আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

প্রথমবার চীনে

অমিয় দেব


‘দি গ্রেট ওয়াল’ নামের জনপ্রিয় ফিল্ম দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ল আমিও তো ওই প্রাচীরে চড়েছিলাম। যেবার প্রথম চীন যাই সেবারই। ১৯৯৫-তে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে - সভা ও সম্মিলনে গিয়েছিলাম, তা শেষ হলে একটু ভ্রমণের ব্যবস্থা ছিল। তাতেই। এক মিং সমাধি প্রাসাদও সেইসঙ্গে দেখেছিলাম। মনে আছে সেই প্রাসাদের গর্ভগৃহে নেমে কোনও এক মিং-বংশীয় সম্রাটের প্রস্তরীভূত চিরনিদ্রা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আর চীনের প্রাচীরে চড়ে রীতিমত উল্লাস হয়েছিল। উল্লাসের একটা কারণ অবশ্যই এতদিন যা ছবিতে দেখে এসেছি তার বাস্তবে পরিগ্রহ হয়ে ওঠা। আরেক কারণ হয়তো এই অভিজ্ঞতা যে চীনেরাও খানিকটা আমাদেরই মতো - যেখানে সেখানে পসরা নিয়ে বসে পড়ে, ওই মহাপ্রাচীরও বুঝি ব্যতিক্রম হবার নয়। না না, ঠিক বাজার নয়। কিন্তু সওদা করার লোক দেখলে কতক পসরাবাহী জুটে যাওয়া বোধকরি অসম্ভব নয়। আর তাতে যে দর কষাকষিও করা যায় তাতে আমার মতো ভারতীয়ের প্রাণে কিঞ্চিৎ পুলক লাগতেই পারে।

সেবার বেইজিং গিয়েছিলাম ব্যাংকক হয়ে। ব্যাংককে একটা রাত কাটাতেও হয়েছিল। এয়ারলাইন্সই হোটেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ডিনার খেতে বসে পরের দিন আমার মতোই বেইজিং-যাত্রী এক চৈনিকের সঙ্গে আলাপ হল। বিদেশে থাকেন। অনেকদিন পরে স্বদেশ যাচ্ছেন। খুব উল্লসিত। আমি প্রথম চীন যাচ্ছি শুনে আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, কোনও ভাবনা নেই, তিনি সব দেখিয়ে দেবেন। বেইজিং-এ আমার গন্তব্যেও আমাকে পৌঁছিয়ে দেবেন। তাঁকে অভিভাবক মতো পেয়ে আমার নিশ্চিন্ত লাগল। সকালে একসঙ্গেই এয়ারপোর্ট গেলাম। চেক-ইন করে বসবার জায়গাও পেলাম পাশাপাশি। গল্প করতে করতে একসময় ভাসলাম মহাচীনের আকাশে। বেইজিং নেমেও বিভ্রান্ত হইনি, অতিথিকে তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। ইমিগ্রেশনে আমার পাসপোর্ট দেখে আমাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছাপ দিয়ে দিল। কিন্তু আমার সহযাত্রীর পাসপোর্ট দেখে মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ওঁকে একটা অন্য জায়গায় ডেকে নিয়ে গেল। তিনি যেতে যেতে আমাকে বললেন, তুমি এগোও, আমি একটু পরেই আসছি। এগিয়ে গিয়ে আমি তাড়াহুড়ো না করে, নিজের ব্যাগ সংগ্রহ করে কাস্টমসে গেলাম। সেখানেও সহজেই ছাড়া পেয়ে গেলাম। বেরিয়ে দেখি আমার নাম লেখা নিশেন হাতে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে তক্ষুনি শহরের পথ না ধরে আমার সহযাত্রীর জন্য খানিক অপেক্ষা করলাম। শেষ পর্যন্ত বুঝলাম ১৯৯৫-এর চীনে বিদেশীরা যতটা স্বাগত, বিদেশবাসী স্বদেশীরা ততটা নয়।

অথচ চীনে তখনও বিদেশীদের জন্য আলাদা বিপণি। যেখানেই টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, সেখানেই দুটো লাইন। একটা স্বদেশবাসীদের, অন্যটা বিদেশীদের। আর বিদেশীদের টিকিটের দামও ঈষৎ অধিক। তিয়ানআনমেন স্কোয়ারের সেই বিখ্যাত প্রবেশগৃহ - যার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাও ১৯৪৯-এর ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন (বাড়িটার গায়েই এখন মাওয়ের মস্ত মুখাবয়ব জ্বলজ্বল করছে) - ঢুকতে গেলে যেমন, বা তিয়ানআনমেনের একপাশে, মাওয়েরই সমাধিগৃহে, তেমনি রাস্তাঘাটে কোনও সর্বসাধারণের ব্যবহার্য শৌচালয়ে ঢুকতে গেলেও। সর্বত্রই আলাদা টিকিট হাতে পাশাপাশি দুটো লাইন। (তবে জানি না - আমার সেই সহযাত্রীর যে-দশায় পড়তে হয়েছিল বেইজিং ইমিগ্রেশনে তা মাথায় রেখে বলছি - অভিবাসী চৈনিকদের কোন লাইনে থাকবার কথা।)

বিদেশীদের জন্য তখনও তন্নির্দিষ্ট দোকানে যাবার কথা হলেও, রাস্তায় মেলে রাখা পসরা কিনতে কোনও বাধা ছিল না। পর্যটনসুখী মহাপ্রাচীরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনের রাস্তায় প্রায় উবু হয়ে বসে দর করতে তো আমাকে কেউ আটকায়নি। হতে পারে তা আমার এশীয় চেহারায় তেমন দৃষ্টিকটু লাগেনি, যেমন লাগতে পারত আমি শ্বেতাঙ্গ হলে। আর বলা বাহুল্য, সেই রাস্তাও খুব ঝকঝকে হলে অমন প্রাকৃত পদ্ধতিতে সওদারই প্রশ্ন উঠত না। এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণও যে খুব ঝকঝকে ও অত্যাধুনিক ছিল তা নয়। তবে পরিচ্ছন্ন, কোথাও কোথাও খানিক ছায়াচ্ছন্নও। বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদুটি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় নিয়ে আসে। তাদের হাসিখুশি ব্যবহারে আমি মুগ্ধ, মুগ্ধ অতিথিশালার ঘরোয়া পরিবেশেও। যে-কদিন ছিলাম, রোজ সকালে একটু হাঁটতে বেরোতাম। ক্যাম্পাসে এক চমৎকার লেক ছিল, নানা রঙের জলজ পাদপে শোভমান। ভালো লাগততার ধারে গিয়ে দাঁড়াতে বা পাড় ধরে হাঁটতে। কোনও নাম ছিল না এই সুদৃশ্য জলাশয়ের, তাই এর নাম ‘ওয়েইমিং’ - ‘অনামা’। আর এই ‘অনামা’-র এক পাড়েই ‘রেড স্টার ওভার চায়না’-খ্যাত এডগার স্নো-র চন্দ্রমল্লিকা-শোভিত সমাধি।

অতিথিশালার অদূরেই এক গেট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। মনে আছে সেই গেটের বাইরে থেকে এক মিনিবাসে চড়ে তিয়ানআনমেন স্কোয়ার গিয়েছিলাম। পথে অনেক সাইকেল চোখে পড়েছিল। ক্যাম্পাসেও বিস্তর সাইকেল। ভাষা ও সাহিত্য ভবনের বাইরে এক আস্ত ঝাঁক। অল্পবয়সীরা তো বটেই, বর্ষীয়সী অধ্যাপিকারাও কেউ কেউ সাইকেলে যাতায়াত করতেন - য়ুএ দাইয়ুন যেমন। দেড় দশক পরে বেইজিং গিয়ে আর অত সাইকেল দেখিনি। জগৎ পারাবারের তীরে ঋদ্ধির চেহারা কি সর্বত্রই অনুরূপ? ১৯৯৫-তে যেসব ‘টেনেমেন্ট হাউজিং’ বেইজিং-এ দেখেছিলাম তা আর নেই। পরিবর্তে সব এখন পরাধুনিক গগনচুম্বী। সেই অনায়াসে অতিক্রম্য এয়ার-টার্মিনালও আর নেই, তা এখন অতিকায়, তার এধার ওধার করতে ট্রেনে চাপতে হয়। মনে আছে একবার ব্যাংককে প্লেন পাল্টাতে কয়েক ঘন্টা কাটাতে হয়েছিল। কী করি, একবার এধারে একবার ওধারে বসে বই পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে সময় কাটাই-যেখানে আরামের নানা আয়োজন সেই বিশ্রামের লাউঞ্জে যাবার পয়সা ছিল না। সেখানে স্রেফ সিনেমা দেখেই ওই ক-ঘন্টা অতিবাহিত করে দেওয়া যেত। বেইজিং টার্মিনাল বুঝি এখন ব্যাংকককেও টেক্কা দেবে!

তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে আমি যাচ্ছি ঊননব্বইয়ের ছ-বছর পরে। চীনা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সেই স্বতঃস্ফূর্ত যুব বিক্ষোভ ও তা দমনকল্পে অবশেষে আবির্ভূত ট্যাংকবাহিনীর কোনও স্মৃতি কোথাও নেই। ওই মাটি ও ওই আকাশ তা হজম করে নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তো তা পুরো গিলে ফেলতে পারে না। পা কি একটুখানি থমকে যায় না? তবে প্রচুর ঘুড়ি ওড়ে তিয়ানআনমেনে। বরাবরই। নানা রঙের নানা চেহারার। বস্তুত, ঘুড়ি ওড়ানো এক চৈনিক ব্যসন। মারাত্মক চীনে মাঞ্জার তো গল্প পড়ি আমাদের কাগজে মাঝে মাঝে। ঘুড়ি-উড়িয়েদের পেরিয়ে একটু এগিয়েই ওই মাও-চিহ্নিত ‘নিষিদ্ধ নগরী’-র প্রবেশদ্বার। তিয়ানআনমেন আসব আর ওই একদা-অগম্য চত্বরে ঢুকব না, তা কি হতে পারে? কী বিপুল ছিল চীন সাম্রাজ্য তার চূড়ান্ত অভিজ্ঞান তো এ-ই - প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, মিং থেকে কিং বংশ। ভিতরে একের পর এক প্রাসাদ - বস্তুত অগণন - অনবদ্য চীনা স্থাপত্যের সব অসামান্য নিদর্শন। আর পুঞ্জ পুঞ্জ কানন। এখানে এক সেতুশোভন চঞ্চল স্রোতস্বিনী, ওখানে এক কেয়ারি করা বিস্তৃত ফুলবাগিচা। কত কী! পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাসাদনগরী। অথচ,এর কথা বলতে গেলেই চীনের শেষ সম্রাট যিনি শৈশবেই সিংহাসনে চড়ে বসেছিলেন (শারীরিকভাবেই চড়তে হয়েছিল), সেই পুয়ি-কে নিয়ে করা বের্তোলুচ্চির ছবি মনে পড়ে যায়। ‘নিষিদ্ধ নগরী’-র অবসান এক বিশাল বৈভবের স্থবির মানচিত্রে। আর তাতে আজ এক্কাদোক্কা খেলে লাখো পর্যটক।

‘সামার প্যালেস’ দেখেছিলাম পরের বার। সেও এক অভিজ্ঞতা! প্রাসাদেরমূল কক্ষে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে এক সুদৃশ্য গোলটেবিল। শুনলাম সেখানে চৌ এন-লাই এলে বসতেন। আমরা কেউ কেউ তাতে একবার বসেও নিলাম। হঠাৎ কে যেন বললেন, আপনি তো দেখছি স্বয়ং চৌ এন-লাইয়ের চেয়ারে! রোমাঞ্চ হল আমার। সেই পঞ্চশীল ও হিন্দি-চীনী-ভাই-ভাই-এর অন্যতর হোতা চৌ এন লাই - যিনি ভারত এসেছেন বারকয়েক, কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট দেখে গেছেন, শান্তিনিকেতনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর হাত থেকে বিশ্বভারতীর সাম্মানিক ডি.লিট. গ্রহণ করেছেন। সবই কি এখন বিস্মৃত বা বিস্মরণকাম্য অতীত!

‘সামার প্যালেস’ সংলগ্ন কুনমিং লেকে একটু নৌকাবিহারও ঘটে গিয়েছিল ওই ভ্রমণে। আবার, ওই দ্বিতীয় দফাতেই বিখ্যাত পিকিং অপেরাও খানিক দেখা হয়ে যায়। ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চীনা অধ্যাপিকা উয়েই লিমিং, রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে যে সম্মিলনে আহূত হয়ে আমরা পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি সেই সম্মিলনের এক উদ্যোক্তা। তাঁর এক ছাত্রকে দিয়ে তিনি উমা দাশগুপ্ত ও আমাকে তিয়ানআনমেন পাড়ায় এক থিয়েটারে পাঠালেন যেখানে মুখ্যত পিকিং অপেরাই মঞ্চস্থ হয়। ভাষা বুঝতে না পারায় আ্মাদের উপভোগ ব্যাহত হচ্ছিল ; কিন্তু সংগীতমুখরতা, পোশাকের বর্ণাঢ্যতা ও অভিনয়ের রীতিপ্রাধান্যে একটা আদল পাওয়া যাচ্ছিল বস্তুটির। আর অভিনব লেগেছিল, মঞ্চের অদূরেই যেখানে আমরা বসেছিলাম সেখানে এক পাত্র চীনা চা আমাদের উপহার জুটেছিল। তাতে চুমুক দিয়েই আমরা গানের পিঠে গান শুনছিলাম। ঐতিহ্য?

সার্ধশতবার্ষিক এই সম্মিলনের প্রকৃত হোতা ছিলেন ওয়েই লিমিংয়ের ‘লাওশি’ তথা গুরু - বস্তুত ওখানে অনেকেরই ‘লাওশি’ - তান চুং। শান্তিনিকেতনে চীনা ভবনের কার্যকরী প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘকালীন অধ্যক্ষ তান য়ুন শান-এর জ্যেষ্ঠপুত্র। তিনি চীনেই থেকে গিয়েছিলেন। পরে ভারত আসেন। কিছুদিন শান্তিনিকেতনে থেকে পরে দিল্লিতে পড়াতে যান - প্রথমে সেনাবাহিনীতে চীনে শেখানো, অতঃপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অবশেষে জেএনইউতে। আমার দিল্লিবাসী বন্ধু শিশিরকুমার দাশ মারফত তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ। বিরল রবীন্দ্রভক্ত। মুখ্যত তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থই ‘টেগোর এ্যান্ড চায়না’ - প্রথমে বেইজিং থেকে প্রকাশিত দ্বিভাষিক, চীনা ও ইংরেজিতে, পরে দিল্লি থেকে কেবল ইংরেজিতে; আমি মাত্র এক স্নেহধন্য সহায়ক। তাঁর বয়স এখন বিরানব্বই, আছেন ছেলের কাছে মার্কিন দেশে।

কিন্তু এই গল্প ২০১০-১১-র। আর আমার প্রথম চীন ১৯৯৫-তে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেইজিং এয়ারপোর্টের উদ্দেশে যে-ট্যাক্সিতে আমাকে তুলে দেওয়া হয় তার চালক এক মহিলা। সেই প্রথম আমি মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখি। ফুরনের ট্যাক্সি, মিটারের নয়। রাস্তায় একবার তাঁকে বেশ খানিকটা ঘুরপথ করে আসতে হয়েছিল। তার জন্য যখন আমি একটু অতিরিক্ত ভাড়া দিতে চাইলাম, কিছুতেই নিলেন না। ইঙ্গিতে বোঝালেন তাঁর গোড়ায় দেওয়া কথাই ধ্রুব। এও অভিজ্ঞতা।


(কৃতজ্ঞতাঃ সৌরীন ভট্টাচার্য)