আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

রুমাল, বেড়াল ও ব্রহ্মাণ্ড

সুরত্না দাস


“ঘাসের ওপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি
অমনি রুমালটা বলল, “ম্যাও!” কি আপদ! রুমালটা ম্যাও করে কেন?”

কাঙ্ক্ষিত বস্তুর জন্য হাত বাড়িয়ে এমন অনাকাঙ্খিত বস্তুর নাগাল পাওয়া যে কেবল অপ্রত্যাশিতই নয়, পারতপক্ষে অসম্ভব, সেই সূত্র ধরে ‘হযবরল’-র তৃতীয় বাক্যেই সুকুমার রায় পাঠককে নিয়ে যান এক অলীক জগতে, যেখানে তারপর থেকে একের পর এক অসম্ভবের অবাস্তবের হাত ধরে গল্পের ধারা এগিয়ে যেতে থাকে তরতর করে। আমাদের রোজনামচার বাস্তব জগতের সাথে ‘হযবরল’-র অলীক জগতের কাণ্ডকারখানার যে বৈপরীত্যগুলি ধরা পড়ে এই গল্পটিতে, তাতেই সৃষ্টি হয় এক অনাবিল হাস্যরসের।

অথচ যা কিনা এই বস্তুজগতের আধার, যা দিয়ে নির্ধারিত হয় বাস্তব জগতের কাণ্ডকারখানার সব নিয়মকানুন, সেই বিজ্ঞানের রঙ্গমঞ্চেই একাধিকবার রুমালের খোঁজে হাত বাড়িয়ে সন্ধান মিলেছে বেড়ালের! পাঠক পাছে ভাবেন নেহাত রসিকতা করা হচ্ছে তাঁদের সাথে, তাই দুটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে প্রথমে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা যাক যে কথাটি মোটেই নেহাত রসিকতা নয়।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর, স্থান জার্মানির উর্‌জ্‌বুক্‌ শহর। পঞ্চাশোর্ধ্ব বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিক উইল্‌হেল্‌ম্‌ রন্টগেন তাঁর পরীক্ষাগারে ক্যাথোড রশ্মির রহস্যোদ্ঘাটনের জন্য একটি পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্বে ব্রতী। সেই সময়ে ক্যাথোড রশ্মির স্বরূপ নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিকই বিশেষ চিন্তিত। তার দু’-তিন দশক আগে কয়েকজন বৈজ্ঞানিক লক্ষ করেন যে ফাঁকা কাচের টিউবের দুই প্রান্তে দুটি ধাতব পাত ঢুকিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করলে পাতদুটির মধ্যবর্তী স্থানে টিউব বরাবর একটি উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভের সৃষ্টি হয় (এই পদ্ধতিতেই প্রস্তুত করা হয় আজকের নিয়ন বাতি), যদিও ক্যাথোড, অর্থাৎ ঋণাত্মক পাতটির সামনের কিছুটা অঞ্চল থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই টিউবের ভেতরকার বাতাস ক্রমাগত বের করে নিতে থাকলে দেখা যেতে থাকে যে ওই উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভের দৈর্ঘ্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, আর তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ক্যাথোডের সামনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল। এইভাবে টিউবের বাতাস বের করে নিতে থাকলে এক সময় আলোকস্তম্ভ সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে টিউবটি পুরোপুরি ঢেকে যাবে অন্ধকারে, অথচ ঠিক তখনই অ্যানোডের (ধনাত্মক পাতের) পেছনের কাচের দেওয়াল হয়ে উঠবে উদ্ভাসিত, আর তাতে ছায়া পড়বে অ্যানোড পাতের। এই পর্যবেক্ষণ থেকে এইটুকু বোঝা গিয়েছিলো যে ঋণাত্মক (ক্যাথোড) পাত থেকে কোনো এক অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয়ে ধেয়ে আসছে ধনাত্মক (অ্যানোড) পাতের দিকে, যার ফলে অ্যানোডের ছায়া পড়ছে পেছনের কাচের দেওয়ালে, আর সাথে সাথে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে সেই দেওয়ালও। এই অদৃশ্য ক্যাথোড রশ্মি (ক্যাথোড থেকে নিঃসৃত বলে এই নামকরণ) তখন দুই দশক ধরে বৈজ্ঞানিকদের শিরঃপীড়ার কারণ।

কিন্তু সেদিন, অর্থাৎ ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর, রন্টগেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো টিউবের ভেতরকার এই রহস্যময় ঘটনা নয়, বরং টিউবের বাইরে ঘটা এক অদ্ভুত ঘটনা। সেদিন ঠিক কী ঘটেছিলো রন্টগেনের পরীক্ষাগারে তার একাধিক বিবৃতি পাওয়া যায় নথিপত্র ঘাঁটলে। তবে বিবৃতিগুলির সারমর্ম এই যে, রন্টগেন লক্ষ করেন টিউবের থেকে প্রায় মিটার খানেক দূরে রাখা একটি কার্ডবোর্ড, যাতে বেরিয়াম-প্ল্যাটিনো-সায়ানাইড নামক একটি রাসায়নিক মাখানো ছিলো, তা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে যখনই তিনি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করছেন তাঁর পরীক্ষাধীন টিউবে (বেরিয়াম-প্ল্যাটিনো-সায়ানাইড রাসায়নিকটির রয়েছে প্রতিপ্রভা (ফ্লুরোসেন্স) ধর্ম, অর্থাৎ তাতে আলো পড়লে রাসায়নিকটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তা থেকে নিঃসৃত হয় এক ম্লান দ্যুতি)। অথচ বাতাসের ভেতর দিয়ে মিটার খানেক দূরত্ব ভেদ করে সেই কার্ডবোর্ড পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষমতাই যে ক্যাথোড রশ্মির নেই সে কথা জানা ছিল আগে থেকেই। টিউবটি মোটা কালো কাগজে মুড়ে, টিউব আর ওই কার্ডবোর্ডের মাঝখানে মোটা ধাতব পাত বা হাজার পৃষ্ঠার মোটা বই রেখেও রন্টগেন দেখলেন যে টিউবে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সাথে সাথে মিটার খানেক দূরে রাখা বেরিয়াম-প্ল্যাটিনো-সায়ানাইডের উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার ঘটনায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, ক্যাথোড টিউব থেকে কোনো এক অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয়ে উদ্ভাসিত করছে মিটার খানেক দূরে রাখা ওই বেরিয়াম লবণকে। সে দিনটি ছিলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন, কারণ এমন হঠাৎ করেই সেদিন রন্টগেন দেখা পেয়েছিলেন এই আশ্চর্য অজানা রশ্মির, যার উৎসের কারণ না জানা থাকায় রন্টগেন তার নাম দিয়েছিলেন 'এক্স রশ্মি' - এমন একটি নাম যা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। আর এই হঠাৎ দেখা পাওয়া এক্স রশ্মিই রন্টগেনকে এনে দিয়েছিলো পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম নোবেল পুরস্কার ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে।

এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনায়। একথা সহজেই অনুমেয় যে এহেন এক্স রশ্মির আবিষ্কারের পরে পরে তা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছিলো তুঙ্গে। ঠিক এমন সময়েই, যখন এক্স রশ্মি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহল তোলপাড়, দেখা পাওয়া গিয়েছিলো আরেকটি ‘বেড়াল’-এর, আর সে ধরা দিয়েছিলো এক নামজাদা ফরাসী বৈজ্ঞানিক অঁরি বেকেরেলের কাছে। আগেই বলা হয়েছে যে বেরিয়াম-প্ল্যাটিনো-সায়ানাইড নামক রাসায়নিকটির রয়েছে প্রতিপ্রভা ধর্ম, অর্থাৎ তাতে আলো পড়লে সেই রাসায়নিকটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তবে আলো সরিয়ে নিলে প্রতিপ্রভ পদার্থ ফিরে যায় তার নিষ্প্রভ অবস্থায়। আবার এমন কিছু কিছু পদার্থ আছে যাতে আলো পড়লে তা উদ্দীপিত হয়ে ওঠে, অথচ আলো সরিয়ে নেওয়ার পরও সেইসব পদার্থ থেকে নিঃসৃত দ্যুতির রেশ থেকে যায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে। পদার্থের এই ধর্মকে বলা হয় অনুপ্রভা (ফস্ফোরেসেন্স)। বেকেরেল পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন অনুপ্রভার কারণে নিঃসৃত আলোতে এক্স রশ্মির কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। রন্টগেনের এক্স রশ্মি যে চোখে দেখা যায় না, সে কথা মাথায় রেখেই বেকেরেল ছক কষলেন একটি সহজ পরীক্ষা পদ্ধতির, ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস। অনুপ্রভ পদার্থ হিসেবে তিনি ব্যবহার করলেন ইউরেনিয়াম ধাতুর একটি লবণ, যাকে সূর্যের আলোতে মেলে ধরলে তা উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। উদ্দীপিত হওয়ার পর সেই লবণ যদি মুড়ে ফেলা হয় মোটা কালো কাগজে, তাহলে তাতে আটকে যাবে অনুপ্রভার ম্লান দ্যুতি, যা চোখে দেখা যায়। অথচ অনুপ্রভায় যদি নিঃসৃত হয় এক্স রশ্মি তাহলে তা ওই কালো কাগজ ভেদ করে বেরিয়ে আসবে অনায়াসেই। তাই কালো কাগজে মোড়া উদ্দীপিত লবণকে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর রেখে দিলে তা থেকে নিঃসৃত এক্স রশ্মি ছাপ ফেলবে সেই প্লেটে, প্রমাণিত হবে অনুপ্রভার দ্যুতিতে এক্স রশ্মির অস্তিত্ব।

প্রথমদিন পরীক্ষা করেই বেকেরেল ফল পেলেন হাতেনাতে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছাপ পড়লো স্পষ্ট। উচ্ছ্বসিতই হওয়ার কথা বেকেরেলের, তাঁর চিন্তাভাবনা যে ঠিক পথে এগিয়েছে প্রথম পরীক্ষার পরেই সে লক্ষণ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানের খাতিরেই যেকোনো বৈজ্ঞানিককে বারংবার যাচাই করতে হয় তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল, যাতে অনেকাংশে লাঘব হয় ভুলত্রুটির আশঙ্কা। বেকেরেল সেদিন জানতেনও না যে তাঁর ভাগ্য তখন দাঁড়িয়ে এক নতুন মোড়ের বাঁকে। পরের দিন যখন বেকেরেল গেলেন তাঁর পরীক্ষাগারে আগেরদিনের পরীক্ষার পুনরাবৃত্তির জন্য, তখন প্যারিসের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্যের মুখ দেখা গেলো না তার পরের বেশ কয়েক দিনেও। হতাশ বেকেরেল ইউরেনিয়ামের লবণকে কালো কাগজে মুড়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটের সাথে রেখে দিলেন তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে। দিন দুই তিন বাদে ড্রয়ার খুলে চমকে উঠেছিলেন বেকেরেল, দেখেছিলেন সেই ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছাপ পড়েছে যা প্রথমবারের চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্ট! অথচ সূর্যালোকের অভাবে ইউরেনিয়াম লবণকে উদ্দীপিত করাই সম্ভবপর হয়নি, ফলে নিঃসৃত হয়নি কোনো অনুপ্রভার আলো। বেকেরেল ইউরেনিয়ামের আরও কিছু লবণ সংগ্রহ করলেন যাদের কোনো অনুপ্রভা ধর্মই ছিলো না। সেই লবণগুলি দিয়েও বেকেরেল করলেন একই পরীক্ষা - কালো কাগজে মুড়ে রেখে দিলেন ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর, আর অবাক হয়ে দেখলেন যে ফটোগ্রাফিক প্লেটে ছাপ পড়ছে স্পষ্ট। বেকেরেল বুঝতে পেরেছিলেন যে অনুপ্রভার দ্যুতি নয়, বরং ইউরেনিয়াম মৌল থেকেই কোনো এক অদৃশ্য রশ্মি নিঃসৃত হয়ে ঘটাচ্ছে এই কাণ্ড। কিন্তু কী সেই রশ্মি, কী তার স্বরূপ - তা নিয়ে আর অগ্রসর হননি বেকেরেল।

এক্স রশ্মির উত্তেজনায় একপ্রকার ধামাচাপাই পড়ে যাচ্ছিলো বেকেরেলের এই পর্যবেক্ষণ, যদি না এই আশ্চর্য ঘটনাকে মাদাম মারী স্কোদভ্‌স্কা কুরী বেছে নিতেন তাঁর ডক্টরেট উপাধির গবেষণার জন্য। এর পরবর্তী ঘটনাসমূহ বিজ্ঞানের ইতিহাসের আরেক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। মাদাম কুরীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তাঁর অতুলনীয় অধ্যবসায়ে আবিষ্কৃত হয় পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম, যার জেরে পদার্থবিজ্ঞানের তৃতীয় নোবেলে ভূষিত হন অঁরি বেকেরেল, পিয়ের কুরী ও মাদাম কুরী ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে।

উপরোক্ত ঘটনা দুটির মতো আরো বেশ কয়েকবার এমন আচমকাই নতুন নতুন দরজা খুলে গেছে বিজ্ঞানের ইতিহাসে - রুমাল খুঁজতে গিয়ে বেড়াল কোলে করে ঘরে ফিরেছেন বৈজ্ঞানিকরা। ইংরিজিতে বেশ সুন্দর একটি নাম রয়েছে এই সব হঠাৎ আবিষ্কারের - Accidental Discoveries। বাংলায় ‘আকস্মিক আবিষ্কার’ বললে হয়তো সঠিক মানেটা উপলব্ধি করতে খানিক সুবিধা হয়। অবশ্য বিজ্ঞানের সুচিন্তিত সুপরিকল্পিত ও যুক্তিজালের নাগপাশে বাঁধা জগতে এমন ঘটনা যে আকছার ঘটে না, তা বলাই বাহুল্য। বিরল হলেও, হঠাৎ খুঁজে পাওয়া এই ‘বেড়াল’গুলি অনেকক্ষেত্রেই ঘুরিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের চলার পথ, বদলে দিয়েছে অনেক সাবেকী চিন্তাভাবনা। বেকেরেলের পর্যবেক্ষণের কথাই ধরা যাক। পরীক্ষা শেষে বেকেরেলের সিদ্ধান্ত - যে অদৃশ্য রশ্মি ছাপ ফেলছে ফটোগ্রাফিক প্লেটে তার উৎসস্থল ইউরেনিয়ামের পরমাণু। অথচ পরমাণুই যে পদার্থের ক্ষুদ্রতম-অবিভাজ্য-অবিনশ্বর অবস্থা এই ধারণাই পোষণ করা হতো তার আগে পর্যন্ত। তাই ইউরেনিয়াম পরমাণু থেকে নিঃসৃত রশ্মি পরমাণুর তৎকালীন অবিভাজ্য-অবিনশ্বর চিত্রের পরিপন্থী, বরং পরমাণু যে আরো ক্ষুদ্রতর কণার সমষ্টি তারই সাক্ষ্য বহন করে এই হঠাৎ খুঁজে পাওয়া ‘বেকেরেল রশ্মি’, যুগান্তর ঘটে যায় বিজ্ঞানের ইতিহাসে।

এমনই এক রুমাল-রূপী বেড়ালের হাত ধরে সূত্রপাত হয় আধুনিক ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের। সালটা ১৯৬৫। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকার বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বার্তা আদানপ্রদান করা যায় কিনা তাই নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত হয় এবং তার একাংশের ভার পড়ে দুই তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্নো পেন্‌জিয়াস ও রবার্ট উইল্‌সনের ওপর। এই কাজের জন্য তাঁরা ব্যবহার করছিলেন বেল ল্যাবরেটরির 'হোমডেল হর্ন' নামক বৃহৎ চোঙার মতো দেখতে একটি অ্যান্টেনা যা সূক্ষ্ম বেতার তরঙ্গ সংগ্রহ করতে সক্ষম। কিন্তু কাজ শুরু করবেন কী! যন্ত্রই যে বিগড়ে বসে আছে! আকাশের যেদিকেই তাক করা হোক না কেন সেই অ্যান্টেনাকে, একটা চাপা খসখসানি থেকেই যাচ্ছে যন্ত্রে, হাজার চেষ্টাতেও তার থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি পায়রায় বাসা বাঁধলো অ্যান্টেনার ভেতরে? হামাগুড়ি দিয়ে অ্যান্টেনার ভেতর ঢুকে পায়রা তাড়িয়ে তাদের বিষ্ঠা পর্যন্ত সাফ করলেন দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু পরিস্থিতি যেই-কে-সেই! আর দুই তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অথৈ জলে। অবশেষে কোনোরকম কূলকিনারা করতে না পেরে তাঁরা যোগাযোগ করলেন মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট ডিকিকে। এই খবর পেয়ে তো রবার্টের মাথায় হাত! কারণ ওই খসখসানিই যে তিনি খোঁজার তালে ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরে। ডিকি পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সনকে খোলসা করে জানালেন, যে খসখস শব্দ তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তার জন্য দায়ী মহাকাশব্যাপী এক বিকিরণ, যা ক্রমবর্ধমান উত্তপ্ত ব্রহ্মাণ্ডের এক অবশিষ্টাংশ মাত্র।

ব্যাপারটা খানিক খোলসা করে বলা যাক। আমাদের ব্রহ্মাণ্ড কেমন হবে তাই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের জনক নিউটন স্বয়ং। তাঁর কল্পনায় ব্রহ্মাণ্ড ছিলো অসীম আর সেই অসীম ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মহাকর্ষের তত্ত্ব অনুযায়ী চির-বিরাজমান, স্থিতিশীল। ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে সেই ধারণাই পোষণ করতেন নিউটন-পরবর্তী বৈজ্ঞানিকেরা। অথচ, ১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিকতাবাদ আবিষ্কারের পর রুশ বৈজ্ঞানিক ফ্রিড্‌ম্যান ও বেলজিয়ান বৈজ্ঞানিক ল্যমাত্রে পৃথকভাবে ১৯২৫ সাল নাগাদ অঙ্ক কষে দেখলেন যে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুসারে সেই অসীম ব্রহ্মাণ্ড বিবর্তমান। অর্থাৎ, তা সময়ের সাথে সাথে সদা পরিবর্তনশীল - হয় তার দেশ সময়ের সাথে সাথে সঙ্কুচিত হচ্ছে, নয় প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন নিজেও সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নিউটনের স্থিতিশীল ব্রহ্মাণ্ডের চিত্রেই তাঁর আস্থা ছিলো বেশি, তাই নিজের তত্ত্বের এই বিশেষ ফলশ্রুতিকে তিনি নিজেই অবহেলা করেছিলেন। ১৯২৯ সালেই ফ্রিড্‌ম্যান-ল্যমাত্রের খাতায়-কলমে পাওয়া ব্রহ্মাণ্ডের সেই বিবর্তনের তত্ত্ব সত্য বলে প্রমাণিত করলেন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এড্‌উইন হাব্‌ল্‌ - তাঁর দূরবীনে ধরা গ্যালাক্সি সমূহের অপসারণের হার থেকে তিনি দেখালেন যে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড (সঙ্কুচিত নয়, বরং) প্রসারিত হচ্ছে ক্রমশ।

ব্রহ্মাণ্ড প্রসারিত হওয়ার অর্থ প্রসারণের সাথে সাথে তা ক্রমশ ঠাণ্ডাও হচ্ছে - এই কথা প্রথম উপলব্ধি করেন সোভিয়েত-মার্কিন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামভ্‌ ১৯৪৮ সালে। পদার্থের শক্তি তার তাপমাত্রার সাথে সমানুপাতিক, অর্থাৎ তাপমাত্রা বেশি থাকলে পদার্থের শক্তিও বেশি থাকে, তাপমাত্রা ক্রমশ কমতে থাকলে কমতে থাকে তার শক্তিও। তাই ব্রহ্মাণ্ডে যে বিপুল পরিমাণ আলোর কণা বা ফোটন রয়েছে তাদের শক্তিও ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণের সাথে সাথে ক্রমশ হ্রাস পাবে। হ্রাস পেতে পেতে যখন তার শক্তি এতোখানি কমে যাবে যে সে আর কোনোরকম বিক্রিয়ায় অংশ নিতেই পারতপক্ষে অক্ষম হয়ে পড়বে, তখন তা ব্রহ্মাণ্ডের বাকি পদার্থের থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়ে যাবে এই ব্রহ্মাণ্ডে, কেবল তার শক্তি আরও আরও হ্রাস পেতে থাকবে ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণের সাথে সাথে। ব্রহ্মাণ্ডে পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন ফোটনকণার এই স্রোত ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বহন করে। আর এই আলোক কণার স্রোতই আচমকা ধরা পড়েছিলো পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সনের হোমডেল হর্ন অ্যান্টেনাতে।

১৯৬৫ সালে পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সন তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করে জানালেন তাঁদের এই মহাকাশব্যাপী বিকিরণের খুঁজে পাওয়ার কথা, আর সেই গবেষণাপত্রে কৃতজ্ঞতা জানালেন রবার্ট ডিকিকে, বিকিরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁদেরকে জানানোর জন্য। সেই একই পত্রিকায় রবার্ট ডিকি তাঁর আরও তিনজন সহকর্মী, পীবল্‌স্‌, রোল ও উইল্‌কিন্‌সনের সাথে এই মহাজাগতিক বিকিরণের ওপর তাঁদের তাত্ত্বিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। গ্যামভের গবেষণার কথা অজানা ছিলো ডিকি ও তাঁর সহ-বৈজ্ঞানিকদের, তাই তাঁর কোনো উল্লেখ ছিলো না ডিকির প্রকাশিত গবেষণাপত্রে। আবার পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সন ডিকিকে কৃতজ্ঞতা জানালেও এই বিকিরণের মহাজাগতিক উৎস নিয়ে তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট সন্দিহান। তাই তাঁদের গবেষণাপত্রে অতি সন্তপর্ণে তাঁরা এড়িয়ে যান এই বিকিরণের কোনো মহাজাতিক উৎসের কথা। তা সত্ত্বেও, ১৯৭৮ সালে এই মহাজাগতিক বিকিরণ (Cosmic Microwave Background Radiation) আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সন - এটিই ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের ঝুলিতে প্রথম নোবেল প্রাপ্তি।

এই মহাজাগতিক বিকিরণ আবিষ্কার আধুনিক ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ এই একটি মাত্র আবিষ্কারেই সন্দেহাতীতভাবে ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের স্বরূপ ধরা পড়ে ছিলো প্রথমবার। এর আগে পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ নিয়ে দুই বিরোধী মতবাদের প্রচলন ছিলো। হাব্‌লের পর্যবেক্ষণকে বিবর্তমান ব্রহ্মাণ্ডের কেবলমাত্র এক পরোক্ষ প্রমাণ হিশেবেই ধরে নিয়েছিলেন তখনকার বৈজ্ঞানিক মহল। তাই নিউটনের স্থিতিশীল ব্রহ্মাণ্ডের সেই চিরন্তন চিত্রকে একেবারে নস্যাৎ করে দিতে পারেননি বৈজ্ঞানিকেরা। আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিকতাবাদকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক ফ্রেড্‌ হয়েল্‌ ১৯৪৮ সালে তাই গড়ে তুললেন এক স্থিতিশীল ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব, যা পরিচিতি পেলো 'Steady State Theory' নামে। হয়েল্‌ ছিলেন বিবর্তমান ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের ঘোর বিরোধী। ব্রহ্মাণ্ড বিবর্তমান মানেই সেই ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক জন্মলগ্ন আছে, যেখান থেকে সেই বিবর্তনের সূত্রপাত। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের এই জন্মলগ্নেই আপত্তি  ফ্রেড্‌ হয়েলের। তিনি মনে করতেন যে বিজ্ঞানীরা এই বিবর্তনরত ব্রহ্মাণ্ডে এই জন্যেই বিশ্বাসী কারণ আদতে তাঁরা বিশ্বাস করেন বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের 'The book of Genesis'-র বৃত্তান্তে যেখানে পরমেশ্বর সৃষ্টি করেন তাঁর এই ব্রহ্মাণ্ড। ফ্রেড্‌ হয়েলের মতে ধর্মীয় কুসংস্কারের বশবর্তী হয়েই বিজ্ঞানের সত্যাসত্য বিচার না করে বৈজ্ঞানিকেরা প্রচার চালাচ্ছেন বিবর্তনরত ব্রহ্মাণ্ডের। ১৯৪৯ সালের ২৮শে মার্চ বিবিসি রেডিওতে সম্প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকারে ফ্রেড্‌ হয়েল্ বলেন যে, বিবর্তমান ব্রহ্মাণ্ড বিশ্বাস করলে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মলগ্নেও বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে এক মহা বিস্ফোরণে (Big Bang) সৃষ্টি হয়েছিলো এই ব্রহ্মাণ্ডের? নিজের মতের বিরোধী মতবাদকে খানিক উপহাসের ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করতে গিয়েই এই 'Big Bang' কথাটি প্রথম উচ্চারণ করেন ফ্রেড্‌ হয়েল্‌। ১৯৬৫ সালে মহাজাগতিক বিকিরণের আবিষ্কার সরাসরি আঘাত হানে ফ্রেড্‌ হয়েলের 'Steady State Theory'-র ওপর, কারণ ব্রহ্মাণ্ড বিবর্তনের মাধ্যমে প্রসারিত না হলে ফোটনের শক্তির হ্রাস হবে না, আর তা না হলে আদি ব্রহ্মাণ্ডের ফোটন কণাগুলি কখনোই অন্যান্য পদার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রহ্মাণ্ডে থেকে যাবে না মহাজাগতিক বিকিরণ রূপে। সেক্ষেত্রে স্থিতিশীল ব্রহ্মাণ্ডে কখনোই সৃষ্টি হওয়ার কথা নয় মহাকাশব্যাপী এই মহাজাগতিক বিকিরণের। মহাজাগতিক বিকিরণের আবিষ্কার তাই স্পষ্টতই মান্যতা দেয় বিবর্তনশীল ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বকে, আর সেই তত্ত্বের প্রধান বিরোধী ফ্রেড্‌ হয়েলের দেওয়া 'Big Bang' নামেই সুপরিচিত হয় আজকের এই আধুনিক বিবর্তনরত ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব।

স্পষ্টতই ‘রুমাল-বেড়ালের’ এইরূপ খেলায় বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে বহুবার। বিজ্ঞানের চলার পথের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এইসব আকস্মিক আবিষ্কার, দরজা খুলে দিয়েছে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক শাখার - আধুনিক ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ, যুক্তিজালে মোড়া বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার আঙিনায় এইসব আকস্মিক আবিষ্কার কখনোই আকাঙ্ক্ষিত নয়। তাই আকস্মিক আবিষ্কারে খুলে যাওয়া নতুন দরজাগুলি দিয়ে বিজ্ঞান আবার এগোয় যুক্তির হাত ধরেই। ১৯৬৫-তে পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সনের আকস্মিক আবিষ্কারের পর অর্ধশতকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, আর আধুনিক ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বও পার হয়ে এসেছে অনেকখানি পথ - আধুনিক বিজ্ঞানের একটি পৃথক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে আজ তা সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পরবর্তী বৈজ্ঞানিকরা আর অপেক্ষা করেননি কোনো রুমাল-রূপী বেড়ালের, বরং আস্থা রেখেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের যুক্তির ভিত্তিতে ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এবং তাকে আশ্রয় করে সুপরিকল্পিত পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়িত করায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

পেন্‌জিয়াস ও উইল্‌সন যে আকাশ-ব্যাপী মহাজাগতিক বিকিরণের দেখা পেয়েছিলেন, তার তাপমাত্রা তাঁরা মেপেছিলেন ৩.৫ কেলভিন (শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস, যে তাপমাত্রায় জল জমে বরফ হয়, তার থেকেও প্রায় ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম)। আকাশের যে দিকেই মাপা হোক না কেন, আদি ফোটনকণার এই তাপমাত্রায় হেরফের হয় না একেবারেই। মহাজাগতিক বিকিরণের তাপমাত্রার আকাশ জুড়ে এই সুষম বিস্তার Big Bang-এ পাওয়া ব্রহ্মাণ্ডের চিত্রের সাথে বেশ খাপে খাপে মিলে যায়। Big Bang মডেলে ব্রহ্মাণ্ডের দেশকে সুষম বলেই ধরে নেওয়া হয় (এটি Big Bang মডেলের একটি পরিগ্রহ বা assumption), তাই সেই সুষম ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্ট কোনো ঘটনা মহাবিশ্বে যে সুষমভাবেই ঘটবে তাতে আর সন্দেহ কি! সেক্ষেত্রে মহাজাগতিক বিকিরণের আকাশ-ব্যাপী সুষম তাপমাত্রা ব্রহ্মাণ্ডের Big Bang মডেলেরই সাক্ষ্য বহন করে। অথচ, আজকের ব্রহ্মাণ্ড কিন্তু মোটেই সুষম নয় - এর কোথাও কোথাও জটলা পাকিয়ে আছে গ্যালাক্সিপুঞ্জ, আবার কোথাও কোথাও কিচ্ছুটি নেই, স্রেফ মহাশূন্য। তাহলে Big Bang-এর সুষম মহাবিশ্ব এমন অসম হলো কেমন করে? এই রহস্য উদ্ঘাটনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেন রবার্ট ডিকির ছাত্র জেম্‌স্‌ পীব্‌ল্‌স্‌। তিনি ধরে নিলেন যে এই অসমতা হঠাৎ করে আজকের ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্ট হয়নি, ব্রহ্মাণ্ডের অনেক আদি কালেই কোনো এক বিশেষ কারণে তার উৎপত্তি। তাহলে মহাজাগতিক বিকিরণ সৃষ্টির কালে যদি এই অসমতা থেকে থাকে ব্রহ্মাণ্ডে, তাহলে তা ছাপ ফেলতে বাধ্য সেই বিকিরণে, ফলে মহাজাগতিক বিকিরণের সুষম তাপমাত্রাতেও থাকে অসমতা। কতখানি হবে সেই অসমতা? ১৯৭০-এর দশকে পীব্‌ল্‌স্‌ অঙ্ক কষে দেখিয়ে ছিলেন বিকিরণের তাপমাত্রায় সেই অসমতা থাকতে হবে ওই ৩.৫ কেলভিনের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ! তবেই সৃষ্টি হবে আমাদের আজকের এই ব্রহ্মাণ্ড। পীব্‌ল্‌সের তত্ত্ব ঠিক হতে হলে খুঁজে পেতে হবে বিকিরণের তাপমাত্রায় সেই অসমতা। সেই অসমতা মাপতেই ১৯৮৯ সালে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NASA, যার নাম রাখা হয় COBE (Cosmic Background Explorer), আর তাতেই ধরা পড়ে মহাজাগতিক বিকিরণের তাপমাত্রায় সেই সূক্ষ্ম (এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাত্র) তারতম্য, যা পীব্‌ল্‌স্ আগেই আঁক কষে বের করেছিলেন! ২০০১ সালে NASA WMAP (Wilkinson Microwave Anisotropy Probe) নামক আরেকটি কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণের মাধ্যমে COBE-র খুঁজে পাওয়া মহাজাগতিক বিকিরণের তাপমাত্রায় তারতম্যকে আরও নিপুণভাবে মেপে মান্যতা দেয় COBE-র খোঁজকে। ২০০৬ সালে নোবেলে ভূষিত হন COBE-র দুই কর্ণধার - জন্‌ ম্যাটার ও জর্জ স্ম্যুট। COBE-র এই আবিষ্কারকেই ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের প্রকৃত সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন নোবেল কমিটি। কারণ এই আবিষ্কার কোনো রুমাল-বেড়ালের খেলায় ধরা পড়া আকস্মিক আবিষ্কার নয়, বরং এই আবিষ্কার ছিলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ নির্ণয়ের প্রথম মাইল ফলক। আর এই আবিষ্কারের পেছনে পীব্‌ল্‌স্‌ ও তাঁর মতো আরও বেশ কয়েকজন তাত্ত্বিকের (রুশ পদার্থবিদ য়াকভ্‌ জেল্‌দোভিচের নাম যাঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য) অবদান অনস্বীকার্য। পীব্‌ল্‌সের কাজের ওপর ভিত্তি করেই COBE খোঁজ করেছিলো সেই সূক্ষ্ম তারতম্যের, পীব্‌ল্‌স্‌ই বলে দিয়েছিলেন কতোখানি সূক্ষ্ম হতে হবে সেই তারতম্য।

আধুনিক ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের সাহায্যে একদিকে যেমন আমরা বুঝতে পেরেছি ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের ইতিহাসকে, তেমনি আবার খোঁজ মিলেছে অনেক অজানা তথ্যের। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণপদার্থ ও তামস শক্তির অস্তিত্বের কথা জানা। এই দুইয়ের উৎসের কথা আমাদের আজও অজানা। তাদের উৎস সন্ধানেও পথিকৃতের কাজ করেছেন পীব্‌ল্‌স্ ও তাঁর সহকর্মীরা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন কী কী কারণে তাদের উৎপত্তি এই ব্রহ্মাণ্ডে। ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের অগ্রগতিতে তাই পর্যবেক্ষণ যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও ঠিক ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব এই কারণেই যেন আবার বৈজ্ঞানিকদের তাকিয়ে থাকতে না হয় কোনো রুমালরূপী বেড়ালের আশায়, বিজ্ঞানই যেন পথ দেখায় ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের অগ্রগতির। সেকারণেই ব্রহ্মাণ্ডের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পথিকৃৎ জেম্‌স্‌ পিব্‌ল্‌সের ২০১৯-এর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলপ্রাপ্তি - খাতায় কলমে ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে’ আমাদের অস্তিত্ব অনুধাবনের প্রচেষ্টারই স্বীকৃতি সেই পুরস্কারে।