আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭
সমসাময়িক
কাশ্মীর ও কেরলের স্থানীয় নির্বাচন
২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দু’টুকরো করে ভেঙে তার রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অবলুপ্তি বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের রথের ধ্বজায় এক গুরুত্বপূর্ণ নিশান হিসেবে স্বীকৃত। জন্মলগ্ন থেকেই বিজেপি ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। তাই ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতার ফেরার পরে তারা এই সিদ্ধান্ত জোর করে সংসদে পাশ করিয়ে নেয়। কাশ্মীরের জনগণকে অবরুদ্ধ রেখে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের সমস্ত সম্পর্ককে ছিন্ন করে দিয়ে, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে কাশ্মীরের মাটিতে নাকি শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে, এমনটাই দাবি প্রধানমন্ত্রী তথা সংঘ পরিবারের।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল সেখানকার জেলা উন্নয়ন কাউন্সিলের। বহু বছরের বৈরিতাকে পাশে সরিয়ে রেখে কাশ্মীরের মূলধারার দুই রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) এবং পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টি (পিডিপি), সিপিআইএম সহ কিছু রাজনৈতিক দল গুপকার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। গুপকার ঘোষণাপত্রের মুখ্য দাবি ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং পুনরায় সেই ধারাকে কাশ্মীরে প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক গতিবিধি গড়ে তোলা। যেহেতু ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে প্রথম নির্বাচন কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত হয়, তাই এই নির্বাচনকে ঘিরে কাশ্মীরের বাইরেও কৌতুহল ছিল।
নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে বোঝা গেল যে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। মোট ২৮০টি আসনের মধ্যে ২৭৮টির ফল ঘোষণা হয়েছে। এর মধ্যে গুপকার গোষ্ঠী জিতেছে ১১২টি আসন, কংগ্রেস ২৭টি এবং বিজেপি জিতেছে ৭৫টি আসন, ৫০টি আসন জিতেছে নির্দল প্রার্থীরা যাদের মধ্যে অধিকাংশ বিজেপি সমর্থিত। গুপকার গোষ্ঠী এবং কংগ্রেস মিলিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। তাই একদিক দিয়ে দেখলে বলা যেতে পারে যে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে।
কিন্তু এই রায় নিয়ে বিজেপি খুব অখুশি নয়। বরং তারাও এই নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বলে দাবি করেছে। এর প্রধান কারণ বিজেপি একক দল হিসেবে সর্বাধিক আসনে জয়ী হয়েছে। এমনকি কাশ্মীর উপত্যকাতেও তারা কিছু আসনে জয়লাভ করেছে। কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় বিজেপি-র সুবিধা করে দিয়েছে। কাশ্মীরেও গোটা দেশের প্রবণতা বজায় রয়েছে, কংগ্রেস তার নিজস্ব শক্তির ক্ষয় রোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে যার সুযোগে বিজেপি নিজেদের সমর্থন এবং আসন সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে নিচ্ছে। আবার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি যে বিজেপি-র সুবিধা করে দিচ্ছে তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। সম্পূর্ণভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন এমন জেলায় বিজেপি ৫৬টির মধ্যে ৮৬ শতাংশ আসনে জয়ী হয়েছে। এই জেলাগুলিতে গুপকার গোষ্ঠী জয়ী হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ আসনে। কাশ্মীরের প্রশাসন লাগাতার বিজেপি-র সুবিধা করে দিয়েছে বলে অভিযোগ। আবার গুপকার গোষ্ঠীকে বিজেপি-র সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দেশবিরোধী আখ্যা দিয়েছে, তাদের হেয় করা হয়েছে তাদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা চেয়ে।
কাশ্মীরের নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তাই বিজেপি-র খুব বড়ো ক্ষতি হয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। যারা ৩৭০ ধারাকে পুনর্বহাল করার দাবি জানাচ্ছেন, তারা এই নির্বাচনে কাশ্মীরের মানুষের তরফে উৎসাহ পেলেও জম্মুর হিন্দু সম্প্রদায় কিন্তু মোটের উপর বিজেপি-র পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। তাই আগামীদিনে আরো অনেক লড়াই বাকি। সার্বিকভাবে গোটা দেশে হিন্দুত্বের রাজনীতি পরাস্ত না হলে কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান সম্ভব নয়।
ভারতের বুকে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে হারানোর ক্ষেত্রে কেরলের বামপন্থীদের কথা আলোচনা করতেই হবে। সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত স্থানীর পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা জয়ী হয়েছেন। ৯৪১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বামপন্থীরা জয়ী হয়েছেন ৫৪৯টিতে, কংগ্রেস ৩৬৫ এবং বিজেপি জিতেছে মাত্র ১৪টি। মোট ৮৬টি পুরসভার মধ্যে বামপন্থীরা ৪৪টিতে জয়ী, কংগ্রেস জয়ী ৪১টিতে। ভোট বা আসনের নিরিখে বিজেপি সুদূর তৃতীয়।
কেরলের এই নির্বাচন দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ২০২১ সালে কেরলে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কেরলের নির্বাচনের ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর অন্তর রাজ্যপাট বদল হওয়াই দস্তুর। সেই হিসেব মানলে ২০২১ সালের নির্বাচন বাম সরকারের সামনে কঠিন পরীক্ষা। তাই এই নির্বাচনের প্রাক্কালে স্থানীয় নির্বাচনে বামপন্থীদের জয়, অনেকের মনেই আশার সঞ্চার করছে যে ২০২১ সালে হয়ত সেই দস্তুরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে বামেরাই পুনরায় ক্ষমতাসীন হবেন।
বামেদের মানুষের সমর্থন পুনরায় লাভের আশা অবশ্য শুধুমাত্র এই নির্বাচনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। লকডাউন এবং কোভিডের প্রকোপে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নজির গড়েছে কেরলের বাম সরকার। এমনকি পরিযায়ী শ্রমিকদের সেখানকার সরকার তথা বাম কর্মীরা যেভাবে সেবা করেছেন তা গোটা ভারতের সামনে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারী স্কুল ও হাসপাতালের তাক লাগানো পরিকাঠানো উন্নয়ন, কোভিডের টিকা রাজ্যের মানুষকে বিনা পয়সার দেওয়ার সরকারী প্রতিশ্রুতি, ১০০ দিনের কাজ, শহরের মানুষের জন্য রোজগার ইত্যাদি মানুষের প্রভূত সমর্থন আদায় করেছে।
অতএব, বাম সরকারের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি চলছে। সোনা পাচার কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা ক্রমাগত করে চলেছে বিজেপি-র নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। এই কাজে তাদের সংগত দিচ্ছে কংগ্রেস। এত কিছুর মধ্যেও বামপন্থীরা কেরলে যেই জয় ছিনিয়ে এনেছেন তা সাধুবাদের যোগ্য।
তবু আত্মসন্তুষ্টির কোনো স্থান নেই। মানুষের পাশে থেকে লাগাতার নবউদারবাদী অর্থনীতি এবং বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা তথা কংগ্রেসের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম পরিচালনা করে যেতে হবে। এই পথেই পাঁচ বছর পর পর সরকার বদলে দস্তুর শুধু নয়, বিজেপি-র মতন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরব সাগরের জলে নিক্ষেপ করবে কেরলের জনগণ এই আশা বুকে নিয়ে জনতার মাঝে যেন সদা তাদের মিত্র হিসেবে থাকে বামপন্থীরা।