আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

সমসাময়িক

ইতিহাসের নবনির্মাণ প্রচেষ্টা বনাম বিশ্বাসঘাতকতা


বর্ষার ছদ্মবেশে শরৎ হানা দিচ্ছে। আকাশে জল, পায়ের পাতায় জল, বহু জায়গায় ধান খেত ডুবে আছে বাংলায়। সবজি খেত বিনষ্ট। আগের নিম্নচাপে বর্ধমানের ধান চাষিদের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু কলকাতা ও আশপাশের জেলার অবস্থা খারাপ।

আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। এতে ভালো-মন্দ দুই আছে। কোথাও জলটান তো কোথাও জলমগ্ন। মালদহ গরমে অস্থির। কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, উত্তর ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলির একাংশ জল-অতিষ্ঠ। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন ১৪ জন।

আর ওদিকে বাজারে দামের দাপটে অপুষ্টিতে ভুগছেন মানুষ। সরষে তেল ২৫০ টাকা ছাড়িয়েছে। আদানি আম্বানিদের হাতে মুদিখানার জিনিস চলে গেছে। কৃষিপণ্যও। ইচ্ছেমতো কম দামে কিনে বেশি দামে বেচছে।হিমাচলপ্রদেশ, কাশ্মীর থেকে ৩০ টাকার কমে আপেল কিনে ২৩০ টাকার বেশি দামে বেচছে। হিমাচলপ্রদেশে আপেলের দাম আদানির একচেটিয়া কারবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। রাজ্যের আপেল চাষীরা আদানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে, কাশ্মীরে মুসলমানদের জমি থেকে বেদখল করতে ১০,০০০ আপেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশে ভোট না হওয়া পর্যন্ত কত কত মানুষকে যে জঙ্গি অপবাদ দিয়ে খুন অথবা জেলবন্দি করা হবে।একমাত্র কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েও কার্যকর করতে পারেনি সরকার। কারণ কৃষক একতা। এই একতার জোর হিসেবে গত এক বছরে দুটি ভারত বনধ হলো ৫০০টির বেশি কৃষক সংগঠনের আহ্বানে। পশ্চিমবঙ্গে বনধ আংশিক সফল। কিন্তু ত্রিপুরায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। পাঞ্জাব হরিয়ানা অচল ছিল। উত্তরপ্রদেশেও জোর সাড়া। আসামে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোকে সরকার বাধ্য করেছে বনধ পালন না করতে। ওদিকে আসামে চলেছে উচ্ছেদ অভিযান। নিহত ১২ বছরের এক কিশোর। খুন হওয়ার সময় হাতে তাঁর রাষ্ট্রিক পরিচয় আধার কার্ড। আঁধার নেমেছে কৃষকের জীবনে।

চাষিদের সহায়ক মূল্য যৎসামান্য বাড়ানো হয়েছে। অথচ সরকার মিথ্যা কথা বলে চলেছে। নীল চাষের মতো চুক্তি চাষের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চাষিদের। অথচ এর বিরুদ্ধে আদালতে পর্যন্ত যাওয়ার পথ বন্ধ। কৃষিপণ্য যত খুশি মজুত করার আইন হয়েছে। এর ফল বাজারে গেলেই টের পাওয়া যাবে। যদিও বাজারে যাওয়ার লোক কমেছে। প্ল্যাস্টিক মেরুদণ্ড নিয়ে প্ল্যাস্টিক উচ্চ মধ্যবিত্ত প্ল্যাস্টিক কার্ড দিয়ে প্ল্যাস্টিক মন নিয়ে কতকগুলো সংখ্যা ব্যবহার করে কেনাকাটা সারছে।

এতে যে জীবনের কম্মও সারা হচ্ছে কে তাঁদের বোঝাবে। আমরাও অনেকে নিজেরাও এই দোষে দুষ্ট। সংশোধনের অযোগ্য বলশেভিক কম পড়িয়াছে। তবে কৃষক আন্দোলনের মধ্যে একটা বলশেভিক জেদ আছে। ৩০০ দিন পার করে লড়ছেন। নতুন পথ নির্দেশ করছেন। চাষিরা জানেন, ফসল একদিনে ফলে না। সময় লাগে। সমবেত প্রচেষ্টা লাগে। এটা অফিসকর্ম বা বক্তৃতাকর্ম নয়।

তাই তাঁরা ভারত জুড়ে বনধ করেছেন। কোথাও সম্পূর্ণ সফল, কোথাও আংশিক। কিন্তু ইতিহাস রচিত হচ্ছে। তা থৈ তা থৈ করে এই ইতিহাস রচনা নয়, আবেগে যুক্তিতে সংগ্রামে এই ইতিহাস নির্মাণ। এর মাঝে কাঙালিভোজের আয়োজন প্রচারমাধ্যমে। দলে দলে যোগদান মোদি বন্দনায়।

তিনি গেলেন তিনি এলেন তিনি বললেন। যারা এর সানাই বাজনে নেই তাঁদের ঘরে ইডি আয়কর।

দ্য প্রিন্ট, দ্য ওয়ার, এনডিটিভি-র পর কলকাতা টিভি। লাইসেন্স বাতিলের হুমকি।

কৃষকদের দেখানো পথে শিক্ষক অধ্যাপক কর্মচারী সাংবাদিক লেখকদের হতে হবে কৃষক আন্দোলনের সহযোগী। শ্রমিক নেতাদের নিতে হবে লড়াকু ভূমিকা। দেশ কৃষি সংবিধান আইন বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে কৃষকের শক্তিশালী মন ও মননে নিয়ে পথে নামতে হবে। লেখায় রেখায় পথচলায় মিছিলে শ্লোগানে নির্মাণ করতে হবে নতুন ভারত সরণি। এক আধটা এসি ঘরের আলোচনা তাকে ভাসাতে পারবে না।

ইতিহাসের নবনির্মাণে সামিল না হওয়া মানে সময়ের সঙ্গে ইতিহাসের সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। তা কি আমরা করতে পারি?

কেন্দ্রীয় কৃষি এবং কৃষক উন্নয়ন মন্ত্রী বলেছে(ন), মান্ডি কখনো বন্ধ হবে না এবং তাঁরা কৃষি পরিকাঠামো কোষকে ব্যবহার করে নিজেদের উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারেন।

কৃষিমন্ত্রীর এই বিবৃতিটি কৌশলী ও সন্দেহজনক এবং মহাভাঁওতা। মান্ডির উপার্জন আসে নিয়ন্ত্রিত বাজার থেকে ব্যবসা করে। এইরকম অবস্থায় মোদি সরকার অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক উপায়ে আইন প্রণয়ন করে বাজারকে অনিয়ন্ত্রিত করে দেয় যা মান্ডি ব্যবস্থার স্বীকৃত বাজারের বাইরে কাজ করতে পারবে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে জানা গেছে মান্ডি ক্রমশই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের কর্মচারীদের এখন তারা বেতন দিতে অপারগ। এগ্রিকালচার প্রডিউস মার্কেটিং করপোরেশনকে এখন কৃষি পরিকাঠামো কোষ থেকে ঋণ নিতে বলা হচ্ছে । কিন্তু কৃষি পরিকাঠামো কোষের জন্য এক লাখ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ আছে এবং এটা কোনো অনুদান নয় যেটা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাইছে সরকার। আসলে এটি ঋণ দেওয়ার একটি ব্যবস্থা। যেখানে এককালীন অর্থসাহায্য ও কিছু গ্যারান্টি পাওয়া যায় সরকার থেকে । কৃষক নেতাদের বক্তব্য - ব্যাপারটি সন্দেহজনক এবং মোদি সরকারের কর্পোরেটদের অনুকূলে কাজ করার একটা নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।

সামাজিক মাধ্যমে কৃষক আন্দোলন প্রচুর অনলাইন সমর্থন পাচ্ছে বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছ থেকে যদিও প্রধানমন্ত্রী এখন বিদেশ সফরে আমেরিকাতে গিয়েছিলেন। আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের প্রবাসী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষজন কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন এবং নিজেরাই অনেক মিছিল এবং নানা রকম প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন। সে খবর ভারতে চেপে দেওয়া হয়েছে। টোপ এবং ভয় দেখিয়ে।

ভারতে কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে হ্যাশট্যাগ সম্বলিত প্রতিক্রিয়ার দীর্ঘ ট্রেন্ড ছিল টুইটারে। টুইটার অনুগামীরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভার ৭৬তম অধিবেশনের সভাপতিকে কৃষক আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। অতীতেও কৃষক নেতারা রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে বার্তা পাঠিয়ে উল্লেখ করেছিলেনঃ ভারত সরকার 'রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রণীত কৃষকদের অধিকার এবং অন্যান্য গ্রামীণ এলাকার কর্মীদের অধিকার বিষয়ক সিদ্ধান্তকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে। উল্লেখ্য, এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রসংঘ ২০১৮-তে নিয়েছিল। এতে সাড়া মিলেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় শ্রোতাদের আসন ছিল চোখে পড়ার মতো ফাঁকা।

এর মাঝে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এস আর বোম্মাই প্রতিবাদী কৃষকদের নামে মানহানিকর মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণাটকের কৃষকেরা কর্ণাটক রাজ্য রাইথা সংঘের নেতৃত্বে এক হুঁশিয়ারি জারি করেছেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে বিধানসভায় ঘেরাও করবেন যেমন মোদি সরকারকে দিল্লিতে করা হয়েছে। কৃষকরা এখন শিগগাও - সাভানুর রাস্তার পাশে একটি পাকা মোর্চা করে প্রতিবাদ জারি রাখার পরিকল্পনা করছে। 'আমরা কৃষকদের দাবিদাওয়া রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করব এবং দেখিয়ে দেবো কৃষকদের দাবিকে এত সহজে অবজ্ঞা করা যায় না'। বলেছেন কর্ণাটকের কৃষকনেতারা। প্রতিবাদের নির্দিষ্ট দিন শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।