আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

সমসাময়িক

অসমে আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস


আবারও সংবাদ শিরোনামে অসম। বরাক উপত্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় রাষ্ট্রের আক্রমণ। এবারের ঘটনাস্থল দরং জেলার সিপাঝার চর এলাকার ধলপুর ৩ নম্বর গ্রাম।

সরকারি বয়ানে বলা হয়েছে যে, ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকার অবৈধ ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’দের উচ্ছেদ করতে অভিযান চালায় অসমের পুলিশ বাহিনী। পুলিশের গুলিতে দু'জন গ্রামবাসী ঘটনাস্থলেই নিহত। আহত অনেক। ঘটনার যে ভিডিও ফুটেজ নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা গিয়েছে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা এক ব্যক্তির উপর ছুটে এসে লাফাচ্ছেন এক চিত্রগ্রাহক। পাশে দাঁড়ানো পুলিশেরাও ওই গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির উপর লাঠি চালাচ্ছে। কয়েক জন পুলিশ ওই চিত্রগ্রাহককে টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে ক্রমাগত লাথি, ঘুসি মেরেই চলেছেন তিনি। পরে জানা যায় যে, তিনি জেলা প্রশাসন নিয়োজিত চিত্রগ্রাহক। পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন জেলার পুলিশ সুপার। তিনি আবার অসমের মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাই।

সরকারের তরফে আরও জানানো হয়েছে যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে শূন্যে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। তখন নাকি গ্রামবাসীরা পাথর ছোঁড়া শুরু করে। বিবৃতিটি মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কমবেশি ১,২০০ পরিবারের সদস্যরা পাথর ছুঁড়লেন অথচ একজন পুলিশকর্মীও আহত হলেন না। বাস্তবে তা কি সম্ভব? অবিশ্যি প্রশাসনিক বিবৃতি তো এমনটাই হয়ে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১। হিন্দুত্ববাদীরা পঞ্জিকার তিথি-ক্ষণ দেখে নতুন কাজ শুরু করতে অভ্যস্ত বলে পিতৃপক্ষ আরম্ভ হওয়ার আগেই সিপাঝার এলাকার ধলপুর ১ নম্বর গ্রামে উচ্ছেদ অভিযানের সূচনা হয়। পঞ্জিকার হিসেবে ২২ সেপ্টেম্বর পিতৃপক্ষ শুরু হয়ে গেলে শুভ কাজে হাত দেওয়া যায় না বলেই হয়তো আগাম প্রস্তুতি। ২২শে সেপ্টেম্বর রাত বারোটা নাগাদ ধলপুরের বাসিন্দাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে পরের দিন ভোর ৬টার মধ্যে জমি-বাড়ি খালি করে দিতে হবে।

এমন অবাস্তব প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার জন্য পুলিশের আক্রমণ। ২০ ও ২৩শে সেপ্টেম্বর পুলিশের হামলায় ১২০০-র বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দখল করা হয়েছে ১০ হাজার বিঘা জমি।

বাস্তুহারা পরিবারগুলি সুদীর্ঘ কাল থেকেই এখানকার বাসিন্দা। বরপেটা ও গোয়ালপাড়া জেলায় অবস্থিত জমি-বাড়ি বন্যা নদীভাঙনে ডুবে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা দরং জেলার মঙ্গলদই লোকসভা কেন্দ্রের বাসিন্দা। ধলপুরের বাসিন্দাদের এনআরসি, প্যান কার্ড, আধার কার্ড তো বটেই রয়েছে জমির খাজনা দেওয়ার রসিদ। লিগ্যাসি ডেটা আছে। এই অঞ্চলে বহু সরকারি প্রাথমিক স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে। তারপরেও তাঁরা অবৈধ? তাঁদের অপরাধ - তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা; সম্প্রদায়গত ভাবে তাঁরা মুসলমান। হিন্দুত্ববাদীদের বিচারে এর থেকে বড়ো অপরাধ আর কী হতে পারে!

একলপ্তে ১০ হাজার বিঘা জমি দখল করার পর অসমের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে বাস্তুহারারা পরিবার পিছু ৬ বিঘা জমি পাবেন। আবারও যুক্তিবিহীন অসংলগ্ন মন্তব্য। তিনি যাঁদের 'অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী' বলছেন তাঁদের কোন আইনে জমি বন্টন করবেন?

দরং জেলার ধলপুর এবং গোরুখুটি এলাকার জমি বিবাদ অনেক দিনের পুরোনো। বরপেটা ও গোয়ালপাড়া জেলার বানভাসি মানুষ এখানে বসবাস শুরু করার পর থেকেই চলছে এই বিবাদ। ১৯৭৯-তে মঙ্গলদই লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন থেকেই শুরু হয়েছিল অসম আন্দোলন। ১৯৮৫ পর্যন্ত চলতে থাকা এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল জাতি বিদ্বেষ। বিদেশি তাড়াও স্লোগানের আড়ালে রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ভাষা ও জাতিভিত্তিক বিভাজন। অসম চুক্তি সেই বিভাজন প্রক্রিয়া প্রতিহত করার কাজে সাময়িক স্বস্তি দেয়। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদ নিষ্ক্রিয় হয়নি। ২০১৪-য় দিল্লিতে গেরুয়া বাহিনী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো অসমেও জাতিবিদ্বেষ ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বানভাসি নবাগতদের তাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন জানিয়ে স্থানীয় দুগ্ধ উৎপাদকদের সংগঠন ২০১৫-য় মঙ্গলদই আদালতের শরণাপন্ন হয়। তার আগেই আরটিআই করে এই এলাকায় পশুচারণের জন্য সরকারের খাস জমির আয়তন জানতে চাওয়া হয়েছিল। সরকারি নথি বিশ্লেষণ করে আরটিআই কর্তৃপক্ষ জানায় যে খাস জমির আয়তন ৭৭ হাজার বিঘা। এবং সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় ফিরে এলে এই জমি দখলমুক্ত করা হবে।

নির্বাচনের পর নতুন মুখ্যমন্ত্রী গত জুন মাসে এলাকাটি পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন যে ১০ হাজার বিঘা জমি শিগগিরই দখলমুক্ত করা হবে। তারপর থেকেই দরং জেলার ধলপুর গ্রামের একটি শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল সুসজ্জিত প্রাকারবেষ্টিত ধর্মীয় প্রাঙ্গণে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরেই অসম সরকার সেখানে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। নবনির্বাচিত বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে ঘোষণা করা হয় যে গোরুখুটি কৃষি প্রকল্প রূপায়ণের জন্য কৃষি বিভাগের বাজেটে ৯ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারের বদান্যতায় ধর্মীয় প্রাঙ্গণ পুনর্গঠন তথা পুনর্নির্মাণের এই প্রক্রিয়ায় নিয়মিত নিপীড়িত হচ্ছে নিরীহ দরিদ্র মানুষ। বাড়ছে ধর্মীয় বিভাজন।

ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের পরে হোজাই জেলার লঙ্কা এলাকার ৭০টি পরিবারকে উৎখাত করা হয়েছে। শোণিতপুর জেলায় উচ্ছেদ হয়েছে ২৫টি পরিবার। ঘটনাক্রমে এই পরিবারগুলি মূলত বাংলা ভাষাভাষী।

আগ্রাসী ধর্মীয় মৌলবাদের আধিপত্য সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপটে রাজ্যের বিরোধী দলগুলির আচরণ সকলের নজর কেড়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৩শে সেপ্টেম্বরের পুলিশি হামলার বিরোধিতা করেছিল রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ করে কংগ্রেস নেতারা বলছেন তাঁরা জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের বিরোধী নয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উচ্ছেদ চালাতে হবে। হাই কোর্ট কোভিডের মধ্যে উচ্ছেদ স্থগিত রাখতে বলেছিল। তারপরেও শিশু-মহিলাদের ঝড়-বৃষ্টিতে ত্রিপলের তলায় রাত কাটাতে হচ্ছে বলে কংগ্রেস দুঃখ প্রকাশ করেছে। গুয়াহাটিতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল ইউডিএফ ও দিল্লি থেকে আসা জামাত-ই-হিন্দ এবং জমিয়তে উলেমা হিন্দের প্রতিনিধিরা। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনায় তাঁরা খুশি। ইউডিএফ-এর দাবি, উচ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হলে তারা আন্দোলনে নামবে। এইসব বিভ্রান্তির মধ্যে অসমের বামপন্থীরা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বামপন্থী প্রতিনিধিরা বারেবারেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নির্যাতিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অবিলম্বে বাস্তুহারা মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বামপন্থীরা সোচ্চার। এবং যথারীতি সরকার ও সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ে নীরব।

অসমের খাস ভূমির আয়তন নির্ধারণ করা একই সঙ্গে কঠিন ও জটিল কাজ। এই বিষয়ে ২০১৭-এ রাজ্য সরকার হরিশঙ্কর ব্রহ্ম-র নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল। ২০১৮-য় জমা দেওয়া সেই রিপোর্টের সঙ্গে রাজ্যের তৎকালীন ভূমি রাজস্ব মন্ত্রীর সরকারি বিবৃতিতে পার্থক্য আছে। রাজ্যের সংসদীয় মন্ত্রী আবার অন্য মত পোষণ করেন। তবে হরিশঙ্কর ব্রহ্ম বলেছিলেন যে কমিটি তদন্ত করে জানতে পেরেছিল বরপেটা, বঙাইগাঁও, দরং, ধুবুড়ি, গোয়ালপাড়া, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, নগাঁও, মরিগাঁও-এর মতো রাজ্যের আট-দশটি জেলায় জবরদখল গুরুতর চেহারা নিয়েছে। যা কোনও ভাবেই সরকারি মদত ছাড়া সম্ভব নয়।

অথচ যে কথাটা পরিষ্কার করে বলা দরকার সেটাই কেউ উচ্চারণ করেন না। ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখানদী ও উপনদীগুলির অভিমুখ নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। ফলে কখনও পুরোনো চর ভাঙে আবার কোনো সময় নতুন চরের সৃষ্টি হয়। কাজেই যথাযথ ভূমি সমীক্ষা কখনোই সম্ভব নয়। বহু এলাকাতেই অসংখ্য মানুষ চরের বাসিন্দা। চরবাসীদের কথায়, "নদীর বুকেই বারবার ঘর বাঁধি আর সেই নদীর বুক থেকেই বারবার আমাদের খ্যাদায়ে দেয়।"

বিদ্বেষ-বিভাজন-আক্রমণ অসমের চরবাসী ও গরিব মানুষের নিত্যসঙ্গী। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অসমেই বারেবারে গড়ে ওঠে গণ আন্দোলন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে দরং জেলায় গণ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে এখানকার পথারুঘাট গ্রামে ১৮৯৪-তে যে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ প্রশাসন রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে। পুলিশের গুলিতে প্রায় দেড়শো জন গ্রামবাসী শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। দরং জেলার মানুষ আজও সেই শহীদদের স্মরণ করেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী জমিতে আগামীদিনে আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হতেই পারে। বিদ্বেষ-বিভাজনের মাত্রা বাড়তে থাকলে গণ আলোড়নের তীব্রতাও নিঃসন্দেহে বহুগুণ বাড়বে।