আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

নয় নয় করে ৯-এ পা


২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি আরেক রকম-এর পথচলা শুরু। সেই হিসেবে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি আরেক রকম ৮ বছর সম্পূর্ণ করে ৯ বছরে পদার্পন করল। ৮ বছর ইতিহাসের নিরিখে একটি পাদটীকাও নয়। তবু ৮ বছর একটি বাংলা পত্রিকাকে নিয়মিত প্রকাশ করে যাওয়া আনন্দসংবাদও বটে। এই ৯ বছর ধরে আরেক রকম লাগাতার প্রকাশিত হয়ে চলেছে পাঠকদের আকুন্ঠ সমর্থন, লেখকদের উৎসাহ, বিজ্ঞাপনদাতাদের ঔদার্য, প্রচ্ছদ শিল্পীদের সাহায্য এবং ছাপাখানার কর্মীদের পরিশ্রমে। অতিমারির কবলে পড়ে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ১ তারিখ থেকে জুন মাসের ১ তারিখ অবধি আমরা পত্রিকা প্রকাশ করতে পারিনি। সেই যন্ত্রণাকীর্ণ দিনের মধ্যেও আরেক রকম-এর ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন আমাদের ওয়েবসাইট টিমের বন্ধুরা। আরেক রকম যে এই অতিমারির আবহে নিরন্তর ওয়েব দুনিয়ার মাধ্যমে পাঠকদের দরবারে পৌঁছতে পারছে, সেই কৃতিত্ব তাদের।

আরেক রকম-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অশোক মিত্র পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন,
“এটা এই মুহূর্তে হট্টমালার দেশ, যাদের গলার দাপট বেশি, তাঁদের কথাই সবচেয়ে বেশি কর্ণগোচর হচ্ছে, খবরকাগজে-বেতারে-দূরদর্শনে তাঁরা সমস্ত জায়গা জুড়ে বিরাজ করছেন। একই ধরনের যুক্তি-অযুক্তি-কুযুক্তি, একই ধরনের আস্ফালন, তত্ত্ববিস্তার, একই গোছের তথ্য পরিবেশন। চোরের মায়ের গলা উচ্চনাদতম। চোরের মায়েরা এই মুহূর্তে সমাজের সর্বত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন, অভিনয় মঞ্চ থেকে খেলার মাঠ, রাজনীতি থেকে শিক্ষাপ্রাঙ্গণ, শিল্পচর্চা থেকে সাহিত্যবিচার, সর্বত্র একই রকম রঙ্গ-বিভঙ্গ।

অস্বস্তি হয়, কোনো কোনো মুহূর্তে বিবমিষাবোধ পর্যন্ত। সব কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রথাগত চর্চা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে একটু আলাদা ধরনের কথোপকথন কি সম্ভব নয়? একটু পরীক্ষা করেই দেখা যাক না কেন। আমরা একটি বিনম্র মঞ্চের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, যাঁর যেরকম ইচ্ছা করবে জাগতিক যে-কোনো সমস্যা নিয়ে স্ব-স্ব মতামত ব্যক্ত করুন, তর্ক জমুক, চর্চা চলুক। চর্বিতচর্বণ নয়, পরিচিত অভ্যাসমেলার রকমফের নয়, অন্য রকম, পুরোপুরি আরেক রকম।”
- আরেক রকম, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা।

পথচলতি ধারার বিপ্রতীপে থেকে সত্যকে উদ্ঘাটন এবং সোজাসাপ্টা ভাষায়, ক্ষমতার ভ্রূকুটিকে ভয় না পেয়ে, যা ন্যায্য এবং যা পরিচিত অভ্যাসমেলার বাইরে তাকে বাংলার পাঠকসমাজের সামনে হাজির করার উদ্দেশ্যে আরেক রকম নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। সেই প্রচেষ্টার মান কেমন হয়েছে, তা বাংলার চিন্তা ও মননের জগতে প্রকৃত অর্থে আরেক রকম দোলা লাগাতে পারল কি না, সে বিচারের ভার পাঠকের। আমাদের তরফে শুধু এটুকুই বলার, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করে গেছি।

২০১৩ সালে আরেক রকম প্রকাশ করার নেপথ্যে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিত প্রেক্ষিত কাজ করেছিল। ২০১১ সালে রাজ্যে বাম সরকার ক্ষমতাচ্যুত। ২০১১ সালের আগে বামফ্রন্টের কিছু ভুলের ফায়দা তুলে রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয় এমন একটি সরকার যা স্বৈরাচার এবং দুর্নীতির নতুন মাইলফলক যে অচিরেই অতিক্রম করবে সে বিষয় চোখ-কান খোলা রাখা মানুষের কোনো সন্দেহ ছিল না। অন্যদিকে, বামপন্থীদের অচলায়তন, ঔদ্ধত্য, এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের বড়ো অংশের মাননীয়ার চেয়ার পোছার দায়িত্ব গ্রহণ এমন এক পরিবেশের জন্ম দেয় যেখানে অন্য রকম বা নতুন চিন্তা মূলধারার গণপরিসর থেকে অজ্ঞাতবাসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। এই পরিস্থিতিতে অশোক মিত্র এবং শঙ্খ ঘোষের মতন ব্যক্তিরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক জগতে নতুন ভাবনার খোরাক সন্ধানের উদ্দেশ্যে আরেক রকম প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আজও আরেক রকম সেই উদ্দেশ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখতে বদ্ধপরিকর।

তবু, মানতেই হবে ২০১৩ সালের পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নয় বছর আগের পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ গুণগত দিক দিয়ে আলাদা। একদিকে রাজ্য সরকারের স্বৈরাচার মিশ্রিত জনপ্রেমী বা পপুল্যিস্ট রাজনীতির শিকড় ২০১৬ সালে আরো দৃঢ়ভাবে রাজ্যে প্রোথিত হয়েছে। একই সময় বামপন্থীদের ক্রমাগত ক্ষয় রোধ করা যায়নি। বরং বাংলার আকাশে এখন গেরুয়া শিবিরের ঘোর ঘনঘটা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়ী হয়ে বিজেপি প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপাচ্ছে। আরেক রকম যখন নয় বছর বয়সে পা রাখছে তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিগত প্রায় ৮০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়ে আবারো সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত হওয়ার কিনারে পৌঁছিয়েছে। সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর ত্রিফলা আক্রমণের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বহমান বিবিধের মাঝে একতার সংস্কৃতির শিকড়ে কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হয়েছে বিজেপি ও সংঘ পরিবার। আরেক রকম-এর পাতায় লাগাতার এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। আগামীদিনে, ক্ষমতায় যেই থাকুক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আরেক রকম-এর কলম কখনও স্তব্ধ হবে না। আমাদের পাঠকদের কাছে এই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের সীমাহীন দুর্নীতি, পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তাদের মতাদর্শহীন সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার থেকেছে আরেক রকম। আবার ঘোষিতভাবে বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও, রাজ্য তথা দেশের বামপন্থীদের ভুলত্রুটি-স্খলন চিহ্নিত হয়েছে বারবার আরেক রকম-এর পাতায়। আরেক রকম রাজনীতির সন্ধান, ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের আরেক রকম কিন্তু যুক্তিনির্ভর এবং তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য সর্বদা আমাদের পত্রিকায় স্থান পাবে।

আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে উথালপাথাল ঘটবে, তার মধ্যেও সুস্থ চিন্তাভাবনা এবং প্রগতিশীল ও বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আরেক রকম অবিচল থাকবে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাংলায় সাম্প্রদায়িক বর্বর অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বৃত্তদের কোনো স্থান নেই। বাংলার মননে প্রগতিশীলতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভাবনার যে শিকড় রয়েছে তাকে শত বাধা বিপত্তি এলেও আগলে রাখতে হবে। বর্তমান মিডিয়া বিজেপি-র মুখপত্রে পরিণত হয়েছে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের অধিকাংশই সরীসৃপের মনুষ্যরূপ। এমতাবস্থায় আরেক রকম-এর গুরুত্ব বাড়ছে। আগামীদিনে, আরো ব্যাপক পরিসরে সুস্থ চিন্তাভাবনা, অনামী বা বিখ্যাত লেখকদের চিন্তাশীল প্রবন্ধ আরেক রকমের পাতায় শুধু নয়, আরো ব্যাপক পরিসরে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার অবকাশ রয়েছে। আমাদের আরো পরিশ্রম করতে হবে, আত্মসন্তুষ্টির কোনো জায়গা নেই। যেসমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়ব বলে ভাবছি, তারা অনেক ব্যাপকভাবে তাদের প্রচার মানুষের মধ্যে চালাচ্ছে, ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা সুচারুভাবে মানুষের মনে প্রোথিত করার একাধিক সাধন দিবারাত্রি ব্যস্ত রয়েছে। আরেক রকম-কে তাই আরো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে চিন্তাশীল কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

লকডাউনের মধ্যে আমরা পত্রিকা ছাপাতে পারিনি। এখনও আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত কারণে আমাদের পত্রিকা ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। তবু এই প্রতিকূলতার মধ্যেও বহু মানুষ আমাদের আর্থিক সাহায্য করেছেন, এবং করছেন যার মাধ্যমে আরেক রকম-এর ওয়েবসাইট পরিচালিত হচ্ছে। যারা যারা আমাদের হাত ধরেছেন, সাহায্য করেছেন, আস্বস্ত করেছেন, তাদের সবাইকে আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমরা একটি বড়ো অংশের মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছি। তবু হাতে পত্রিকা নিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকা পুনরায় ছাপানোর জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করছি। আশা করছি শীঘ্রই আপনাদের হাতে পত্রিকা তুলে দিতে পারব।

আরেক রকম আট বছর পেরলেও আরো বহু পথ পেরোনো এখনও বাকি। আপনাদের সাহায্য এবং উৎসাহকে পাথেয় করে আমরা সেই পথে অবিচল থাকতে পারব এই আশা আমাদের রয়েছে।