আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

চিত্তরঞ্জন দাশ

রজত রায়


দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বল্পকালীন রোগভোগের পর কিছুটা আকস্মিকভাবে মারা যান ১৯২৫ সালের ৬ জুন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫৫ বছর। তাঁর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরে ভিয়েনায় বসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে লিখতে বসে সুভাষচন্দ্র বসু মন্তব্য করেন -
"Today, as we look back on the year 1925, we cannot help feeling that if Providence had spared the Deshbandhu a few years more, the history of India would probably have taken a different turn." (Indian Struggle, Subhas Chandra Bose)

ইতিহাসে এমন অনেক সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক ও চর্চা অব্যাহত। যেমন, রাশিয়ায় লেনিনের মৃত্যুর পরে বলশেভিকদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে যদি স্তালিনের বদলে ট্রটস্কি জিততেন, তাহলে রুশ বিপ্লবের অভিমুখ কোন পথে এগোত? শ্রীঅরবিন্দ, যিনি ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাপুরুষ ছিলেন, যদি আচমকাই সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে আধ্যাত্মিক জীবন বেছে না নিতেন, তা হলে ভারতের স্বাধীনতার লড়াই কোন পথে এগোত? অথবা, লোকমান্য তিলক যদি অসময়ে মারা না যেতেন, তা হলে দেশের চরমপন্থীরা কি এত সহজে নিজেদের শক্তি হারিয়ে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সামনে আত্মসমর্পণ করতেন? এরকম উদাহরণ আরও আছে।

চিত্তরঞ্জন দাশের জীবন ও কর্ম প্রসঙ্গে আলোচনায় ইতিহাসের অনিবার্যতার মুখে এই 'যদি' নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ একটাই - মাত্র ছয় বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে তিনি শুধু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের অন্যতমই হয়ে ওঠেননি, আন্দোলনকে নতুন দিশা দেখাতেও শুরু করেছিলেন। আর সেটা তিনি করতে পেরেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই। এক দিক থেকে দেখলে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষচন্দ্রের বেশ মিল চোখে পড়ে। দুজনেই জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। চিত্তরঞ্জন ১৯২২ সালে, সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে। দুজনেই গান্ধীজির বিরোধিতার কারণে কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন এআইসিসি অধিবেশনে নিজের প্রস্তাব পাশ করাতে পারেননি, এবং সেজন্য সভাপতি পদ থেকে ইস্তুফা দিয়ে নতুন দল তৈরি করে পালটা লড়াই চালিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসের মধ্য থেকেই করেছিলেন স্বরাজ পার্টি, আর সুভাষ ফরওয়ার্ড ব্লক। তবে সুভাষচন্দ্রকে গান্ধীজির সম্মতিক্রমে কংগ্রেস কার্যত দল থেকে বহিষ্কার করলেও চিত্তরঞ্জনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অবশ্য তিনি যদি বেশিদিন বেঁচে থাকতেন এবং স্বরাজ পার্টির কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন, তা হলে তাঁকেও কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হতে হত কিনা, সেই প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যায় তাঁর অকালপ্রয়াণে।

তিনি যাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পরে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন, সেই গান্ধীজির সঙ্গেও চিত্তরঞ্জনের বেশ মিল ছিল। দুজনেই বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে নিজের পেশায় নাম করেন। আবার দুজনেই আইন পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে এসে সবকিছু ত্যাগ করে সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন। তবে দুজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল ছিল অন্য এক জায়গায়, দুজনেই তাৎক্ষণিক লাভক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত জীবনযাপনে এবং গোষ্ঠীবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নৈতিকতাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। আজকের দিনে যখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের আচরণে ও জীবনযাপনে নৈতিকতার দিকটিই সবচেয়ে উপেক্ষিত হতে দেখা যায়, তখন রাজনীতিকে সতেচনভাবে নৈতিকতার বেদিতে বসানোর জন্য এই সব দেশনেতাদের প্রয়াসের কথা ভাবলে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দেশবাসীও তাঁদের জীবন ও কর্মের স্বীকৃতি দিতে একজনকে 'মহাত্মা' ও অপরজনকে 'দেশবন্ধু' অভিধায় অভিহিত করতে কার্পণ্য করেনি।

যেহেতু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর বিরোধ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বহু আলোচিত এক অধ্যায়, তাই সংক্ষেপে তার উল্লেখ না করে উপায় নেই। ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে গান্ধীজি একাধিক ছোটবড় আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর গণ আন্দোলনের তত্ত্বকে যাচাই করে দেখছিলেন। ১৯১৭ সালে চম্পারণ সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম পরীক্ষাটি করেন। তারপর আরও কয়েকটি ছোটবড় সত্যাগ্রহের পরে ১৯১৯ সালে খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ইতিমধ্যে দেশে বেড়ে ওঠা হোম রুলের দাবিকে সামাল দিতে মন্টেগু চেমসফোর্ড রিফর্ম জারি করে ব্রিটিশ সরকার দেশের কেন্দ্রীয় আইনসভা ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে দেশীয় মানুষদের অংশগ্রহণের জন্য দরজাটা সামান্য ফাঁক করে। চিত্তরঞ্জন দাশের মতো অনেকেই ওই সামান্য মুষ্টিভিক্ষায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের মত ছিল, কংগ্রেস নির্বাচনে অংশ নিয়ে আইনসভার ভিতরে গিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতিতেই ব্রিটিশ শাসকদের কাজে অনবরত বাধা দিয়ে চলুক। আর ইউরোপীয় সভ্যতা, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির বিপরীতে গ্রামভারতকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণে আগ্রহী গান্ধীজির কাছে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণে ছিল প্রবল অনীহা। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এক বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজির প্রস্তাবিত আইন আমান্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত পাস হয়। যদিও চিত্তরঞ্জন তার বিরোধিতা করে আরও বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিতে চাপ দিচ্ছিলেন। কলকাতায় ওই অধিবেশন থেকেই প্রথম বিলিতি কাপড় ও পণ্য বর্জন, সরকারের স্কুল বর্জন করে জাতীয় স্কুলে (এর পরে তৈরি হবে) পড়তে যাওয়া এবং পরিধেয় বস্ত্র হিসাবে খদ্দরকে গ্রহণ করার ডাক দেওয়া হয়। পরে ডিসেম্বরে নাগপুরের সাধারণ কংগ্রেস অধিবেশনে ওই সব সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় এবং একই সঙ্গে কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংস্কার করে গান্ধীজিকে দলের শীর্ষে মুকুটহীন সম্রাটের মতো ক্ষমতাবান করে দেওয়া হয়।

গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস যখন বিলিতি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে পথে নামতে শুরু করে, তখন বিলেত থেকে একই জাহাজে করে দুই বাঙালি ভারতে ফিরছিলেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষচন্দ্র বসু। দীর্ঘ জাহাজযাত্রার অবকাশে তাঁরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও করেন। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি তখন মধ্যগগনে, আর সুভাষচন্দ্র আইসিএস উত্তীর্ণ হয়েও ইংরেজের গোলামি না করে দেশসেবা করবেন বলে ইস্তুফা দিয়ে ভারতে ফিরছেন। বিলিতি দ্রব্য বর্জনের প্রসঙ্গে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর বিরোধিতার কথা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্য সভায় বলেছেন এবং তাঁর উপন্যাস 'ঘরে-বাইরে'তে অনবদ্যভাবে বুঝিয়েছেন। আর সুভাষচন্দ্র বোম্বাইয়ে জাহাজ থেকে নেমে সেইদিনই দেখা করেন গান্ধীজির সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি নিজেই লিখেছেনঃ "১৯২১ সালের মে মাসে আইসিএস থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে ফিরি। লক্ষ্য ছিল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া।… ১৬ জুলাই বোম্বাই পৌঁছে সেদিনই গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, গান্ধীজির কাছ থেকে আন্দোলনের পরিকল্পনার রূপরেখা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া। মণি ভবনে পৌঁছনোর পর আমাকে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরের মেঝে ভারতীয় কার্পেটে (শতরঞ্চি?) মোড়া। ঘরের কেন্দ্রস্থলে দরজার দিকে মুখ করে উপবিষ্ট গান্ধীজি। ঘরের বিভিন্ন প্রান্তে আরও কয়েকজন। সবার পরনেই খদ্দরের বস্ত্র। আমার পরিধানের সাহেবি পোশাকের জন্য নিজেরই খুব অস্বস্তি হচ্ছিল এবং সেকথা গান্ধীজিকে বলে ক্ষমা চাইতে তিনি স্নিগ্ধ হাসিতে পরিস্থিতি সহজ করে দিলেন। আমার প্রশ্নবাণের উত্তরও তিনি ধৈর্য সহকারে দিচ্ছিলেন। আমি প্রধানত তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। এক, কংগ্রেসের বিভিন্ন ধরণের আন্দোলন কি করে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়ে দেশের মানুষকে ব্রিটিশ শাসকদের চাপানো কর না দিতে উদ্বুদ্ধ করবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেন তিনি মনে করেন যে মানুষ আইন অমান্য আন্দোলন এবং কর দেওয়া বন্ধ করলেই ইংরেজ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবে? তৃতীয় প্রশ্ন, কেন নাগপুর কংগ্রেস থেকেই গান্ধীজি বলতে শুরু করেছেন যে তাঁর দেখানো পথে চললে এক বছরের মধ্যেই দেশে স্বরাজ (পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, হোম রুল) আসবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই এক কোটি টাকার অর্থভাণ্ডার গড়া ও এক কোটি স্বেচ্ছাসেবক জড়ো করার জন্য তাঁর আহ্বানে ভালো সাড়া মিলেছে। পরের কয়েক মাস তিনি বিলিতি পণ্য বর্জনের উপর জোর দেবেন। ব্রিটিশ যখন দেখবে তাতে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তখন তারা কংগ্রেসের উপর দমনপীড়ন নিয়ে আসবে। কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকরা দেশের জেলগুলি ভরিয়ে দিয়ে ইংরেজ শাসকদের নাস্তানাবুদ করে তুলবে। তারপরে শেষ পর্যায়ের আন্দোলনে কর দেওয়া বন্ধ করতে হবে।" প্রথম প্রশ্নের ব্যাখ্যায় সুভাষচন্দ্র সন্তুষ্ট হলেও নিজেই জানিয়েছেন যে, বাকি দুই প্রশ্ন সম্পর্কে গান্ধীজির ধারণা যথেষ্ট ধোঁয়াশাপূর্ণ বলে তাঁর মনে হয়েছিল। তখন গান্ধীজি তাঁকে কলকাতায় গিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করতে পরামর্শ দেন। সুভাষ কেমব্রিজ থেকেই চিত্তরঞ্জনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তিনি আইসিএস ছেড়ে দেশের কাজে যোগ দিতে চান। এইভাবে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগে গান্ধীজি অনুঘটকের কাজ করেছিলেন।

এতদিন কংগ্রেসের মধ্যে যে শহরকেন্দ্রিকতা এবং ভদ্রলোকের আধিপত্য ছিল, তা অসহযোগ আন্দোলনের সুবাদে অনেকটাই গণভিত্তি পেতে শুরু করেছিল। আর সেই সময় কংগ্রেসকে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গান্ধীজি সহযোগী হিসাবে পেয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে মতিলাল নেহরুকে (জওহরলাল নেহরু তখন তরুণ), পঞ্জাবে লালা লাজপৎ রায়কে, বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাশকে, বোম্বাইতে বিঠলভাই ও বল্লভভাই প্যাটেল, পুনাতে তিলকের মৃত্যুর পরে কে সি কেলকার, সেন্ট্রাল প্রভিন্সে অভয়ঙ্কর, বিহারে রাজেন্দ্র প্রসাদ, মাদ্রাজে রাজাগোপালাচারী ও রঙ্গস্বামী আইয়ার, তেলুগু (তখনও অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হয়নি) অঞ্চলে প্রকাশমের মতো তাবড় চিন্তাশীল নেতাদের। এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন কৃতবিদ্য এবং পেশায় আইনজীবি, অর্থাৎ, জীবন নির্বাহের জন্য ব্রিটিশ সরকারের চাকরির উপর নির্ভরশীল নন, স্বাধীন। যেহেতু এঁদের মধ্যে কয়েকজন নিজেদের বুদ্ধিমত্তার উপর যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন, তাই সহযোগী হলেও গান্ধীজির প্রতিটি সিদ্ধান্তকে যাচাই না করে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। এমনকি, প্রয়োজনে তাঁর বিরোধিতা করতেও দ্বিধা করেননি তাঁরা। তাই চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, লাজপৎ রায়দের গান্ধীবিরোধিতাকে সেইভাবেই দেখতে হবে, যা পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র সুভাষচন্দ্র দেখিয়েছিলেন। তিলক ও লাজপৎ রায়ের অকালপ্রয়াণ, তার পরে চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহরুর সঙ্গে গান্ধীজির (কংগ্রেসের) বিচ্ছেদ কার্যত গান্ধীজিরই ক্ষতি করেছিল বলে মনে করেন সুভাষচন্দ্র, কারণ তখন আর তাঁকে সৎ, কিন্তু অপ্রিয় পরামর্শ দেওয়ার কেউ ছিল না।

চিত্তরঞ্জনের স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক জীবনে এহেন স্বীকৃতি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। কিন্তু তাঁর এই প্রদীপ জ্বালানোর পর্বের আগে সলতে পাকানোর পর্বটিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র পালের মতো চরমপন্থী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আলিপুর বোমা মামলায় অরবিন্দের হয়ে আদালতে সাফল্যের সঙ্গে আইনী লড়াই চালিয়ে পাদপ্রদীপে আসেন তিনি। ১৯০৫ থেকে বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ 'বন্দে মাতরম' নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন। চিত্তরঞ্জন নেপথ্যে থেকে ওই প্রকাশনায় অর্থসাহায্য করে গিয়েছেন। পরে অবশ্য নিজের স্বরাজ পার্টি গঠনের পরে তার মুখপত্র হিসাবে 'ফরওয়ার্ড' নামে একটি পত্রিকা বার করেন এবং তার সম্পাদক হিসাবে সুভাষচন্দ্রকে দায়িত্ব দেন। অনেক পরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নিজের আলাদা দল গঠন করার সময় সুভাষচন্দ্র যে 'ফরওয়ার্ড ব্লক' নামটিই বেছে নেবেন, তা নিছক কাকতালীয় না-ও হয়ে থাকতে পারে।

তিনি যখন সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ব্রিটিশদের হয়ে ওই যুদ্ধে ১০ লক্ষের বেশি ভারতীয় সেনা ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল, বহু ভারতীয় সেনা প্রাণও দিয়েছিল। তখনকার দিনের বৃহত্তম ঔপনিবেশিক শক্তি হয়েও ইংরেজরা দাবি করছিল যে, তারা প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছে প্রধানত ছোট ছোট দেশগুলির স্বাধীনতা ও নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তির লক্ষ্যে, তাই ভারতীয় জনগণের মনে আশা জেগেছিল নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর সম্ভাবনায়। তাই কংগ্রেস সহ ভারতীয় রাজনৈতিক মহল থেকে দাবি উঠছিল ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ নীতি স্পষ্ট করার জন্য। এই দাবির জবাবে তখনকার ভারতসচিব (ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভারত সংক্রান্ত বিদেশসচিব) এডুইন মন্টেগু ভারত ঘুরে এসে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডের সঙ্গে যৌথভাবে এক গুচ্ছ সুপারিশ করে ভারতীয়দের সীমিতভাবে দেশের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার দিতে সম্মত হয়। ওই সুপারিশগুলির ভিত্তিতে ভারতের জন্য এক সংবিধান রচনা করা হয়। যা গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯১৯ আইনের মাধ্যমে বলবৎ করা হয়। কিন্তু ওই সব সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা ভারতের শাসনব্যবস্থায় যে সংস্কার করে তাতে ভারতীয়দের হাতে সামান্যই ক্ষমতা দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার যে কোনও সিদ্ধান্ত খারিজ করার ক্ষমতা ভাইসরয়ের হাতে থেকে যাওয়ায় মূল ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতেই থেকে যায়। তা ছাড়া পুলিশ, অর্থ এবং বিচারব্যবস্থা বিষয়ে ভারতীয়দের কোনও মতপ্রকাশের সুযোগ না দিয়ে তা ভাইসরয়ের মনোনীত নিজস্ব এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের হাতে রাখা হয়। এই অবস্থায় কংগ্রেসের মধ্যে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে ও বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। ততদিনে গান্ধিজি কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি আইনসভার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বদলে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৯২০ সালে কলকাতায় এআইসিসি-র বিশেষ অধিবেশন এবং পরে সেই বছরেই নাগপুরে এআইসিসি-র সাধারণ অধিবেশনে তাঁর প্রস্তাবিত কর্মসূচি গৃহীত হয়। ওই সময় মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ গান্ধীজির প্রস্তাবিত আইনসভা নির্বাচন বয়কটের বদলে তাতে অংশ নিয়ে আইনসভার ভিতর থেকে সাংবিধানিক রীতি মেনে সরকারের কাজে ক্রমাগত বাধা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এব্যাপারে কংগ্রেসের মধ্যেকার চরমপন্থীদের নেতা বালগঙ্গাধর তিলক বিরোধীদের নেতৃত্ব দেবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তিলকের আকস্মিক প্রয়াণের কারণে গান্ধীজির পক্ষে নিজের মত প্রতিষ্ঠার কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যায়।

কিন্তু গান্ধীজির পক্ষেও ব্রিটিশদের প্রস্তাবিত সংস্কারকে সরাসরি খারিজ করে আইন অমান্য এবং অসহযোগ আন্দোলনের পথে যাওয়ার ব্যাপারটা অত সহজে হয়নি। ব্রিটিশদের সংস্কারের প্রস্তাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও কয়েকটি ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের সঙ্গেই বিজিত পক্ষের অন্যতম তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। যুদ্ধে জয়ী ব্রিটেন ও ফ্রান্স তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আরবদুনিয়ার বিভিন্ন দেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যত হয়। তখনও পর্যন্ত ইসলামের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বা খিলাফৎ হিসাবে তুরস্ক গোটা ইসলামী দুনিয়ায় স্বীকৃত ছিল। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হলে খিলাফৎ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে, এই আশঙ্কায় ইসলামী দুনিয়ায় এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন মাথা তোলে।

গান্ধীজি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ওই খিলাফৎ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানান। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা সীমিত ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ভারতীয়দের নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে রাউলাট অ্যাক্ট জারি করে। ওই আইনের সুবাদে যে কোনও ভারতীয়কে ব্রিটিশরা বিনাবিচারে অনির্দিষ্টকাল জেলে আটক করে রাখাকে আইনী বৈধতা দেয়। এর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে এমনই এক বিক্ষোভ সমাবেশে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে সেনারা গুলি চালিয়ে কয়েকশো মানুষকে হত্যা ও আরও কয়েকশোকে গুরুতর আহত করে। ওই অবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ফেরৎ দেন। গান্ধীজিও নিজের পত্রিকা 'ইয়ং ইন্ডিয়া'তে পর পর কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন ইংরেজদের কড়া সমালোচনা করে। তার জেরে ১৯২২ সালের গোড়ায় তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গান্ধীজি তাঁর মানসিকতার পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, সারাজীবন ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও বাধ্য হয়েই তিনি ব্রিটিশদের বিরোধিতার পথে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, গোড়ায় কংগ্রেসের সহযোগীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯১৯ সালের অমৃতসর কংগ্রেসে তিনি মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষেই সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু যে ভাবে দমনপীড়নের রাউলাট অ্যাক্ট চালু হল, তারপর জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ঘটল এবং সর্বশেষে ব্রিটিশদের তরফে খিলাফতি আন্দোলনকারী ভারতীয় মুসলমানদের কাছে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হল, তাতে তিনি মর্মাহত। আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও অমৃতসরের মানুষদের ক্ষতে প্রলেপের কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হল না, ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হল না দেখে গান্ধীজি বুঝতে পারেন যে, ইংরেজরা শাসনব্যবস্থায় সংস্কার করে ভারতীয়দের তাতে অংশীদার করার প্রস্তাব করায় যে আশা জেগেছিল, তা সবই মিথ্যা প্রমাণিত। তাই বিরোধী গণআন্দোলন করার পথে তিনি যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ও আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব নিয়ে ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশনে আলোচনা হয়। আগে মনে করা হয়েছিল বাল গঙ্গাধর তিলক ওই অধিবেশনে অংশ নিয়ে চরমপন্থীদের হয়ে গান্ধীজির বিরোধীপক্ষের নেতৃত্ব দেবেন। কারণ, চরমপন্থীরা চাইছিল, পুরনো হোম রুলের দাবি ছেড়ে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি গ্রহণ করুক। কিন্তু সে বছরই আগস্ট মাসে তিলক আচমকা মারা যান, ফলে, গান্ধীজির পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে যায়। গান্ধীজির প্রস্তাব অনুযায়ী কংগ্রেস অহিংস আন্দোলনের পথে যাওয়ার সঙ্গেই যাবতীয় সরকারি খেতাব বিসর্জন, আইনসভা, আইন আদালত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বছরই ডিসেম্বরে নাগপুরে কংগ্রেস অধিবেশনে কলকাতার বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে খতিয়ে দেখে তা অনুমোদন করা হয়। চিত্তরঞ্জন এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা সেখানেও গান্ধীজির বিরুদ্ধে গিয়ে আইনসভা বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিলের চেষ্টা করেন। কিন্ত ততদিনে সে বছর নির্বাচন পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে কংগ্রেস অধিবেশনে প্রতিনিধিদের মধ্যে বিশেষ হেলদোল হয়নি। ফলে, গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাবে চিত্তরঞ্জন সায় দিতে বাধ্য হন। নাগপুর অধিবেশনে বয়কট আন্দোলনের প্রস্তাব পাস করানোর সঙ্গেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতদিন কংগ্রেসের সংবিধানে হোম রুল বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থেকে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দলের মধ্যেকার বামপন্থীরা তাতে সন্তুষ্ট ছিল না। এবার নাগপুর কংগ্রেসে সংবিধান সংশোধন করে দলের লক্ষ্য স্বরাজ আনার কথা বলা হল। কিন্তু 'স্বরাজ' বলতে কি বলা হচ্ছে তা স্পষ্ট করা হল না। বরং তা কংগ্রেস নেতাদের নিজের নিজের ভাবনার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হল। সুভাষচন্দ্র মনে করেন, গান্ধীজির দৃষ্টিতে স্বরাজের অর্থ - সম্ভব হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেই স্বায়ত্ত শাসন, আর নিতান্তই তা অসম্ভব হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ না থেকে স্বরাজ আনা। মনে রাখতে হবে, কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলে ঠিকই, কিন্ত আরও প্রায় ১০ বছর পরে। তার অনেক আগেই চিত্তরঞ্জন যে আলাদা দল গঠন করবেন এবং তার নাম দেবেন 'স্বরাজ পার্টি'।

গান্ধীজি তো দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলেন, কিন্তু ১৯২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেই আন্দোলনে তেমন সাড়া মিলছিল না, স্বরাজ আসারও কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এই সময় প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস একটা সুযোগ পেল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করল, প্রিন্স অব ওয়েলস যেখানে যেখানে যাবেন, সেখানেই তাঁকে বয়কট করা হবে। শুরুতে ইংলন্ডের যুবরাজের বোম্বাই পৌঁছনোর দিন দেশ জুড়ে হরতালের ডাক দেওয়া হল। কলকাতায় তাতে ভালো সাড়া পেলেও বোম্বাইতে তা তেমন সফল হল না। ব্রিটিশ প্রশাসন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে ওই বিক্ষোভ প্রদর্শনকে 'বেআইনী' ঘোষণা করল। কিন্তু আইন অমান্য করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা সেভাবে তখনও এগিয়ে আসছিল না। তখন আন্দোলনে গতি আনতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে চিত্তরঞ্জন দাশ ঠিক করলেন, তিনি, তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও পুত্র একটি ছোট দল নিয়ে আইন অমান্য করবেন। যা ভাবা গিয়েছিল, হলও তাই। ইংরেজ সরকারের পুলিশ প্রথম দিন দেশবন্ধুর পুত্রকে, তারপরে স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষ স্বেচ্ছায় আইন অমান্য করতে এগিয়ে আসতে শুরু করল। এরপরে ১০ ডিসেম্বর, ১৯২১ চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র, বীরেন্দ্র শাসমল সহ দেশবন্ধুর আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

ততদিনে দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকরা আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে বাংলার জেলগুলি ভরিয়ে তুলেছেন। তখন আইন অমান্যকারীদের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল, তাঁরা কেউই আদালতে আইনী সহায়তা নেবেন না। ফলে বিচারকদের পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে যায়। দ্রুত শ'য়ে শ'য়ে আইন অমান্যকারীর বিচারের নিষ্পত্তি হতে থাকে। কিন্তু তাঁদের মুক্তির আদেশ হলেও বন্দীরা কেউই জেল ছেড়ে যেতে রাজি নন। বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে কোনও ফল হল না। এদিকে প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা সফর নির্দিষ্ট রয়েছে ২৪ ডিসেম্বর তারিখে। তাই প্রশাসন বলপ্রয়োগ করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে রাজি নয়। এই অবস্থায় ভাইসরয় লর্ড রিডিং এলেন কলকাতায়। তারপর তাঁর বার্তা নিয়ে মদনমোহন মালব্য প্রেসিডেন্সি জেলে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করলেন। লর্ড রিডিংয়ের তরফে প্রস্তাব ছিল, কংগ্রেস যদি আন্দোলন প্রত্যাহার করে প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর নির্বিঘ্নে হতে দেয়, তাহলে সরকার সব স্বেচ্ছাসেবীদের জেল থেকে মুক্ত করে দেবে এবং শীঘ্রই কংগ্রেসের সঙ্গে একটা রাউন্ড টেবল বৈঠকের আয়োজন করে ভারতের নতুন সংবিধান তৈরির বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে। তখন মহাত্মা গান্ধী ছাড়া দেশের বেশিরভাগ নেতাই জেলে। এই অবস্থায় চিত্তরঞ্জন প্রথমে জেলে বসেই মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ করেন। তারপর প্রস্তাব দেন, শুধু সত্যাগ্রহীদের মুক্তি দিলেই হবে না, খিলাফত আন্দোলনের দুই নেতা মহম্মদ আলি ও সৌকত আলিকেও (তাঁদের দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল) মুক্তি দিতে হবে। ভাইসরয়ের তরফে জানানো হল, ওই দুজনকে যেহেতু সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বন্দী করা হয়নি, তাই তাঁদের মুক্তির বিষয়টি কংগ্রেস আন্দোলন বন্ধ রাখার পূর্বশর্ত হিসাবে রাখতে পারে না। তবে ভাইসরয়ের আশ্বাস, ওদের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে, কিন্তু আগে কংগ্রেসকে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে।

গান্ধীজিকে টেলিগ্রাম করে চিত্তরঞ্জন ও মৌলানা আজাদ সব জানালেন। কিন্তু গান্ধীজি আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের মুক্তির দাবিতে অনড়। ফলে আলোচনা আর এগোল না। চিত্তরঞ্জনের যুক্তি ছিল, ১৯২১ সাল শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি, অথচ গান্ধীজির ঘোষণামত স্বরাজ আসার কোনও লক্ষণই নেই। তাই ভাইসরয়ের এই সন্ধিপ্রস্তাব গ্রহণ করলে কংগ্রেসের (এবং অবশ্যই গান্ধীজির) অন্তত কিছুটা মুখরক্ষা হবে। তা ছাড়া যদি রাউন্ড টেবল বৈঠক করে কোনও ইতিবাচক কিছু না পাওয়া যায়, তখন কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আবারও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতেই পারে। এ নিয়ে কয়েক দফা চিঠিপত্র আদানপ্রদানের পরে গান্ধীজি সুর নরম করে তখনকার মতো সন্ধি করতে রাজি হন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ শাসকরা আর এ নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হয়নি। এভাবেই গান্ধীজির প্রতিশ্রুত 'স্বরাজ' অধরা রেখেই ১৯২১ শেষ হয়।

১৯২২ সালের শুরুতেই দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গান্ধীজি এবার সরাসরি কর দেওয়া বন্ধ রাখার আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিয়ে ভাইসরয়কে চিঠি দিলেন। বললেন, সরকার যদি কংগ্রেসের দাবিসমূহ সম্পর্কে নমনীয় মনোভাব না দেখায়, তাহলে অচিরেই গুজরাতের বরদলি এলাকায় কর দেওয়া বন্ধ রাখার আন্দোলন শুরু করবেন। সেইমত সব প্রস্তুতির মধ্যেই ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরায় উত্তেজিত জনতা স্থানীয় থানায় আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে দিলে বেশ কয়েকজন পুলিশ মারা যায়। ক্ষুব্ধ, মর্মাহত গান্ধীজি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আন্দোলন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এতে দলের অন্দরমহলে তীব্র ক্ষোভ শুরু হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ জেলে বসেই গান্ধীর ওই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর ক'দিন পরেই ২২ মার্চ গান্ধীজি গ্রেফতার হন এবং আদালতে নিজের বক্তব্যে বিচারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেনঃ I am guilty as charged. ইংরেজ বিচারক তাঁকে ছয় বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়। গান্ধীজির ওই বিচারপর্বের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তখনই বুঝতে পেরে ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে দেশবন্ধু ওই বিচারের তুলনা হিসাবে রোমান বিচারক পন্টিয়াস পিলাতের সামনে যীশুখ্রিষ্টের বিচারের উল্লেখ করেছিলেন।

এদিকে জেলে বসেই চিত্তরঞ্জন বাংলা প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে বুঝতে পারেন যে, আন্দোলন গান্ধীজি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তিনি তখন জেলে বন্দী অন্য সহযোগীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আইনসভা থেকে শুরু করে প্রাদেশিক সভা এবং যেখানে যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায় তা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে কংগ্রেসকে অংশ নিতে হবে। এভাবে সরকারে আসা সম্ভব হবে না ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেসের নির্বাচিত সদস্যরা আইনসভায় গিয়ে সরকারের বিভিন্ন কাজের ক্রমাগত সমালোচনা করে প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়াইয়ের অন্য রণাঙ্গন তৈরি করতে পারবে। চিত্তরঞ্জন তখন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। তাই ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁর পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব পেশ করা হলেও গান্ধীজির অনুগামীদের বিরোধিতায় তিনি ভোটে পরাজিত হন। এর পরে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হয় নতুন দল গড়ার। ওই গয়া অধিবেশন চলাকালীনই মতিলাল নেহরু ঘোষণা করেন কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই তাঁরা 'স্বরাজ পার্টি' গঠন করছেন। সেই পার্টির সভাপতি হন চিত্তরঞ্জন দাশ, সাধারণ সম্পাদক মতিলাল নেহরু।

স্বরাজ পার্টি যে ১৯২২ সালে তৈরি হওয়ার পরের তিন বছরের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, তার প্রমাণ ওই সময় কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচনে স্বরাজ পার্টির আপেক্ষিক সাফল্যের খতিয়ান। সুভাষচন্দ্রের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইনসভায় মোট ১৪৫টি আসনের মধ্যে স্বরাজ পার্টি পেয়েছিল ৩৮টি। মনে রাখতে হবে, তখন ব্রিটিশ শাসকরা দেশে সবার জন্য ভোটাধিকার না দিয়ে বিভিন্ন বাছাই করা ইন্টারেস্ট গ্রুপ (যেমন, জমিদার ও ভূস্বামী শ্রেণি, ইউরোপীয়, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং কিছু সাধারণ মানুষ) ইত্যাদির জন্য আলাদা করে আসন নির্দিষ্ট করে রেখেছিল এবং ভোটদাতাদের সংখ্যা গোটা দেশে মোট ১০ লক্ষের মধ্যে সীমিত ছিল। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় আইনসভায় ১৪৫টি আসনের মধ্যে ভোট হত মাত্র ১০৫টিতে, বাকি ৪০টি আসন ব্রিটিশরা নিজেদের অনুগত আমলা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকদের মনোনীত করে আনত। কংগ্রেস ১৯২৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকে। এই অবস্থায় স্বরাজ পার্টি কেন্দ্রীয় আইনসভায় ৩৮টি আসন জিতে সবচেয়ে বড় দল হিসাবে বিরোধী নেতার মর্যাদা পায়। একইভাবে স্বরাজের সাফল্য আসে প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচনেও। (অবিভক্ত) বাংলায় ১৩৯টি আসনের মধ্যে ৪৯টি, সেন্ট্রাল প্রভিন্সে ৬৯টির মধ্যে ৫০টি, ইউপি (তখনকার আপার প্রভিন্স) তে ১২৩টির মধ্যে ৩৮টি, পঞ্জাবে ৮৩টির মধ্যে ২৮টি এবং বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ১১১টির মধ্যে ৩২টি আসন পায়। মনে রাখতে হবে, তখন স্বরাজ পার্টির বয়স মাত্র এক বছরও পেরোয়নি।

এই সাফল্যের ফলে কংগ্রেসের মধ্যে স্বরাজপন্থীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীবাদীরা চিত্তরঞ্জনের স্বরাজপন্থীদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। যার ফলে, আগের অবস্থান থেকে সরে এসে কংগ্রেস চিত্তরঞ্জনের দাবি অনুযায়ী আইনসভা ও স্থানীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলির নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

সেই অনুসারে ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের আইন সংশোধন করে ভোটার সংখ্যা ও এলাকা বৃদ্ধির পরে স্বরাজ পার্টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কলকাতার মেয়র, শহীদ সুরাবর্দী ডেপুটি মেয়র হন এবং সুভাষচন্দ্রকে চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার পদে নিযুক্ত করেন। তাঁর আমলে কলকাতা কর্পোরেশন পুরনো রীতি থেকে সরে এসে ব্রিটিশ রাজপুরুষদের সম্বর্ধনা দেওয়ার বদলে মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু প্রমুখ দেশীয় গুণীজনকে সম্বর্ধনা দিতে শুরু করে। কর্পোরেশনের মেয়র থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সব কর্মীর পরিধান হিসাবে খদ্দর চালু হয়। সেই সঙ্গে শহরে অসংখ্য পৌর বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছোটদের জন্য বিনামূল্যে দুগ্ধ বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়। শহরের ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীর সংস্কার করে আধুনিক করার জন্য কর্পোরেশনের প্রাক্তন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্য নিয়ে একটি সার্বিক পরিকল্পনাও সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়, যা ১০ বছর ধরে টালবাহানার পরে সরকার গ্রহণ করে। শহরের বেশ কয়েকটি পার্ক ও রাস্তার নাম পালটে বরেণ্য দেশীয় নেতাদের নামে রাখা হয়। কর্পোরেশনের কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। কর্পোরেশনের কাজে নিত্যব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস কেনার সময় নিয়ম করে দেশীয় পণ্য কেনার উপর জোর দেওয়া হয়। স্বরাজ পার্টির পরিচালনায় কলকাতা কর্পোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পগুলি নিয়ে সরকার বিশেষ মাথা না ঘামাতেই পারত, কিন্ত কেন্দ্রীয় আইনসভায় এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় স্বরাজ পার্টির সদস্যরা ক্রমাগত হৈচৈ বাধিয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলায় সরকার স্বরাজ পার্টিকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছিল না। এ ভাবেই চিত্তরঞ্জন সাংবিধানিক পদ্ধতির সঙ্গে গণআন্দোলনকে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই সময়েই (১৯২৩ সালের শেষভাগে) দেশবন্ধু হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন দূর করে সম্প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করার লক্ষ্যে 'বেঙ্গল প্যাক্ট' করেন। তখন অবিভক্ত বাংলায় জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকুরিতে, শিক্ষায় তাদের উপস্থিতি অনেক কম ছিল। এ নিয়ে মুসলমান সমাজের মধ্যে হিন্দুদের প্রতি ক্ষোভও ছিল। চিত্তরঞ্জন তা সংশোধন করার চেষ্টায় 'বেঙ্গল প্যাক্ট' করলেও ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে কোকনদ কংগ্রেস অধিবেশনে তা খারিজ হয়ে যায়। কারণ হিসাবে বলা হয়, মুসলমানদের অনেক বেশি বেশি ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনে (১৯২৪ সালের মে মাসে ) চিত্তরঞ্জন তাঁর 'বেঙ্গল প্যাক্ট' প্রস্তাব পাস করাতে সক্ষম হন। এভাবেই তিনি গান্ধীজির সমান্তরালে কংগ্রেসে (এবং অবশ্যই নিজের স্বরাজ পার্টির মধ্যে) ব্রিটিশ শাসনের অবসানকল্পে বিকল্প লাইন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যান।

গান্ধীজির সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মৌলিক পার্থক্য কোথায়? দুজনেই আন্দোলনের গণচরিত্র ধরে রাখতে আগ্রহী। গান্ধীজি যদি গোড়ায় ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশবাসীর জন্য কিছু কিছু সুবিধা ও অধিকার করতে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন, এবং পরে বাধ্য হয়ে অসহযোগ ও আইন অমান্যের পথ গ্রহণ করে থাকেন, চিত্তরঞ্জন আর এক ধাপ এগিয়ে গোড়া থেকেই আইন অমান্য ও অসহযোগকে বৃহত্তর রণকৌশল হিসাবে গ্রহণ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আইনসভার মধ্যে গিয়ে অসহযোগকে অন্য মাত্রা দিতে আগ্রহী ছিলেন। দুজনেই সংহিস পথ বর্জনে নীতিগতভাবে বিশ্বাসী, কিন্তু গান্ধীজি চৌরিচৌরা কাণ্ডের পরে পূর্বঘোষিত আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি একতরফাভাবে বাতিল করতে দ্বিধা করেন না। অন্যদিকে, আরও অনেক কংগ্রেস নেতার মতোই চিত্তরঞ্জন গান্ধীজির ওই সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য সমালোচনা করতে পিছিয়ে যান না। সহিংস কর্মকাণ্ডে নিজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ না করতে চাইলেও এ নিয়ে গান্ধীজির মতো তাঁর ছুঁৎমার্গ ছিল না। তাই বিপ্লবী তরুণ গোপীনাথ সাহা কলকাতার পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার পরে আদালতে দাঁড়িয়ে সেই কথা স্বীকার করে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দেওয়ার পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন। তবে দুজনেই সম্ভবত প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ছিলেন না। অবিভক্ত বাংলায় কংগ্রেস সংগঠনে দেশবন্ধু একজন ডিক্টেটরের মতোই ক্ষমতা ভোগ করেছেন, যা সর্বভারতীয় কংগ্রেসে গান্ধীজি করেছেন। হয়তো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দেশের অনেক নেতাই প্রকৃত দেশপ্রেমী হয়েও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ছিলেন না, যেমন সুভাষচন্দ্র।

তবে এই প্রসঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের গান্ধীজি সম্পর্কে মূল্যায়ণ প্রণিধানযোগ্য। সুভাষচন্দ্র তাঁর 'Indian Struggle' বইয়ে লিখেছেন যে গান্ধীজির গুণ ও দোষ নিয়ে প্রায়শই মন্তব্য করতেন দেশবন্ধু। "According to him, the Mahatma opens a campaign in a brilliant fashion; he works it up with unerring skill; he moves from success to success till he reaches the zenith of his campaign - but after that he loses his nerve and begins to falter." আর যিনি অসহযোগ আন্দোলনকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান রণকৌশল হিসাবে গ্রহণ করে কংগ্রেসকে সেই পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং সেই কারণেই চিত্তরঞ্জনের প্রস্তাবিত পথে কংগ্রেসকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে রাজী হননি, সেই গান্ধীজিও স্বরাজ পার্টির এই নজিরবিহীন সাফল্য দেখে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, "My political conscience is in keeping of the Swarajists. I shall cling to the Swaraj Party as a child cling to its mother."