আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

সমসাময়িক

(রাজ)নীতিহীনতা


কোনো দেশের রাজনীতি যদি হয় নীতিহীন, পচনগ্রস্ত, তাহলে সে দেশটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই পচন তখন সংসদীয় ব্যবস্থা, বিচারসভা, পুলিশ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হয়ত তারই একটা প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে, যখন দুটো পচে যাওয়া দল তৃণমূল ও বিজেপি একে অপরের সদস্য নেতা কর্মীদের নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। জনসভাগুলিতে অন্য দল থেকে নেতা ভাঙিয়ে এনে পেশিশক্তির নির্লজ্জ প্রদর্শন করছে। পুরোটাই কালো টাকার খেলা, যেখানে স্রেফ টাকার জোরে বিধায়ক সাংসদদের কিনে নিয়ে দুটো দল একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে দখল করবে বাংলার মসনদ। এই অবস্থায়, মানে এই যেখানে রাজনীতির হাল, তার প্রভাব গিয়ে পড়বে বিধানসভায়, সংসদের ঘোড়াকেনাবেচায়, ক্ষমতাশীলের কাছে পুলিশ প্রশাসন বিচারব্যবস্থার বিক্রি হয়ে যাওয়াতে, সেসবই স্বাভাবিক। তবে এই প্রসঙ্গে কয়েকটা বক্তব্য রাখতেই হচ্ছে, যেগুলো নিয়ে এখনো বিশেষ আলোচনা শোনা যাচ্ছে না।

প্রথম যেটা লক্ষ করবার, তা বিজেপি-র সংগঠন। এবং এখানেই এক মস্ত ধাঁধা। বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের কর্মীরা গত ষাট বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে বনাঞ্চলে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন, জনসেবামূলক নানা প্রকল্প নিচ্ছেন, স্কুল খুলেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কার্য চালিয়েছেন, এবং এভাবেই তৃণমূল স্তরে তৈরি করেছেন দুর্ভেদ্য জনসংযোগ। অন্তত সেরকমটাই দাবি করে এসেছে সংঘ পরিবার। তাহলে আজ কী এমন ঘটল যে সেই সংগঠনের ওপর আর ভরসা করে থাকা যাচ্ছে না? কোন তাড়নায় বিরোধী দলের নেতা মন্ত্রীদের টাকা ছড়িয়ে কিনতে হচ্ছে? এই জিনিস ২০১৯-এ করতে হয়নি, এবং তারপরেও ১৮টা আসন এসেছে লোকসভায়। মূলত তখনই সংঘপরিবারের এই অনলস প্রয়াসের কথা বারবার শোনা যেত। তাহলে এখন যা ঘটছে, তার কারণ হতে পারে দুইয়ের মধ্যে যে কোনো একটা। হয় সংঘ ও বিজেপির এই কর্মসূচীর পুরোটাই গল্পগাথা, বাস্তবে বিজেপির কোনো সংগঠনই নেই আর তাই অন্য দল থেকে নেতা কর্মী কিনে আনতে হচ্ছে; অথবা এই বিজেপি কর্পোরেট মন্ত্রে দীক্ষিত একটি সুবিধাবাদী দল, যা নিজেদের দক্ষিণপন্থী আদর্শকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে আয়ারাম গয়ারাম নীতি গ্রহণ করে নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, বামপন্থার মতই দক্ষিণপন্থার আদর্শকেও টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার পড়ে ত্যাগ, নিষ্ঠা ও সততার। আর তাই দীনদয়াল উপাধ্যায়দের ব্যক্তিগত সততা প্রবাদ হয়ে থেকে যায়। কিন্তু এই বিজেপি সেই আদর্শগত রাজনীতি থেকেও অনেক দূরে। এবার, যে কারণেই ঘটুক না কেন, বামপন্থী রাজনীতির কাছে সেটা সুখবর তো বটেই। শত্রু দক্ষিণপন্থা তার আদর্শগত ভিত্তি হারাচ্ছে অথবা সংগঠন বলে কিছুই নেই, আছে শুধু টাকা, এর কোনো একটার অর্থই হল মতাদর্শের দীর্ঘ লড়াইতে অথবা সংগঠনের প্রশ্নে বিজেপির পিছু হটা। এর সুফল চট করে না মিললেও ভবিষ্যতে আসবেই, কারণ শুধু টাকা ছড়িয়ে কোনো দল সংসদীয় ব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারে না যদি না জনভিত্তি থাকে।

দ্বিতীয় যেটা বলবার, তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি রাজ্যের মানুষের সামনে পেটফাটা ভাঁড়ামির যে নিদর্শন রাখছে, সে জিনিস আগে কখনো দেখা গিয়েছে কি? এই হারে চলতে থাকলে বিধানসভা ভোটের আগেই গোটা দল উঠে যেতে পারে। তেমন কোনো বড় সঙ্কট আসেনি, অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম তৈরি হয়নি দলের ভেতর, মূল নেতারা সকলেই জীবিত - শুধুমাত্র একটা বড় দলের টাকা আর ব্ল্যাকমেলের সামনে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে এতবড় একটা দল, কারণ দলটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকলে দূর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে ভরসা করা হবে কোন যুক্তিতে? আরো বড় ব্যাপার হল, একটা দল দশ বছর রাজ্যে সরকারে আছে, নানা রকম কাজ করেছে। তার পরেও তাদের এখন বলতে হচ্ছে ‘বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের ভোট দিন’। মানে, নিজেদের কোমরের জোরে নয়, নিজেদের কাজের পরিসংখ্যান দেখিয়ে নয়, উলটে বিরোধী দলের জুজু দেখিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে ভোট চাইতে হচ্ছে, এমনধারা উলটপুরাণ তৃণমূলের ক্ষেত্রেই সম্ভব। কী গ্যারান্টি আছে যে ভোটের পর নেতারা বিজেপিতে লাইন দিয়ে চলে যাবেন না? তৃণমূলের বিজেপি-বিরোধীতা একদমই অপরীক্ষিত, বরং যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায় যে বিজেপি দলটাকে ভাঙিয়ে নেবে। অতীতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলে এসে লোকসভায় বিভিন্ন ইস্যুতে যখন ভোটের দরকার পড়েছে যথাস্থানে ভোট দিয়েছেন অথবা ওয়াক-আউট করে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছেন। সারদা নারদা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে তিনি সত্যিই আন্তরিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে আর রাস্তায় নামার জায়গাতে নেই।

তৃতীয় যেটা বক্তব্য, তা বামেদের প্রসঙ্গে। তারাও খুব নীতিগতভাবে একদম স্বচ্ছ অবস্থানে আছে এমন নয়, এবং তাদেরও বিধায়ক, কাউন্সিলার বা নেতারা বেশ কয়েকজন বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু, যেটা বামেদের তৃণমূল থেকে আলাদা করে দেয়, তা হল - মতাদর্শভিত্তিক রেজিমেন্টেড পার্টি হবার কারণেই, কাল যদি বামেরা ভোটের অংকে তলানিতে এসে ঠেকেন, তার পরেও বামেরা রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে কিনা তা নির্ভর করবে তাদের লড়াইয়ের উপর। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল মতাদর্শগতভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারবে না। তাই বলে ‘আগে রাম, পরে বাম’ মার্কা যেই স্লোগান বাংলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে বামেরা সরব হন। ইতিহাসে অবশ্যম্ভাবী বলে কিছু নেই। তৃণমূলের গরম কড়াই থেকে বিজেপি-র জ্বলন্ত উনুনে ঝাপিয়ে পড়ার আত্মঘাতী রাজনীতির সার্বিক বিরোধীতা করা অবিলম্বে প্রয়োজন।

তীব্র মেরুকরণের বাজারে বামেরা চাইলেও তাদের ভোট খুব বেশি বাড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। পরিচিতি নির্ভর রাজনীতির মেরুকরণ যেখানেই তীব্র হয়েছে সেখানে শ্রেণি রাজনীতি পিছু হটেছে, বারবার। তবু এই প্রশ্ন উঠবেই যে কেন বামপন্থীরা রাজ্যের মানুষের সামনে নিজেদের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে হাজির করতে পারল না। অবিলম্বে বামেরা নতুনভাবে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দিক। তৃণমূল ছত্রভঙ্গ ও দিশাহীন এবং বিজেপির নিজস্ব সংগঠন বলে কিছু আছে কি না তা নিয়েই যেখানে সন্দেহ, বা থাকলেও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে হয়ত, সেখানে বামেরা সংগঠনের দিকে নজর দিক। ভোট এবং সংগঠন কিন্তু এক জিনিস নয়। দুর্বল সংগঠন হলেও ভোট প্রচুর আসতেই পারে ঘরে, যেমন আসছে বিজেপির। আবার উল্টোদিকে সংগঠন মজবুত করলেও ভোটে সাময়িক প্রাপ্তি নাও ঘটতে পারে। কিন্তু বাম রাজনীতির কাছে দৃঢ় সংগঠনের ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে। আগামীদিনে বাংলায় প্রতিরোধে যে রাজনীতির প্রয়োজন পড়বে তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। ফ্যাসিবাদ অথবা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দায়িত্ব বামেদের নিতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় বাম ঐক্য এবং পার্টি কাঠামোর বাইরে যেই প্রগতিশীল শক্তিরা আছে তাদের একত্রিত করা। বর্তমান বাম নেতৃত্ব তা করতে পারবেন কিনা, তার উপরে নির্ভর করবে পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ। এবার, তার মধ্যেও অন্তর্ঘাত চলবে, বিজেপির টাকার হাতছানি থাকবে, ক্ষমতার মোহ থাকবে, বামেদের ঘর ভাঙবে এসবের কারণে - এবং এগুলোকেই ড্রিবল করে করে এগিয়ে যেতে হবে, এটা বুঝে নিয়েই যে রক্তপাত অনিবার্য এবং তুমুল জনসমর্থন এখনো সুদূরপরাহত।

কিন্তু বাম সংগঠন রাজনীতি ব্যতিরেকে তৈরি হতে পারে না। তাই রাজনীতির প্রশ্নে বামপন্থীদের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে হবে, এবং তা নিয়ে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। আয়ারাম গয়ারাম নির্ভর যেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং তৃণমূল আমদানি করেছে, তার বিরুদ্ধে মানুষের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা বামেদের আশু কর্তব্য। একদিকে বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক সিএএ-এনআরসি-এনপিআর নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে বিজেপি-র সাম্প্রদায়িকতা এবং কর্পোরেট বান্ধব আর্থিক নীতি এবং অন্যদিকে তৃণমূলের নীতিহীনতার বিরুদ্ধে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোন বিকল্প মানুষের সামনে হাজির করছে? তার সুস্পষ্ট রূপরেখা মানুষের সামনে হাজির করতে হবে। নবউদারবাদ বিরোধী এবং মানুষের সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে বামপন্থীদের অবস্থান মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা হতে হবে। এই দাবিসমূহকে ঘিরে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বাম সংগঠনকে মজবুত করার লক্ষ্যে ব্রতী হতে হবে। শুধুমাত্র নেতিনির্ভর রাজনীতি নয়, সদর্থক বিকল্প মানুষের সামনে হাজির করতে হবে।

শেষ বক্তব্য যেটা, তা বিজেপি-বিরোধী উদারনৈতিকদের উদ্দেশ্যে। আপনারা দিকে দিকে ‘বিজেপি-কে ভোট দেবেন না’ এই স্লোগান দিয়ে এক হিসেবে বিজেপির-ই সুবিধে করে দিচ্ছেন, কারণ বিজেপি সবথেকে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই স্লোগানের মাধ্যমে। আপনারা যদি মনে করেন যে বিজেপির এই নীতিহীন রাজনীতি দেখে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে তাহলে তার থেকে বড় ভুল আর কিছু নেই। যদি মনে করেন যে বিজেপির ফ্যাসিবাদ দেখে মানুষ দূরে চলে যাবে তাহলে বলতেই হয় আপনারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। সাধারণ গরীব মানুষের ফ্যাসিবাদ বা হিন্দুরাষ্ট্র দিয়ে কিছুই এসে যায় না। তৃণমূলের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা হাতের সামনে যাকে পেয়েছেন তাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। বিজেপি এখন যতটা দুর্গন্ধময়, পচনশীল ছিল, ২০১৯ বা ২০১৪ সালেও ততটাই ছিল, এবং মানুষ সেসব জেনেই বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। কাজেই আজ বিজেপি ফ্যাসিবাদ আনছে বা নীতিহীনতার আমদানি করছে এসব বলে আপনি ভোটের তরী পার হতে পারবেন না, কারণ এই ফ্যাসিবাদ বা কালো টাকা বিজেপির দুর্বলতা নয়, এটাই তার শক্তি। এই রাজনীতিহীনতার দিনে দাঁড়িয়ে, আদর্শ যেখানে মৃত, সেখানে আপনার ব্যক্তিগত নৈতিকতার দায় বিজেপির কাঁধে চাপাতে যাবেন না। তাতে লাভ নেই। যদি বিজেপি বিরোধীতায় একনিষ্ঠ হন, তাহলে কোনও নির্দিষ্ট দলের হয়ে প্রচার করুন। সেই দল বাম হতেই হবে তার মানে নেই। হতেই পারে যে আপনি বামেদের পছন্দ করেন না। সেক্ষেত্রে তৃণমূল বা কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করুন, তাদের ভোট দিতে আবেদন করুন মানুষের কাছে। কিন্তু সেটা না করে শুধুমাত্র ‘বিজেপিকে ভোট দেবেন না’ বললে বিজেপিকেই আরো প্রাসঙ্গিক করে তোলা হয়। এটাই আজকের দ্বান্দ্বিকতা।