আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

মৌলবাদ

নিখিলরঞ্জন গুহ


মৌলবাদের অবস্থিতি মানব সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রকাশ ভেদে তার পার্থক্য থাকলেও মৌলিক প্রশ্নে, প্রকৃতিগত দিক থেকে তার কোনও পার্থক্য থাকে না। আভিধানিক দিক থেকে 'মৌলবাদ' শব্দটি বিশেষ অর্থ বহন করলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক সময় এই শব্দটি কোনও বিশেষ ধারণা, মূল্যবোধ বা আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক অলঙ্ঘনীয় সংস্কার হিসেবে মান্যতা পেয়ে থাকে। সেই কারণে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সংহত রূপ দিয়ে মানুষ তাঁকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং যখন মানুষকে সেই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে আত্মনিয়োগ করে তখন তা সাধারণভাবে মৌলবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মৌলবাদের ধর্মই হল পরিবর্তনশীল বিশ্বপ্রকৃতির বিরুদ্ধচারণের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করা এবং সমাজকে প্রভাবিত করার ক্রিয়াশীলতাকে অব্যাহত রাখা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এর জন্য কম মূল্য দিতে হয়নি । উত্তর আধুনিক বিশ্বও এর থেকে মুক্ত একথা বলা যাবে না। অবশ্য একটা ইতিবাচক দিক হল সভ্যতার বিকাশের ধারায় মানুষের চিন্তন ও মননের উপর এই মনস্তত্ত্ব স্থায়ী ভিত্তিতে কোনদিনই প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। বিপরীতে বিকৃত ও সংকীর্ণতার তকমা নিয়ে একে ক্রমশ ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থেকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অসহায় প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয়েছে। তবে তার বিলুপ্তি ঘটেছে বলা যাবে না। বরং কখনো কখনো তা বিশেষ পরিবেশ থেকে শক্তি পেয়েছে এবং সমাজের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে যদিও তা স্থায়ী হতে পারেনি।

বিকাশমান সমাজে ভিন্ন স্বার্থ যুক্ত বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এমন মৌলবাদী ধারণা থেকে একশত শতাংশ মুক্ত একথা বলা যাবে না। সুতরাং মৌলবাদকে শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বিবেচনা করলে ভুল হবে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং সভ্যতা পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে যে প্রভাব ফেলছে, সমাজ বিকাশের ধারায় তার অনিবার্যতাকে অস্বীকার করাও এক ধরণের মৌলবাদ। ধর্মীয় ক্ষেত্রেই হউক বা অন্য কোনও ক্ষেত্রেই হোক যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন কোনও ধারণা বা সংস্কার সমাজে উদ্ভূত কোনও শক্তিকে ভর করে চেপে বসলে তা যেমন সমাজকে পিছনের দিকে টেনে ধরে তেমনই এই সংস্কার ভাঙার প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সামাজিক শক্তিগুলির মধ্যে অতীত ধারণায় আটকে থাকার প্রবণতা দেখা দিলে পক্ষান্তরে তা কেবল মৌলবাদেরই পুষ্টি বিধান করে না, স্থিরিকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতিকেও অনিবার্য করে তোলে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের যুগদাবির বাস্তবতাকে অনুধাবন করার এই অক্ষমতা পক্ষান্তরে মৌলবাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।

সমাজ বিকাশের ধারণায় মার্ক্সীয় ব্যাখ্যায় যে শ্রেণি দ্বন্দ্বের উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে একটা ব্যবস্থা থেকে আর একটা ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রশ্নে সমাজ বিকাশের ধারায় সৃজনশীল চিন্তন ও মননের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। কোনও লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অনিবার্যতা থাকলেও সৃজনশীলতা কখনই শর্ত নিরপেক্ষ হয় না। এই শর্ত বলতে বোঝায় জাগতিক পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি বিধান করা এবং চিন্তন-মননের মধ্যে এই পরিবর্তনকে মান্যতা দান করা। অন্যভাবে বলা যায় জাগতিক পরিবর্তনের সাথে চিন্তন ও মননের সম্পৃক্তকরণের মধ্যেই এই শর্ত নিহীত। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে আমরা কখনই উপেক্ষা করতে পারি না। অন্যথায় বিকাশমান সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রেক্ষাপটে যুগদাবির নিরিখে শুধু নিজেদের সরিয়ে রাখা হয় না বিপরীতে মৌলবাদের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। উৎপাদন এবং পরিষেবা শিল্পে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের অনুপ্রবেশ বর্তমান বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এই সাফল্যকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ভবিষ্যৎ বিশ্বে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে ধরে নেওয়া যায়। আধুনিক বিশ্বে সংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যার ক্রমহ্রাস এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির বিবিধ কারণগুলির মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির এই অভাবনীয় বিকাশের ভূমিকাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। এই বিকাশ শ্রমজীবী মানুষের সাথে উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্কের উপরেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য। কারখানায় একজন শ্রমিক নিয়োগের প্রশ্নে উদ্যোগপতির দিক থেকে কতকগুলি দায়বদ্ধতার বিষয় থাকে। এই প্রশ্নে শ্রম শোষণের হাতিয়ার পুঁজির নিয়ন্ত্রককে শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের উপর নির্ভর করতে হয় যার লক্ষ্য থাকে উদ্বৃত্ত মূল্যের উপর ভাগ বসানো। এই দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি স্থান পায় সেগুলি হল বেতন কাঠামো, উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবেশ, শ্রমদানের সময়সীমা, উৎসাহ ভাতা দান, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রভৃতি। কারখানায় একজন শ্রমিককে নিয়োগের সাথে সাথে এই প্রশ্নগুলি চলে আসে। এই ক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে একজন শ্রমিক শুধু কলকারখানায় শ্রম দানের উৎস হিসেবে শ্রমের আধার বা যন্ত্র এই ধারণাও ঠিক নয় । তার বাইরেও তাঁর আর একটা অস্তিত্ব আছে যা সামাজিক স্বীকৃতি দাবি করে এবং যা তাঁর চিন্তা ও চেতনার মধ্য দিয়ে সমাজের বাকি অংশের মতোই স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সক্ষমতা রাখে। কৃত্তিম বুদ্ধি সম্পন্ন একটা রোবট সেই জায়গা নিলে একজন উদ্যোপতির ক্ষেত্রে সহজেই এইগুলিকে উপেক্ষা করা সম্ভব। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এই রোবটিক উৎপাদন ব্যবস্থা কেবল বহুগুণ উৎপাদন বৃদ্ধিরই সহায়কই নয়, সেই সাথে একজন শ্রমিকের তুলনায় নিখুঁত কাজেও সে অনেক বেশি দক্ষ। এই কারণে প্রারম্ভিক ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে লাভজনক হওয়ায় রোবটের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে বাধ্য এবং হচ্ছেও তাই। উন্নত দেশগুলিকে শিল্পে ব্যবহারযোগ্য রোবট উৎপাদন শিল্পে বানিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে লগ্নি করতে দেখা যাচ্ছে। প্রাসঙ্গিক ভাবেই জাপান, চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনের নাম এই ক্ষেত্রে চলে আসে। এক সমীক্ষায় আশঙ্কা করা হয়েছে এই শিল্পে উৎপাদনের হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জনসংখ্যাকে তা ছাড়িয়ে যাবে। এটা কোনও কল্পজগতের কথা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধির উপর গবেষণা এবং রোবটের উপর তার প্রয়োগের আবশ্যিক ফল হিসেবেই তথ্যনিষ্ট ভিত্তির উপর তা প্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি হিসেবেই তাকে মান্যতা দিতে হবে। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সমীক্ষা বলছে ভবিষ্যৎ বিশ্বে শিল্পে দক্ষ ম্যানেজারের গুরুত্ব যেমন বৃদ্ধি ঘটবে তেমনই দ্রুত হ্রাস পাবে শ্রমশক্তির চাহিদা। এই ক্ষেত্রে রোবট পরিচালনায় দক্ষ উন্নত প্রযুক্তিবিদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পাবে। এই পরিচালন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রধানত হবেন প্রযুক্তি নির্ভর রোবটিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালক। শিল্প থেকে ক্রমাগত মানবিক সম্পদ, শ্রমশক্তির অবসৃত হওয়ায় মানবসম্পদের ভবিষ্যৎ সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তনকেও অনিবার্য করে তুলবে যা আমাদের অনেক কিছু নিয়েই নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। এই ভবিষ্যৎ পরিবর্তনকে অস্বীকার করে অতীতকে ধরে বসে থাকাও এক ধরণের মৌলবাদ।

বিশ্বপ্রকৃতির বস্তুগত অবস্থা যেমন আমাদের চিন্তনকে সক্রিয় করে তোলে এবং মননকে পুষ্টিদান করে, ঠিক তেমনই মানুষের চিন্তন ও মননও ভূপ্রকৃতির বস্তুগত বিষয়গুলিকে প্রভাবিত করে এবং তাকে নিত্যনতুন ভাবে আবিস্কার করতে সাহায্য করে এবং তাঁর রূপ ও গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের কাছে ধরা পড়েছে আধুনিক বিশ্ব, বর্তমান বিজ্ঞান ও সামাজিক বিন্যাস। প্রকৃত প্রস্তাবে সভ্যতার আদিকাল থেকেই এই বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হল মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা যা এক সময় অন্যান্য জন্তু জানোয়ার থেকে মানুষকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে। বিভাজিত সমাজে শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্নেও তা সমান ক্রিয়াশীল থাকে। তাকে অস্বীকার করা যায় না। সৃজনশীলতার ধর্মই হল বস্তু ও পারিপার্শিক অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করা এবং লব্ধ এই জ্ঞানকে বিকশিত করা। সেই সাথে নিজেকে তা গ্রহণের জন্য উপযুক্ত করে তোলা। বিপরীতে যা থাকে তা হল পারিপার্শিক পরিবর্তনগুলিকে অস্বীকার করা। যার অর্থ দাঁড়ায় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পন। সেই মৌলবাদ যেমন প্রাত্যহিক জীবনে অনুসৃত সংস্কার হতে পারে তেমনই যুক্তি নিরপেক্ষ ভাবাবেগ বা কুসংস্কারও হতে পারে। সামাজিক চাহিদা যেহেতু যে কোনও ধরণের সংস্থা বা সংগঠনের গড়ে ওঠার ভিত্তি এবং রাজনৈতিক দলগুলির উদ্ভবও যেহেতু একই কারণে, তাই মৌলবাদের ছায়া থেকে তা মুক্ত হতে পারে না। বলা যায় রাজনীতিও এই রোগে আক্রান্ত। রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্য রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে বিম্বিত হয়ে থাকে এবং তা যেহেতু সামাজিক দ্বন্দ্বের ফল, তাই সেই দ্বন্দ্ব-উদ্ভূত ফলগুলির মধ্যেও নিরন্তর বিরোধ বর্তমান। এই বিরোধে অবস্থান নির্ধারণের বাধ্যবাধকতাকে তাই কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এই ক্ষেত্রেও লক্ষ্য স্থির থাকলেও অবস্থান নির্ণয়ের সীমাবদ্ধতা জনিত কারণে তার প্রাসঙ্গিকতা বিনষ্ট হতে পারে এবং সৃজনশীল মনস্কতার অভাবকেই তার জন্য দায়ী করা যায়। সমাজকে পেছনের দিকে টেনে ধরার রাজনীতি যদি হয় মৌলবাদ তবে তার বিরুদ্ধচারণ হল তা থেকে বেরিয়ে আসা বা তার উত্তরণ, অথবা প্রগতিবাদ এবং যা সৃজনশীল চিন্তন ও মনন নির্ভর। এই ক্ষেত্রে যদি তার ভূমিকা হয় প্রগতিবিরোধী তবে তা একধরণের মৌলবাদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন সভ্যতার উৎকর্ষতার পক্ষে অন্তরায় তেমনই অসৃজনশীল মনোজগত, রাষ্ট্র এবং সমাজ জীবনে শুধু বিপদ ডেকে আনে না বরং তাঁর গর্ভেই ধর্মীয় মৌলবাদের পুষ্টিদানের সহায়ক হয়।