আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

গৌতমদার চলে যাওয়া

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার




খবরটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ তাঁর কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবরটা জানতাম না। ফলে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আগরতলার এক বন্ধু জানিয়েছিলেন খবরটা। তখনই জানলাম তাঁর কোভিড হওয়ার কথা এবং বাড়াবাড়ি হওয়ার পর তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসার কথা। একজন সক্রিয় মানুষ এভাবে হঠাৎ জীবন থেকে অন্তর্হিত হলে একটা শূন্যতা নেমে আসে। শূন্যতার অনুভব হয় কিন্তু সবটা পরিমাপ করা যায় না তক্ষুণি। সিপিআই(এম)-এর ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সম্পাদক গৌতম দাশ একজন সক্রিয় মানুষ হবেন এ আর বিচিত্র কী! ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরও যে দল প্রতিদিন মুখোমুখি সংগ্রামে প্রতিরোধে ত্রিপুরার প্রতিটি কোণে সক্রিয়তায় টগবগ করছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার রাজ্য সম্পাদক একজন সক্রিয় মানুষ হবেনই। বিশেষ করে ত্রিপুরায় যেখানে নেতা এবং সাধারণ কর্মীরা একইভাবে আক্রান্ত রক্তাক্ত এবং পুলিশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গৌতমদার সক্রিয়তার পরিমাপ শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের সাধারণ সক্রিয়তা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। গৌতমদার সক্রিয়তার ব্যাপ্তি ছিল বিচিত্র ক্ষেত্র জুড়ে। মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকেই সেই ব্যাপ্তির কথাই মনের ভেতরে আসা যাওয়া করছিল।

আমার মতো একজন সাধারণ স্তরের বামপন্থী কর্মীর সাথে গৌতমদার স্তরের নেতার খুব একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা নয়। ঘনিষ্ঠতা বলতে দৈনন্দিন ঘনিষ্ঠতা বোঝালে সেই ঘনিষ্ঠতা অবশ্যই আমার ছিল না। তবু তাঁর এই আকস্মিক চলে যাওয়ার পর অনুভব করছি একটা নৈকট্য অবশ্যই ছিল তাঁর সাথে। এই নৈকট্য তিনিই তৈরি করেছেন এবং এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা। আমার মতো এমন সাধারণ বহু শিল্পী সংস্কৃতিকর্মীর সাথে ছিল তাঁর এমনই নৈকট্য। ফলে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে ওই সব মানুষের মধ্যে অবশ্যই একটা শূন্যতার বোধ গড়ে উঠবে। এঁদের অনেকেই হয়ত প্রথাগত অর্থে রাজনীতির মানুষ নয়। কিন্তু আদ্যোপান্ত রাজনীতির মানুষ গৌতম দাশের মৃত্যুতে তাঁদের মনে স্বজন বিয়োগের ব্যথাই অনুভূত হচ্ছে। আবার এই নিকটজনেরা শুধু ত্রিপুরার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে রয়েছেন ভাবলেও ভুল হবে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে বাংলাদেশেও তাঁর এমন অসংখ্য নিকটজনেরা রয়েছেন যাঁরা এখন স্বজনবিয়োগের ব্যথা অনুভব করছেন। মন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধি নয়, শুধু কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক রাজনীতির নেতৃত্বের অবস্থানে জীবনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করার পরও সমাজের এই ব্যাপ্ত অংশের সাথে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত খুব কম। নীতিগতভাবে কমিউনিস্টরা এমন সম্পর্ক গড়ার কথা বলে ঠিকই, কিন্তু হয় না। সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকা পার্টিবৃত্তের একটা দেওয়াল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে এমন প্রতিদিনের সহজ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সম্ভবত একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীরই ছিল। ওই ঘনিষ্ঠতার জন্যে যোশীকে সহকর্মীদের বিপুল সমালোচনাও শুনতে হয়েছে। যদিও ভারতের বামপন্থী সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক বুনিয়াদটি গঠিত হয়েছিল যোশীর সাংগঠনিক নেতৃত্বেই। কোনো সন্দেহ নেই যোশীযুগের অবসানের পর সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন কেন্দ্রীয়ভাবে সেভাবে কোনো অর্থবহ দিশা দেখাতে পারেনি। সদর্থক যা কিছু হয়েছে তার সবটাই নীচের স্তরের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে।

সংস্কৃতি আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে এই ক্ষেত্রে গৌতমদার অনন্য ভূমিকাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি প্রথমে অনিল সরকার ওপরে গৌতম দাশের নেতৃত্বেই ত্রিপুরার বামপন্থী সংস্কৃতি আন্দোলন একটা স্বতন্ত্র চরিত্র অর্জন করতে পেরেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি আন্দোলন ৩৪ বছরের বাম জমানায় অর্জন করতে পারেনি। বিশিষ্ট সাহিত্যিক বা অভিনেতা বা পরিচালকের সাথে নেতৃত্বের কারো কারো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দিয়ে এই দিশা অর্জন করা যায় না। তুলনায় রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তির বিচারে দুর্বলতর হয়েও বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলনে বামপন্থীরা অনেক বেশি নেতৃত্বকারী ভূমিকা রাখতে পেরেছে। কেরলের খবর অতটা বিস্তারিত জানি না, ত্রিপুরায় সংস্কৃতি আন্দোলন একটা সুস্পষ্ট দিশা নিয়ে যাত্রা করেছিল, যার অনেকটা জুড়েই ছিলেন গৌতমদা।

গৌতমদার সাথে আমার পরিচয় ত্রিপুরায় অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সূত্রেই। তখন হয়ত তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদক ছিলেন না, কিন্তু পার্টির দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের ব্যস্ততাপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। কীভাবে পরিচয় হয়েছিল মনে নেই, কিন্তু গৌতমদা নিজেই ফোন করে আমি যে হোটেলে থাকতাম সেখানে চলে আসতেন। তখন আমার পরিচয় প্রতিবেশী আসামের একটি জেলা শহরের গায়ক যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত। মাত্র এই সাধারণ পরিচয়ের একজন মানুষের সাথে ত্রিপুরার সিপিআই(এম) রাজ্য নেতৃত্বের অগ্রসারির একজন মানুষ দেখা করতে চলে আসবেন তার হোটেলে, এটা অকল্পনীয়ই। কেন? কারণ তাঁর আমার গান ও গানের মাঝে মাঝে বলা কথাগুলি ভালো লেগেছিল। দৈনিক খবরের কাগজের ব্যস্ততার মধ্যেও গৌতমদা নিয়মিতই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতেন। একটু দেরিতে গিয়ে হয়তো পেছনের দিকের একটি আসনে বসে শ্রোতার ভূমিকা পালন করতেন। আবার অনুষ্ঠান শেষ হলেই দ্রুত ফিরে যেতেন পত্রিকা দফতরে। এমন বহুবার হয়েছে, উদ্যোক্তরা বলেছে, গৌতমদা এসেছিলেন। পেছনে বসে গান শুনে চলে গেছেন। এভাবে শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের শিল্পী নয়, অন্য শিল্পীদের গানও তিনি শুনতে যেতেন। কলকাতা বা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পীর সাথে এভাবেই তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল। ত্রিপুরার শিল্পীদের সাথে তাঁর ছিল দৈনন্দিন সম্পর্ক। আমি গেলে হোটেলে ফোন করে বলতেন, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন না তো? আমরা খবরের কাগজের মানুষ, আমরা রাতেই চড়ে বেড়াই। আগামীকালের কাগজটা ছেড়ে দিয়ে আসব হোটেলে। আসতেন। অনেক রাত অবধি নানা বিষয়ে কথা হত। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে দৈনন্দিন খবর রাখতেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে এপারের সংস্কৃতি আন্দোলনের সম্পর্ক গড়ে ওঠাটা যে দু’টি দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যেই জরুরি একটি বিষয়, এটা গৌতমদা জানতেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের চর্চা ও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রক্ষার আন্দোলন, এই সবকিছুই যে উপমহাদেশের বামপন্থী রাজনীতির জন্যেও একটা প্রয়োজনীয় চর্চার বিষয় এটা গভীরভাবে অনুভব করতেন গৌতমদা। গভীর রাতের আলোচনা জুড়ে থাকত সেই কথাগুলি। একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলতেন ত্রিপুরার সংস্কৃতি আন্দোলনের কথা। উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চার সাথে ত্রিপুরার সংস্কৃতি আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কথাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেন।

আরেকটি বিষয় দেখতাম, পার্টি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সংবাদজগতের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গৌতমদার সম্পর্ক ছিল সাধারণ মাঠপর্যায়ের সংবাদকর্মীদের সাথেও। তাঁরাও নিজেদের কথা তাঁর কাছে গিয়ে অকপটে বলতে পারতেন।

তাঁর আমন্ত্রণে ত্রিপুরার বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় কেন্দ্র’-এর রাজ্য সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের কামাল লোহানী এবং পশ্চিমবঙ্গের ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি আসাম থেকে আমিও। সম্মেলনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আন্দোলনের প্রতিনিধিরা ছিলেন। ছিলেন মনিপুরের প্রতিনিধিও। আমার কাছে জীবনের একটি অনুপম কর্মশালা ছিল সেই সম্মেলন।  ওই স‌ম্মেল‌নের প‌রিকল্পনাটাই ছিল অ‌‌ভিনব। সাধারণত বামপন্থী যে কো‌নো সংগঠ‌নের সম্মেল‌নের প্রধান বা একমাত্র কাজ হ‌চ্ছে নানা বিষ‌য়ে আলাপ-আ‌‌লোচনা তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি যার ওপর ভি‌ত্তি ক‌রে অতী‌তের কাজক‌র্মের পর্যা‌লোচনা হয় এবং আগামীর রূপ‌রেখা চূড়ান্ত করা হয়। সম্মেলনের প্রধান বিষয় হচ্ছে বক্তৃতা। গান-বাজনা প্রদর্শনী ইত্যাদি যাই হয়, তা সম্মেলনের বহিরঙ্গের বিষয়। সম্মেলন কক্ষের ভেতরের ঘটনাবলীর সাথে সম্মেলন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না। সাংস্কৃ‌তিক বা সা‌হিত্য বিষয়ক সংগঠ‌নেও এর কো‌নো ব্যোত্যষয় হয় না।

ত্রিপুরা সাংস্কৃ‌তিক সমন্বয় কে‌ন্দ্রের সেই স‌ম্মেল‌ন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চ‌রি‌ত্রের। স‌ম্মেল‌নে বক্ত‌ব্যের অংশ ছিল অ‌‌পেক্ষায় ক্ষুদ্রতর। বে‌শিরভাগটা জু‌ড়ে ছিল সাংস্কৃ‌তিক উপস্থাপনা। সম্মেলন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী - সবটাই ছিল সম্মেলনের ভেতরের কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ক এই সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করেই হয়েছে। বিষয়টি একটু বিস্তারিতভাবে না বললে এর অভিনবত্ব বোঝা যাবে না।

সম্মেলন মঞ্চে সভাপতিমণ্ডলী ও পরিচালন সমিতির সদস্যদের আসন ছিল মঞ্চের দু’টি প্রান্তে কৌণিকভাবে দর্শকদের দিকে মুখ করে। মঞ্চের মাঝখানের জায়গাটা ছিল ফাঁকা রাখা। সম্মেলনের শুরুতে উদ্বোধকের ভাষণের পর সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করা হয় বক্তব্যের মাধ্যমে। তারপরই ওই প্রতিবেদনের সম্পূরক অংশ ছিল সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা। রাজ্য কমিটির সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, যন্ত্রসঙ্গীত ও চিত্রকলা উপসমিতি কুড়ি মিনিট পঁচিশ মিনিট ধরে নিজেদের উপস্থাপনা রাখেন যাকে সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। একইভাবে বিভিন্ন বিভাগীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে যখন সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর আলোচনার পর্ব আসে সেখানেও ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার অংশ। অর্থাৎ প্রতিটি বিভাগীয় কমিটি নিজেদের মতামত তুলে ধরেছে বক্তব্য ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মাধ্যমে। সবচেয়ে চমকপ্রদ উপস্থাপনাটি হয়েছিল চিত্রকলা উপসমিতির। একটি বিশাল শূন্য ক্যানভাসকে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড় করানো হয়। ওখানে একদল শিল্পী নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে একটি বিশাল ছবি আঁকেন প্রতিনিধিদের সামনে। প্রতিনিধিরা চাক্ষুষ সাক্ষী হল কীভাবে একটি শূন্য ক্যানভাস একদল শিল্পীর রং তুলির ছোঁয়ায় একটি চিত্রশিল্পে পরিণত হয়। সম্মেলন উপলক্ষ্যে যে অতিথি শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, তাও প্রতিনিধি সম্মেলনের বাইরে হয়নি। সম্মেলন চলাকালীনই প্রতিনিধিদের সামনে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন অতিথি শিল্পীরা। আলোচনা চক্রও অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলন কক্ষেই প্রতিনিধিদের সামনে। চিত্র প্রদর্শনী বলা বাহুল্য আলাদা হলে হয়েছিল। কিন্ত সম্মেলনের সময়সূচিতেই প্রতিনিধিদের চিত্র প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময় স্থির করে রাখা ছিল। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিনিধিদের আলোচনা পর্যালোচনায় সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের বক্তব্য, সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা, অতিথি শিল্পীদের অনুষ্ঠান, আলোচনা চক্র এবং চিত্র প্রদর্শনী - সবটাই উঠে আসুক। এমনকী সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্বদের সম্বর্ধিত করা হয়। সেটাও অনুষ্ঠিত হয় প্রতিনিধি সম্মেলনের মধ্যেই।

সম্মেলন চলাকালীন সময়ে গৌতমদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই অভিনব পরিকল্পনা বিষয়ে। তিনি বললেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্মেলনে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা একটা অঙ্গ হওয়া উচিত। শুধু বক্তৃতা দিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের পর্যালোচনা সম্ভব নয়। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলি কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা তো বক্তৃতা দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না, তাই সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাকে সম্মেলনের অভ্যন্তরীণ কার্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। যে গভীর প্রত্যয় নিয়ে গৌতমদা সেদিন কথাগুলি বলেছিলেন সেটা থেকেই বুঝতে পারি সিদ্ধান্তটি যৌথভাবে গৃহীত হলেও এমন অভিনব পরিকল্পনা হয়ত তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।

আসাম ছেড়ে আসার পর গৌতমদার সাথে নিয়মিত দেখা হত না ঠিকই, কিন্তু ফেসবুকে কখনো কখনো মতবিনিময় হত। ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। স্থানীয় নানা চ্যানেল থেকে আমার আমন্ত্রণ আসছিল। এক অংশের কমরেড বলছিলেন, প্রথমে বাম মনোভাবাপন্ন চ্যানেলে অংশ নিয়ে পরে অন্য চ্যানেলগুলিতে যেতে। গৌতমদা ভিন্নমত পোষণ করলেন। বললেন, শুভকে যে চ্যানেল প্রথমে ডাকবে সেখানেই যাবে। প্রথম যাওয়া দ্বিতীয় যাওয়া কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। বরং পার্টিবৃত্তের বাইরে যত বেশি যাওয়ার সুযোগ আসবে তার ব্যবহার করতে হবে। ওই নির্বাচনী প্রচারের সময়ই কয়েকটি জরুরি বিষয়ে কথা বলার জন্যে গৌতমদার সময় চেয়েছিলাম। উনি একদিন অনেক রাতে সময় দিলেন। সারাদিনের সাংগঠনিক কাজ ও পত্রিকার প্রিন্ট পাঠানোর পর পার্টি অফিসের ঘরে তাঁর সাথে আমার সেই দেখাই শেষ সাক্ষাৎ। নানা বিষয়ে কথা হয়েছিল। নানা বিষয়ে গৌতমদা এত তথ্য রাখতেন যা অবাক করে দিত। উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিও তিনি গভীর মনোনিবেশ নিয়ে অধ্যয়ন করতেন। বাংলাদেশের প্রতিদিনের রাজনীতি নিয়ে তিনি সবসময়ই অবহিত থাকতেন। সরকার ও বিভিন্ন দলের অভ্যন্তরের রাজনীতির দৈনন্দিন গতিপ্রকৃতির খবর তিনি অনুসরণ করতেন। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে তিনি বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলির সাথে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন সেটা যেমন তাঁর এই হালনাগাদ থাকার কারণ। আবার তাঁর এই অনুপুঙ্ক্ষ জ্ঞানের জন্যেও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফ থেকে তাঁর ওপরেই এই দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল বললেও ভুল বলা হবে না।

গৌতমদা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। কখনো মন্ত্রী হননি। বরাবর সংগঠনের মানুষ। বেশিরভাগ সময় পার্টি পত্রিকার দায়িত্বেই কাটিয়েছেন। তারপরও তাঁর জনসংযোগ ছিল ঈর্ষণীয় স্তরের। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা যখন ঘটছে তখন তাঁর দল আর ক্ষমতায় নেই। একটি কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায় আসীন। তারপরও গৌতমদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ত্রিপুরার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে শোকের ঢেউ আছড়ে পড়েছে তার থেকে এটা স্পষ্ট গৌতমদা কখনোই ক্ষমতার রাজনীতিকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পাথেয় করেননি। তাই ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরও মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান এতটাই অটুট রয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে। এটা খুব কম অর্জন নয় আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে।

সেজন্যেই তাঁর মৃত্যু একটি গভীর শূন্যতার বোধের জন্ম দেয়। অবশ্য গৌতমদা বিশ্বাস করতেন ব্যক্তির চলে যাওয়ায় কোনো স্থায়ী শূন্যতার সৃষ্টি হয় না। সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব শূন্যতাই যোগ্য উত্তরাধিকার পেয়ে পূরণ হয়ে যায়। আশা করব, গৌতমদার সব স্বপ্নের মত এই বিশ্বাসও সত্য হবে। আরও অনেক গৌতম দাশের জন্ম দেবে ত্রিপুরা।