিলেন ডেভিড কর্নওয়েল। বিবিসির- ম্যালকম মাগারিজের প্রশ্নের উত্তরে জানাচ্ছেন জেমস বন্ডের উপন্যাসের কাঠামোয় আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নামটুকুও জানার দরকার পড়ে না। রাজনৈতিক সচেতনতা কেন, রাজনৈতিক বোধের ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না ইয়ান ফ্লেমিং-এর লেখায়। আর সে বোধ নেই বলেই কর্নওয়েল বন্ডকে ‘স্পাই’ তকমাটুকুও দিতে রাজি নন। কী অপরিসীম ঔদ্ধত্য! নাকি অটুট আত্মবিশ্বাস?

কে এই ডেভিড কর্নওয়েল? চুয়ান্ন বছর পরেও কেন বিবিসি ফের ঘটা করে পুনঃসম্প্রচার করছে সেই সাক্ষাৎকার? শুধু স্কোরকার্ড দিয়ে ডেভিড কর্নওয়েলের মাহাত্ম্য বোঝা সম্ভব নয় কিন্তু পাঠকদের জানিয়ে রাখি গত ষাট বছর ধরে ডেভিডের বই-ও বিক্রি হয়েছে ছ কোটির বেশি। ঘটনাচক্রে তিনিও ব্রিটিশ, এবং স্পাই থ্রিলার নামক সাহিত্যধারাটির পথিকৃৎ বিশেষ। যদিও লোকে তাঁকে চেনে তাঁর ছদ্মনামে। ডেভিড কর্নওয়েল ওরফে জন লে কারে। উননব্বই বছর বয়সে তাঁর কলম অবশেষে থামল গত ১২ই ডিসেম্বর।

জন লে কারে এক অবিস্মরণীয় নাম, এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না জন প্রায় একার হাতে স্পাই থ্রিলারকে মণ্ডসাহিত্য থেকে রসসাহিত্যে উন্নীত করেছেন। এবং রাজনীতি তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের পটভূমিকায় একের পর এক উপন্যাস লিখে জন তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন। যত দিন গেছে সেই সব উপন্যাস লাভ করেছে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’ বা ‘টিংকার, টেলর, সোলজার, স্পাই’ এর মতন অবিস্মরণীয় সব সাহিত্যনির্মাণ ঘটেছে জনের কলমে। কিন্তু ওই আমেরিকা বনাম রাশিয়া, বার্লিন বনাম বন্, কেজিবি বনাম এম-আই ফাইভ এহেন অতিসরলীকৃত রাজনীতির বীক্ষণে লে কারে কে ফেলাটা নেহাতই মূর্খামি হয়ে দাঁড়াবে। তাঁর দুনিয়া সাদা-কালো নয়। তাঁর দুনিয়ায় ভালো-খারাপ নিয়ে মাথা ঘামানোটা অধিকাংশ সময়েই বাতুলতা। তাঁর দুনিয়ায় ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের অধিকর্তা নির্দ্বিধায় বলেন - ‘‘You can’t be less ruthless than the opposition simply because your government’s policy is benevolent, can you now?’’ ইতিহাস-সচেতন পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে তথাকথিত মঙ্গলকামী ব্রিটিশ রাষ্ট্রশক্তি কীভাবে গোয়েন্দাদপ্তরকে কাজে লাগিয়ে ৫৭ সালে অন্যায় ভাবে মিশরে যুদ্ধ বাধিয়েছিল শুধুমাত্র সুয়েজ খালের দখলদারি বজায় রাখতে।

ডেভিড বরাবরই রাজনীতির মনোযোগী ছাত্র। নিজে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে কাজ করার দৌলতে আরোই ভালো বুঝেছিলেন যে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’-এ আদর্শ কম, লিপ্সা বেশি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক হয়েও তাই সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাস রাখে, আবার ব্রিটেন বা আমেরিকা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেও এক প্রবল পুঁজিবাদী নির্যাতনে শ্বাস রোধ করে তোলে উন্নয়নশীল দেশগুলির। ‘দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার’ উপন্যাসে তাই সত্যিকারের খলনায়ক যদি কিছু থাকে সে হল পুঁজিবাদ। বইয়ের রসদ খুঁজতে আফ্রিকায় গেছিলেন ডেভিড, নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন এডস নামক মহামারির মধ্যেও পশ্চিমী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি অফুরন্ত মুনাফা লুট করে চলেছে। বাতিল হয়ে যাওয়া ওষুধ তারা বিক্রি করছে চড়া দামে, ভোক্তাদের ন্যূনতম তথ্য সরবরাহ করছে না, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের সহযোগিতায় বাজারে রাখছে শুধুই ব্র্যান্ডেড ওষুধ। আর এই সমস্ত অনৈতিক এবং বেআইনি কাজ চলছে পশ্চিমী সরকারগুলোর পরোক্ষ মদতেই। আর এই সমস্ত ধামাচাপা পড়ে যাওয়া খবরই রসদ জুগিয়েছিল তাঁর উপন্যাসের। ‘দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার’ লেখা হয়েছিল ২০০১ সালে, আর ওই বছরেই তাঁর আরেক উপন্যাস ‘দ্য টেলর অফ পানামা’-র পেপারব্যাক এডিশনের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে ডেভিড তীব্র সমালোচনা করেছিলেন জর্জ বুশ সরকারের। জানিয়েছিলেন স্রেফ নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ কায়েম করার জন্য আমেরিকা কিয়োটো প্রোটোকল নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না, বিশ্ব জোড়া উষ্ণায়ণ রোখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই সে দেশের। ‘পরিবেশ রাজনীতি’ নিয়ে সার্বজনীন চর্চা শুরু হওয়ার বহু আগেই ডেভিড জানিয়েছিলেন একবিংশ শতকের কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব গড়ে উঠবে এই বিশ্বায়িত উষ্ণায়ণকে কেন্দ্র করেই।

‘কবিরে পাবে না তাহার চরিতে’ আপ্তবাক্যটি ডেভিডের জন্য যথাযথ। নিজের একাধিক উপন্যাসে পুঁজিবাদ ও কর্পোরেট অর্থলিপ্সাকে প্রবল আক্রমণ করলেও ডেভিড নিজে কিন্তু যথেষ্ট বিলাসবহুল জীবন নির্বাহ করেছেন। এবং সেই টাকা যুগিয়েছে বিশ্বের তাবড় কর্পোরেট হাউসগুলি। হ্যাম্পস্টেডের বিলাসবহুল বাড়িতে স্কচ খেতে খেতে বা লন্ডনের রাস্তায় মার্সিডিজ গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি অনুজপ্রতিম প্রিয়পাত্রদের বলে গেছেন প্রচুর অর্থোপার্জন জীবনের একটা অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের প্যাঁচপয়জার যেরকম চলতে থাকে সেরকমটা কী ডেভিডের ব্যক্তিগত রাজনীতির ক্ষেত্রেও সত্যি তাহলে? এই আপাতবৈপরীত্য কিন্তু আমাদের অধিকাংশের জীবনে এক অন্যতম স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। ডেভিডের উপন্যাস থেকে মনোযোগী পাঠকরা যদি কিছু জীবনশিক্ষা নিয়ে থাকেন তাহলে এ কথায় তাঁরা অবাক হবেন না। তিনি উদারপন্থী, তিনি বিশ্বাস রাখেন ব্যক্তিগত অধিকার ও বাজারনির্ধারিত শ্রমের মূল্যে। ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’ এর অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে প্রথমে বিস্মিত করেছিল কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি বুঝেছেন স্পাই থ্রিলার সাহিত্যধারাটিতে তাঁর লেখার চাহিদা আকাশস্পর্শী, মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক গুনে নিতে ডেভিড আদৌ ইতস্তত করেন নি। পুঁজিবাদের প্রবল সমালোচক হয়েও বাজার অর্থনীতিতে ডেভিডের দৃঢ় আস্থা তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ পাঠককে মনঃক্ষুণ্ণ করে তুলতে পারে কিন্তু আসল সমস্যা সেখানে নয়। ডেভিডের রাজনীতি কাটাছেঁড়া করতে বসলে আমার কাছে যে প্রশ্নটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে – উদারপন্থী ডেভিড আসলে ঠিক কতটা উদার?

আগেই বলেছি ডেভিড কর্নওয়েল ওরফে জন লে কারে স্পাই থ্রিলারের শ্রেণি উত্তরণ প্রায় একার হাতে ঘটিয়ে ছিলেন। কিন্তু এক হিসাবে রাজনৈতিক থ্রিলারের পথিকৃৎ লে কারে নন। তাঁরও আগে সে কাজ বেশ সাফল্যের সঙ্গে করেছিলেন আরেক ব্রিটিশ লেখক গ্রাহাম গ্রীন। কিন্তু গ্রীনের লেখালেখি শুধু থ্রিলার জঁর ঘিরেই আবর্তিত হয়নি, আর তাই বৃহত্তর পাঠক সমাজ তাঁকে শুধু রোমাঞ্চসাহিত্যের সঙ্গে মেলাতে চায় না। ডেভিড নিজেও গ্রাহাম গ্রীনের গুণমুগ্ধ ছিলেন, এবং গ্রীনের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে বহু আলাপ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। পরবর্তী কালে তাঁদের মধ্যে এই সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কটি নষ্ট হয়ে যায় এক বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) রাশিয়ান গুপ্তচরকে ঘিরে, যিনি আদতে ব্রিটিশ। অধিকাংশ পাঠকই হয়ত আন্দাজ করতে পারছেন গুপ্তচরটি আসলে কে। হ্যাঁ, কিম ফিলবির কথাই বলছি। ১৯৬৩ সালে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত কিম ফিলবি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের একাধিক উচ্চ পদে কাজ করে এসেছেন, এবং প্রায় তিন দশক ধরে সমানে গোপন তথ্য যুগিয়ে চলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে। ডেভিডের কাছে কিম ফিলবি এক চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতক যিনি লোভের বশবর্তী হয়ে নিজের জন্মভূমির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন। তাঁর চিন্তাধারা নিয়ে ডেভিড কোনো রাখঢাক করেন নি, এবং তাঁর সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘টিংকার, টেলর, সোলজার, স্পাই’-এর অ্যান্টাগোনিস্ট অর্থাৎ খলনায়কের চরিত্রচিত্রায়ণ-ও করেছিলেন ফিলবির আদলে। গ্রাহাম গ্রীন কিন্তু ফিলবিকে দেখেছিলেন এক সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। গ্রীনের লেখালেখি এবং ফিলবির সঙ্গে তাঁর যে পত্রবিনিময় ঘটেছিল তা থেকে দেখতে পাই গ্রীন ফিলবিকে প্রায় এক শিল্পী হিসাবে দেখেছিলেন। গুপ্তচরবিদ্যা যদি শিল্পকলা হয় তাহলে মানতেই হবে সে শিল্পে কিম ফিলবি অত্যুচ্চ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। গ্রীনের কাছে তাই তথাকথিত বিশ্বাসঘাতকতা এক অবশ্যম্ভাবী ফল যা দেশকালনির্বিশেষে ঘটবেই। অতএব, গ্রীন ফিলবিকে দোষী সাব্যস্তই করেন না। বিশ্বাসঘাতক তকমাটি তাঁর কাছে গণ্ডগোলে, এক সাদা-কালো এবং দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীর মূঢ় বিশ্বাস মাত্র। অথচ এই কথাগুলি অনায়াসে বলে উঠতে পারত ডেভিডের উপন্যাসের কোনো চরিত্র। ‘টিংকার, টেলর, সোলজার, স্পাই’ উপন্যাসেই দেখি ডেভিড লিখে ফেলেছেন ‘‘There was nothing dishonourable in not being blown about by every little modern wind’’। সেই নিরিখে বলশেভিক আন্দোলনের সাফল্যকে এক দুর্দম ঝড়ই বলা যায় যা বহু ব্রিটিশ এবং আমেরিকানকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল। কিম ফিলবিকে নিয়ে ডেভিডের বক্তব্যকে গ্রাহাম গ্রীন ‘ছেলেমানুষি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর ডেভিড এই ২০১০ সালেও জানিয়েছিলেন ফিলবির রক্তমাখা হাত তিনি ভুলেও করমর্দনের জন্য তুলে নিতে পারতেন না।

ডেভিডের রাজনীতি কী তাহলে মোটের ওপর নরমপন্থী? উদারপন্থী রাজনীতিকে নিজের মতন করে সংযমশীল বানাতে গিয়ে নিজের রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের আরেকটু গভীরে যেতে হবে, জানতে হবে কীভাবে ডেভিডের শ্রেণিচেতনা তাঁর রাজনীতিকে গড়ে তুলেছে। ডেভিড তাঁর দীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে দেখে এসেছেন ব্রিটিশ সমাজে শ্রেণির ভূমিকা। শত্রুর সঙ্গে লড়তে লড়তেও দুই ব্রিটিশ সৈন্য পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘কোন স্কুল? কোন কলেজ?’’ । হ্যারো না ইটন, অক্সফোর্ড না কেমব্রিজ, নতুন টাকা না বনেদী টাকা এহেন কৌতূহল এবং চর্চা সেই মধ্যযুগ থেকে ব্রিটেনে চলে আসছে। দিন কে দিন সে চর্চা পৌঁছেছে এক অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। এবং শুধু চর্চাই তো নয়, উচ্চশ্রেণির ছাপ থাকলে অনায়াসে পৌঁছনো গেছে ক্ষমতার পিরামিডের সর্বোচ্চতলায়। ইটন এবং হ্যারো, এই দুই পাবলিক স্কুল থেকে আজ অবধি সাতাশ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেরিয়েছেন। এহেন শ্রেণিবৈষম্যকে ডেভিড চিরজীবন ঘৃণা করে এসেছেন। শুরুর দিকে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন উচ্চবংশীয় ব্রিটিশদের শুধুই মুখেন মারিতং জগৎ, আবার প্রায় শেষবেলায় এসে জানিয়েছেন এই শ্রেণিবিভাজনের জন্যই ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। জেমস বন্ডের মতন উচ্চশ্রেণির প্রতিভূ তাই স্বাভাবিক ভাবেই ডেভিডের দু চোখের বিষ। আরেক বিখ্যাত পাবলিক স্কুল ওয়েস্টমিনস্টার এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত কিম ফিলবি-ও সেই একই কারণে ডেভিডের কাছে বিষবৃক্ষের ফল বিশেষ। ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল বা শেফিল্ডের খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্য থেকে কিম ফিলবি উঠে এলে সম্ভবত ডেভিড এতটা বিরূপ হতেন না, হয়ত গ্রাহাম গ্রীনের মতন তিনিও গুপ্তচরবৃত্তিকে দেখতেন জাতীয়তাবাদ রক্ষার থেকেও বড় কোনো সাধনার অপরিহার্য উপাচার হিসাবে।

জর্জ স্মাইলি, ডেভিডের সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচটি উপন্যাসে স্মাইলি প্রধান চরিত্র এবং চারটি উপন্যাসে সহযোগী চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে স্মাইলিও গড়ে উঠেছিল ডেভিড কর্নওয়েলের ব্যক্তিগত শ্রেণিচেতনা থেকেই, যেখানে বংশগত কৌলীন্য নয়, ব্যক্তিগত প্রতিভাই শেষ কথা। তুলনামূলকভাবে মেদবহুল, টাক পড়ে যাওয়া, মধ্যবয়স্ক স্মাইলি শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পুরোপুরি ভাবেই অ্যান্টি-বন্ড। চরিত্রগতভাবেও যে খুব দাপুটে তা নন। মন্ত্রী এবং সচিবদের থেকে কম কথা শুনতে হয় না তাঁকে। কিন্তু দিনের শেষে নিজের কাজটা ঠিক করে ফেলেন। আর সেই কাজ শেষ করতে তাঁর সবথেকে বড় সহায় অভিজ্ঞতা এবং বাস্তববুদ্ধি। স্মাইলির মগজ শার্লক হোমসের মতন চলে না, আবার লন্ডনের অফিস ছেড়ে দুনিয়াদারি করতেও বিশেষ ডাক পড়ে না তাঁর। কিন্তু একবিংশ শতকে জর্জ স্মাইলির জনপ্রিয়তা জেমস বন্ডের থেকে ইতরবিশেষই কম। নামজাদা কাগজের সমালোচকই হন বা সাধারণ পাঠক, সবার কাছেই জর্জ স্মাইলি হয়ে উঠেছে এক অতি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র। সেই স্মাইলি যিনি পড়াশোনাও করে এসেছেন নাম না জানা পাবলিক স্কুল বা অক্সফোর্ডের অখ্যাত কলেজ থেকে। না আছে বংশকৌলীন্য, না আছে কেতাবী শিক্ষার চটক, অথচ সেই সব কারণেই স্মাইলির ‘ব্র্যান্ড রেপুটেশন’ ঈর্ষণীয়।

২০১০ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীলরা লিবারল ডেমোক্র্যাটদের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করার পর পরেই ডেভিড তাঁর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘The Etonians have taken back the shop with the help of some B-list inexperienced liberals who will evaporate in their own hot air before long, leaving the shop to a ragbag of ivy league Tories, born again PR men, sexists, anti-Europeans, nostalgists and eco-ostriches’’ । ব্রেক্সিটের তখনো ছ’বছর বাকি, লিবারল ডেমোক্র্যাটদের পতনের ন বছর, অথচ কী অসীম দূরদর্শিতা! জন লে কারে তো লিখছেন না, যেন এক গোপন গভীর মুহূর্তে কলম চালাচ্ছেন জর্জ স্মাইলি নিজেই, সমস্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতা জড়ো করে, গোয়েন্দাসুলভ প্রজ্ঞায় জানিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ জীবনের ওঠাপড়া ঠিক কীভাবে ব্রিটেনের মানুষের গায়ে লাগবে। অশীতিপর ডেভিড তাঁর হ্যাম্পস্টেডের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেন নি বটে কিন্তু স্মাইলি ইংল্যান্ড ছেড়েছেন। ২০১৭-র উপন্যাস ‘আ লেগ্যাসি অফ স্পাইজ’-এ স্মাইলি অবসর নিয়ে নিয়েছেন, সময় কাটাচ্ছেন জার্মানিতে এবং বন্ধুকে জানাচ্ছেন ইওরোপের জন্য তাঁর কাজ জারি থাকবে।

ব্রিটেন নয়, ইওরোপ। ইংল্যান্ড নয়, জার্মানি। আইভি লীগের ডিগ্রীধারী বিশ্বাসঘাতক নয়, চাই শ্রেণিবিহীন মুক্তচিন্তক। ডেভিড কর্নওয়েলের রাজনীতি এখন অতটাও রহস্যগভীর ঠেকছে না, তাই না?