আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

মেয়েজীবনের নিবিড় পাঠঃ ভাবনায় আশাপূর্ণা দেবী

রুনা চট্টোপাধ্যায়


গোষ্ঠীজীবন থেকে তৈরি হল সমাজ। সমাজজীবনের সূচনা থেকেই প্রায় মেয়েদের জন্য অন্দরমহলের অন্ধকারই বরাদ্দ হল। ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মাতৃতন্ত্রের প্রভাব বৈদিক ও পরবৈদিক যুগে এক আধটা দেখা যায় বটে। মহাভারতে মাহীষ্মতী নগরের কথা আছে যেখানে প্রশাসকের ভূমিকায় মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। সে তো বিচ্ছিন্ন দু’একটা ঘটনামাত্র। আসলে মেয়েদের মেধা ও মনন গুরুত্ব পায়নি কোনোদিনই। সমাজনির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে পা রাখতে চাইলে সমালোচিত হয়েছে। সে সমালোচনা যে সবসময় পুরুষদের কাছ থেকে এসেছে এমনটা নয়, অন্তরমহলে ঝড় কম ওঠেনি। আসলে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম নিষেধকেই পরম বলে ভাবতো পৃথিবীর দ্বিতীয় লিঙ্গরাও। আশাপূর্ণার লেখায় সেইসব মেয়েদের কথাই বেশি।

‘বালির নীচে ঢেউ’ উপন্যাসের খুব ক্ষুদ্র অংশে যার উপস্থিতি সেই তরুলতা নামের নিতান্ত সাধারণ মেয়েটি তার স্বামী সম্পর্কে বলতে গিয়ে উচ্চারণ করেছিলো, ‘ওকে আমি ঘৃণা নয়? ঘেন্না করি, বুঝলি! হ্যাঁ, ঘেন্না’। গল্পের আর এক চরিত্র প্রভুচরণ মনে করিয়ে দেন, ‘তবু - তবু উনি তো আপনার স্বা-স্বামী’। বলে দেওয়া প্রয়োজন, স্বামীর প্রতি এত ঘেন্নার কারণ তরুলতার স্বামী পুলিশ অফিসার। দেশের জন্য কাজ করে যারা, তাদের শাস্তি দেয়। প্রভুচরণ মনে করিয়ে দেয়, ‘‘পুলিশ সাহেব খুন হয়ে গেলে আপনি যে বিধবা হয়ে যাবেন সে খেয়াল আছে?’’ তরুলতা উত্তর দেয় ‘‘তুচ্ছ একটা মেয়েমানুষের বিধবা হওয়াটা কি পৃথিবীতে এমন একটা বড় ঘটনা যে তার জন্যে দেশের স্বার্থ বলি দিতে হবে রে, প্রভু? দেশকে তবে কী ছাই ভালবাসিস!’’ তরুলতাদের আসলে সমাজনিয়মে বাঁধা যায় না। একজন মেয়ে মনুষ্যপদবাচ্য নয় বলেই বিবাহ প্রথার মধ্যে দিয়ে তাকে সম্প্রদান করা হয়। তরুলতা বোঝে সেই বঞ্চনাকে। ‘‘স্বামী! সেই সুগঠিত ওষ্ঠাধর থেকে এবার তিক্ত হাসি বেরিয়ে এসেছিল একটি ব্যঙ্গ বাক্যকে অবলম্বন করে। আইনত তাই বলে বটে। অগ্নি নারায়ণ সাক্ষী করে আমার বাবা ওঁর হাতে আমায় সম্প্রদান করেছিলেন তো। মেয়ে মানুষের তো আর নিজের কোনো সত্তা নেই। আত্মাও নেই, চিন্তাও নেই। জমি জমা, বাসনপত্র, সোনা টাকার মত তাকে দান করে ফেলা যায়। এক মালিকের হাত থেকে অপর মালিকের হাতে গিয়ে পড়া এই আর কী। আর মালিক মানেই তো প্রভু, স্বামী, তাই না?’’ প্রভুত্বের অধিকার থেকেই যাবতীয় বশ্যতার দাবি। সেখানেই মেয়ে জীবনের যন্ত্রণা। মনে মনে জমে বিদ্রোহ - সবসময় শেকল ভাঙা হয়তো যায় না। কিন্তু সংসারের ইতিউতি স্ফুলিঙ্গ যে ছড়িয়ে পড়ে সেটা তো সত্যি। আশাপূর্ণা সেই যন্ত্রণাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে রূপ দিয়েছেন তাঁর লেখায়। যন্ত্রণার মধ্যে গুমরে মরা, জীবনের নানা পর্যায়ে হস্তান্তর হয়ে পিতা স্বামী পুত্রের অধীনস্থ হওয়া - এমনটাই ভবিতব্য হতে পারেনা।

বকুলকথা আশাপূর্ণা দেবীর ত্রয়ী উপন্যাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। ‘বকুলকথা’র সূচনাতেই তাই শম্পার কথা। ব্যস্ত লেখিকা অনামিকা দেবীকে সেজদির চিঠি মনে করিয়ে দেয় বকুলের খাতাখানা খুঁজতে হবে। খাতাখানা আসলে বকুলের যন্ত্রণার ডায়রি। বকুল শম্পার মধ্যে দেখতে পায় নিজেকে। শম্পার প্রাণচাঞ্চল্য দেখে অনামিকা দেবীর মনে হয় খাঁচার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি বন্দী পাখি, এসে আলোর দরজায় উঁকি মারে। যন্ত্রণার গভীর থেকে গভীরে নির্বাসিত এক মেয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তির আলো দেখতে চায়। পারুল অভিমানী, বকুল ভীরু। কিন্তু শম্পা তো পারবে। সেই না পাওয়ার পৃথিবী থেকে সব পেয়েছির দেশে পৌঁছতে। শম্পা অনামিকা দেবীর প্রশ্রয়ে আহ্লাদে ভাসে। অনামিকা দেবীর বুকের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাস। বড্ড না পাওয়ার সময়কে তিনি যে অতিক্রম করে এসেছেন। সে পথ অতিক্রম করতে গিয়ে পদতল ক্ষতবিক্ষত। কত অপচয়! কত জীবনই তো অপব্যয়িত হয়েছে। বকুল পারুল তাদের মা প্রাণ ভরে বিশ্বাস নেবার একটা পৃথিবী পায়নি বলেই তো বাতাসের অভাবে দম আটকে মরেছে। সত্যবতী বালিকা সুবর্ণলতার বিবাহ মানতে পারেনি - সংসার ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো সে। সুবর্ণলতা তপ্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেছে সারাটা জীবন। বকুল পারুল মনের মধ্যে নির্বাসন নিয়েছে। আর শম্পা, পারুলের পুত্রবধূরা, বকুলদের উত্তরনারীরা সেভাবে খেয়াল করছে না এই লড়াইকে। সে এক যন্ত্রণা। ‘আমরা মেয়েরা লড়াই করেছিলাম - মনে মনে উচ্চারণ করেছিলো পারুল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে, অযথা শাসনের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে - আমি, আমার পূর্বতনীরা।... শুধু প্রকৃতির অসতর্কতায় আমাদের ভাগটা পেলুম না। আমার যুগটা কখন স্খলিত হয়ে পড়ে গেছে।’’ বকুলের ভাইপো অপূর্ব ও তাঁর স্ত্রী অলকা বকুলদের রক্ষণশীল পরিবার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়। বাড়ির মধ্যেই পাঁচিল তুলে দিয়ে অলকা আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। আধুনিকতার বিজ্ঞাপনের আড়ালে ভোগবাদ মানুষকে ক্রমাগতই নিজের গহ্বরে টেনে নিয়ে যায়। মানুষকে বিচ্যুত করে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে। তারপর মেয়ে পণ্যে পরিণত হয়। আরও পাওয়া আরও পাওয়ার নেশা ক্রমাগত তাঁকে ঠেলে দেয় অনিবার্য ধ্বংসের দিকে। অলকার মেয়ে আত্মহত্যা করে। সেই মর্মান্তিক মৃত্যুদৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে বকুল মনে মনে সুবর্ণলতা সত্যবতী ও আরও অজস্র পূর্ব নারীদের সঙ্গে কথা বলে চলে। ‘মা, তুমি কি অহরহ এই মুক্তিই চেয়েছিলে? এই শৃঙ্খল মুক্তি? তোমার প্রাণ কুড়ে চাওয়ার ফল কি এই?... কিন্তু এইটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? আমি, তুমি, আমাদের মা দিদিমা, দেশের অসংখ্য বন্দিনী মেয়ে? এটাই কি সেই স্বাধীনতার রূপ? যে স্বাধীনতার জন্যে পরাধীন মেয়েরা পাথরে মাথা কুটেছে, নিরুচ্চার আর্তনাদে বিধাতাকে অভিসম্পাত করেছে? এ কি সেই মুক্তির আলো, যে মুক্তির আশায় লোহার কারাগারে শৃঙ্খলিত মেয়েরা তপস্যা করেছে, প্রতীক্ষা করেছে?’

মেয়েবেলা যখন জুড়ে প্রতিষ্ঠান শিখিয়ে চলে ভালো মেয়ে হয়ে ওঠার পাঠ, সিমোন দ্য ব্যোভয়া তাকে স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ বলেছেন। ব্যোভয়া লিখেছিলেন, ‘‘Woman is her husband’s prey his possession!’’ ভার্জিনিয়া উলফ লেখেন, ‘‘It is far more difficult to murder a phantom than a reality!’’ অতএব ভালো মেয়ে হয়ে ওঠার এইসব শর্ত যেগুলো সমাজ ও সংসার জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তাকে তো যুক্তি দিয়েও খুব সহজে নস্যাৎ করে দেওয়া যাবেনা। আশাপূর্ণা এই বিষয়টিকে খেয়াল করেছেন সতর্কভাবে। যদিও এটাও ঠিক সমকালীন রাজনৈতিক চর্চা, মেয়েদের রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সেভাবে বুঝতে পারেননি আশাপূর্ণা। অন্তত তাঁর লেখায় সেভাবে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত টানাপোড়েন এবং সমাজ জীবনে মেয়েদের লড়াই আশাপূর্ণার লেখায় অনেক স্পষ্ট। আশাপূর্ণা দেবী ‘নেপথ্য নায়িকা’ উপন্যাসের পূরবীর রাজনৈতিক জীবনের এবং ব্যক্তি জীবনের পরিচয় দিতে যখন শুরু করেন তখন মনে হয়েছিলো হয়তো বা অচলায়তনটা ভাঙলো। তারপরও পূরবীর দিদি মাধবীদেরই আশাপূর্ণার উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায়। স্বামী সংসার সন্তানের জন্য নিবেদিত প্রাণ। মাধবী অবশ্য তার বাবার সেবায়, বোনের পরিচর্যায় এতটাই নিবেদিত যে নিজের সুখ স্বামী সংসার সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ। নিজের দুঃখ যন্ত্রণা ভালো লাগা মন্দ লাগা সবটাই অবশ্য খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে এই মেয়ে। আর পূরবী যখন বলে ‘‘তবে এটা ঠিক যে যতদিন না ধর্মের গোঁড়ামি দূর হবে আমাদের দেশ থেকে, আর সামাজিক মুক্তি না আসবে কোথাও কিছু উন্নতি হবেনা। এ আমি বলবোই।’’ পূরবীকে তখন অত্যন্ত সচেতন নাগরিক বলে মনে হয়। মনে হয়, পূরবীরা হয়তো ভেঙে ফেলতে পারলো সামাজিক ঘেরাটোপটা। শুধু তো বাইরের পৃথিবীতে পা রাখাই মানা নয়। একটা সামাজিক মূল্যায়ন পদ্ধতিও তো রয়েছে। মেয়ের মনন, চিন্তন কোনোটাই যেখানে বিবেচ্য নয়। মেয়েরা রান্নাবাটি ঘর সাজানো বাবা বা স্বামীর যত্ন নিয়ে ভাবতে পারে। যেমনটা মাধবী ভাবতে পারে। মেয়েরা বেকার সমস্যা নিয়ে ভাববে, দেশের কথা ভাববে এমনটা প্রত্যাশিত নয়। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ অবশ্য ব্যতিক্রম নয়। দু’একজন রিজিয়া, চাঁদ সুলতানা বা লক্ষ্মীবাঈয়ের কথা যেমন ইতিহাসে রয়েছে তেমনই এদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলো। যারা আসতে পারেননি, তাঁদের মনেও যে রাজনৈতিক ভাবনা ছিলো আশাপূর্ণা দেবীর অনেক লেখায় তার উল্লেখ রয়েছে। তবু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। অভিজাত পরিবার সূত্রে অভিজাত রাজনীতির শরিক হওয়া বা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনৈতিক পরিচিতি লাভ করা যতটা ঘটেছে খুব সাধারণ পরিবার থেকে মতাদর্শের কারণে মেয়েরা রাজনৈতিক জীবনে আসছে এমন ঘটনা কিন্তু আশাপূর্ণার লেখায় বিরল। তাই যখন পূরবী বলে, ‘‘বড়ো বড়ো পরিকল্পনা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, অথচ বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে’’ তখন আশার আলো জাগে। তখন সত্যিই মনে হয় পূরবীরা তাহলে কি পথ খোঁজার শরিক হচ্ছে? সে বাসুদেবকে আক্রমণ করে বলে, ‘‘বিপ্লবের স্বরূপ জানবার সৌভাগ্য কোনোদিনই হয়নি আপনার’’। পূরবী সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলে। বাসুদেব কংগ্রেস কর্মী। স্পষ্ট উল্লেখ না করে আশাপূর্ণা হয়তো নিজেই রাজনৈতিক ছোঁয়াচ বাঁচিয়েছেন। কিন্তু ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। একটা আদর্শগত সংঘাত। যেখানে অত্যন্ত দায়িত্বশীল সমাজ সচেতন মেয়েটি উত্তাল তর্ক করতে পারে। তবুও শেষ পর্যন্ত কেমন করে যেন সমাজ সচেতন মেয়েটি মাধবীর ছায়া হয়ে যায়। সমিতির পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে বন্দুক চালানো শিখে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। আবার সে মেয়ে হঠাৎই পালটে যায় বাসুদেবের প্রেমে। বাসুদেবের মন জয় করবার জন্য বাসুদেবের মায়ের কাছে পৌঁছে যায়। তাঁর কাছে অপমানিত হয়। তবু সে অবিচল। তখন আর দেশ নয়, মতাদর্শ নয়, তার লড়াইয়ের ক্ষেত্র ঘর সংসার। উপন্যাসের সূচনায় যে পূরবীকে দেখে আশার আলো জেগেছিলো তার সঙ্গে পরবর্তী সময়ের পূরবীকে আর মেলানো যায়না। দেশের ভাবনা, বিপ্লবের ভাবনা পূরবীকে যে একটুও ভাবিয়েছে তার চিহ্নমাত্র পরবর্তী সময়ে পূরবীর আচরণে নেই। এইখানে প্রশ্ন জাগে। কোথায় পৌঁছে দিতে চাইছেন আশাপূর্ণা। পূরবীর মত মেয়েরা যারা মাধবীর ছাঁচ থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের আলো দেখছে বলে মনে হয় তারা কেন শেষ পর্যন্ত ভাবালুতায় ভেসে যাচ্ছে! আশাপূর্ণা কি সমস্যার গভীরে পৌঁছতে এক্ষেত্রে ব্যর্থ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘মুক্তি’ কবিতায় লিখলেন, ‘এইটে ভালো, ওইটে মন্দ, যে যা বলে সবার কথা মেনে … তাই তো ঘরে পরে/সবাই আমায় বললে লক্ষ্মীসতী/ভালোমানুষ অতি!’ মেয়ের ভালোমানুষ হয়ে ওঠার এ এক অবশ্যম্ভাবী শর্ত। এই বিষয়টা কিন্তু আশাপূর্ণা খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছেন। তাঁর উপন্যাস ‘নদী দিকহারা’য় অমিতা সংসারের চোখে তেমনই এক লক্ষ্মী মেয়ে। যাবতীয় সামাজিক অবরোধকে মেনে নেয় নতমস্তকে। অগ্ন্যুৎপাত কিন্তু ঘটে। ‘সবাই তো বলছে এত লক্ষ্মী মেয়ের এ কেমন ধারা!... বলছে অমিতার বুদ্ধি বিবেচনার তুলনা হয়না। তুলনা হয়না ভব্যতা আর সংযমের। বিধবা হয়ে পর্যন্ত অমিতা নাকি চুলে কোনোদিন গন্ধতেল দেয়নি। গায়ে মাখেনি সৌখিন সাবান।’ সেই অমিতাও বিদ্রোহিণী হয়। আসলে ভালো মেয়ে হয়ে ওঠার শর্ত পূরণ করলেও সবসময়ে যে নিয়মভাঙারা মনের ভেতরে একেবারে মরে যায় এমনটা নয়। এই বিষয়টা আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় বারবার এসেছে।

আশাপূর্ণা দেবী ‘দিকভ্রষ্ট’ নামে একটি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখেছেন। যেখানে তাঁর নাতনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেনঃ ‘সমাজ এখনও পুরুষশাসিত, বুঝলেন? আমরা মেয়েরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই!... আমরা এখনও সেই মনুর শাসনের যুগে পড়ে আছি।’ একথার সূত্র ধরে প্রাবন্ধিক বিশ্লেষণের পথে হেঁটেছেন। মেরী উলস্টোনক্রাফট বড়ো হতাশ হয়ে লিখেছিলেন, ‘She was created to be the toy of man’ আশাপূর্ণা এখানে তাঁর আত্মোপলব্ধির কথা জানান। ‘সেই লেখালিখির সময়ে স্বপ্ন দেখেছি মেয়েদের বন্দীত্ব মোচনের। ভাবতে চেষ্টা করেছি - পাথরের দেয়ালে মাথা কুটে মরা মেয়েরা যদি ওই পাথরের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে, যদি খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে, যদি বৃহৎ বিশ্বের কর্মযজ্ঞের শরিক হতে পারে আর জগতের আনন্দযজ্ঞে তাদেরও নিমন্ত্রণ জোটে, কী অনির্বচনীয় হবে সেই দৃশ্য! কেমন মহিমাময় হয়ে উঠবে আমাদের পুরনো পচা সমাজ?’ বোঝা যায় বুকের গভীরে কোন প্রত্যয় লুকিয়ে ছিলো তাঁর।

প্রাবন্ধিক মল্লিকা সেনগুপ্ত ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’-এ লেখেন - ‘ধর্মীয় অনুশাসনগুলি বহুযুগ আগে থেকে আছে, সমাজ এগিয়ে এসেছে। সেই মান্ধাতার আমলের অনুশাসন এখনও চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, বহু ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা সফলও হয়। ১৯৯৪ সালে কলকাতার বুকের ওপর বসে জনৈক জগতগুরু শঙ্করাচার্য বললেন মেয়েদের বেদ পাঠের অধিকার নেই। মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিলেন সারদাশ্রমের বেদপাঠিকা মহিলাকে। প্রতিবাদী মেয়েদের মিছিলকে বললেন - নিকালো হিয়াসে। এই ঘটনা যে এখনও ঘটতে পারছে, এটাই শুধু দুশ্চিন্তা নয়, বরং মাথা চাড়া দেওয়া হিন্দু মৌলবাদের সঙ্গে সঙ্গে নতুন শক্তিতে জাঁকিয়ে বসেছে এই ধর্মীয় পিতৃতন্ত্র।’ যাবতীয় সামাজিক রীতি পদ্ধতির প্রতি আনুগত্য রাখতে হবে, এমন একটা অনুশাসন সমাজ ব্যবস্থায় আছে। কেননা প্রতিষ্ঠান এত সহজে বিনির্মাণকে মেনে নেবেনা। মানুষের সমাজ জীবন যাপনের সূচনা করা থেকেই প্রায় উত্তরাধিকারের প্রশ্নে সন্তানের পিতৃত্ব নির্ণয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। যার অবশ্যম্ভাবী সমাধান সূত্র হিসেবে নারীর এক বিবাহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু শুধুই তো পিতৃত্ব নির্ণয়ের প্রয়োজন নয় - সবলের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় - শুধু সেটুকু হলে মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্যরকম হত। তাই নিয়ম নিষেধের আইনকানুন দিয়ে ক্রমশই মজবুত করা হয়েছে পিতৃতন্ত্রের ভিত। কখনও ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে, কখনও সংস্কারের আফিম খাইয়ে মেয়েদের মনে প্রশ্নাতীত আনুগত্য গড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যে আনুগত্য উত্তরনারীতে সঞ্চারিত হয়েছে। মেয়েদের অস্থি মজ্জায় মিশতে মিশতে একদিন এইসব নিয়মকেই অনিবার্য ভাবতে শুরু করেছে। একসময় সেইসব মেয়েরাই হয়ে উঠেছে পিতৃতন্ত্রের রক্ষক। তাঁরা সমাজের শক্তি, পরিবারের শক্তি। কিন্তু শত নিয়ম, চোখরাঙানি দিয়েও যাদের মগজধোলাই করা গেলনা তাদের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়। অশিক্ষা, পুরুষের হাতে সমর্পিত হওয়ার অনিবার্য ভবিতব্য, অন্তঃপুর, সন্তান উৎপাদন ও পালনের দায়দায়িত্ব সামলে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের অতন্দ্র প্রহরী হতে হতে উত্তরনারীতে যাবতীয় সংস্কারের বীজ বপন করে দেওয়া - এটুকুই শুধু রইলো। বাংলা কথাসাহিত্যে প্রথম থেকেই মেয়েদের যাপিত জীবনকে এই ছকেই বেঁধে রাখা হয়েছিলো। আর সেই সঙ্গেই নিয়ম ভাঙা মেয়েরা সমাজনিয়মের বিপত্তি ঘটিয়ে কপালকুন্ডলার মত বলেছে - ‘যদি জানিতাম স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।’

আশাপূর্ণা দেবীর গল্প উপন্যাসে পিতৃতন্ত্রের একনিষ্ঠ নিয়মরক্ষক মেয়েরা যেমন উপস্থিত, তেমনই উপস্থিত প্রশ্ন তোলে যারা সেইসব মেয়েও। সংস্কার, নিয়মনিষ্ঠা আর নিষেধের ফাঁসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে হয় যাঁদের, সেইসব মেয়েদের প্রতি আশাপূর্ণার একটা তীক্ষ্ণ মনোযোগ আছে। স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ কিন্তু উদাসীন নয়। বরং আশাপূর্ণার গল্প উপন্যাস পড়তে পড়তে বারেবারেই মনে হয় লেখিকা সেইসব মেয়েদের কথাই মূলত বলতে চেয়েছেন যারা ধরতে পারে সেক্সুয়াল পলিটিক্সের কথা। যারা বুঝতে পারে মেয়েরা এই পৃথিবীতে সেকেন্ড সেক্স। কেট মিলেট, সিমোন দ্য ব্যোভয়া, মেরী উলস্টনক্রাফটরা ইউরোপীয় সমাজে বেড়ে ওঠার সূত্রে সমাজের এই স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণের পদ্ধতিকে একভাবে চিনেছিলেন। আর বাংলা সাহিত্যের কথাকার আশাপূর্ণা দেবী সত্যবতী, সুবর্ণলতা, ইন্দিরা, সরযূ, সুহাসিনীদের কথা লিখতে গিয়ে খুব যে খোলামেলা সোচ্চার উচ্চকণ্ঠ এমনটা নয়। হৈ হৈ রৈ রৈ করে প্রতিবাদ করার ঘটনাও কম। কিন্তু তিনি আন্তরিক। পিতৃতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী এলোকেশী, মোক্ষদা, তরঙ্গিনী সম্পর্কে সচেতন এই লেখিকা। মেয়েদের স্বপ্ন দেখার অধিকার যেখানে সীমায়িত, প্রশ্ন তোলা যেখানে মানা সেখানে বিরুদ্ধতার মাঝখানে নতুন রাস্তা খোঁজার প্রয়াস যারা চালিয়েছে তাদের কথা বলার দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন আশাপূর্ণা। ‘পিতামহীর প্রপিতামহীর ঋণশোধ না করে নিজের কথা বলতে নেই।’ আশাপূর্ণার লেখায় বকুল বলেছে তার মা দিদিমার কথা। যারা রান্নাঘর, শোবার ঘর, আঁতুড় ঘর দৌড়োদৌড়ি করতে করতেও মুক্তির স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি। ‘তারা সংখ্যায় অজস্র ছিলোনা, তারা অনেকের মধ্যে মাত্র এক একজন। তারা একলা এগিয়েছে। এগিয়েছে খানা ডোবা ডিঙিয়ে, পাথর ভেঙে, কাঁটাঝোপ উপড়ে। পথ কাটতে কাটতে হয়তো দিশেহারা হয়েছে, বসে পড়েছে নিজেরাই কাঁটাপথের পথ জুড়ে। আবার এসেছে আর একজন, তার আরব্ধ কর্মভার তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। এমনি করেই তো তৈরি হল রাস্তা।’

ব্যক্তি আশাপূর্ণা নিজে এই সমাজের বুকে বেড়ে ওঠা একজন কলমজীবী মেয়ে। পূর্বমানবীদের কথা তাঁর জানা। মেয়েজীবনে যন্ত্রণার উৎস আসলে অনেক গভীরে। পিতৃতন্ত্রের পরিসরে সমাজ সাহিত্য সমস্তই একপেশে ধারণা নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই একপেশে ধ্যান ধারণাই মেয়েদের যন্ত্রণার কারণ। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বিরুদ্ধতার চাবুক হাতে তুলে নেওয়ার কথা আশাপূর্ণার গল্প উপন্যাস জুড়েই আছে। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর ‘অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি - প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The emancipation of women becomes possible only when women are enable to take part in production on a large social scale, and when domestic duties required there attention only to a minor degree. And this has become possible only as a result of modern large scale industry, which not only permit of the participation of women in production in large numbers but actually calls for it and moreover strive to convert private domestic work into a public industry.’ অর্থাৎ বৃহত্তর উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে হবে মেয়েদের, ভাঙতে হবে মিথগুলি। আশাপূর্ণা কিন্তু সেদিকেই এগিয়েছেন। প্রমাণ বকুলের ভাইঝি শম্পা। যার মধ্যে দিয়ে সত্যবতী, সুবর্ণলতার দেখা স্বপ্ন একটি নির্দিষ্ট রূপ পায়। আশাপূর্ণা দেবী কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের কথা বলেননি সেভাবে। বরং অনেকক্ষেত্রেই তাঁর লেখায় মেয়েদের প্রতিবাদ বড্ড মৃদু। তবুও আশাপূর্ণার গল্প উপন্যাসগুলিতে যেসব মেয়ের কথা পাওয়া যায় তারা ‘এ বৃহৎ বসুন্ধরা কী অর্থে যে ভরা’ সেটা বুঝতে চেয়েছে। বাঙলা কথাসাহিত্য আশাপূর্ণাকে সেখান থেকে বিচার করলেই ঠিক করবে। হঠাৎ করে একদিনে পিতৃতান্ত্রিক শোষণ পীড়ন বঞ্চনাকে উড়িয়ে দেবার কথা লিখলে সেটা বেখাপ্পা হত। বরং নিবিষ্ট মনে চারপাশে তাকিয়ে যতটা দেখেছেন সেটুকুকে খুব সৎভাবে লিখেছেন আশাপূর্ণা।