আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

সংবিধানের ৩৭০ ধারা কি অবলুপ্ত?

গৌতম লাহিড়ী


দু'বছর মাস খানেক। জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা 'অবলুপ্ত' হয়েছে। এটাই জনপ্রিয় ধারণা। সেই মর্মে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রের সরকার প্রচার করে চলছে। এমনকি ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এমনটাই বিশ্বাস করে। আদৌ কি হয়েছে? না। এর অর্থ এই নয় যে কাশ্মীরে এখনও ৩৭০ ধারা বলবৎ রয়েছে। বিজেপি দল নিঃসন্দেহে সুকৌশলে ৩৭০ ধারা প্রয়োগ স্থগিত করতে পেরেছে। বিজেপি এবং আরএসএস জন্ম লগ্ন থেকেই প্রচার করে এসেছে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হওয়া উচিত। লোকসভার পরে ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাজ্যসভায় সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। আদতে বিলোপ হয়নি। স্থগিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা পরে জানাচ্ছি। নিজেদের সমর্থকদের কাছে গর্বের সঙ্গে প্রচার করছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা মুছে দিয়েছে। আদতে আজও ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা বিদ্যমান। জ্বলজ্বল করছে। কেবলমাত্র প্রয়োগ স্থগিত হয়েছে।

এরকম কি আদৌ করা যায়? এই প্রশ্ন নিয়েই সুপ্রীম কোর্টে মামলা হয়েছে। যার শুনানি আজও হয়নি। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট রাজ্যসভার কার্যবিবরণীতে লেখা রয়েছে, "এই সভা ৩৭০ ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্বারা জারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সুপারিশ করছে - ভারতের রাষ্ট্রপতি ভারতীয় সংসদের সুপারিশে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত ৩৭০ ধারায় বর্ণিত সকল ধারা কেবলমাত্র ১ উপধারা ব্যতীত কার্যকর হওয়া থেকে বিরত থাকবে।" তারপরে মূল বিষয়টি বলা হয়, ভারত সরকার যা যা আইন প্রণয়ন করবে তার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে। অর্থাৎ এতদিন জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা স্বাধীনভাবে যে সিদ্ধান্ত নিতে পারত তা পারবে না। রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রয়োগ স্থগিত হলো।

এটি একটি প্রস্তাব। আইন নয়। বা সংবিধান সংশোধনই নয়। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভা ও রাজ্যসভায় 'প্রস্তাবটি' পেশ করার সময়ে তাই বলেছেন। যদিও ভাষণ দেওয়ার সময়ে একবার বলে ফেলেছিলেন, "বহু আগেই কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ হওয়া উচিত ছিল। রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিরোধীরা প্রতিরোধ করতে পারেননি"। সেই দিনই রাতে রাজ্যসভায় কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রয়োগ স্থগিত হয়ে গেলো।

আশ্চর্যের বিষয় হল বিজেপি সরকার যা চাইছিল সেই মতো সরকারি বয়ান জারি হয়ে গেলো প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর প্রেস বিবৃতিতে। সংসদে যা হয়নি, তার এক রকম বিকৃত ব্যাখ্যা করে প্রেস বিবৃতি জারি হয়ে গেলো - "সংসদ কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার প্রস্তাব পাশ করল"। প্রশ্ন হল এই পথে কেন গেলেন বিজেপি সরকার? সংবিধান থেকে যদি ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হত তাহলে লোকসভা ও রাজ্যসভার দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদদের সমর্থন প্রয়োজন হত। তারপর ভারতের অর্ধেক রাজ্য বিধানসভার অনুমোদন প্রয়োজন হত। এটা করা জটিল। সময় সাপেক্ষ। সাধারণ পরিষেবা কর বা জিএসটি লাগু করার সময়ে এই পদ্ধতি নিতে হয়েছিল। পরিবর্তে সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত হল - সাপও মরল লাঠিও ভাঙ্গল না। চালাকির দ্বারা কখনও কখনও ‘মহৎ’ কার্য করা যায়। প্রমাণিত হল।

অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল - এই প্রস্তাব এবং কাশ্মীর পুনর্গঠন বিলটি কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই সাতসকালে সংসদে পেশ করা হয়। সাধারণত কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে বা আইন পেশ করার আগে স্পীকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান সকল দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। যাকে সংসদীয় পরিভাষায় 'বিজনেস অ্যাডভাইসারি কমিটি' বলা হয়। কোনো আলোচনা ছাড়াই আচমকা সকাল এগারোটায় নতুন কর্মসূচী পেশ করে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

এমন এক 'বৈপ্লবিক' সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মোদী সরকার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ দ্বারা বিজ্ঞপ্তি জারির দু'দিন আগে থেকেই প্রায় ৩৫ হাজার অতিরিক্ত সেনাবাহিনী কাশ্মীর উপত্যকায় মোতায়েন করা হয়েছিল। অনেকেরই ধারণা ছিল হয়তো পাকিস্তান আক্রমণ হানতে চলেছে। আত্মরক্ষার জন্য ভারত সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আদতে কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা স্থগিত করার এবং কাশ্মীরকে বিভক্ত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে।

এই প্রশ্নটাই উঠল সংসদে। কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান অনুযায়ী আদৌ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে প্রথমত প্রস্তাব বা স্ট্যাটুয়ারি রেজলিউশান প্রয়োগ করতে পারে কি? সংবিধানের ৩৭০(৩) ধারা অনুযায়ী উপরের ধারা ব্যতিরেকে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৭০ ধারা স্থগিত বা লঘু রাখতে পারেন। তবে একটি শর্ত রয়েছে। সেটি হল রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি জারি করার জন্য জম্মু-কাশ্মীর গণপরিষদ বা কনস্টিটুয়েন্ট আসেম্বলির অনুমোদন প্রয়োজন। কাশ্মীরের বিধানসভাকে এমনটাই বলা হত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য এই যুক্তি খারিজ করে জানিয়ে দেন - কিসের অ্যাসেম্বলি? রাষ্ট্রপতি তো সকালেই গণপরিষদ ভঙ্গ করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হল - যদি বিধানসভা বা গণপরিষদের অনুমতি নাই মেলে তাহলে রাষ্ট্রপতি একতরফা ভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারেন? আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি কি নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? যদি পারেন তাহলে তো রাষ্ট্রপতি ধাঁচের শাসন ব্যবস্থা লাগু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এটাই তো সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

এর আগে সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ জম্মু-কাশ্মীর বনাম সম্পত প্রকাশ মামলায় রায় দিয়েছিল ৩৭০ ধারা কার্যত স্থায়ী ধারা। অস্থায়ী নয়। তাছাড়া ভারতের সংবিধান প্রণেতারা দীর্ঘ বিতর্কের পরে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার সুযোগ দেওয়ার পক্ষেই রায় দেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ। রাজ্য বিধানসভার মত ব্যতিরেকে যদি কেন্দ্রীয় সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে যে কোনো রাজ্যকেই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে দিতে পারে কি? যেসব রাজ্যে বিজেপি শক্তিশালী নয়, যেমন তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, কেরলকে কি এইভাবে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করা যেতে পারে? প্রশ্নটা সংসদেই করা হয়েছে। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন উহ্য রেখেই প্রথমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে বিধানসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রয়োজন কি প্রয়োজন নয় - এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য তা নয়। প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে। এইসব প্রশ্ন সুপ্রীম কোর্টের সামনে রয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত শুনানি হচ্ছে না। যে প্রশ্নগুলি সংসদে বিতর্কের সময়ে উঠেছে সেগুলি হল এক কলমের খোঁচায় রাজ্যকে পুরসভা করে দেওয়া হচ্ছে। অথবা বলা যেতে পারে কেন্দ্রের উপনিবেশ। মৌলিক প্রশ্ন হল ৩৭০ ধারা ব্যবহার করে কি ৩৭০ ধারা সংশোধন করা যায়? নাকি কোনো আইন এইভাবে বদল করা যায়?

এও মনে রাখা দরকার যখন রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞপ্তি জারি করছেন তখন গোটা কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা, যারা ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের অর্ন্তভুক্তিকে সমর্থন করেন, তাঁদের সকলকে আটক করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নেতাদের আটক করে কোন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে? ভারত বিভাজনের সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ অঞ্চলের যুক্তি উঠেছিল। তা সত্ত্বেও গুরুদাসপুর যেমন ভারতে যুক্ত হয়, তেমনি সংখ্যালঘু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীর ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই কারণেই ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়। পাকিস্তানের মত ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়।

ভারতীয় জনতা পার্টি যে সর্দার প্যাটেলের প্রতি ভক্তি দেখান ইদানীং সেই প্যাটেলই কাশ্মীরকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করায় উদ্যোগী হন। এবং ৩৭০ ধারার মতো বিশেষ ধারার সুযোগ দেওয়াকে সমর্থন করেন। প্রশ্নটা মৌলিক। যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যকে ভেঙ্গে তিন টুকরো করে দেওয়া হয়, তাহলে ভারতের রাষ্ট্র চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন আসন্ন। এই প্রশ্নটাই মুখ্য হয়ে উঠছে।

সংসদে কাশ্মীর সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি এবং রাজ্যকে তিন খণ্ড করে জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল এবং লাদাখকে স্বশাসিত অঞ্চল করার বিল পাশ হওয়ার পরেই সুপ্রীম কোর্টে একগাদা আপীল জমা পড়ে। ওই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়ার দাবি জানিয়ে। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত ঐ মামলার শুনানি হচ্ছে না। সুপ্রীম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ - বিচারপতি রঞ্জন গগৈ (আজ যিনি বিজেপি মনোনীত রাষ্ট্রপতির কোটায় সাংসদ), বিচারপতি এস এ বোবড়ে (যিনি পরে প্রধান বিচারপতি হন), এবং বিচারপতি আবদুল নাজির আপীলের বিরুদ্ধে কোনো নোটিসই কেন্দ্রকে দিলেন না। কেননা, কেন্দ্রের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে ভেণুগোপাল এবং সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা যুক্তি দিয়েছিলেন এই মামলায় কেন্দ্রকে নোটিস দিলে পাকিস্তান রাষ্ট্রসংঘে কাশ্মীর ইস্যু তুলে আন্তর্জাতিক করে দেবে।

অক্টোবর মাসে সুপ্রীম কোর্ট মামলাটি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে কার্যত ঠান্ডাঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। যে কারণে আজ পর্যন্ত শুনানি হচ্ছে না। তার মধ্যে করোনার কারণ তো রয়েইছে। এর মধ্যে কাশ্মীরের কমিউনিস্ট নেতা ইউসুফ তারিগামি সুপ্রীম কোর্টে সম্প্রতি এক নয়া আপীল করে দ্রুত শুনানির আর্জি জানান। কোনো জবাব মেলেনি এখনও পর্যন্ত। সংসদে কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যা সিদ্ধান্ত অনুমোদন করালেন সেটা আদৌ সাংবিধানিক কিনা তার আজও বিচার হলো না। অথচ ৩৭০ ধারা সংবিধান থেকে হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি তারস্বরে প্রচার করে চলেছে। যেটা তারা সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সময় থেকে দাবি জানিয়ে আসছে। এখনও পর্যন্ত কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা স্থগিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের শীলমোহর মেলেনি। আদৌ মিলবে কি?