আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান ও তৃণমূলের ভবিষ্যৎ

সম্বিত পাল


২০০৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ পর্যন্ত একজন সাংবাদিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির খবর করতে গিয়ে, কী কী ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়েছে - সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলন, শিল্পায়নের জন্য কৃষি জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তীব্র বিতর্ক, কৃষক ও গরীবদের জীবন-জীবিকা, শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকদের কর্মসংস্থান ও শিল্পে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা উচিত কিনা, তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর, কোন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা রাজ্যে বিনিয়োগ করবে, তা নিয়ে জল্পনা, বামেদের অত্যাচার, মাওবাদী উগ্রপন্থা ও কিছুটা সময় ধরে দার্জিলিঙে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন।

এক দশক পরে, পশ্চিমবঙ্গে সাংবাদিকরা কী কী বিষয় নিয়ে চর্চা করছেন - ডানপন্থী গেরুয়া শিবিরের উত্থান, ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, নাগরিকত্ব বিল, জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নিয়ে দাবি-দাওয়া, রাজ্যের শাসক দলের দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও ভাঙন, বাঙালি-বহিরাগত বিতর্ক, উন্নয়ন ও অনুদানের রাজনীতি ইত্যাদি।

বিষয়গুলির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে বামপন্থী জীবন-জীবিকার রাজনীতি থেকে ডানপন্থীদের হাত ধরে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির দিকে ঘুরে গেছে এই রাজ্য। যেখানে এক সময় ‘‘তোমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম’’ বা ‘‘তোমার নাম, আমার নাম নন্দীগ্রাম’’ স্লোগান উঠেছিল, সেখানে আজ রাজনৈতিক স্লোগান উঠছে, ‘‘জয় শ্রী রাম’’। এই পরিবর্তন এক দিনে হয়নি। ৩৪ বছরের বাম সরকারের পতনের মতোই একটি বিশেষ কোনও কারণেও অতি ডানপন্থী বিজেপির উত্থান এই রাজ্যে হয়নি। বিভিন্ন কারণের সমাহার এই পরিবর্তনের পিছনে।

বাংলায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে কিনা, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, গেরুয়া শিবির তৃণমূলের বিরুদ্ধে এ রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। ২০১৬-তে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী জোট হলেও, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কংগ্রেস-বাম জোট করেও সেই জায়গা নিতে পারবে না বলেই মনে হয়।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি ২টি আসন জিতেছিল। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনেও নিজেদের জোরে তিনটি আসন তারা জয়ী হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯-এ নির্বাচনী রাজনীতির সংখ্যার জোরে বিজেপি এ রাজ্যে নিজেদের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। তার আগেও, ২০১৬-র পর থেকে ধীরে ধীরে বেশির ভাগ উপনির্বাচনে এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও কিন্তু বিজেপিই প্রধান বিরোধী দলের জায়গা করে নিয়েছে।

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির ১৮টি আসন জিতে যাওয়া, বামেদের শূন্য হাতে ফেরা ও তৃণমূলের আসন সংখ্যা এক ধাক্কায় এতটা কমে যাওয়া বাংলায় একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ইঙ্গিত করে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে এ রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে, বেশ কয়েকটি দিক থেকে এই ঘটনাক্রমকে ব্যাখ্যা করতে হয়।

এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি, সংগঠন ও সরকার পরিচালনার পদ্ধতি, দুই, বামেদের দুর্বলতা ও সর্বোপরি তিন, বিজেপির রাজনীতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা।

২০১১ সালে দীর্ঘ তিন দশকের বাম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোট এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল। জমি-রাজনীতির আন্দোলনে ভর করে তীব্র বাম বিরোধী অবস্থানকে সঙ্গী করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া। গত এক দশক ধরে সরকার চালাতে গিয়ে তিনি মূলত পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সরকারি অনুদানের উপরেই ভরসা রেখেছেন।

সরকারে আসার পরেই রাজ্যে জুড়ে রাস্তাঘাট তৈরি ও সারানো, সরকারি অফিস, হাসপাতালগুলির খোলনলচে বদলে দেওয়া, ব্রিজ তৈরি করা, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি মান্ডি তৈরি করার মতো বিভিন্ন প্রকল্প তিনি হাতে নিয়েছেন। তার ছবি রাজ্যের কোনায় কোনায় দেখা গেছে।

পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী ‘জন্ম থেকে মৃত্যু’ পর্যন্ত সবার জন্য সরকারি অনুদানের প্রকল্প তৈরি করেছেন একে একে। কন্যাশ্রী ও সবুজ সাথী প্রকল্পের সাফল্যও গ্রাম বাংলার মানুষ দেখেছেন। আবার স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্পও তৈরি হয়েছে আম জনতার জন্য। এই সব অনুদানের সুফল যে একদমই রাজ্যের জনতা পায়নি, তা বলা যাবে না। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্য রাজ্য সরকারকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও এনে দিয়েছে।

কিন্তু কন্যাশ্রীর মাধ্যমে যে মেয়েটি পড়াশোনা শেখার ব্যাপারে আগ্রহী হল, তার যেটুকু ক্ষমতায়ন হল, তার সদ্বব্যবহার সে কীভাবে করবে? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সরকারের কাছে পাওয়া গেল না। সরকারি অনুদান পেয়ে যে পরিবারটি বেঁচে বর্তে রয়েছে, সেই পরিবারের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা শিখে একটি চাকরি বা নিজের পায়ে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারবে তো? এ প্রশ্নেরও সদুত্তর পাওয়া গেল না। কারণ, এখন রাজ্যে কর্মসংস্থানের বিষয়টি এখন ক্ষীণভাবে উঠে এলেও, তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা এখনও নেই সরকারের কাছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কিছু বিনিয়োগ হলেও, বড় শিল্পের অভাব সরকার ও রাজ্যবাসী - উভয়ই টের পাচ্ছে। যেটুকু বিনিয়োগ হয়েছে বলে সরকার দাবি করে, তাতে কর্মসংস্থান যথেষ্ট হয়নি। রাজ্যের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য যে পরিকল্পনার দরকার ছিল, তাও অনুপস্থিত।

তৃণমূল কংগ্রেসের একটি নির্দিষ্ট ও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক আদর্শের অভাবই এর জন্য দায়ী। বাম বিরোধিতা ও নিজেদের উন্নততর বামপন্থী হিসেবে তুলে ধরার মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা রয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতি করা অসুবিধাজনক। খাতায় কলমে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেই সব হয় না। সেই মতাদর্শে সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় অর্থনৈতিক নীতির দিশা না থাকলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্ভব নয়। শুধুই নির্বাচনী রাজনীতির নিরিখে ‘যখন যেমন, তখন তেমন’ নীতির কুফলই রাজ্যের মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। ধারাবাহিক একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের অভাবে আরও কী সমস্যা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে পরে আরও আলোচনার অবকাশ রয়েছে এই প্রবন্ধে।

কিন্তু তৃণমূল সরকার তথাকথিত উন্নয়ন ও অনুদানের রাজনীতির মধ্যেও একটি আশার আলো ছিল। যে হাওয়ায় সেই আলো নিভে গেল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও দুর্বল করে দিল, সেটি হল দুর্নীতি। ‘কাট মানি’ বিতর্কের মাধ্যমে যা অনেক পরে সরকারি ভাবে তৃণমূল নেত্রীর মান্যতা পেয়েছে। সরকার একটি করে নতুন রাস্তা বা বাড়ি বা সেতু তৈরি করেছে অথবা পুরনো বাড়ি রং করেছে, আর তাতে পকেট ভরানোর অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠছে, সরকারি অনুদানের টাকা মানুষের পকেটে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় নেতারা হাত পেতে দাঁড়িয়ে গেছেন বাড়ির সামনে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকদের নাভিশ্বাস উঠেছে ‘প্রোটেকশন মানি’ দিতে গিয়ে বা নেতাদের আবদার মানতে গিয়ে।

এর ফল ২০১৯-এর নির্বাচনের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে নাতে টের পেয়েছেন রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এত দিন মনে করা হতো, যতক্ষণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে দুর্নীতির কালি না লাগছে, ততক্ষণ সব ঠিক আছে। তাই সারদা-নারদ কেলেঙ্কারির পর্ব পেরিয়ে আরও বেশি আসন নিয়ে একক ভাবে লড়ে ২০১৩-তে পঞ্চায়েত ও ২০১৬-তে বিধানসভায় বেশি আসন নিয়ে ফিরে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

তবে নিজের দলের নেতাদের দ্বিতীয় সারিতে রেখে পুলিশ-প্রশাসনের ভরসায় রাজনীতি করতে গিয়ে মাটির সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ২০১৬ সালে যেমন ‘২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ২০১৯-এ কিন্তু সেই ‘ক্যারিশমার’ পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেননি তিনি।

নিজে সরকারের কাজে মন দিয়ে যে ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের’ হাতে দলের সংগঠনকে ছেড়ে রেখেছিলেন, সেই মুকুল-সুব্রত-পার্থর জুটিও ভেঙে গিয়েছিল মুকুল রায়ের তৃণমূলত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে। ত্রয়ীর অন্য দুই মাথা সুব্রত বক্সী ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন দলের যুব নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানে। দলের মধ্যেও যুব তৃণমূল ও মূল তৃণমূলের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল নব্য তৃণমূল ও আদি তৃণমূলের মধ্যে।

কমিউনিস্ট বা আরএসএস-এর মতো তৃণমূল কোনও কঠিন শৃঙ্খলায় আবদ্ধ একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নয়। ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ দলের নিয়ন্ত্রণ রাখা সমস্যা হয়েছে তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে। উপরন্তু অনুব্রত মণ্ডল বা শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতা ছাড়া জেলায় সংগঠনের রাশ নিজেদের হাতে রাখবে, এমন কোনও নেতাকেও পাশে পাননি দলনেত্রী। যেমন, বহুদিন ধরে ঝাড়গ্রাম জেলার কোনও সভাপতিই ছিল না তৃণমূলের। একটি কমিটি বানিয়ে চলছিল দল।

যখন তিনি বুঝতে পেরেছেন দলের রাশ হারিয়ে ফেলছেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছন্নছাড়া সংগঠনকে আর গুছিয়ে উঠতে পারেননি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে।

এর উপরে তৃণমূল কংগ্রেস যেটি করেছে, তা হল, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে গ্রাস করে নেওয়ার চেষ্টা। ২০১১ থেকেই কংগ্রেস ও বামেদের থেকে দলে দলে নেতা-কর্মী, এমনকী বিধায়কদেরও নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিরোধীশূন্য হয়ে গিয়েছিল অনেকটা জায়গা।

কিন্তু কোনও জায়গাই খালি থাকে না। বামেদের রাজনৈতিক কর্মসূচির দুর্বলতা, মার খাওয়া কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে না পারা, নতুন করে সংগঠনকে চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হওয়া ও নবীন প্রজন্মের নেতার অভাবে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল তারা। ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে দ্বিধান্বিত জোট করেও কোনও লাভ হয়নি তাদের। উল্টে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে অনেক বাম নেতা-কর্মী-সমর্থকই তৃণমূলের বিপক্ষে বিজেপিকেই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে ভোট দিয়েছিল। বাম নেতৃত্ব প্রকাশ্যে অস্বীকার করলেও, ‘আগে বাম, পরে রাম’ নীতিতে বিশ্বাস করে অনেকেই তৃণমূলকে পর্যুদস্ত করতে পদ্মফুলে ভোটটি দিয়ে এসেছিল।

এই সুযোগেই ধীরে ধীরে বিজেপি জায়গা করে নিল পশ্চিমবঙ্গে। বিরোধীদের স্থান পূরণ করে দিল মাত্র কয়েক বছরে। তৃণমূল ও বামেদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই রাজ্যে জাঁকিয়ে বসল তারা। মূলত যে ছিদ্র পথ দিয়ে বিজেপির এ রাজ্যে এত বাড়বাড়ন্ত তা হল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুসলমানদের তোষণের অভিযোগ। এই অভিযোগ অমূলক নয়। ইমাম ভাতা থেকে শুরু করে, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরির মতো সংখ্যালঘু নেতাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া ও কট্টরপন্থী ইমামদের দল ও সরকারের অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে রাখা, হিজাব পরা মুখ্যমন্ত্রীর পোস্টার-ফেস্টুনে রাস্তা ছেয়ে দেওয়া একটি অন্য ধরনের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল দিকে দিকে। এই সুযোগই লুফে নিয়েছিল গেরুয়া শিবির।

সরকারি দলের ‘তোষণে’ মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নয়নে যে খুব একটা ছাপ পড়েনি তা সরকারি চাকরি, স্বাস্থ্য, অপরাধ - এই সব ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু তৃণমূলের নীতি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে যে একটি অংশের মুসলমান যুবকদের বেপরোয়া করে তুলেছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজ্যের যেখানে যেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে হিন্দুদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় এই লুম্পেন শ্রেণীর যুবকদের প্রতি তাঁরা কতটা রুষ্ট। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, এই বেপরোয়া যুবক ও কট্টরপন্থী সংখ্যালঘু নেতাদের প্রতি তৃণমূল সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। সুতরাং তারা যা খুশি তাই করে পার পেয়ে যেতে পারে। এতে এক শ্রেণীর মুসলমানেরা বিব্রত হলেও, তারা হালে পানি পাননি। যেমন হালে পানি পাননি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যপন্থী মানুষেরা, যাঁরা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ থামাতে এগিয়ে আসতেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আপাত ঐক্য বজায় রাখতে।

এই পরিস্থিতিতে ‘রাজ্যের হিন্দুরা তৃণমূল সরকারের আমলে নিরাপদ নয়’ - এই হাওয়া তৈরি হল। সেই আলেখ্য তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নিল প্রথমে কিছু প্রান্তিক হিন্দু সংগঠন, তার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ছাতায় থাকা কিছু সংগঠন। এরই রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে শুরু করল বিজেপি।

অনেকেই বলে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনও জায়গা ছিল না। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে মিশে এ রাজ্যে বরাবর থেকেছে ও দুই ধর্মে কোনও বৈরিতা ছিল না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বহু নজির পশ্চিমবঙ্গে থাকলেও, এই বিশ্বাস যে সর্বাংশে সত্যি এমনটা কিন্তু নয়। বাঙালির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে কিন্তু একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব সামান্য হলেও ছিল। তা চাপা পড়ে ছিল এতদিন। না হলে এত তাড়াতাড়ি ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী শক্তি এ রাজ্যে জায়গা করে নিতে পারে না। তার জন্য বাংলার ইতিহাস অনেকাংশেই দায়ী।

ব্রিটিশ শাসনের চাল হিসেবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বৈরিতা তৈরি করেছিল, তার উত্তরাধিকার আমরা। যে রাজ্য ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে আসন ভাগ করা দেখেছে, প্রাক্ স্বাধীনতা কালে মুসলিম লিগের শাসন দেখেছে, হিন্দু মহাসভার রাজনীতি দেখেছে, ১৯৪৬-এর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং দেখেছে, ধর্মের নামে দেশ ভাগ হতে দেখেছে, ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর মুসলমানদের অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীদের জায়গা দিয়েছে, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ‘মোল্লা পাড়া’ গড়তে উঠতে দেখেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ছোঁয়া জল গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে - সে রাজ্যের জনগণের মনে কোনও দিনই সাম্প্রদায়িক ভাবনা জমে ছিল না, এটা খানিকটা ভাবের ঘরে চুরি।

কিন্তু যে রাজ্যে হিন্দু মহাসভার নেতা ও ভারতীয় জন সংঘের (যা পরে বিজেপি নাম নিচ্ছে) প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম, সেখানে দীর্ঘ সাত দশক ধরে বিজেপি কেন মাথা তুলতে পারল না, সেটাই বরং রহস্য।

তার কিছু ব্যাখ্যা অবশ্যই রয়েছে। প্রথমত, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়াতে এবং অবিভক্ত বাংলার মুসলমান অধ্যুষিত অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি খানিকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন সংঘ ১৯৫২-র সাধারণ নির্বাচনে প্রায় ছয় শতাংশ ভোট ও ৯টি আসন পেলেও বা হিন্দু মহাসভা ২ শতাংশের মতো ভোট পেলেও, তিনি নেহরু মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৩ সালেই তাঁর মৃত্যু।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীরাও তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বোড়ে হয়ে উঠতে পারত। আরএসএস সেই সময়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করেছিল। কিন্তু ১৯৪৮-এ মহাত্মা গান্ধীর হত্যা ও তার পরে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায়, সেই কাজ বাংলায় সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে দানা বাঁধতে পারেনি।

এর মাঝেই কংগ্রেসের সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থী রাজনীতি ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা করে নেয়। বামপন্থী সংগঠনগুলি উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজ শুরু করে। মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে বামপন্থীদের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে মন সরিয়ে দেয় বাংলার মানুষের। জোতদার বনাম গরীবের লড়াই প্রাধান্য পায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের বাঙালী বিপ্লবীদের প্রভাব যেন ফিরে আসে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলার রাজনীতিতে, ৬০-৭০ দশকে কমিউনিস্ট-নকশালদের দাপটে ক্রমশ কোনঠাসা হতে থাকে কংগ্রেস।

অন্যদিকে, উত্তর ভারতের দল হিসেবেই থেকে যায় জনসংঘ বা পরবর্তীতে বিজেপি। রাম মন্দির আন্দোলনের সময় কিন্তু একটি হিন্দুত্বের হাওয়া এ রাজ্যের একটি অংশের মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। সে সময়ে অযোধ্যায় শিলাপূজন করে আসা মানুষের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অনেকেই ‘পুণ্য’ অর্জন করতেন সে সময়ে। কিন্তু বামেদের দাপটে বিজেপি এর রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেও পারেনি এবং হয়ত চায়ওনি। আর তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে যেভাবে পার্টির প্রভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদীরা চুপচাপ কাজ করে গেলেও, মাথা তুলতে পারেনি।

তবুও সুযোগ কী একেবারেই ছিল না? ৯০-এর দশকের রামমন্দির আন্দোলন পেরিয়ে ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে বিজেপি যখন জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে, তখন তাঁরা কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসকে বাংলায় নিজেদের সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, আরএসএস-এর মূল শত্রু কিন্তু কংগ্রেস বা তৃণমূল নয়। দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকরের ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইটি পড়লেই বোঝা যাবে বামপন্থী ভাবধারাই হিন্দুত্ববাদীদের মূল বিরক্তির কারণ। নেহরুবাদ হোক বা কমিউনিজম - সবেতেই এই উদারপন্থী বাম ধারার বিরোধীতা করছেন আরএসএস পন্থীরা। প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির ভাবধারায় গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদেই তাদের বিশ্বাস। উদারপন্থী আন্তর্জাতিকতাবাদে নয়।

তো সেই বামপন্থীদের নিধনের কাজ যখন বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস করছে, তখন বিজেপির পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে ভাবার বিশেষ প্রয়োজন হয়নি। ২০১১ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমস্ত রকমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা বিজেপি করে গেছে। এমনকি ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের তৈরি করা মহাজোটের পক্ষেও অনেক বিজেপি কর্মী কাজ করেছেন, এ কথা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিজেপি নেতারাই স্বীকার করেন।

এদিকে বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিআইএম-এর ঘরে ৯০ দশক থেকেই বেনোজল ঢোকা শুরু করে দিয়েছে। বার বার শুদ্ধিকরণের ডাক দিয়েও কাজের কাজ হয়নি। এলসিএস, এলসিএম-দের দাপটে গ্রামের মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠছে। বিরোধীদের উপর অত্যাচারের খবর উঠে আসছে মিডিয়ায়। সাচার কমিটির রিপোর্টে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের দুরবস্থার কথা উঠে আসছে এবং সেই সুযোগে তৃণমূল কংগ্রেস বামেদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাতে শুরু করছে। তখন বাম সরকারের শেষ পেরেকটি পোঁতার কাজ শুরু হয়েছিল শিল্পায়নের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণে তাড়াহুড়ো করার মধ্যে দিয়ে। দলকে ও দলীয় কর্মীদের অগ্রাহ্য করে পুলিশ প্রশাসনের ভরসায় শিল্পায়ন করতে গিয়ে তৃণমূলের পায়ে বল তুলে দিয়েছিলেন সিপিআইএম-এর শীর্ষ নেতৃত্ব। নন্দীগ্রামের গুলি চালানোর ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলেছিল।

২০১১-র সরকারে পরিবর্তনের পরে, ২০১৬-র মধ্যে যখন নির্বাচনী অঙ্কে বাম-নিধন যজ্ঞ প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস, তখন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি মাঠে নামেন। ২০১৪-র নির্বাচনের পরেই বিজেপি নির্বাচনী ম্যানেজারেরা বুঝে যান, এবার পূর্ব ভারতের দিকে তাকাতেই হবে। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অটুট রাখতে পূর্ব ভারত থেকেই আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। তখন অসম, ত্রিপুরার পরে পশ্চিমবঙ্গ তাঁদের লক্ষ্য হয়।

বিজেপি সভাপতি হওয়ার পরে ২০১৫ সালে কলকাতার ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনের সভা থেকে অমিত শাহ প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হুঙ্কার দিয়ে যান - তাঁরা আসছেন ‘দিদিকে নবান্ন থেকে উৎখাত’ করতে। যে রাজ্য বিজেপি নেতারা বার বার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে ধরনা দিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর চড়ানোর অনুনয়-বিনয় করতেন, তাঁরা এবার মনে বল পান। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে রাজ্য বিজেপির সংগঠনেও আমূল পরিবর্তন হয়। প্রাক্তন সংঘ প্রচারক ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতা দিলীপ ঘোষকে রাজ্য বিজেপির সভাপতি করে বার্তা দিয়ে দেওয়া হয়, রাজ্যে এবার সংঘের রাজ শুরু হল।

পর্যবেক্ষক পদে বদল, বিস্তারক কর্মসূচি, সদস্য সংগ্রহ অভিযান, সোশ্যাল মিডিয়া সেলের তৎপরতা বৃদ্ধি, বুথ স্তরের সংগঠনে জোর, পাঁচটি জোনে ভাগ করে কেন্দ্রীয় স্তরের নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে সংগঠন তৈরি করা - গেরুয়া শিবির নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে।

অন্যদিকে আরএসএস-এর প্রচার কর্মসূচি এবং সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে রাজ্যে। ২০১৭ সালে সংঘের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলাদা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যা সংঘের ক্ষেত্রে একটি বিরল ঘটনা। কোনও রাজ্যকে নিয়ে আলাদা করে এমন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি কখনও। এতেই বার্তা যায় হিন্দু সংগঠনগুলির কাছে। উত্তরবঙ্গে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম বা একলব্য বিদ্যালয় চালানোর মতো হিন্দু সংগঠনগুলির এতদিনের কাজের সুফল ঘরে তুলতে থাকে বিজেপি।

একদিকে রামনবমীর মতো উৎসবকে হিন্দু-রাজনীতির হাতিয়ার করে নেওয়া, অন্যদিকে বজরং দলের হনুমান মন্দির তৈরি করে স্থানীয় মানুষদের একজোট করা, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে রাজ্যে বিভিন্ন প্রান্তে গেরুয়া পতাকা উড়তে থাকে।

আর অর্থনীতির মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের অভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এই হিন্দুত্ব রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে যায়। তাদের পক্ষে হিন্দুত্বের এই আগ্রাসনের যথাযথ বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি। বরং অন্যান্য তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মতোই নরম হিন্দুত্বকে আঁকড়ে ধরে। তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান। নিজেদের হিন্দু পরিচয়কে তুলে ধরতে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চন্ডী পাঠ, মন্ত্র উচ্চারণ, দূর্গা নাম করতে শুরু করেন। রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী হয়। ইমাম ভাতার সমালোচনার জবাবে হিন্দু পুরোহিত ভাতা চালু হয়।

বিজেপি যখন নিজেদের একটি মতাদর্শের ভিত্তিতে মতুয়া সমাজের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে বা আদিবাসীদের বন্ধু হতে চায়, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস শুধুই ভোট-ব্যাঙ্কের নিরিখে এই জাতি-গোষ্ঠীগুলির আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে তোল্লাই দেয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিত্তিতে রাজ্যে কতগুলি উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হয়েছে, সেই সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির ফাঁদে কীভাবে পড়ে গিয়েছে রাজ্যের শাসক দল।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মতো তৃণমূলের কাছেও কোনও শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা নেই। কোনও ব্যক্তি-বিরোধীতার মাধ্যমে বা এনআরসি হোক বা কৃষক আন্দোলন - কোনও ইস্যুকে হঠাৎ করে তুলে ধরে সরকারের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর হিন্দুত্ব-মতাদর্শকে হারানো সম্ভব নয়। হিন্দু সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদী সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরে কোনও রাজনৈতিক আলেখ্যই তৈরি করা যায়নি এখনও।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গকে একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ২০১৯-এর নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং প্রশান্ত কিশোরের মতো নির্বাচন-কৌশলীকে নিয়ে এসে নিজেদের ইমেজ পুনরুদ্ধারে নেমেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির সাংগঠনিক মেশিনারির মোকাবিলা করার জন্য (যার অনেকটাই আরএসএস-এর সংগঠনের ধারায় তৈরি) রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রশান্তের আইপ্যাকের কর্মীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলের সংগঠন এতে চাঙ্গা হবে নাকি কিছু নেতা এতে উত্যক্ত হয়ে দলেরই ক্ষতি করবেন, তা দেখতে হবে। ইতিমধ্যেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রশান্ত কিশোরের চাপে শুভেন্দু অধিকারীর মতো অনেক নেতা দল ছেড়েছেন। আমফানের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি দেখিয়ে দিয়েছে, তৃণমূল স্তরের দুর্নীতি এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। পিকে শুধুই ‘দিদির ইমেজ’ পুনরুদ্ধার করে, তাঁকেই সামনে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

বিজেপিও আঁট-ঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে। একদিকে তৃণমূলকে দুর্বল করা, অন্যদিকে নিজেদের সংগঠনকে মজুবত করার লক্ষ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুভেন্দু অধিকারীকে তুলে না ধরলে, গেরুয়া শিবিরের হাতে মাটি থেকে আন্দোলন করে উঠে আসা নেতার অভাব এখনও রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জননেত্রীর মোকাবিলা করতে কোনও মুখ্যমন্ত্রী-পদপ্রার্থী এখনও গেরুয়া শিবিরের হাতে নেই। বরং পদ্ম শিবিরের অন্দরেই কে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন, তা নিয়ে চাপা উত্তেজনা রয়েছে। এই নিরিখে একটু হলেও পিছিয়ে থাকতে হবে তাদের। তবে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন অনেকটা ক্রিকেটের একদিনের ম্যাচের মতো। বুথ যার, ভোট তার। সে খেলায় তৃণমূলকে কতটা টেক্কা দিতে পারবে বিজেপি তার উপরেও নির্ভর করছে ২০২১-এর নির্বাচনের ফলাফল। শুধুই মানুষের মধ্যে গেরুয়া হাওয়ার উপর ভরসা করে এই নির্বাচন জেতা কঠিন।

বাম সমর্থকদের যে অংশ ‘আগে বাম পরে রাম’ বলে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিলেন, তাঁরা আবার বাম-কংগ্রেসের ভোট বাক্স ভরিয়ে দেন কিনা তার উপরেও তৃণমূল-বিজেপির ভাগ্য নির্ভর করবে। হায়দ্রাবাদ-স্থিত মিমের মতো সংখ্যালঘুদের দল যদি সত্যিই বাংলার নির্বাচনে লড়ে এবং এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের একটি বড় অংশ যদি মিমকেই নিজেদের রক্ষাকর্তা বলে ভেবে নেন, তাহলে তার প্রভাবও ২০২১-এর নির্বাচনে পড়বে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই নির্বাচনের প্রচারের যে হাওয়া দেখা যাচ্ছে, সেখানে কোনও রিপোর্ট কার্ড বা রাজ্যের মানুষের রুটি-রুজির কথা নয়, বেকারদের কথা নয়, চাকরি না পাওয়া শিক্ষকদের কথা নয়, এই নির্বাচন ‘বাঙালী ও বহিরাগত’ এই রকমই আত্মপরিচয়ের বাইনারিতে হতে চলেছে।

______________________________
(পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখা সম্বিত পালের বই ‘বেঙ্গল কনানড্রামঃ দ্য রাইজ অফ দ্য বিজেপি অ্যান্ড ফিউচার অফ দ্য টিএমসি’ ব্লুমসবেরি কর্তৃক প্রকাশিত হতে চলেছে ১৮ জানুয়ারি, ২০২১।)