আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

সমসাময়িক

ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্রের হাওয়া


সমাজতন্ত্র মৃত না হোক, তা যে মুমূর্ষু, এবম্বিধ মতবাদ গোটা পৃথিবী জুড়েই বেশ চালু আছে । ইতিহাসের অবসানও ঠারেঠোরে ঘোষণা করেই দিয়েছিলেন বহু সমাজতাত্বিক। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নরওয়ে, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি দেশের নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিকদের জয় এবং জার্মানিতে তাদের বৃহত্তম পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ চমকপ্রদ বই কি।

নরওয়েতে ২০১৩ থেকে ক্ষমতায় ছিল রক্ষণশীল নেত্রী অ্যারনা সোলব্যর্গের নেতৃত্বাধীন জোট। আট বছর পর তাদের ক্ষমতাচ্যুত করল বামপন্থী জোট। ১৬৯ সদস্যের পার্লামেন্টে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৮৫টি আসনের। বামপন্থীরা পেয়েছেন ১০০টি আসন। এ কথা ঠিক যে বহুদিন ধরেই লাতিন আমেরিকাতে বামপন্থীরা ক্ষমতায়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পশ্চিমা আলোকপ্রাপ্তি নজরে পড়ে না। কিন্তু এখন লড়াইটা একদম ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তথাকথিত প্রথম বিশ্বেই, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলো তাদের মধ্যে অন্যতম, হুড়মুড় করে ক্ষমতায় চলে আসছেন সমাজতান্ত্রিকরা। সুইডিশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন এই বলে যে, সারা ইউরোপে এখন বাম হাওয়া বইছে। সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটের জোনাস গাহর স্টার খুব শিগগিরই যখন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ নরওয়ে একটি ছোট দেশ হলেও ইউরোপের ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর পাল্লাকেই ভারি করবে।

ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডরিক্সেন এবং ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মেরিন, দু’জনেই সোস্যালিস্ট সরকারের প্রধান। আইসল্যান্ড শাসন করছেন সমাজতান্ত্রিক ক্যাটরিন জ্যাকোবসডাতিরের। মনে করা যায় না শেষ কবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলির সর্বত্র সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতায় ছিলেন। এছাড়াও, স্পেন শাসন করছেন পেদ্রো সানচেজ এবং পর্তুগাল শাসন করছেন আন্তোনিও কোস্টা। এঁরা সকলেই সমাজতন্ত্রী অথবা সমাজ-গণতন্ত্রী। এবং জার্মানিতে নির্বাচনে এঞ্জেলা মার্কেলের দলকে হারিয়ে বৃহত্তম পার্টি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে মধ্য-বামপন্থী এসপিডি। কাজেই, বর্তমান ইউরোপে সোস্যালিস্টদের যে ইতিবাচক তরঙ্গ বইছে, তা নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব পরিবর্তন।

মনে রাখতে হবে যে এই দলগুলির অধিকাংশই কমিউনিস্ট নয়। কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই দ্বৈত সদস্যপদের ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের এই বামপন্থী দলগুলির ভেতর ঢুকে কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু সোভিয়েত বা চিন বা কিউবার আয়নাতে এই দলগুলিকে বোঝা সম্ভব নয়। এরা কেউই একদলীয় শাসনে বিশ্বাস করে না, আস্থা রাখে না শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্রেও। কিন্তু একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন প্রকল্প, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিপুঁজির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিকাশ, কল্যাণকামী কর্মসূচী ইত্যাদি প্রশ্নে এদের অবস্থান বামদিকে। এবং বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটুকুও অনেক। সত্যিই ধ্রুপদী কায়দায় বিপ্লব হবে কি না, একদলীয় শাসনের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা আজকের পৃথিবীতে কতটা, নির্বাচনে জয়লাভকে কীভাবে ব্যবহার করা যাবে এসব প্রশ্ন বহুচর্চিত এবং এই সম্পাদকীয় তার জায়গা নয়। কিন্তু যেটা বলার, সামগ্রিকভাবে বামপন্থীদের ইউরোপ জুড়ে জয়লাভ দেখিয়ে দিচ্ছে যে রাষ্ট্রচালনার সমাজতান্ত্রিক নীতিসমূহ ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রপ্রকল্পটিকে এত সহজে উড়িয়ে দেবার জায়গা তো নেইই, বরং গত এক দশকের বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা দেখিয়ে দিচ্ছে যে লাগামছাড়া পুঁজিবাদের দিন শেষ। মানুষ আর খোলা বাজারের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না, বরং নিজেদের মৌলিক অধিকারের দায়ভার তাঁরা ন্যস্ত করতে চান রাষ্ট্রের ওপরেই। এটা বাম সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনের পক্ষে সুখবর।

আরেকটা যেটা লক্ষ্যণীয়, এই নতুন ধারার বামেদের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে, যেটা আদি কমিউনিস্টদের মধ্যে কিছুটা ঘাটতি ছিল। জার্মানিতে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে গ্রিন পার্টি। নরওয়ের নির্বাচনী প্রচারের সময় সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে রিপোর্ট। বামপন্থীরা বলেছিলেন, তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে নরওয়েকে সরে আসতে হবে। গ্রিন পার্টি অবিলম্বে তেল খোঁজার কাজ বন্ধ করার দাবি তুলেছিল। সেই দাবি ব্যাপক মান্যতা পেয়েছে জনসাধারণের মধ্যে। আইসল্যান্ড ও ডেনমার্কের বামপন্থীদের এজেন্ডার মধ্যেও বৃহৎ জায়গা জুড়ে আছে উত্তর ইউরোপের জলবায়ু, পেট্রো-নির্ভরতার বিপদ, আটলান্টিকের জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পরিবেশ সচেতনতার আন্দোলন যে বামপন্থার প্রধান মেরুদণ্ড, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যায় এঁদের দেখে। ভারতের বামপন্থীরাও এ থেকে সদর্থক শিক্ষা নিতেই পারেন।

সব মিলিয়ে, পরিস্থিতি সুখপ্রদ সন্দেহ নেই। ভবিষ্যৎ যে শেষ পর্যন্ত বামপন্থারই হাতে, এ বিশ্বাসে স্থির থাকার প্রেরণা যোগাচ্ছেন ইউরোপের সমাজতান্ত্রিকেরা।