আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পালকের মতো কথা, তার মধ্যে পৃথিবীর নড়াচড়ার শব্দ

অলিভিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়




সময়-সমাজ তথা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আজীবন কবিতাচর্চা করেছেন অরুণ মিত্র (১৯০৯-২০০০)। এই পৃথিবী আর মানুষের সংলগ্ন যে-জীবন, সেই জীবন ও মানবমূল্যের দায়ই তাঁর কাব্যদর্শন ও শিল্পচিন্তাকে স্বতন্ত্র পথে নিয়ে গেছে -

পৃথিবী আর মানুষ আর তাদের সংস্পর্শে আমার সত্তা, এই তো আমার কবিতার মূল। সব কবিতারই মূল। এদের সংলগ্নতা থেকে ভাষায় যা প্রকাশিত হয় তাই কবিতা। [১]

একদিকে যেমন তাঁর এই ভাবনারই প্রতিফলন দেখা যায় প্রান্তরেখা (১৯৪৩), উৎসের দিকে (১৯৫৪), ঘনিষ্ঠ তাপ (১৯৬৩) থেকে শুরু করে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর (১৯৮৬) বা ভাঙনের মাটি (১৯৯৮) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে, চারের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত তাঁর সুদীর্ঘ কাব্যযাত্রায়; পাশাপাশি পৃথিবী আর মানুষের সংলগ্নতায় এই কবিসত্তারই নির্মাণ-আলেখ্য ধরা আছে তাঁর জীবনের রঙে (১৯৯৯)-র টুকরো টুকরো আত্মকথামূলক গদ্যরচনাগুলিতে, যেগুলি কবি অরুণ মিত্রের আত্মজীবনীর ভগ্নাংশ হিসেবে গণ্য হতে পারে। অন্যদিকে তিনি মনে করতেন, কবিতা লেখার পাশাপাশি কাব্য-সম্পর্কিত ভাবনাকে সর্বজনবোধ্য গদ্যে প্রকাশ করাও কবির অন্যতম কাজ, কবিতার অগ্রগতিও তবেই সম্ভব। ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে (১৯৮৫), সৃজন সাহিত্যঃ নানান ভাবনা (১৯৮৭), কবির কথা, কবিদের কথা (১৯৯৭) প্রভৃতি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলিতে কবিতা নিয়ে তাঁর নানা ভাবনা, সাহিত্যচিন্তা ও ফরাসি সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি লিপিবদ্ধ। তেমনি তাঁর খোলা চোখে (১৯৯২)-এর সাহিত্যভাবনামূলক রচনাগুলিও বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ - এগুলির উৎসমুখও সেই দর্শনের গভীরে নিহিত, যেখানে সাহিত্য ও জীবন আদৌ বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র নয়। পথের মোড়ে (১৯৯৬)-র ব্যক্তিনামাঙ্কিত রচনাগুলিতে কবি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের সেইসব সহযাত্রী বা সহযোদ্ধা এবং সমসাময়িক কবি-লেখক-শিল্পী-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিচারণ করেছেন। আর সেই সূত্রে অবধারিতভাবেই এসেছে সেই সময়ের কথা যা কবিজীবনের আধার, নিজের কথা বলতে গিয়ে আত্মকথার আত্মরতিকে অতিক্রম করে সেই সময়ের হাত ধরেছেন কবি।

প্রচলিত অর্থে আত্মজীবনী বা পূর্ণাঙ্গ আত্মকথাও রচনা করেননি অরুণ মিত্র। তবে জীবনের রঙে-র অন্তর্গত রচনাগুলিতে যশোরে অতিবাহিত জীবনের প্রথম পর্যায়, কলকাতায় শিক্ষা-সাহিত্য-সঙ্গীত-সাংবাদিকতা-বামপন্থী রাজনীতির চর্চা অর্থাৎ যাপনের প্রতিটি পরিসর মানবিক সংস্পর্শে মূর্ত হয়ে উঠেছে। যশোরের গ্রামীণ আবহাওয়া থেকেই কেমন করে তাঁর শৈশব-কৈশোর সঞ্চয় করে নিয়েছে ভবিষ্যৎ কবিতার জল-মাটি, এক ভাঙনের মাটিতে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের পটভূমি কিভাবে তাঁর সাহিত্যভাবনা ও জীবনদৃষ্টিকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে, ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সহজাত আকর্ষণ কিভাবে তাঁর কবিমনকে পরিপুষ্ট করেছে - এসবই অরুণ মিত্র সহজ সাবলীল ভাষায় খোলা মনে বলে গেছেন উল্লিখিত গ্রন্থের নিবন্ধগুলিতে। বর্তমান আলোচনায় তাঁর আত্মকথাধর্মী গদ্যরচনাগুলির সমাহারেই কবি অরুণ মিত্রকে যথার্থভাবে চিনে নিতে চেয়েছি।


[এক]

'কবির কথা, কবিদের কথা' রচনায় অরুণ মিত্র বলেছেন -

এক জন কবির মধ্যে একটি শিশুর স্থায়ী বসবাস বোধহয় দরকার। আধো-আধো কথা বলা শিশু নয়। পৃথিবী যাকে কোনও সময় আনন্দে, কোনও সময় ক্রোধে বা ক্ষোভ বা অভিমানে স্পন্দিত করবে, পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যে কখনও মজা পাবে কখনও কষ্ট, আর ক্রমাগত প্রশ্নে এবং কৌতূহলে চঞ্চল হবে, এমন শিশু। জীবনের সঙ্গে এই জীবন্ত যোগ আর কোন দৃষ্টিই বা ধরে রাখে? তাই বুঝি কবিরা অনেকেই শৈশবের দিনগুলোয় বারে বারে ফেরেন, তাজা আবেগের এক স্বভাব সত্তাকে আহ্বান করেন। [২]

জীবনের রঙে-র অন্তর্গত রচনাগুলিতে কবি অরুণ মিত্র নিজের অন্তর্গত সেই শিশুটির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বিশেষত তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ-এর ‘আপন কথা’ বিভাগের 'আমার জীবন আমার সময়', 'ভয়', 'ছোটবেলায় বড়মানুষের সামনে', 'কলকাতায় প্রথম এবং বারবার এবং বরাবর', “'অরণি’র আলোয়' প্রভৃতি টুকরো আত্মকথনমূলক রচনায় ধরা আছে কবির নিজের ভাষ্যে নিজের জীবনের কথা। এর মধ্যে 'আমার জীবন আমার সময়' শীর্ষক সূচক-রচনাটিতে অরুণ মিত্রের জন্মবৃত্তান্ত, শৈশব-কৈশোরের পরিচয় আছে। ১৯০৯ সালে যশোরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যশোর তখন একদিকে খোলা ইটের পাকা রাস্তা, দালানকোঠার পাশাপাশি কাঁচা মাটির পথ, কুঁড়েঘর, নারকেল-সুপুরি-তাল-খেজুরের সারি, জঙ্গল-ঝোপঝাড় নিয়ে আধা-শহর আধা-গ্রামে মেশানো এক মফস্‌সল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পক্ষপাত ছিলো ‘গেঁয়ো আবহাওয়া’র প্রতিই, যা পরবর্তীকালে কবিতাতেও ছায়া ফেলেছে। স্বয়ং কবির সাক্ষ্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য -

কেউ কেউ বলেছেন আমার কবিতায় নাকি বাংলার জলমাটি অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ... আমার শৈশব ও কৈশোর তাদের সংগ্রহ করে রেখেছিল।

...আমার শরীর ও মনের গ’ড়ে-ওঠাকে সেখানকার পরিবেশই নিয়ন্ত্রিত করেছিল। [৩]

জন্মের পর সাত-আট বছরের মধ্যেই লেখাপড়ার জন্য কলকাতায় চলে এলেও এবং কলকাতাই তাঁর স্থায়ী বসবাসের ক্ষেত্র হয়ে উঠলেও কলকাতা নিয়ে কোনো মোহ ছিলো না ছেলেবেলায়। যশোরের প্রতি তাঁর আত্মিক টান আলগা হওয়ার বদলে আরো পোক্ত হয়েছে, এক তীব্র ‘nostalgia’ কলকাতায় তাঁকে জড়িয়ে ঘিরে রাখতোঃ ‘এই জীবনটা আমাকে খুব টানত শ্রীকান্তের মতো’। সেই টানেই তিনি প্রত্যেক গ্রীষ্মাবকাশ আর পুজোর ছুটিতে চলে যেতেন যশোরে, তাঁর ‘নিজের জায়গায়’, সেইখানেই ছিলো তাঁর ছেলেবেলার অন্তরঙ্গ সঙ্গীসাথীরা। তাদের মধ্যে একদিকে যেমন অসম সাহসী অ্যাডভেঞ্চারপটু কয়েকজন ছিলো, তেমনি ছিলেন লেখক, দেশসেবক তথা মননশীলরাও। ফলে ছেলেবেলা থেকেই নাগরিক ও গ্রামীণ দুই ভিন্ন সংস্কৃতির সমান্তরাল ধারা এবং বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে সহজ সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতাই কোনোদিন তাঁকে সাহিত্যিক আর সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো শ্রেণিভেদ করতে শেখায়নি -

সাহিত্য যে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, নিছক শব্দের খেলা নয়, জীবনের অভিঘাতেই যে কবিতা তথা যে-কোনো সৃজনী শিল্পের জন্ম, আমার এই বিশ্বাসের ভিত্তি মনে হয় আমার অজ্ঞাতসারে সেই সময়েই গড়ে উঠেছিল। এবং তারই অঙ্গ হিসেবে এই বোধেরও যে, সাহিত্যিকরা উচ্চতর কোনো শ্রেণি নয়, সর্বসাধারণেরই এক অংশ যার একটা বিশেষ প্রবণতা ও ক্ষমতা আছে। যেমন অন্যান্য অংশের অন্যান্য বিশেষ প্রবণতা ও ক্ষমতা আছে। আমার মেলামেশায় ও আচরণে সেই বোধই আপনা থেকে রূপ নিত। কোনো জাতবিচার আমার মনে ছিল না। [4]

যশোরে অরুণ মিত্রের পৈতৃক বাড়ির পাশের পাড়াতেই ছিলো তাঁর মামার বাড়ি, নানা দিক থেকে বিশিষ্ট এই কবিব্যক্তিত্বের গড়ে ওঠার পেছনে এই বাড়ির ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ -

সেখানে অনেক রকমের অজস্র বই এবং নানান পত্রপত্রিকা ঘাঁটতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। আমার কৌতূহলেও তারা শান লাগাত। সেই সূত্রে বেশকিছু অন্য ধাঁচের মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয়, যা ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।... তাদের সঙ্গ আমার সামনে এক মস্ত পৃথিবীর দরজা খুলে ধরত। আমার পল্লবগ্রাহিতা এবং বিবিধ বিষয়ে তাদের গম্ভীর চিন্তা ও কাজের রেশ যে মানসিক আবহাওয়া তৈরি করেছিল তারই মধ্যে আমার মস্তিষ্কের কোষগুলো আস্তে আস্তে বয়স্ক হতে থাকে। [৫]

মামার বাড়ির মুক্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তাঁকে সাহিত্যের প্রতি উৎসুক ও উৎসাহী করে তুলেছে। সেখানে 'প্রবাসী' (১৯০১), 'ভারতবর্ষ' (১৯১৩) প্রভৃতি পত্রিকা আসতো নিয়মিত; 'এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা' ছাড়াও ছিলো নানা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-গোয়েন্দাকাহিনির সম্ভার, যার প্রতি স্বভাবতই বালকমনের আকর্ষণ ছিলো, অধিকারও ছিলো নিরঙ্কুশ। আমরা অনেকেই জানি, বিভিন্ন বিষয়ে অরুণ মিত্রের আগ্রহের অন্যতম প্রধান একটি হলো সঙ্গীত, মূলত রাগসঙ্গীত। এই আগ্রহের বীজও সম্ভবত মামার বাড়িতেই উপ্ত হয়েছে, সেখানে একটি গ্রামোফোন ও অনেক গানের রেকর্ড ছিলো। অন্যদিকে এখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চেতনার ভিতটিও প্রস্তুত হতে থাকে। সন্ত্রাসবাদী, গান্ধীবাদী, সাম্যবাদী নানা ভাবধারার ‘তরুণদের মিলনক্ষেত্র’ এই বাড়িতে বহির্জগতের তথা রাজনৈতিক নানা তরঙ্গ এসে পৌঁছোতো। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার ছিলেন সাহিত্যানুরাগী এবং যশোরের এক সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। সেই সূত্রে বিপ্লবী দল পরিচালিত কিশোর-পত্রিকা "বেণু"-তে অরুণ মিত্রের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় (১৯২৫), কবি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সেই অনুপ্রেরণাতেই কয়েকজন বন্ধু মিলে তাঁরা নিজেরাই কলকাতা থেকে 'কলাপী' নামে মাসিকপত্রও প্রকাশ করেন, যদিও সেটি ছিলো স্বল্পায়ু। আর মামার বাড়ির প্রসঙ্গে তরুণদের প্রেরণাদাতা হিসেবে ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন কবিঃ ‘সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে এক জীবন্ত আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি’ [৬]। 'কল্লোল' (১৯২৩) ও 'ভারতবর্ষ'-এ ফণীভূষণের লেখা প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি, তাঁর কাছে শোনা কল্লোল-এর আড্ডার বিবরণ কিশোরমনে মুগ্ধতা জাগিয়েছে।

আত্মকথায় অরুণ মিত্র জানিয়েছেন, কবিতার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ বালকবয়স থেকেই। আর ‘তখনকার কবিতা-অনুরাগী সব বাঙালি ছেলের মতো আমারও প্রথম প্রেম রবীন্দ্রনাথ' [৭]। নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬), মোহিতলাল (১৮৮৮-১৯৫২), সত্যেন্দ্রনাথ (১৮৮২-১৯২২) প্রমুখের কবিতা পড়লেও, তা তাঁকে রবীন্দ্রকবিতার মতো আচ্ছন্ন-অভিভূত করে রাখতো না। সেই সময় থেকেই তাঁর নিয়মিত কবিতাচর্চার ফলে উনিশ বছর বয়সে একটি মোটা খাতায় ভরে উঠেছিলো সেই কবিতার সঞ্চয়, যদিও বাড়ি বদলের সময় খাতাটি হারিয়ে যায়। নিজের প্রাথমিক সেই কাব্যপ্রকাশ বা প্রয়াস কেমন ছিলো, পিছন ফিরে তাকিয়ে কবি তার জন্য পরিণত কৌতূহল প্রকাশ করলেও, একইসঙ্গে এও স্বীকার করেছেন যে, ‘আসলে তখন লেখার বা ছাপার হরফ ছাড়িয়ে যে-জীবন সেটাই আমাকে বেশি কৌতূহলী করে রাখত’ [৮]। আমরা জানি, শুধু সেই বয়সেই নয়, এই জীবনাগ্রহই তাঁর আজীবনের কাব্যসাধনার উপজীব্য। আসলে প্রাত্যহিক জীবনানুভূতিতে পরাধীনতার গ্লানি এবং মুক্তির সংগ্রামী চেতনাই তাঁকে প্রতিদিনের বাঁচা-মরা থেকে সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে শেখায়নি -

পরাধীনতার যন্ত্রণা এখন নেই যা ছিল আমাদের প্রতিদিনের যন্ত্রণা। পরশাসন এবং নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্যে ব্যাকুলতা ও সংগ্রাম ছায়া ফেলে থাকত আমাদের পুরো মানসপটে। এই সমস্ত নিয়ে যে-জীবন, সাহিত্যকে তারই এক অচ্ছেদ্য অংশ বলে আমার মনে হত, তার বেশি নয়। [৯]

অরুণ মিত্র স্পষ্টতই বলেছেনঃ ‘শিল্প-সাহিত্যে সৃজনশীলতা এবং চিন্তাপ্রক্রিয়ার উৎস শৈশবের বিদ্যালয় আর অভিজ্ঞতার মধ্যে কোথাও যেন আত্মগোপন করে থাকে' [১০]। আর এ-প্রসঙ্গে তিনি একেবারে ছেলেবেলায় স্কুলে পড়াকালীন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯২৪) এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪)-এর সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। যশোর থেকে কলকাতায় আসার দু’বছর পর কবি তখন তাঁর বাবার কর্মস্থল সাঁওতাল পরগনার মধুপুরে একটি স্কুলে তখনকার পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন, এগারো-বারো বছর বয়স। সেই স্কুলেরই এক শিক্ষক তথা কবির পিতৃবন্ধুর বাড়িতে প্রফুল্লচন্দ্র ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, বালক অরুণ সে-বিষয়ে জ্ঞাত নয় জেনে তিনি ইতিহাসের নানা ঘটনা সম্বন্ধে জানার আবশ্যকতার কথাও তাঁকে বলেন।পরবর্তীকালে ফরাসি ভাষা-সাহিত্য তথা সংস্কৃতির প্রতি অরুণ মিত্রের উৎসাহ ও চর্চা সর্বজনবিদিত। কিশোর বয়সে অনন্যসাধারণ ওই দুই ব্যক্তিত্বের অনুপ্রেরণাও পরোক্ষভাবে তাঁর চিন্তাচর্চায় ছাপ ফেলেছে বলে মনে করেছেন কবি।


[দুই]

মধুপুর থেকে আবার কলকাতা ফিরে অরুণ মিত্র বঙ্গবাসী স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভরতি হন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে (১৯২৬) বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তির পর এতদিনের ‘অনাত্মীয় শহর’ কলকাতা তার গড়ের মাঠ, ফুটবল-ক্রিকেট-হকি, মিনার্ভা-গ্লোব-এলিট-নিউ এম্পায়ার - এই সমস্ত কিছু নিয়ে নিজেকে একটু একটু করে মেলে দিতে থাকে তাঁর কাছে। কলেজে পড়াকালীন নিয়মিত গড়ের মাঠে গোষ্ঠ পাল (১৮৯৬-১৯৭৬) বা ধ্যানচাঁদ (১৯০৫-৭৯)-এর খেলা, যোগেশ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪২), শিশির ভাদুড়ী (১৮৮৯-১৯৫৯), অহীন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৬-১৯৭৪) বা উদয়শঙ্কর (১৯০০-৭৭) প্রমুখ প্রতিভাকে সামনে থেকে দেখা, বিদেশি নানা সিনেমার পাশাপাশি দেশীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের গান-বাজনা শোনার সুযোগ যেমন ঘটেছে; তেমনি একবার সাহিত্য পরিষদে বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২)-এর বক্তৃতার কথা স্মরণ করেছেন অরুণ মিত্র। আসলে এ-সময় সঙ্গীত-নাটক-চলচ্চিত্র তথা সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি সবকটি শাখা থেকেই আত্মবিকাশের রস ও রসদ খুঁজে নিয়েছেন কবি। পরবর্তীকালে সঙ্গীত-নৃত্য-চিত্র বা ভাস্কর্য তাঁর অনেক কবিতায় বিষয় হিসেবে এসেছে। জীবনের রঙে-র ‘নাটক সিনেমা সঙ্গীত’ বিভাগের রচনাগুলিতেও এইসব সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমগুলি আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার সূত্রে।

অরুণ মিত্র কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপকগণ যথা ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লকুমার ঘোষ, বিপিনবিহারী গুপ্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ, যাঁদের অনেকেই ছিলেন সেসময়ের বিশিষ্ট লেখকও, তাঁদের স্মৃতিচারণ করেছেন 'শিক্ষক-লেখক রহস্য' শীর্ষক নিবন্ধে। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ (১৯২৮) এবং রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ইংরাজি অনার্সে ডিস্টিংশন সহ বিএ পাশ করে (১৯৩০) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি নিয়ে এমএ-তে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক পরিস্থিতির চাপে এমএ পড়তে পড়তেই তাঁকে 'আনন্দবাজার'-এ চাকরি নিতে হয় (১৯৩২)। 'আনন্দবাজার'-এ সাংবাদিকতা এক নতুন উদ্দীপনার জোয়ার এনে দিয়েছে তাঁর জীবনে। স্বাধীনতা অর্জন, সমাজ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য মোচনের সংকল্পই সকল কর্মীকে সেসময় এক ঐক্যসূত্রে বেঁধে রেখেছিল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৯২-১৯৫৪) সম্পাদিত 'আনন্দবাজার'-এ। শেষ পর্যন্ত আর এমএ পরীক্ষা দিতে পারেননি অরুণ। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি ছাড়িয়ে তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্মোদ্যমে তখন দেশীয় ও বৈশ্বিক স্পন্দনের দোলা লেগেছে -

আমি স্বদেশবাসীর দারিদ্র্য ও দুর্দশা নিরসনের ভাবনা থেকে সারা পৃথিবীর জনসাধারণের দুরবস্থা দূর করার এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনায় উপনীত হয়েছি এবং সাম্যবাদকে জীবনাদর্শ রূপে গ্রহণ করেছি। এই পত্রিকার মাধ্যমে সর্বসাধারণকে সচেতন ও সক্রিয় করা আমার এক কর্তব্য বিবেচনা ক’রে আমি তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি এবং তা এই পত্রিকার মহত্ত্বেরই পরিপূরক ব’লে আমার মনে হয়েছে। [১১]

পাশাপাশি সাংবাদিকের এই উন্মুক্ত বস্তুনিষ্ঠ জীবনদৃষ্টি তাঁর কাব্যের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে ফ্যাসিবাদের উগ্র অভ্যুত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কলকাতায় ইংরেজ প্রশাসক আর দেশীয় মুনাফালোভীদের বানিয়ে তোলা দুর্ভিক্ষ, পথেঘাটে অগণিত ক্ষুধাতুর মানুষের শব - এসবই খুব কাছ থেকে দেখেছেন দৈনিক সাংবাদিকতার সূত্রে। 'আনন্দবাজার'-এ দীর্ঘ এগারো বছর (১৯৩২-১৯৪৩) কাজ করেন। সেই সময়েই মার্কসবাদ নিয়ে গভীর অধ্যয়নের পাশাপাশি রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে, যদিও কোনোদিনই পার্টির সদস্য ছিলেন না। মার্কসীয় চিন্তাচর্চার আলোচনাচক্র ‘অনামী চক্র’ (১৯৩৭)-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই বছরই প্রগতি লেখক সংঘের উদ্যোগে প্রকাশিত প্রগতি সংকলনে আঁদ্রেজ়িদ (১৮৬৯-১৯৫১)-এর একটি প্রবন্ধের অরুণ মিত্র কৃত অনুবাদ ও তাঁর একটি কবিতা গৃহীত হয়।

'আনন্দবাজার'-এর পরিচালকদের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে সত্যেন্দ্রনাথ পদত্যাগ করেন (১৯৪০) এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিকী 'অরণি' (১৯৪১) পত্রিকা প্রকাশ করেন। অরুণ মিত্রও 'আনন্দবাজার' ছেড়ে (১৯৪৩) যোগ দেন 'অরণি'-তে, যা ছিলো সাম্যবাদের আদর্শে পরিচালিত। এই পত্রিকার সূত্রেই তখন সরোজ দত্ত (১৯১৪-১৯৭১), সুশীল জানা (১৯১৬-২০০৮), সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭), সিদ্ধেশ্বর সেন (১৯২৬-২০০৮), মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯২০-২০০৩) প্রমুখ লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে, যাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রগতিশীল সমাজ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার অনুগামী। 'অরণি’র আলোয়' শীর্ষক নিবন্ধে অরুণ মিত্র তাঁর সেই সময়ের যাপনচিত্র তুলে ধরেছেন -

লেখা আলোচনা, তর্কবিতর্কের এক বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায় আমরা প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাস নিতাম। কী করে দেশকে এবং দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে, কী করে সর্বসাধারণকে সচেতন করে সমাজতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করা যাবে, এ সম্বন্ধে প্রতিদিন আমরা ভাবছি, আলোচনা করছি, লিখছি। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি যে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বস্তু নয়, মানুষের সঙ্গে তথা পৃথিবীর সমস্ত বাস্তবের সঙ্গে তার সংযোগ যে গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য, এই কথা আমরা নানাভাবে বলেছি এই পত্রিকার মাধ্যমে। প্রবন্ধে গল্পে উপন্যাসে কবিতায় অনুবাদ-রচনায়, এই মনোভাবই প্রতিফলিত হত প্রতি সংখ্যায়। কিন্তু দলীয় কোনো যান্ত্রিকতার প্রশ্রয় তাতে ছিল না। সে-ভাবনা দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে তর্কও দেখা দিত। নতুন ভাবনা ও নতুন রচনা সাদর অভ্যর্থনা পেত ‘অরণি’র কাছে। বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তার আকর্ষণ তো ছিলই, তার সঙ্গে গোঁড়ামি মুক্ত শিল্পদৃষ্টির আবহাওয়া কম আকর্ষণের নয়। এই ভাবনা এবং তার প্রকাশকে ঘিরে কত লেখক-বন্ধুর সমাবেশ...। আমাদের সকলেরই এ যেন চিন্তা ও কর্মের এক যুগলবন্দী আনন্দ। [১২]

অন্যদিকে মানবমূল্যকে রক্ষা করার বিবেকী দায় থেকেই কবি যোগদান করেছেন 'সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি' (১৯৪১) এবং 'ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ'-এ, যার পূর্ব-পটভূমিধরা আছে তাঁর 'সময় ও সাহিত্যের আরেক অধ্যায়' (সৃজন সাহিত্যঃ নানান ভাবনা) প্রবন্ধে। সেই সূত্রেই তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৭-৭৮), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-৫৬), স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য (১৯০৮-৬৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধী প্রধান (১৯১২-৯৭), চিন্মোহন সেহানবিশ (১৯১৩-৮৭), শম্ভু মিত্র (১৯১৫-৯৭), বিনয় ঘোষ (১৯১৭-১৯৮০), বিনয় রায় (১৯১৮-৭৫), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩), হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-৮৯) প্রমুখ অনেকের সঙ্গে গভীর আত্মিক সংযোগ গড়ে ওঠে অরুণ মিত্রের। এখান থেকেই পরে জন্ম হলো গণনাট্য সংঘের। 'পথের মোড়ে'-র রচনাগুলিতে কবি তাঁর সেই সহযাত্রীদের স্মৃতিচারণ করেছেন। ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চেপে সমস্বরে সেসময়ের সুবিখ্যাত গণসংগীত গাইতে গাইতে রাতে বাড়ি ফেরার সেই ছবি কিছুটা অন্যভাবে কবি ধরে রেখেছেন তাঁর 'এখন দ্যাখো' (যদিও আগুন ঝড় ধসাভাঙা) কবিতায়।

কিন্তু সম্মিলিত সাহিত্যসৃষ্টি বা দল বেঁধে কোনো কাব্যান্দোলনে কোনোদিনই আস্থা ছিলো না কবি অরুণ মিত্রের, আত্মকথায় একাধিক প্রসঙ্গে সে-কথা বলেছেন। তাঁর কবিতাভাবনার মূলে ছিলো একান্ত ব্যক্তিগত পথের অনুসন্ধান -

...নিজের পক্ষ থেকে কথা বলার উপায় অন্বেষণ এবং তার অবলম্বনে অন্যকে সে-কথা জানানো। আমার সামনে যে-সমস্যা ছিল তা রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার নয়, তা কবিতা লেখারই।... কবিতা তো কাউকে অতিক্রম করার জন্য লেখা হয় না। লেখা হয় নিজের অনুভূত অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার জন্য এবং তা অন্যের মনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কী ক’রে নিজের কথা ঠিকমতো বলা যায়, এ চেষ্টা সব কবিরই। কিন্তু অন্যের কাছে পৌঁছোনোর সমস্যাটা বড় বিভ্রান্তিকর। আমাকে সেটাই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিয়েছে। আজও দেয়। এই পৌঁছোনোর সীমাবদ্ধতায় প্রতিহত হয়ে আমি বারে বারে এক ব্যর্থতাবোধে কবিতার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। অবশ্য সেভাবে বেশি দিন থাকতে পারিনি, আবার তার দিকে ফিরেছি। সে-সময় এ সমস্যার মূল কারণগুলো, সামাজিক কারণগুলো বুঝিনি। আজ কতকটা বুঝি। ফলে সংযোগ স্থাপনের সমস্যা যদিও আমাকে পীড়িত করে, তবু ব্যর্থতাবোধ আমাকে চেপে ধরে না। [১৩]

মানুষের সঙ্গে সমাজের সঙ্গে সৌহার্দ্য আর সংযোগ স্থাপনেই সে ব্যর্থতাবোধ থেকে উজ্জীবনের উপায় খুঁজে নিয়েছেন কবি। অন্যান্য লেখালেখিতেও নিজের কবিতাভাবনা সম্পর্কে তাঁর এই প্রত্যয় প্রকাশিত -

আমি মনে করি মানবভাবনার পটভূমিতেই সমস্ত সৃজনের অর্থময়তা। মানুষের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ভাবনাই সৃষ্টির স্তরে যায় না।...

...মানবভাবনা এক মানসিক আবহাওয়ার ব্যাপার, যার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তের জীবনধারণের সংস্পর্শ।...

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষেরই সৃষ্টি এবং তার ভাবনাও মানুষকে ঘিরে। এই মানবভাবনা থেকে মনকে বিক্ষিপ্ত ক’রে দেওয়ার নানা প্রয়াস সর্বদাই চলে। কখনো কখনো কলাকৈবল্য ইত্যাদি শিল্পসংজ্ঞার নামে। এ-কথা সত্যিকার সাহিত্যিক বা শিল্পী বলবেন না যে, সাহিত্য অথবা শিল্পকে কোনো এক বাঁধা ছকে চলতে হবে এবং যে কোনো অভিনবত্ব বর্জনীয়। পরীক্ষানিরীক্ষা নিশ্চয়ই করতে হবে, নতুন নতুন শৈলী, নতুন নতুন বাক্‌রীতি প্রবর্তন করতে হবে, দৃষ্টিসীমাকে আরো প্রসারিত করতে হবে। কিন্তু এ-সমস্ত যদি মূলগতভাবে মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়, তাহলে কি কোনো কিছুর অর্থ হয় শেষ পর্যন্ত? মানবিক পরিস্থিতির দিকে চোখ বুজে থেকে সাহিত্য কত দূর আর চলতে পারে?... পৃথিবীতে এমন কোনো মহৎ লেখক কি জন্মেছেন, যাঁর সৃষ্টি মানবভাবনায় সম্পৃক্ত হয়নি! মানবিক দায়বদ্ধতা সাহিত্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয় এবং বাইরে থেকে তা চাপিয়ে দিয়ে কোনো প্রকৃত সৃষ্টিও হয় না। সাহিত্যের নিজস্ব প্রকৃতিতেই তা নিহিত থাকে। ভিক্‌তর য়্যুগোর বাক্যের প্রতিধ্বনি ক’রে বলি, প্রতিভা এক দায়িত্ব, তা এড়িয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই। [১৪]

বলাই বাহুল্য, এই মানবভাবনা ও মানবপ্রত্যয় তথা ‘মানবিক সংবেদন’ই অরুণ মিত্রের যাবতীয় কবিতাকর্মের মূল ভিত্তি। কিন্তু সেজন্য কোনোদিন কোনো সাহিত্যিক গোষ্ঠীভুক্ত হননি। কবিতাকে চিরকাল তাঁর একলার ভাবনা বা প্রয়াস হিসেবেই দেখেছেন, যা মূলত রসদ পেয়েছে ফরাসি চিন্তা-চেতনার দ্বারা। আত্মকথায় কবি স্পষ্টতই জানিয়েছেন, ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে তাঁর ‘সাহিত্যিক চিন্তা ও মনোভাব পুষ্টি আহরণ করেছে।’ [১৫] আর মানুষী উত্তাপই কবিকে ফরাসি কবিতার দিকে আকৃষ্ট করেছে।

তাঁর আত্মকথা থেকেই জানতে পারি, ছেলেবেলাতেই ভিকতর য়্যুগো (১৮০২-৮৫)-র 'লে মিজেরাব্‌ল' উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ পড়ে প্রাথমিকভাবে ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিএ পড়ার সময় থেকেই নিজস্ব উদ্যোগে ফরাসি ভাষা শেখার চেষ্টা করেন, কলেজে বিভিন্ন ফরাসি গ্রন্থ পাঠ করতে শুরু করেন। কলেজ পত্রিকায় ফরাসি লেখক আলফাঁজ দোদে (১৮৪০-৯৭) বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন ইংরাজিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতার ফরাসি মহলের সঙ্গে অরুণ মিত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ-এর সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে যান, প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের গবেষণার জন্য। এরপর, দেশে ফিরে (১৯৫২) কবি অরুণ মিত্রের পরবর্তী জীবনের দীর্ঘ কুড়ি বছর (১৯৫২-১৯৭২) অতিবাহিত হয় এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপনায়। কিন্তু যাবতীয় দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেও তিনি এ-প্রসঙ্গে একাধিকবার বলেছেনঃ জাত-শিক্ষক তিনি নন, তিনি কবি - সেই তাঁর একমাত্র সত্যকার পরিচয়।


[তিন]

সাম্যবাদী অনুপ্রেরণা, সর্বমানবের মুক্তি ও সমানাধিকারের মার্কসীয় দর্শন অরুণ মিত্রের কবিচৈতন্যে প্রধানতম এক নির্ণায়ক ভূমিকায় দেখা দিয়েছে, যার নেপথ্যে সক্রিয় দেশ-কাল সম্পর্কে তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল এক সাংবাদিকের সজাগ দৃষ্টি। বিপন্ন মানুষের সংকটতথা মানব-অস্তিত্বের কথাই ভাষা পেয়েছে চারের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত তাঁর সুদীর্ঘ কবিতাযাপনের পরতে পরতে। কবিতাকে ব্যক্তিগত নিভৃত সাধনার বিষয় হিসেবে দেখলেও ফরাসি কাব্যপাঠের সুসমৃদ্ধ অভিজ্ঞতায় তিনি জেনেছিলেন -

...যখন এই একক সাধনাকে ছিন্নভিন্ন ক’রে মানব সমাজের সংকট দেখা দেয়, তখন এমন কবিরাই সমূহ বিপদ প্রতিহত করতে কবিতাকে অস্ত্র ক’রে তোলেন। গত মহাযুদ্ধে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা পেলাম ফরাসি কবিদের কাছ থেকে প্রতিরোধ সংগ্রামে। এমনকি, যাঁরা সমাজ-ভাবনা নিয়ে আদৌ ব্যাপৃত ছিলেন না, তাঁরাও এই ভূমিকায় অংশ নিলেন। [১৬]

কবি অরুণ মিত্রের মতে - সব মানুষ স্বাধীনভাবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবে, সেই পৃথিবীর ভাবনাই সাহিত্যের প্রগতি চিহ্ন। এই ভাবনারই প্রতিফলন দেখি তাঁর উৎসের দিকে, ঘনিষ্ঠ তাপ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে। সাম্যবাদের প্রতি কবি আস্থা রেখেছেন সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত সমাজের বাস্তব রূপায়ণকল্পে। কিন্তু পার্টির মতাদর্শের প্রচারসর্বস্ব কবিতা বা কবিতার নামে স্লোগান রচনায় তাঁর সম্মতি ছিলো না। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত শিল্পী মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ তাঁর অন্তরের সংবেদনায়, সার্থক শিল্প সব সময়ই প্রগতিশীল। কিন্তু সেই শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্টির বিধান নয়, শিল্পীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন কবি। তাঁর মতে কবিতা রাজনীতি নয়। রাজনৈতিক দাবিতে নয়, কবিতা লেখা হয় জীবনের দাবিতেই। কবিতার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট শিল্পাদর্শের নামে কোনোরকম যান্ত্রিকতার বিরোধী ছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৪৭-৪৮-এর আরাগঁ-গরোদি বিতর্কে তিনি গরোদিকে সমর্থন করেন। [১৭] শিল্প তথা কবিতার ক্ষেত্রে আজীবন সৎ ছিলেন বলেই কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী থেকেও পরবর্তীকালে সরে এসেছেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে -

কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসেছিলাম পার্টির কোন দোষে নয়। একথাই মনে হয়েছিল যে বিপ্লবী হবার মতো শক্তি আমার নেই, সম্পূর্ণভাবে যে আত্মনিয়োগ করব সেই চরিত্র আমার নয়। এর কারণ হলো গান, কবিতায় আমার আকর্ষণ। বিপ্লবীর চরিত্র আমার নয়। তা যদি চেষ্টা করতাম তাহলে সেটা হত চরম ভণ্ডামি। [১৮]

নিজ কবি-আত্মার প্রতি বিশ্বস্ততাই, তাঁর মতে কবিজীবনের একমাত্র পাথেয়।

পরবর্তী পর্যায়ে ফ্রান্সে গবেষণা করতে গিয়ে বাংলার রাজনৈতিক ওঠাপড়া থেকে দূরে সরে গেলেও, জনজীবন তথা মানুষের সংলগ্নতা থেকে কবিসত্তার শিকড় কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই প্রত্যক্ষ উচ্চকণ্ঠ রাজনীতি থেকে সরে এসেও, শান্ত অনুচ্চ স্বরে গভীরচারী পালকের মতো কথায় উজ্জীবনের দিশা খুঁজে নিয়েছেন, মানব-অস্তিত্বের ঘনিষ্ঠ তাপে -

এই তো নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো উচ্চারণ করেছিঃ মানুষ
আমি তোমার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে পেরেছি
তুমি প্রসন্ন হও। [১৯]

অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তীর এক প্রশ্নের উত্তরে কবি একবার বলেছিলেন, ‘না, যুক্তি-বুদ্ধির প্রাধান্য নয়, হৃদয় দিয়েই আমি বাঁচতে চাই’ [২০]। কবিতাকে কোনোদিনই তিনি নিছক বুদ্ধিপ্রসূত কিংবা শব্দের খেলা বা চাতুরি বলে ভাবতে পারেননি, কাব্যে শব্দসর্বস্বতা তাঁর কাম্য নয়। শব্দকেও মানুষ তথা জীবনের সঙ্গে সংলগ্ন করে ভেবেছেন তাঁর কাব্যসৃজনে। তাই কবিতার সৃজনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অরুণ মিত্র বলেছেন -

আমার সময়ে পৃথিবী আর মানুষের সংস্পর্শে রয়েছে আমার সত্তা। এই সংস্পর্শ কবি-মনে কথা বলবার ইচ্ছে জাগিয়ে দেয়।... অতএব আমি আমার কালের মানুষ এবং মানবজীবনের সঙ্গে না জড়িয়ে কবিতাকে ভাবতে পারি না। সহ-অনুভূতি তার ভিত্তি। সুতরাং কবিতায় বুদ্ধিকে প্রধান করতে বা দেখতে আমি নারাজ। শব্দ-সর্বস্বতাও ওই কারণে আমাকে বিমুখ করে। [২১]

কবিতার ক্ষেত্রে অরুণ মিত্র কোনো ফর্মের সংস্কার বা প্রথাসিদ্ধ ছককে স্বীকার করেননি। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন বিষয়গতভাবে ফরাসি কবিতার সঙ্গে তিনি মানবিক উত্তাপের নৈকট্য অনুভব করেছেন, অন্যদিকে তেমনি সুদীর্ঘকাল ফরাসি সাহিত্যের চর্চা তাঁকে কবিতায় নিজস্ব ফর্মের সন্ধান পেতে সহায়তা করেছে, বিশেষত আর্তুর র্যাঁকবো (১৮৫৪-৯১), স্যাঁ-ঝন্‌ পের্স (১৮৮৭-১৯৭৫), পল এল্যুয়ার (১৮৯৫-১৯৫২), আঁরি মিশো (১৮৯৯-১৯৮৪), ঝাক্‌ প্রেভ (১৯০০-৭৭), র্যেনে শা (১৯০৭-৮৮) প্রমুখ ফরাসি কবিদের গদ্যকবিতার সুগভীর অধ্যয়ন ও অনুবাদের সূত্রে। ফরাসি কবিতা তাঁকে শিখিয়েছে, কবিতার কোনো নির্ধারিত ছক বা ফর্ম হয় না। তাঁর মনে হয়েছে ধরাবাঁধা ছন্দমিলে জীবনের বিশালতা আর বৈচিত্র্য কাব্যে আর যেন ধরা যায় না, তাই ছন্দে যা বলতে পারেননি, তাকে গদ্যে বলতে চেয়েছেন। এটাই তাঁর কবিতায় পদ্য থেকে গদ্যের দিকে যাওয়ার কারণ, বলেছেন কবি। তাঁর এই মনোভাবই সম্যক ভাষারূপ পেয়েছে 'পুরনো নতুনের টানে গদ্য' (প্রথম পলি শেষ পাথর) কবিতাটিতে।

পরিশেষে বলা যায়, অরুণ মিত্র বিশ্বাস করতেন জীবন সম্বন্ধে তত্ত্বকথা বলা কবিতার কাজ নয়। বরং জগৎ ও জীবনের যাবতীয় প্রকাশ যথা নিসর্গ-প্রাণী-মানুষ, পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রেম-অপ্রেম সমগ্র কবিসত্তায় যে-উন্মোচন ঘটায়, কবিতার মাধ্যমে তা আলোর মতো সকল অস্পষ্টতা-অস্বচ্ছতা-অন্ধতার বাধা পেরিয়ে অপরকেও দেখতে ও দেখাতে সাহায্য করে; একেই তিনি বলেন ‘কবির প্রজ্ঞা’। সেই কবির প্রজ্ঞায় কবিতায় যেমন তিনি স্পর্শ করেছেন মানবিক সংস্পর্শের সমস্ত কিছুকে; তেমনি স্বচ্ছন্দ গদ্যে জীবনের বিভিন্ন বিচিত্র প্রকোষ্ঠকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন নিজের প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলিতেও, যেগুলির মধ্যে মিলেমিশে আছে তাঁর কবিমানসের বিশিষ্ট পরিচয়।

এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে (১৯৭২) নানা জায়গায় অস্থায়ী বাসের পর্ব চুকিয়ে, অবশেষে কবির নিজস্ব এক চিলতে স্থায়ী বাসস্থান হয় তিলজলার ছোটো দু-কামরার সরকারি আবাসনে (১৯৭৭)। অপরিসর গৃহেস্থান-সংকুলানের সমস্যায় ফরাসি গ্রন্থের বিপুল সংগ্রহ, কত পত্র-পত্রিকা রাখতে পারেননি। ছুটির দিন অনুরাগী-অনুজদের সমাগমে অসুবিধা সত্ত্বেও ‘পায়রার খুপরির মতো’ সেই ছোট্টো ফ্ল্যাটের মধ্যেই সহজ আন্তরিকতায় প্রিয় মানুষদের কাছে টেনে নিতে পারতেন। অবন্তীকুমার সান্যালের মতো কারো কারো স্মৃতিচারণায় যেমন সেই ছবি ধরা আছে, তেমনি অরুণ মিত্রের নিজের কোনো কোনো কবিতাতেও -

বড্ড ছোট আমার ঘর। এখানে আমার প্রিয়দের আমি ধরাই কী করে? কতরকম কায়দা করি, কিন্তু কোনো সুরাহা হয় না।... সিমেন্টের মেঝেটা টেনে বাড়ানোর কিংবা কংক্রিটের দেওয়ালগুলো ঠেলে হটানোর ক্ষমতা আমার নেই। তারা অনড়। বাকি থাকে এক নিজের শরীর। সেটাকে চেপেচুপে হাত মুচড়ে পা দুমড়ে একটু ছোট করতে পারি, কিন্তু সে আর কতটুকু?...

অগত্যা পৃথিবীর দিকে ঘুরি, মেঘ-রোদের দিকে ঘুরি, তাদের বলিঃ তোমরা চলে এসো, সমস্ত ফসলের আহ্লাদ বুকে ধরে চলে এসো। তারাদের ডেকে বলিঃ তোমরা মায়াবী আকাশটা নিয়ে ঢুকে পড়ো। সবাইকে বলিঃ তোমাদের কোনো অন্তরায় এখানে নেই।... এসো পাহাড় সমুদ্র এসো অরণ্য পশুপাখি, আমার প্রাণবায়ু আমার উচ্চারণ সব ফটক খুলে দিয়েছে, এসো।...

এই আমার ঘর, ছোট ঘর বটে, কিন্তু কখন দেয়াল ভেঙে ছাত ভেঙে সে দুনিয়ায় দুনিয়ার পর আরো দুনিয়ায় ভিড়ে গিয়েছে। আমার প্রিয়রা তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের সবার ঠাঁই আমার ঘরে।... [২২]

এটিই অরুণ মিত্রের প্রশস্ত কবিহৃদয়ের যথার্থ স্বরূপ-পরিচয়। আসলে পৃথিবী আর মানুষকে নিয়েই তো তাঁর কবিতার ঘর-সংসার। আর এখানেই এক হয়ে যায় তাঁর কবিজীবন ও কবিতা। অরুণ মিত্রের কবিতাই আসলে তাঁর যথার্থ আত্মকথা - ‘পালকের মতো কথা, তার মধ্যে পৃথিবীর নড়াচড়ার শব্দ’।


সূত্রঃ
১) অরুণ মিত্র, কবিতা, আমি ও আমরা, প্রবন্ধসংগ্রহ ১, পৃ. ১৫৫।
২) অরুণ মিত্র, 'কবির কথা, কবিদের কথা', কবির কথা, কবিদের কথা, প্রবন্ধসংগ্রহ ১, পৃ. ১৪।
৩) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', জীবনের রঙে, প্রবন্ধসংগ্রহ ২, পৃ. ১২৩-১২৪।
৪) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫।
৫) অরুণ মিত্র, 'শৈশব স্মৃতি', পথের মোড়ে, প্রবন্ধসংগ্রহ ২, পৃ. ৪৩৯।
৬) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', জীবনের রঙে, প্রবন্ধসংগ্রহ ২, পৃ. ১২৫।
৭) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬।
৮) অরুণ মিত্র, প্রাগুক্ত।
৯) অরুণ মিত্র, প্রাগুক্ত।
১০) অরুণ মিত্র, 'ছোটবেলায় বড়মানুষের সামনে', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪।
১১) অরুণ মিত্র, 'অরণি'র আলোয়', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।
১২) অরুণ মিত্র, 'অরণি'র আলোয়', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩।
১৩) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯।
১৪) অরুণ মিত্র, 'সাহিত্যসৃজনঃ ভাবনা ও নির্মাণ', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১-১৯৩।
১৫) অরুণ মিত্র, 'আমার জীবন আমার সময়', প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮-১২৯।
১৬) অরুণ মিত্র, 'জীবন-ছন্দে ফরাসি কবিতা', জীবনের রঙে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪-২১৫।
১৭) এর কারণ হিসেবে সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তী ফরাসি সাহিত্যে অরুণ মিত্রের সুগভীর অনুধ্যানের কথা উল্লেখ করেছেন -
'তরুণ বয়স থেকেই ফরাসির মতো একটি সমৃদ্ধ ও সুপরিণত সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগের ফলে তাঁর (অরুণ মিত্রের) মনের মধ্যে খোলা হাওয়া চলাচলের দরজা কিছুতেই রুদ্ধ হতে পারেনি। ফ্রান্সের শিল্পী-সাহিত্যিকরা চিরকাল বন্ধন-অসহিষ্ণু। সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা যদি স্বৈরাচার ও পুঁজিবাদের হাতে বিপন্ন হয়, সেখানে তাঁরা প্রতিবাদী। আবার, লেখক-সত্তার স্বাধীনতার ওপর কোনো অনুশাসনের হস্তক্ষেপও তাঁদের সহ্য হয় না।' (সুমিতা চক্রবর্তী, 'প্রগতি-আন্দোলন ও অরুণ মিত্রের কবিতা', দ্র. কবি অরুণ মিত্র, সম্পাদনাঃ শঙ্খ ঘোষ - অরুণ সেন, পৃ. ৭০।)
১৮) 'একান্তে কবি অরুণ মিত্রের সঙ্গে', ডা. জয়ন্ত সেনের নেওয়া অরুণ মিত্রের সাক্ষাৎকার, আবর্ত - শারদ সংখ্যা, ১৪০৪, পৃ. ৬৭।
১৯) অরুণ মিত্র, 'আর এক আরম্ভের জন্য', উৎসের দিকে, অরুণ মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃ. ৩২।
২০) সুমিতা চক্রবর্তীর 'প্রগতি-আন্দোলন ও অরুণ মিত্রের কবিতা' প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত, দ্র. কবি অরুণ মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।
২১) অরুণ মিত্র, 'কবির কথা, কবিদের কথা', প্রবন্ধসংগ্রহ ১, পৃ. ৩৯-৪০।
২২) অরুণ মিত্র, 'আমার ঘর', খরা-উর্বরায় চিহ্ন দিয়ে চলি, অরুণ মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃ. ১৬৪-১৬৫।


উল্লেখপঞ্জিঃ
● অরুণ মিত্র, অরুণ মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা, কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং, ২০০৯।
● কবিতা, আমি ও আমরা, প্রবন্ধ সংগ্রহ ১, সম্পাদনাঃ চিন্ময় গুহ, কলকাতাঃ গাঙচিল, ২০১২।
● কবির কথা, কবিদের কথা, প্রবন্ধ সংগ্রহ ১, প্রাগুক্ত।
● জীবনের রঙে, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২, সম্পাদনাঃ চিন্ময় গুহ, কলকাতাঃ গাঙচিল, ২০১৪।
● পথের মোড়ে, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২, প্রাগুক্ত।
● সৃজন সাহিত্যঃ নানান ভাবনা, প্রবন্ধ সংগ্রহ ১, প্রাগুক্ত।
● শঙ্খ ঘোষ-অরুণ সেন (সম্পা.), কবি অরুণ মিত্র, কলকাতাঃ কবি অরুণ মিত্র সংবর্ধনা সমিতি।
● আবর্ত - শারদ সংখ্যা, সম্পাদনাঃ অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, ১৪০৪।
● শিলীন্ধ্র - অরুণ মিত্র সংখ্যা, সম্পাদনাঃ কমল মুখোপাধ্যায়, ৩৫ বর্ষ ১ম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০০১।