আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭
প্রবন্ধ
ভগবান নেই, রাজা নেই, মালিক নেই
বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী
পৃথিবীতে অনেক রকম সামজিক চিন্তাধারা নিয়ে অনেককাল থেকেই নানারকম পরীক্ষা হয়েছে, এবং সময়ের অবগাহে তাদের অনেক কিছুই হয় ভেসে গেছে, নয়তো এমন বিকৃতি ঘটেছে, যে আসল চেহারা কী ছিল তা আর বোঝাই যায় না। সবাই সামাজিক চিন্তাধারার বিকাশের সময় একটা দেশের কথাই ভাবে, এর রাজনৈতিক আর সামাজিক চিন্তাধারার তফাৎটা হারিয়ে যায়। তবে এমন গোষ্ঠীও ছিল যারা রাজনীতির বিরুদ্ধে, কিন্তু তাদের সামাজিক চিন্তাধারা একেবারে মৌলিক। এদের সমাজে - মূল মন্ত্র ‘স্বাধীনতা, সমানতা, সখ্য’ (লিবার্তে, ইকোয়ালিতে, ফ্রাতারনিতে)। সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তি - প্রত্যেকের থেকে তার দক্ষতার হিসাবে, প্রত্যেককে তার দক্ষতার অনুসারে । দক্ষতাই একটা মানুষের পরিচয় এবং ওপরে ওঠার সিঁড়ি। দলের প্রধানেরও ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা সামাজিক দায়বদ্ধতার নিয়ম ভাঙার অধিকার নেই। বিশ্বাসঘাতকতা এবং সমাজের বিরুদ্ধাচরণ করার শাস্তি - মৃত্যু। বিচার হয় জনসমক্ষে এবং প্রত্যেক সাক্ষীর কথা শুনে। বিচারক একাধিক। দলের সবাই বিচারক হতে পারে। দলের প্রধানের একা কোনো শাস্তি দেবার ক্ষমতা নেই।
এরা কারা? এরা কি -
১। গেরিলা দল? না।
২। কম্যুনিস্ট ? না।
৩। কোনো প্রজাতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দল? না।
৪। কোনো দেশের বিপ্লবী দল? না।
৫। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কোনো দল? তাও না।
তবে?
এরা জলদস্যু। হ্যাঁ। তবে একটা বিশেষ সময়কার জলদস্যু। পৃথিবীতে যবে থেকে সামুদ্রিক ব্যাবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তবে থেকেই জলদস্যুরা নিজেদের কাজ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই ইতিহাসে পরে আসব। যে বিশেষ সময়টার কথা বলছি সেটাকে বলে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ। সময়টা ১৬৫০-১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ের মধ্যে প্রধানত ক্যারিবিয়ানের এই জলদস্যুরা তদানীন্তন ইংরেজ, ফরাসী, এবং স্পেনের সরকার, নৌবাহিনী এবং ব্যাবসায়ীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
জলদস্যু বললেই যে ধরনের লোকেদের কথা মনে পড়ে (কারণ সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞান অতখানিই - তাতে দোষের কিছু নেই), তারা জন্তু বিশেষ - খুনি, মদ্যপ, ধর্ষক, বর্বর, নৃশংস, রক্তলোলুপ, একদল মনুষ্যত্বহীন মানুষ। এটা অনেকাংশেই সত্যি। কিন্তু মজার কথা হল, এইসব মানুষরা নিজেদের জন্য যে ব্যবস্থা খাড়া করেছিল, সেটা - তারা নিজেরা তথাকথিত ‘সভ্যতার’ শত্রু হওয়া সত্ত্বেও - আজ পর্যন্ত কোনো দেশেই পুরোপুরি বলবৎ করা যায়নি।
এই জলদস্যুদের ‘সমাজ’ ব্যাবস্থার উপর কিছু টিপ্পণী দিয়ে এই প্রবন্ধ শুরু করেছি। এই টিপ্পণীগুলো একটু বিশদভাবে আলোচনা করা যাক। নইলে পাঠক-পাঠিকারা বাঁকা হাসি হাসবেন।
১। মূলমন্ত্র ‘স্বাধীনতা, সমানতা, সখ্য’ (লিবার্তে, ইকোয়ালিতে, ফ্রাতারনিতে)
ফরাসী বিপ্লবের একশো বছরেরও আগে থেকে ক্যারিবিয়ানের জলদস্যুরা নিজেদের এই মতেই চালাত। জলদস্যুদের জীবনযাত্রার কড়া সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন যে ‘জলদস্যু সম্প্রদায় আসলে ছিল... প্রজাতান্ত্রিক’। অনেক গবেষক এই মত পোষণ করেন। অনেকে তো এ কথাও বলেছেন যে এদের সমাজ ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর সবথেকে গণতান্ত্রিক সংগঠন, এবং ‘মূলত কম্যুনিস্টিক’। ‘ভাসমান গণতন্ত্র’ বা ‘ভাসমান প্রজাতন্ত্র’ এরকম বিশেষণও দিয়েছেন কেউ কেউ। তোরতুগার জলদস্যুরা নিজেদের ‘সমুদ্রতটের ভ্রাতৃত্ব’ (ব্রেদ্রেন অফ্ দ্য কোস্ট) বলতে শুরু করে ১৬৪০ নাগাদ। এই গণতান্ত্রিক (বা কম্যুনিস্টিক) সমাজে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে প্রত্যেক অভিযানের আগে একটা ‘কোড’ বা চার্টার সই করতে হত (বেশিরভাগ সদস্যরা নিরক্ষর বলে শুধু একটা ক্রস মেরে দিত)। এর বাইরে যাবার ক্ষমতা ছিল না। এক একজন জলদস্যুর প্রধানের নিজস্ব দল তো অবশ্যই ছিল, কিন্তু দস্যুপ্রধানকেও বারবার এই ‘চার্টার’ সই করতে হত। ১৬৫০ সালের পরে দেখা গেল সব জলদস্যু দলের চার্টার (বা সনদ বা ফরমান বা গণতান্ত্রিক চুক্তি বা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট যাই বলুন) প্রায় একইরকম। একজন ঐতিহাসিক বলেছেন যে এই ‘ভাসমান গণতন্ত্র’গুলিকে এই কারণে ‘কমনওয়েলথ্’ বলা উচিত (তবে এই ‘কমনওয়েলথ্’-এর কোনো প্রধান ছিল না)। জলদস্যুরা পৃথিবীর তাবৎ সভ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, এবং সেই লড়াইয়ে যারা শামিল, তাদের মধ্যে সখ্য তো গড়ে উঠবেই। তারা নিজেদের ভ্রাতৃস্বরূপ অন্যান্য জলদস্যুদের হয়ে প্রতিহংসা নিতে কোনোদিন পিছপা হয়নি তেমনই, যেসব জায়গায় জলদস্যুদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেসব জায়গার জাহাজকে বারবার আক্রমণ করেছে। বিখ্যাত জলদস্যু ‘ব্ল্যাকবেয়ার্ড’ এই কারণে নিউ ইংল্যান্ডের জাহাজ দেখলেই গোলাবর্ষণ করত। ক্যাপ্টেন কন্ডেটের জলদস্যুরা বেশ কিছু পর্তুগীজদের নাক এবং কান কেটে দিয়েছিল কারণ তারা কিছু জলদস্যুকে বন্দী বানিয়ে তাদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার চেষ্টায় ছিল।
মতবিরোধ হলে সাধারণতই সেগুলো আপোষে মিটিয়ে নেওয়া হত। এবং সেই কারণেই কোনো দলই কখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়ত না। আবার দুই দলের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও তাতে পুরো ‘কমনওয়েলথ্’-এ ভাঙন ধরত না। সপ্তদশ শতাব্দীর বাণিজ্য-জাহাজে (এবং নৌবাহিনীতেও) সাধারণ নাবিকদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তখনকার দিনের আইন অনুসারে নাবিকদের জীবন-মরণ পুরোটাই ক্যাপ্টেনদের হাতে ছিল এবং ক্যাপ্টেনরা সেই অধিকারের প্রায়শ অপব্যবহারই করত। খুব সাধারণ ভুলের জন্য চাবুক মারা বা শাস্তি হিসাবে জাহাজের সব থেকে বিপজ্জনক কাজ করতে বাধ্য করা, এসব তো ছিলই। এর ওপর ছিল খাবারের কষ্ট, নূন্যতম মাইনে এবং অন্যান্য ব্যবস্থার ঘাটতি। তার তুলনায় জলদস্যুদের জীবনের স্বাধীনতা, কাজ ভাগ করে নিজেদের উৎসাহে করা, কাজের হিসাবে টাকা, এসবের এতই তফাৎ, যে সাধারণ নাবিকদের কাছে তা খোলা হাওয়ার মতো। বাণিজ্য জাহাজে সাধারণ নাবিকরা নিজেদের মধ্যে একজন অন্য জনকে সাহায্য করত নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার জন্য, আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য। এই বন্ধনেরই পূর্ণ প্রকাশ জলদস্যুদের চার্টারে। বস্তুত, যে সমস্ত বৈষম্য, অবিচার এবং অত্যাচার থেকে পালিয়ে লোকেরা জলদস্যুদের দলে নাম লেখাত, তাদের চার্টারকে সেইসব অন্যায় এবং অবিচারের প্রতিবাদে যুদ্ধঘোষণাই বলা যায়।
২। সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তি - প্রত্যেকের থেকে তার দক্ষতার হিসাবে, প্রত্যেককে তার দক্ষতার অনুসারে। দক্ষতাই একটা মানুষের পরিচয় এবং ওপরে ওঠার সিঁড়ি।
জলদস্যুদের চার্টার বা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট কীরকম ছিল? চার্টার বা আর্টিকল্স লিখিত আর দলের প্রত্যেককে এতে সই করতে হত। চার্টারে বলা থাকত কীভাবে লুট ভাগ হবে; কেউ কোনো নির্দিষ্ট বা বাঁধাধরা টাকা পেত না - no prey, no pay - শিকার না থাকলে মাংসও নেই। এবং এই ভাগাভাগিতে দক্ষ কর্মচারীদের আলাদা করে চিহ্নিত করে তাদের জন্য বিশেষ ভাগ দেওয়া হত। ক্যাপ্টেন নিজের ভাগ পেত - সর্বসম্মতিক্রমে। তার ভাগটা বেশি, কারণ জাহাজটা তার। এরপর দক্ষ লোকেরা। তাদের মধ্যে ব’সন (জাহাজের সকল কাজের কাজি), জাহাজের ছুতোর, জাহাজের পাল সেলাই করার লোক (সেলমেকার), ডাক্তার, এদের সবার নাম থাকত। শুধুমাত্র এদের ক্ষেত্রে মাইনেরও ব্যবস্থা ছিল। এরপর সাধারণ নাবিক। যুদ্ধে যদি কারও ক্ষতি হয়, বা হাত-পা কাটা পড়ে, তার জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাবস্থা ছিল। কেউ যদি মারা যায়, তার ভাগের টাকা তার পরিবারকে, বা পরিবার না থাকলে যাকে সে মনোনীত করে গেছে তাকে পৌঁছে দেওয়াটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ত।
ক্যাপ্টেন লোথার একজন নামকরা জলদস্যু। তার ‘আর্টিকল্স’ বা চার্টার থেকে একটু উদাহরণ দিচ্ছি।
১। লুটের মাল যা পাওয়া যাবে (এর মধ্যে বন্দী - যাদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করা যেতে পারে, এবং যাদের জন্য তাদের পরিবাররা ভালো টাকা দিতে প্রস্তুত তাদেরও দাম ধরা হবে) তা সমানভাবে ভাগ হবে। ক্যাপ্টেন পাবে দুটো ভাগ, শিপ মাস্টার (প্রধান নাবিক) পাবে দেড় খানা ভাগ, ডাক্তার, ছুতোর, মেট, গানার, এবং ব’সন সোয়া ভাগ প্রতিজন। বাকি সবার একভাগ করে।
২। জাহাজ লুটের সময় বা লুট করা পুরো জাহাজের ওপর থাকার সময় কেউ যদি নিজের সাথীর বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র তুলে নেয়, তাকে ক্যাপ্টেন এবং পুরো দলের বেশিরভাগ লোক যা শাস্তি ঠিক করবে, সেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৩। যুদ্ধের সময় কেউ যদি কাপুরুষতার পরিচয় দেয় তাকেও ওইভাবে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৪। যদি লুটের জাহাজের কোনো সোনা-দানা বা দামী জিনিষ পাওয়া যায়, এবং যে পেয়েছে সে যদি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সেটা জাহাজের কোয়ার্টারমাস্টারের (যে জাহাজের সমস্ত জিনিষের হিসাব রাখে - ভান্ডারী বলা যায়) কাছে জমা না করে, তাহলেও তাকে ওইরকমভাবেই শাস্তি দেওয়া হবে।
৫। কেউ যদি অন্য কাউকে ঠকায় এবং সেটা প্রমাণিত হয়, তাকেও শাস্তিভোগ করতে হবে।
৬। যুদ্ধতে যদি কারো কোনো শারীরিক ক্ষতি হয় তাহলে তাকে দেড়শ পাউন্ড নগদ দেওয়া হবে (এটা সেই সময়কার কথা যখন বছরে দশ পাউন্ডে একটা পরিবারের জীবন ভালভাবে চলে যেত), এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্বেও যদি সে জাহাজের সঙ্গেই থাকতে চায়, তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হবে।
৭। শত্রু যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে সেটা মেনে নিতে হবে।
৮। যে প্রথমে শিকার দেখতে পাবে তাকে শিকারের জাহাজের সবথেকে ভাল অস্ত্র উপহার হিসাবে দেওয়া হবে।
বলেছি, যে এটা ক্যাপ্টেন লোথারের চার্টার। অন্যান্যরা আরো বিশদভাবে এসব লিখত। উদাহরণ হিসাবে -
১। ডান হাত কাটা পড়লে ছ’শো সোনার মোহর বা ছয়জন ক্রীতদাস।
২। বাঁ হাত কাটা পড়লে পাঁচশো মোহর বা পাঁচজন ক্রীতদাস।
৩। একটা চোখ বা একটা আঙ্গুলের জন্য একশো মোহর বা একজন ক্রীতদাস।
সব মিলিয়ে দেখতে গেলে এইসব চার্টারের বিশেষত্ব - (১) সকলকে সমানভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, (২) দক্ষতার জন্য বিশেষ সুবিধা, (৩) দলপতি কী পাবে তা সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক করা, (৪) জাহাজের ভাঁড়ারের ভাগাভাগি সকলের প্রয়োজন অনুযায়ী, (৫) সততা এবং ন্যায়বিচারের উপর জোর, (৬) শাস্তি দেবার প্রথা - সবার সামনে এবং সবার অনুমতিক্রমে, এবং (৭) ক্রীতদাসদের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করা। বলে রাখি, জলদস্যুদের জাহাজে শাস্তি মানে সাধারণত নির্জন দ্বীপে একা ছেড়ে দেওয়া, বা মৃত্যুদন্ড।
যদিও ক্যাপ্টেনের রায় মেনে চলা এইসব আর্টিক্লের একটা বিশেষ অঙ্গ হিসাবে সবসময়তেই থাকত, তবুও সাধারণ জলদস্যুদের তরফ থেকে কোয়ার্টারমাস্টারের অধিকার ছিল ক্যাপ্টেনকে প্রশ্ন করার। সেদিক থেকে কোয়ার্টারমাস্টারকে এখনকার ভাষায় ‘ওমবুড্সম্যান’ বলা যায়। কোয়ার্টারমাস্টার নির্বাচিত হত ক্যাপ্টেন এবং ডাক্তার, মেট ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে বাকি দলের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে থেকে, অবশ্যই সর্বসমক্ষে তার দক্ষতার বিচার হবার পর। ক্যাপ্টেন আর বাকিদের মধ্যে দূরত্ব (যেটা তখনকার বাণিজ্যিক বা নৌবাহিনীর জাহাজে অলঙ্ঘনীয় ছিল) ঘোচাবার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের রাজসিক কেবিন ভেঙে ছোট কেবিন বানিয়ে দেওয়া হত।
জলদস্যুদের স্বর্ণযুগের ব্যাপারে বিশিষ্ট ঐতিহাসিকরা বলেছেন যে ১৭১৬-১৭২৬ পর্য্যন্ত প্রায় ৪০০০ জলদস্যু অতলান্তিকের ওপর অবাধে ঘোরাফেরা করত। এরা যে কোনো সময়ে ২০০০ মতো জলদস্যু ২০-২৫টা জাহাজে শিকার খুঁজে বেড়াত। লক্ষণীয়, এরা একজন অন্যজনের ওপর আক্রমণ করত না কখনোই, যদিও একটা জাহাজ হয়ত ভালো শিকার পেয়েছে, আর অন্যটা পায়নি। যেহেতু এক দলের জলদস্যুরা বিভিন্ন কারণে অন্য দলে চলে যেত কোনোরকম বৈরীভাব ছাড়াই, সেজন্য বিভিন্ন দলগুলোর মধ্যে একটা সদ্ভাব তো তৈরি হতই, তাছাড়া ব্যবহারিক দিক দিয়েও রীতিনীতি, স্বভাব এবং আচরণে অনেক মিল ছিল। এই ভাবেই জলদস্যু ‘সমাজ’ সুসংবদ্ধ হতে পেরেছিল।
জলদস্যু হবার পিছনে একটা বড়ো কারণ তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজে নীচুস্তরের মানুষদের প্রতি অত্যাচার। স্পেন, ফ্রান্স, তুর্কী বা ইংল্যান্ডে এই অত্যাচারের একই চেহারা। এই অত্যাচার থেকে যারা পালাত, তাদের কাছে পৃথিবীটাই শত্রু। তারা পালিয়ে জলদস্যু হত বেঁচে থাকার জন্য, তাদের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ধর্ম, জাত বা চামড়ার রঙে তাদের কিছু এসে যেত না। বস্তুত তখনকার ধর্মগুরুরাই (বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিত গোষ্ঠি) মানুষের, বিশেষ করে নীচুস্তরের মানুষের ওপর অত্যাচারের ব্যাপারে অগ্রণী ছিল। রাজ/রাণী/রাজপরিবারের সদস্য বা উচ্চস্তরের সম্ভ্রান্ত লোকেদের অমানবিক ব্যবহারকে ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং সামাজিক বহিষ্কারের ভয় দেখিয়ে এই ধর্মগুরুরাই সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এজন্যই জলদস্যুরা বলত যে তাদের কোনো ভগবান নেই। জলদস্যু হবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপরিচয় জলাঞ্জলি দিত। যখন আক্রমণ করত তখন শুধু সাহসিকতার পরিচয় দিলেই হত। যে ‘সভ্যতা’ তাদের শত্রু, সেই সভ্যতার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আর কিছুই তাদের আটকাতে পারত না।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, জলদস্যুদের ‘সমাজব্যবস্থা’ যদি এতই ভালো ছিল, তা টিকল না কেন? উত্তরে বলতে হয় যে এই ব্যবস্থা নমনীয় (flexible) হলেও পুরো পৃথিবীর তাবৎ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো, একটা সমঝোতায় আসতেই হয়। এই ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ জলদস্যুদের ক্ষেত্রে, কেননা তাদের কোনো দেশ নেই। যদি নির্জন দ্বীপেও বসবাস শুরু করে, তাহলেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তো রাখতেই হবে। এদিকে সব দেশই তো শত্রু। সম্পর্ক না রাখলে, সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে সেই স্বাধীনতাটাই খোয়াতে হবে যার জন্য জলদস্যু হওয়া। স্বাধীনতা রক্ষার একটাই উপায় - দস্যুতা করে যাওয়া। সেটা আবার অনন্তকালের জন্য সম্ভব নয়।
তদানীন্তন শক্তিশালী দেশরা এই মনস্তত্ব ভালই বুঝেছিল এবং তার সুযোগও নিয়েছিল। জলদস্যুদের শায়েস্তা করা যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তখন চালু হল ‘লেটার অফ্ মার্ক’ (letters of marque)। এটা একটা মারাত্মক চাল। প্রথমে শুরু করল ইংল্যান্ড, পরে তার দেখাদেখি ফ্রান্স এবং স্পেন। সবথেকে নামকরা জলদস্যুদের অফার দেওয়া হল, ‘যেখানে যেখানে তোমাদের ঘাঁটি আছে তোমরা যদি আমাদের কথা শোনো তাহলে তোমাকে সেখানকার গভর্নর করে দেওয়া হবে। তোমরা নিজেদের দস্যুতা চালিয়ে যেতে পার, এক শর্তে - আমাদের আর আমাদের মিত্র দেশের জাহাজ আক্রমণ করবে না। নাও এই লেটার অফ্ মার্ক।’ তবে আরও একটা শর্তও থাকত - লুটের একটা লভ্যাংশ দেশের রাজার নামে পাঠিয়ে দিতে হবে। মোক্ষম চাল। মর্গানের মত জলদস্যুরা এই ফাঁদে পা দিল। অবশ্য সবাই নয়। ক্যাপ্টেন টীচ বা ব্ল্যাকবেয়ার্ডের মত জলদস্যুরা কোনো আপোষে আসতে রাজি হয়নি কখনো। কিন্তু ঘুণ ততদিনে ধরে গেছে। ছোটো ছোটো দল যারা নির্জন দ্বীপে থাকার সিদ্ধান্ত নিল, তাদের পিছনে নৌবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হল। সহজেই শায়েস্তা করা গেল। এক ঢিলে দুই পাখি - কোষাগারে টাকা এবং জলদস্যুদের ‘পুনর্বাসন’ (শব্দটা এই জন্য ব্যবহার করলাম যে, তখন লেটার অফ্ মার্ক দেবার সময় এই শর্তটাই দেওয়া হত)। এই ভাবে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ শেষ হল।
কয়েকটা প্রশ্ন পাঠক তুলতে পারেন। প্রথম, জলদস্যুরা এল কোথা থেকে? দুই, যদি মেনে নেওয়া যায় যে জলদস্যুদের নিজস্ব জাহাজ ভালরকমই ছিল, তাহলেও ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের নৌবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দেবার মত নিশ্চয়ই নয়। তাহলে তারা এই সত্তর বছর দাপিয়ে বেড়াল কি করে? কি তাদের যুদ্ধকৌশল? তিন, জলদস্যুদের স্বর্ণযুগই তাদের ইতিহাসের শুরু এবং শেষ নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এদের শুরু কবে? আর আধুনিক যুগেই বা এদের স্থান কোথায়? এই বিষয় গুলো পরে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
জলদস্যুদের ওপর অন্তত কয়েকশ’ বই আছে। কয়েকটা রেফারেন্স বইয়ের নাম নীচে দিচ্ছি।
পিটার উইলসন, ‘পাইরেট ইউটোপিয়া’
ডেভিড মার্লি, ‘পাইরেটস্, এ্যাডভেন্চারারস অফ দ্য হাই সীজ্’
জন্ এস্কেমেলিং, দ্য বুকানীরস্ অফ আমেরিকা’
মারকুস রেডিকার, ‘বিটুইন দ্য ডেভিল আন্ড দ্য ডীপ সী’।
জলদস্যুদের নিয়ে লেখা অনেক গল্পের বই আছে। ভালো রিসার্চ করে লেখা বইয়ের মধ্যে রাফায়েল সাবাতিনির ‘ক্যাপ্টেন ব্লাড’, বা মাইকেল ক্রাইটনের ‘পাইরেট ল্যাটিচিউডস্’ পড়ে দেখা যায়।