আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮
প্রবন্ধ
কোভিড লকডাউন, তিরিশের মহামন্দা আর মহা আর্থিক সংকটের সালতামামি
গৌতম সরকার
বিগত আঠারো মাস যাবৎ করোনা ভাইরাস পৃথিবীব্যাপী টর্নেডো বইয়ে চলেছে, প্রলয়ঙ্কর সেই ভাইরাস মুহুর্মুহু আচার-আচরণ, গতি-প্রকৃতি বদলে ফেলে বিজ্ঞানীদের ধোঁকা দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বুকের ওপর দিয়ে রোলার চালাচ্ছে। উৎপাদন, বিনিয়োগ, পরিবহন এবং বণ্টন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণাত্মক প্রভাব পড়ছে এবং তার ফলে আগামী দিনে বিশ্বজুড়ে যে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা আসতে চলেছে তার তুলনা কেবলমাত্র ১৯৩০ দশকের মহামন্দা এবং কিছুটা ২০০৮-এর মহা আর্থিক সংকটের সাথে করা যায়।
২০২০ সালে মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আইএমএফ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, কোভিড সংক্রমণ এবং লকডাউন ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের হার তিন শতাংশ কমিয়ে দেবে। আজ ২০২১-এর শেষ প্রান্তে এসে বুঝতে পারছি, আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডারের আন্দাজ কতটা সঠিক ছিল। অর্থনীতিতে উৎপাদন হ্রাসের সর্বাগ্রে প্রভাব পড়ে কর্মক্ষেত্রে, সেখানেও তথ্য বলছে বেকারত্ব সৃষ্টির হিসেবে করোনাজনিত মন্দা ইতিমধ্যেই রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং বহু মানুষের ডবল ডোজ নেওয়ার পরেও যেভাবে এই অনু ভাইরাস অনবরত চোখ রাঙিয়ে চলেছে, একটার পর একটা ঢেউ এনে গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, বিশেষজ্ঞ মহল মনুষ্যজীবনে এই অতিমারীর সম্ভাব্য প্রভাব আন্দাজ করতে ইতস্তত বোধ করছেন৷ তবে একটা ব্যাপারে তাঁরা সহমত প্রকাশ করছেন, কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে যে মহামন্দার সৃষ্টি হবে সেটা তিরিশের মহামন্দাকে অনেক দিক থেকেই ছাপিয়ে যাবে, আর ২০০৮ সালের মহা আর্থিক সংকট কোনো তুলনাতেই আসবে না। আসলে করোনা উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকট আগের দুটি সংকটের চেয়ে চরিত্রগতভাবে আলাদা। অতীতের দুই মন্দা সৃষ্টির কারণ ছিল অর্থনৈতিক, কিন্তু ২০২০ সাল কোভিড-১৯ সৃষ্ট মন্দার সাথে অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তাই এর হাত থেকে পরিত্রাণের আশু সমাধান তত্ত্ব অর্থনীতির বইয়ে নেই। এই সঙ্কটে শুধুমাত্র উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ছারখার হচ্ছে তাই নয়, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস ইতিমধ্যেই কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, লক্ষ লক্ষ পরিবারকে পথে বসিয়েছে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সর্বোপরি করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে সমস্ত দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির অগ্রগতি থমকে গেছে।
মন্দা কি এবং কেন
বিভিন্ন জার্নালে অর্থনীতিবিদরা তিরিশের দশকের মন্দার সাথে বর্তমানে চলতে থাকা মন্দার একটা তুলনামূলক আলোচনা করতে সচেষ্ট হয়েছেন, যদিও সেই প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হবে বলা যাচ্ছে না, কারণ এই ভাইরাসের মারণযজ্ঞ কবে শেষ হবে এবং তার আগে বিশ্ব অর্থনীতি কতটা আহত হবে কারোর জানা নেই। তবুও তাদের সেই প্রচেষ্টা থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। সেগুলোর বিশ্লেষণই এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে, মন্দা কী; অর্থাৎ কোন কোন অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য দেখে বোঝা যাবে একটি দেশ মন্দার কবলে পড়েছে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, মন্দার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে এর তিনটি বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা একমত প্রকাশ করেন। সেগুলি হল - এক, এর প্রভাব হয় পৃথিবীব্যাপী; দুই, এটি সামগ্রিক জীবনযাত্রায় গভীর দাগ ফেলে যায়; এবং তিন, এর ঋণাত্মক প্রভাবগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অর্থনীতিতে দুটো শব্দ আছে 'রিসেশন' আর 'ডিপ্রেশন'। প্রথমটাতে অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়ন (যেমন, স্থূল জাতীয় উৎপাদন, জাতীয় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি) হ্রাসের মাত্রা কম থাকে, আর ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে এই সংকোচনের মান কয়েকগুন বেড়ে যায়। রিসেশন অর্থনীতির ক্ষেত্রে সেই অর্থে সঙ্কট না হলেও, এর মান বাড়তে বাড়তে যখন ডিপ্রেশন স্তরে পৌঁছয় তখন দেশের সরকার থেকে নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ সবাইকে নড়েচড়ে বসতে হয়। এই অর্থনৈতিক অভিশাপের কালজয়ী প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে সত্বর সমাধান সূত্রের তল্লাশ চালাতে হয়। এই মুহূর্তে আমরা যে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেখানে বহু আগেই ডিপ্রেশনের সংজ্ঞা পার হয়ে এসেছি। ব্যাপারটা খোলসা করতে আমাদের মন্দার বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে বর্তমান সময়টাকে মিলিয়ে নিতে হবে৷
প্রথমতঃ, বর্তমানের অর্থনৈতিক অধোগতি যে বিশ্বজনীন সে বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। করোনা ভাইরাস একদিকে যেমন উন্নত-অনুন্নত দেশের ভেদাভেদ রাখেনি, তেমনি মৃত্যুমিছিলে ধনী-দরিদ্র সবাই একসাথে সামিল হচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশগুলি যেমন চিন, আমেরিকা এবং ইউরোপ মহাদেশের একাধিক দেশ, এই অতিমারীর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিন তো আবার এই রোগের আঁতুরঘর বলে চিহ্নিত হয়েছে। করোনা এই সমস্ত দেশের উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থাকে সাঙ্ঘাতিক ভাবে পঙ্গু করে সহজেই এই মন্দাকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত, মন্দার (ডিপ্রেশন) সংজ্ঞা অনুযায়ী এই সমস্যার ভেদশক্তি অন্যান্য সাধারণ মন্দার (রিসেশন) তুলনায় অনেক বেশি। করোনাজনিত অর্থনৈতিক সংকটের আকস্মিকতা এবং সঙ্গে মৃত্যুর পরোয়ানা এই মন্দাকে ভয়াল-ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসেই আমেরিকায় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রায় ২২ মিলিয়ন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিল, যদিও মে মাসে ৭.৫ মিলিয়ন শ্রমিকের পুনরায় কর্মসংস্থান ঘটেছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে বহুবার লকডাউনের কারণে পুনরায় লক্ষ লক্ষ মানুষ রুটি-রুজির সংস্থান হারিয়েছে। ইউনাইটেড নেশনস্-এর শ্রম বিশেষজ্ঞদের মতে ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারাবে। ১৯৩০-এর মহামন্দার পর এই প্রথম আমেরিকায় বেকারত্মের হার ১৪.৭ শতাংশে ছুঁয়েছিল। সবথেকে বিপদের কথা হল করোনাসৃষ্ট বেকারত্বের মধ্যে অধিকাংশই হল স্থায়ী বেকারত্ব। এর মূল কারণ হল দীর্ঘকাল ব্যাপী চলতে থাকা অতিমারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছোট-বড় বহু কোম্পানিকে চিরকালের মত উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য করেছে এবং এই পরিস্থিতিতে কোনো দেশের সরকারের ধুঁকতে থাকা উৎপাদন ক্ষেত্রকে নিরন্তর আর্থিক সাহায্য যোগান দেওয়ার ক্ষমতা নেই৷ এখানেই উঠে আসছে মন্দা বা ডিপ্রেশনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি শক্তিশালী মন্দা সাধারণ মন্দার তুলনায় অনেক বেশি স্থায়ী হয়। গত আশি বছরে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সব মন্দাই ধারে, ভারে, ব্যাপ্তিতে এবং প্রভাবে চলতে থাকা মন্দার তুলনায় অনেক দুর্বল ছিল। ইতিমধ্যেই অর্থনীতিবিদরা বলতে শুরু করেছেন, আগামী কয়েক দশক ধরে এই মন্দার মন্দ প্রভাব অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হবে। বিশেষ করে, মানুষের রুজি-রোজগার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, রেকর্ড সংখ্যক বেকারত্ম অর্থনীতির উন্নয়নের চাকাকে উল্টোমুখে ঘোরাবে, সেই জটিল আবর্ত থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করার আশু প্রেসক্রিপশন অর্থনৈতিক শল্যচিকিৎসকরাও দিতে পারছেন না৷
মন্দার প্রভাব
এক, বস্তুগত অর্থনীতিতে প্রভাব:
আমরা যদি করোনাসৃষ্ট মন্দার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে প্রথমেই বলতে হয় ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকটি ১৯৩০-র মহামন্দাকে ছাপিয়ে গেছে। বর্তমান সংকটে আমরা বিশ্বজুড়ে চাহিদা আর যোগান দু'দিক থেকেই সঙ্কোচনশীলতা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ রিচার্ড বল্ডউইন-এর ভাষ্যে ব্যাপারটি পরিষ্কার বোঝা যায় -
"In normal recessions the big problem is a lack of demand. Due to a subprime mortgage crisis and a loss in the household wealth, the 2007-08 financial crisis had resulted in a plunge in consumer spending, which 'affected the demand side first'. Moreover, even in the event of the 1930’s Great Depression, the stock market crash had burst the financial bubble which then drained the consumption and investment spending, leading to a contraction in the aggregate demand."
অন্যদিকে এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে উৎপাদন, বিনিময় এবং কর্পোরেট কাজকর্ম চালায় আমেরিকা, চিন এবং ইউরোপের দেশগুলি। তাদের ক্রিয়াকর্ম একটি জটিল যোগান-শৃঙ্খল অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকর্মের মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয়। এই মুহূর্তে এই তিনটি দেশে এবং পৃথিবীর বহু দেশ করোনা অতিমারীর সাথে লড়াই চালাচ্ছে, ফলে বিশ্বব্যাপী যোগান-শৃঙ্খল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি দেশে দেশে খাদ্যসঙ্কট প্রবল হয়ে উঠেছে। 'ইনস্টিটিউট অফ সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট'-এর একটি সার্ভেতে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ কোম্পানী জানিয়েছে, কোভিডের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে উৎপাদন, সংগ্রহীকরণ এবং সরবরাহ সমস্ত ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন যোগান-শৃঙ্খলের ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এর সাথে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে জিনিসপত্রের দাম কমে গেছে, উৎপাদন ও যোগান আরও কমে গিয়ে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা ত্বরান্বিত করছে।
দুই, বিশ্বায়নই বর্তমান সমস্যার আসল কালপ্রিট:
এই মহাব্যাধির কবল থেকে বাঁচার প্রাথমিক শর্তগুলি হল, সেল্ফ আইসোলেশন, কন্টেইনমেন্ট জোন, হাইওয়ে, রেলস্টেশন এবং এয়ারপোর্টে বাইরের দেশ থেকে আসা যাত্রী এবং পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। ২০০৫ সালে যখন এভিয়ান ফ্লু বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল তখন মাইক ডেভিস তাঁর একটি বইয়ে বলেছিলেন, "Pandemics are a perfect example of the kind of crises to which global capitalism is particularly vulnerable. Since things today are taking place in a much more globalized setting as opposed to the times of Great Depression in the 1920s and 1930s, we are seeing the impact to be much more immediate and turbulent."
আর্থিক সংস্কারের সাথে সাথে সারা বিশ্বজুড়ে যে উদারীকরণ এবং বিশ্বায়নের প্রবাহ চলছে, তাতে বিশ্বের সমস্ত দেশ পরস্পরের সাথে যত বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিটি দেশ স্বকীয়তা এবং স্বাবলম্বিতা হারাচ্ছে। অধুনা একটি দ্রব্যের যোগান-শৃঙ্খল বেশ কয়েকটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। একটি দ্রব্যের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রস্তুত হয়, তারপর কোনও একটি দেশে সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলি জুড়ে মূল দ্রব্যটি তৈরি হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই 'মাল্টি-ডিপেন্ডেন্সি' হল গ্লোবালাইজেশনের ফসল। এখন এই অসীম যোগান-শৃঙ্খলের কোনো একটি উৎসমুখ খুলে গেলেই সামগ্রিক উৎপাদন ব্যাহত হবে। অন্যদিকে করোনাকালীন লকডাউন, পরিবহন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার চলনশীলতার উপর প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা উৎপাদন কাঠামোর মূলে কুঠার চালিয়েছে। এই যোগান-শৃঙ্খলের অখণ্ডতা ২০২০-২১ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে অনেক কম ছিল। সেই কারণেই মহা আর্থিক সঙ্কটের সময় বিশ্বের কোনো দেশই এই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়নি। আর তিরিশ দশকের মন্দার সময় 'বিশ্বায়ন' শব্দটির অস্তিত্ব পৃথিবীর শব্দকোষে ছিল না। এর মূল কারণ হল চিন তখন বিশ্ব মানচিত্রে নেহাত এক নাবালক। ২০০৮ সালের মহা আর্থিক সঙ্কটের কথা যদি ভাবা হয়, চিন ওই সময় বিশ্বের ৫-৬ শতাংশ স্থুল জাতীয় উৎপাদনের অধিকারী ছিল, আর এই মুহূর্তে চিন বিশ্বের ১৭-২০ শতাংশ জিডিপি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কোভিডের কারণে বিশ্বজনীন যোগান-শৃঙ্খলে চিনের যোগদান হ্রাস সমস্যা ও সঙ্কটকে কয়েকগুন পরিবর্ধিত করেছে।
তিন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর প্রভাব:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম গোটা বিশ্ব একই সাথে উৎপাদন হ্রাসের সাক্ষী রইল। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। করোনাকালীন সময়ে সীমান্তগুলিতে নিষেধাজ্ঞা, নৌবন্দরগুলি বন্ধ করে দেওয়ায় মালবাহী জাহাজ কার্যত অচল হয়ে পড়ে, ফলে বিশ্ববাণিজ্য কার্যত থমকে গিয়েছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সারা বিশ্বে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৩-৩২ শতাংশ হ্রাস পাবে। যদি মহা আর্থিক সংকটের সাথে তুলনা করা যায়, ২০০৮ সালে বিশ্ববাণিজ্য আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। ১৯৩০ সালের মহামন্দায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাসের পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশ। কোভিডাক্রান্ত বিশ্বের আরেক বড় সমস্যা হল, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের সাথে সাথে সেবাক্ষেত্রের উন্নয়নও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে৷ আইএমএফ-এর একটা রিপোর্ট বলছে, হোটেল, পরিবহন, রিটেইল এবং বিনোদন শিল্প, যেগুলিতে মানুষের কাছাকাছি আসাটা খুব জরুরি, কোভিডের কারণে সেই সমস্ত সেবাক্ষেত্রগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
চার, সার্বিক চাহিদার উপর প্রভাব:
যোগানজনিত সমস্যার পাশাপাশি চলতে থাকা কোভিড সঙ্কট সার্বিক চাহিদা সঙ্কটকেও ডেকে এনেছে। এরজন্যও দায়ী করা হচ্ছে বিশ্বায়নের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উর্দ্ধমুখী পারদকে। অর্থনীতিবিদ স্ট্রস-কানের (Strauss- Kahn) মতে, যে মুহূর্তে উৎপাদন গ্রাফ নিম্নমুখী হতে শুরু হয়েছে, এবং বিভিন্ন কোম্পানি কাজের প্রক্রিয়াকে অফলাইন থেকে অনলাইনে মোডে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তখন থেকেই শ্রমের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। এছাড়া বহু কোম্পানী পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এইসব ঘটনার সার্বিক ফল হয়েছে কর্মী ছাঁটাই এবং উদ্ভূত বেকারত্ব। মানুষের আয়ের আকস্মিক হ্রাসের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে ক্রয়ক্ষমতায়। কেবলমাত্র আমেরিকাতেই এই প্যান্ডেমিক সময়ে প্রায় ৩০ শতাংশ (২২ মিলিয়ন) মানুষ কাজ হারিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মহামন্দার সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, ১৯৩৩ সালে এক দশক ধরে চলতে থাকা মন্দায় যখন অর্থনৈতিক বিকাশ সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছিল তখনও যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ছিল ২০ শতাংশ (১৫ মিলিয়ন), এবং মহা আর্থিক সঙ্কটকালে কেবলমাত্র ২.৬ মিলিয়ন মানুষের কাজ হারানোর হিসেব সরকারি খাতায় নথিভুক্ত আছে। চাহিদা এবং যোগানের যুগ্ম ফলার আঘাতে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যুদস্ত। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে বিশ্বের গড় জিডিপি তিন শতাংশ হ্রাস পাবে। এই করোনাজনিত অর্থনৈতিক অবনমন কতটা সুদূরপ্রসারী হবে সেটি নিয়ে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা যারপরনাই চিন্তিত।
পাঁচ, আর্থিক ক্ষেত্রের উপর প্রভাব:
বস্তুতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রভাবের পাশাপাশি বর্তমান সংকট পৃথিবীব্যাপী আর্থিক বাজারকে সংঘাতিকভাবে সংকুচিত করে আগুনে ঘৃতাহুতি ফেলেছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আজকের সমস্যা আর ২০০৮-এর ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস' কিছুটা একই ধরনের। শুধু তফাতের জায়গাটা হল, বর্তমান সংকটের মূল কারণ হল ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ঋণের যোগান, আর মহা আর্থিক সংকটের মূল কারণ নিহিত ছিল সম্পত্তি এবং মর্টগেজ লোন সংক্রান্ত বিবিধ সমস্যা। ঋণ সংক্রান্ত যে সমস্যা ২০০৮ সালে শুরু হয়েছিল কোভিড সময়ে সেই সমস্যা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে আরও প্রকটিত হয়েছে। একদিকে ২০০৮ সাল থেকে অনাদায়ী ঋণের বোঝা, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান ঋণের চাহিদার কারণে সুদের হার বৃদ্ধি, ঋণের এই ব্যয়বৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ কমছে এবং কর্মী ছাঁটাই বাড়ছে। আবার সুদের হার বৃদ্ধি এবং শিল্পোৎপাদনের অধোগতি ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে ডিফল্টারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ এর ফলে ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থা ঋণদানে কৃপণ হতে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে আয় কমিয়ে সামগ্রিক চাহিদা গ্রাস ঘটিয়ে মন্দার মন্দ প্রভাবের গতিবেগ কয়েকগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ছয়, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হল শেষ সহায়:
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আর্থিক মন্দা, কর্পোরেট ঋণজনিত সমস্যা আরও বড় হয়ে দেখা দিত যদি না ২০০৮-এর গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের সমস্ত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, বিশেষ করে ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসত। তাদের সময়মতো যোগদান (কর্পোরেট এবং সরকারি ঋণপত্র ক্রয়) বিশ্বকে আরও বড় আর্থিক সংকটের হাত থেকে আপাতভাবে রক্ষা করেছে। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের সমীক্ষা বলছে, 'What Europe and the US have succeeded in doing is to flatten the curve of financial panic by maintaining the all-important flow of credit. If globalisation facilitated the damage to real economy, it is also the globalisation of finance which is helping us out today because in comparison to 2008 and the Great Depression of course, we have a much better regulated financial system.'
প্যান্ডেমিকের কারণে ব্যবসায়িক ক্ষেত্র যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তার থেকে নিষ্কৃতি দিতে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়ে শূন্য শতাংশ করেছে এবং আরও চোদ্দটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাথে একযোগে কাজ করে বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নতিকামী দেশগুলির আর্থিক বিপর্যয় কিছুটা কমানোর একটা সৎ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কসমূহের এই ভূমিকা তিরিশ দশকের মন্দার সময় পরিলক্ষিত হয়নি। তার বড় কারণ অর্থনীতিবিদ আইসেনগ্রিনের বক্তব্যে ধরা পড়ে - "Gold-standard system hamstrung countries and limited the ability of governments and Central Banks to respond to the real depression. But today FED can keep the global liquidity of dollars going as long as they want to stabilise the world economy. In a nutshell, the Central Banks have intervened on a scale far greater even than in 2008 and in the Great Depression.
তিরিশের মহামন্দা বনাম কোভিডোদ্ভুত মন্দা
বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ইতিমধ্যেই কোভিড সৃষ্ট মন্দার সঙ্গে একমাত্র তিরিশ দশকের মহামন্দার তুলনা চলে বলে মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদরা নিজ নিজ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তুলনামূলক আলোচনায় কতকগুলি চলক ধরে নিয়েছেন। এটা সর্বজনবিদিত যে আমেরিকা দেশটি মহামন্দার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকাকে সামনে রেখে এই পর্বের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
ক) স্থূল জাতীয় উৎপাদনঃ ২০২০ সালের করোনা সংক্রমণের প্রথম তিন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত জিডিপি পাঁচ শতাংশ হ্রাস পায় এবং পরের কোয়ার্টারে এই হ্রাস বেড়ে হয় ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে মহামন্দার কালে ১৯৩০ সালে জিডিপি হ্রাস পায় ৮.৫ শতাংশ, ১৯৩১ সালে আরও ৬.৪ শতাংশ এবং ১৯৩২ সালে পুনরায় ১২.৯ শতাংশ। আবার যদি ২০০৭-০৯-এর মহা আর্থিক সঙ্কটের কথা ভাবা যায়, ওই সময়কালে আমেরিকা ৪.৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের উৎপাদন হারিয়েছিল, যেটি আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ জিডিপি হ্রাস সূচিত করে। সুতরাং হিসাব থেকে বোঝা যাচ্ছে একদম শুরুতেই করোনাসৃষ্ট মন্দা মহামন্দাকে অতিক্রম করে অর্থনীতির অবনমন প্রকট করে তুলেছে।
খ) বেকারত্বঃ মহামন্দার সময় আমেরিকায় প্রতি চারজন ব্যক্তির মধ্যে একজন কাজ হারিয়েছিল, অর্থাৎ বেকারত্বের হার বেড়ে ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কুড়ি হাজারের বেশি কোম্পানী উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল এবং তেইশ হাজার দেশবাসী আত্মহত্যা করেছিলেন। বর্তমান সময়ের সৃষ্ট সঙ্কট মানুষের দুর্দশা আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ‘ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিস্টিকস’ একটা হিসেবে দেখাচ্ছে, ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার বেকারত্বের হার ছিল ৩.৫ শতাংশ, সেটি বেড়ে এপ্রিল মাসে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে, পরে এই হার কিছুটা কমে সেপ্টেম্বর মাসে হয় ৭.৯ শতাংশ। ওইসময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ সেন্ট লুইসের প্রেসিডেন্ট জেমস বুলার্ড আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পরের কোয়ার্টারে দেশের বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ ছুঁয়ে যাবে। ২০১৮ সালের পর ওই দেশে বেকারত্বের হার কখনও চার শতাংশের উপরে ওঠেনি৷ মহামন্দার সময় বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ থাকলেও, সেই বৃদ্ধি ধীরে ধীরে ঘটেছিল, কিন্তু করোনা প্যান্ডেমিক পিরিয়ডে বেকারত্বের অকস্মাৎ বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বেসামাল করে দিয়েছে।
গ) মানসিকতায় প্রভাবঃ তিরিশ দশকের মন্দায় দীর্ঘকাল যাবৎ আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিক যন্ত্রনা মানুষকে জাতীয়তাবোধে অতি সচেতন করে তুলেছিল, যার পরিণামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে এই করোনাকালীন বদ্ধ-জীবন, বাধ্যবাধকতা, নানাবিধ বিধিনিষেধ মানুষের মধ্যে একইরকম সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ, অপ্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং বিদেশীবিরোধী মানসিকতার জন্ম দেবে। যার সম্ভাব্য ফল প্যান্ডেমিক পরবর্তী সময়ে দেশ-কাল ভোগ করবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ভবিষ্যতে বিশ্বায়ন এবং উদারিকরণের সংজ্ঞাটাই হয়ত পাল্টে যাবে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলি অন্য মাত্রা পাবে, আন্তর্জাতিক লেনদেন সন্দেহের চোখে দেখা হবে। সীমান্তে অনেক বেশি কড়াকড়ি করা হবে, মানুষ এবং দ্রব্যসমূহের আসা যাওয়ায় অনেক বেশি বিধিনিষেধ আরোপিত হবে, স্বীকৃত ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট না দেখাতে পারলে ব্যবসায়ী, পর্যটক, ছাত্রী-ছাত্রী-গবেষকদের অন্য দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঘ) স্থায়িত্বঃ মহামন্দার প্রভাব সেই অর্থে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অবসরপ্রাপ্ত বা অবসরের মুখোমুখি থাকা ব্যক্তিদের কথা বাদ দিলে বাকিরা সাময়িক ধাক্কা সামলে সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের পূর্বাবস্থায় ফিরতে সমর্থ হয়েছিল৷ মহামন্দার পরপরই শিল্পোন্নত দেশগুলির অর্থনীতি একটা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেছে, যেটা ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু কোভিড উদ্ভূত মন্দা সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব শুধুমাত্র দেশের মানুষদের আচার-আচরণ এবং জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে না, বিশ্বের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক যোগদান হ্রাস করবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক অনিশ্চিত করে তুলবে।
ঙ) দাম সূচকঃ মহামন্দা কালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশজুড়ে দীর্ঘকালীন মুদ্রাহ্রাস ঘটেছিল। ১৯৩৩ সালে ভোগ্যপণ্যের দামসূচক ১৯২৯ সালের তুলনায় ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ২০২০ সালে প্রথম কোয়ার্টারে দাম সূচক কিছুটা কমলেও পরবর্তী সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরেছে এবং ২০২১ সালে এই মন্দার মধ্যেই জিনিসপত্রের দামের গড় বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
চ) স্টক মার্কেটঃ ১৯২৯ সালের কুখ্যাত স্টক মার্কেট বিপর্যয়ের পর অর্থনীতির প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে। ১৯২৯ সালে অক্টোবরের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে মাত্র তিন মাসে স্টকের দাম ৩০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ১৯৩২ সালে প্রায় ৮৫ শতাংশ দাম হ্রাস ঘটে। করোনা প্যান্ডেমিককালে স্টকের দাম গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে কমে ২০ শতাংশ হয়, কিন্তু জুন মাসে কিছুটা বৃদ্ধির ফলে স্টকের দাম ফেব্রুয়ারির দামের ৯৪ শতাংশে পৌঁছায়। যদিও এই মুহূর্তে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে স্টক মার্কেটের ভবিষ্যৎ আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে৷
পরিশেষে বলা যায়, মহামন্দার তুলনায় করোনা সৃষ্ট মন্দা ব্যাপ্তিতে অনেক বড়। ১৯৩০-এর মন্দার প্রভাব পড়েছিল মূলত পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে, কিন্তু বর্তমান সংকটের করাল ছায়া গ্রাস করেছে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত দেশকে। শুধু ব্যাপ্তিতে নয়, ২০২০ থেকে শুরু হওয়া মন্দার আকস্মিকতা এবং ত্বরিত গতি তামাম বিশ্বকে চমকে দিয়ে, ভয় পাইয়ে যেভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছে, তার তুলনা মানবজাতির ইতিহাসে আর নেই। এর আগেও মনুষ্য সমাজ বহু প্যান্ডেমিকের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু ব্যাপ্তিতে, প্রজ্ঞায়, ধারে এবং ভারে ২০২০-এর মন্দা সবার উপরে থাকবে। এর সবথেকে বড় কারণ হল এই প্যান্ডেমিকজনিত মন্দা যোগান এবং চাহিদা দুটো দিককেই একইসাথে পঙ্গু করে দিয়েছে। যার ফলে অর্থনীতির অবনমনের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। এই ত্বরণের অন্যতম কারণ হল বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন দিন দিন দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তুলেছে, ফলে চাহিদা বা যোগান-শৃঙ্খলের একটা গিঁট খুলে গেলেই পৃথিবী জুড়ে তার প্রভাব পড়ছে। ১৯৩০ সালের 'গ্রেট ডিপ্রেশন'- এর মূল কারণ ছিল চাহিদা হ্রাস, যোগান তার নিজের জায়গাতেই ছিল। আর বর্তমান সময়ে চাহিদা-যোগানের যুগ্ম আঘাতে, সমষ্টিগত অর্থনীতির চলকগুলি সাংঘাতিক ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। শুধু উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থাই নয়, কোভিড প্যান্ডেমিক ব্যাঙ্কিং সেক্টরেও একাধিক ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে। কর্পোরেট সেক্টরে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ অত্যধিক হারে বেড়ে গেছে, এর ফলে আমানতের অপ্রতুলতায় ব্যাঙ্ক নতুন ঋণ সৃষ্টি করতে অপারগ হচ্ছে। অর্থনীতিতে অর্থের যোগান কমে যাওয়ায় চাহিদার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যে কারণে মন্দা গতি পাচ্ছে এবং ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একটাই আশার কথা ১৯৩০ (এমনকি ২০০৮-০৯) সালের তুলনায় সমস্ত দেশের আর্থিক ক্ষেত্র এখন অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। ১৯৩০ সালের স্বর্ণমানের (Gold standard) সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কসমূহের কার্য সম্পাদনে বহু প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেই সমস্যা বর্তমানে কাগজী মুদ্রার যুগে নেই। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গঠনমূলক প্রয়াস কোভিড প্যান্ডেমিক সৃষ্ট মন্দাকে ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে৷ বিশ্ববাসী করজোড়ে প্রার্থনা জানাচ্ছে শীঘ্রই স্বাভাবিক যাপন ফিরে আসুক, পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক, সব বাধা বিঘ্ন জয় করে বিশ্ব অর্থনীতির রথের চাকা আবার স্বাভাবিক গতি পাক।