আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮
সম্পাদকীয়
কেমন আছে কৃষক?
কৃষকদের বন্দনা করে না, এমন রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দল আমাদের এই তথাকথিত কৃষি প্রধান দেশে প্রায় নেই বললেই চলে। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের আয় ২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করতে চায়। রাজ্য সরকার তো ঘোষণাই করে দিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের বার্ষিক আয় ২০১০-১১ সালের তুলনায় তিন গুণ বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে হয়েছে ২,৯১,০০০ টাকা। অর্থাৎ, রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা (২০১৯-২০) অনুযায়ী রাজ্যে কৃষকদের মাসিক আয়ের পরিমাণ প্রায় ২৫,০০০ টাকা। মানে রাজ্যের কৃষকরা প্রায় স্বর্গরাজ্যেই বিরাজ করছেন। কিন্তু তথ্য কী বলছে?
দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ সম্প্রতি ২০১৮-১৯ সালের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টের তথ্য থেকে স্পষ্ট যে কেন্দ্রীয় সরকার তথা রাজ্য সরকার দেশের কৃষকদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেশবাসীকে এতদিন শুনিয়ে এসেছে। আসলে দেশের কৃষকদের দুর্দশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেশের গ্রামীণ এলাকার ৫৪ শতাংশ পরিবার কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং ৪৬ শতাংশ যুক্ত রয়েছে অকৃষি কাজের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের রাজ্যে ৪৬ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত, আর ৫৪ শতাংশ পরিবার যুক্ত রয়েছে অকৃষি কাজের সঙ্গে। অর্থাৎ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ পরিবার আর কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়।
পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে গুটিকয়েক রাজ্যের মধ্যে একটি যেখানে ভূমিসংস্কার হয়েছে। তবু দেখা যাচ্ছে যে যেখানে দেশের ৮.২ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার ভূমিহীন, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১১.৬ শতাংশ। আবার দেশে যেই পরিবারগুলি কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তার মধ্যে ৮৬.৮ শতাংশ প্রান্তিক ও ছোট জোতের মালিক। আমাদের রাজ্যে এই সংখ্যা ৯৫.২ শতাংশ। রাজ্যের অধিকাংশ কৃষক যেখানে প্রান্তিক ও ছোট জোতে চাষ করছেন সেই রাজ্যের কৃষকের আয় মাসিক ২৫,০০০ টাকা বলে যেই সরকার দাবি করে তারা মানুষকে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে, রাজ্যের বিধানসভায় দাঁড়িয়ে।
এই মিথ্যার বেসাতির পর্দাফাঁস করতে হলে আমাদের তাকাতে হবে কৃষকদের আয়ের তথ্যের দিকে। কৃষি কাজে যুক্ত পরিবারের গড় আয় ভারতের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১০,২১৮ টাকা। আমাদের রাজ্যের কৃষক পরিবারের মাসিক গড় আয় ৬,৭৬২ টাকা। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে ২০১৭-১৮ সালেই আমাদের রাজ্যের চাষীরা মাসিক ২৫,০০০ টাকা আয় করছে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহৎ সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে কৃষক পরিবারের মাসিক আয় তার এক-চতুর্থাংশ। এই ৬,৭৬২ টাকা আয় কোথা থেকে আসছে? দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যে কৃষক পরিবারের ফসল ফলিয়ে এবং তা বিক্রি করে আয় হয় মাসিক ১,৫৪৭ টাকা, মজুরির জন্য আয় হয় মাসিক ৩,৭২১ টাকা, পশুপালনে আয় মাসিক ৯৩৫ টাকা। অর্থাৎ শুধুমাত্র ফসল ফলিয়ে একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের পক্ষে গ্রাসাচ্ছাদন করা সম্ভব নয়। তাদেরকে মজুরের কাজে নিযুক্ত হতে হয় যেখান থেকেই তাদের আয়ের মুখ্য অংশ আসে। ছোট ও প্রান্তিক জোতে চাষ করে এর থেকে বেশি আয় করা রাজ্যের কৃষকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এক কথায় বলা যেতে পারে যে কৃষিকাজ রাজ্যে আর মানুষের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই রাজ্যের মানুষ দলে দলে রাজ্যের বা দেশের অন্য শহরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে চলে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করছে।
রাজ্য তথা দেশের কৃষির অনেক সমস্যা রয়েছে যা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের মূল যে নীতি বর্তমানে কৃষিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে তার মূল কথা হচ্ছে কৃষকদের হাতে কিছু নগদ টাকা তুলে দেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার কিছু কৃষককে মাসে দুই হাজার টাকা করে দিচ্ছে তো রাজ্য সরকার পাঁচ হাজার টাকা করে দিচ্ছে। কিন্তু যেখানে কৃষক পরিবারের মাসিক আয় ৬,০০০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে তাতে এই যৎকিঞ্চিত সরকারী অনুদান যে কোনো বিশাল পরিবর্তন করতে অক্ষম তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না।
অন্যদিকে এই অনুদানগুলি তারাই পায় যাদের নামে জমি রয়েছে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই দেখলাম যে আমাদের দেশে ৮.২ শতাংশ এবং রাজ্যে ১১.৬ শতাংশ কৃষক ভূমিহীন। অন্যদিকে কৃষক পরিবারের গড় জমির মালিকানাও লাগাতার কমছে। ২০০৩ সালে দেশে একটি কৃষক পরিবারের গড় জমির পরিমাণ ছিল ০.৭২৫ হেক্টার যা ২০১৯ সালে কমে হয়েছে ০.৫১২ হেক্টার। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পরিবার পিছু গড় জমির মালিকানা মাত্র ০.১৭ হেক্টার, অর্থাৎ দেশের গড়ের এক-তৃতীয়াংশ। জমির পরিমাণ লাগাতার হ্রাস পাওয়ার নেপথ্যে অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোত খণ্ডিত হচ্ছে। অন্যদিকে, অকৃষি কাজে মানুষ যেতে পারছে না কারণ সেখানে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে জমির উপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু চাষের সামগ্রীর খরচ বাড়ার ফলে কৃষকদের আয় কমছে। কৃষি অধিকাংশ মানুষের জীবনে ন্যূনতম আয়ও সুনিশ্চিত করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দেওয়া ছিঁটেফোঁটা অনুদান কৃষকদের মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম।
দ্বিতীয়ত, দেশে জমি ইজারা নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। যাদের নিজের নামে জমি নেই অন্যের জমিতে চাষ করে তারা এই যৎকিঞ্চিত সরকারী অনুদানও পাচ্ছে না। ২০১৮-১৯ সালের সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২২ শতাংশ কৃষক পরিবার জমি ইজারা নিচ্ছে, যেখানে দেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১৩.৯ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ শতাংশ জোত ইজারায় নিয়ে চাষ করা হচ্ছে। যারা জমি ইজারা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কৃষককে জমির মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দাদন হিসেবে দিতে হচ্ছে। অতএব, কোনো কারণে কৃষক ফসলের দাম না পেলে সে বাধ্য হচ্ছে বাজার থেকে ধার নিয়ে হলেও জমি-মালিকের পাওনা দাদন মেটানোর। আমাদের রাজ্যের ৫০ শতাংশের বেশি কৃষক ঋণগ্রস্ত, যদিও সেই ঋণ তারা মূলত নিয়েছে সরকারী ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি আইন পরিবর্তন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার দিকে প্রথম ধাপ নিয়েছে। বিগত প্রায় এক বছর ধরে এই নীতির বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলন করে চলেছে। বারবার বলা হয়ে থাকে যে অধিকাংশ কৃষকরা নাকি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে অবহিত নন, তারা সরকারী জায়গায় ফসল বিক্রি করেন না ইত্যাদি। কথাগুলি অর্ধসত্য এবং তাই বেশি ভয়ংকর। চালের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং ২৪ শতাংশ ফলন ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বেচা হয়েছে। গমের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা দুটি হল ৩৭ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। কিন্তু এই তথ্যে রাজ্যগত ফারাক রয়েছে। যেমন, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা, ইত্যাদি রাজ্যে যেই কৃষকরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাদের অধিকাংশই সরকারের কাছেই তাদের ফসল বিক্রি করে থাকে। অর্থাৎ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে মানুষকে আরো বেশি সচেতন করলে আরো বেশি সংখ্যায় মানুষ সরকারী ক্ষেত্রেই ফসল বিক্রি করবেন। আসলে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কথাটি একটু বেমানান। হিসেব করলে দেখা যাবে যে এই মূল্য আসলে সর্বাধিক মূল্য। খোলা বাজারে ফসলের দাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কম হয়। অতএব কৃষকরা এই ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে লড়াই করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে এই লড়াই যে খুব বেশি দাগ কাটেনি তার কারণও এই সমীক্ষা রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ৫০ শতাংশ ধান চাষী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও মাত্র ৭ শতাংশ কৃষক ফসল সরকারী সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেন। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে রাজ্যের মোট ধান উৎপাদনের মাত্র ১২ শতাংশ বিক্রি হয় সরকারী ক্ষেত্রে। বাকিটা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিক্রি হয়। অতএব এই রাজ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে চাষীদের মধ্যে খুব বেশি উৎসাহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই পাঞ্জাবের কৃষকের আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সংহতি থাকলেও রাস্তায় নেমে তার পাশে দাঁড়াতে রাজ্যের কৃষকদের দেখা যায়নি।
২০১৮-১৯ সালের এই সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে যেই তথ্য উঠে আসছে তা থেকে কয়েকটি কথা স্পষ্টভাবে বলা যেতে পারে। প্রথমত, গোটা দেশে তথা পশ্চিমবঙ্গে কৃষি আর লাভজনক জীবিকা নয়। কৃষক পরিবারের কৃষি থেকে আয় যৎসামান্য পরিমাণে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, লাগাতার জমির ভাগ-বাঁটোয়ারার ফলে জমির উপর চাপ বেড়েছে, জমি খণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু অকৃষি কাজে যেই পরিমাণ কর্মসংস্থান হলে কৃষকদের বড়ো অংশ সেখানে কাজ পেত তা হয়নি। অতএব গ্রামেই অকৃষি কাজ বাড়লেও, তার উৎপাদনশীলতা এবং আয় নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, গত শতাব্দীর কৃষক আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল ‘লাঙল যার, জমি তার’। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে দেখা যাচ্ছে লাঙল এবং জমি দুই-ই থাকলেও কৃষি কাজ করে সংসার চালানো ক্রমাগত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অতএব, বর্তমানের কৃষক আন্দোলনে আমরা জমির লড়াই কম দেখতে পাই। বরং ফসলের দাম, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে কৃষকরা লড়াইয়ে নামছেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে কৃষকের থেকে জোর কর জমি কেড়ে নিয়ে শিল্পায়ন করাই একমাত্র পথ। মনে রাখতে হবে জমি চলে গেলে কৃষকের বিকল্প কর্মসংস্থান কী হবে তা নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই, কারণ অ-কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে কৃষক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামীণ ভারতে শ্রেণি বিন্যাস, কৃষকদের জীবনের আশু সমস্যাকে চিহ্নিত করে, বাস্তবোচিত দাবিসমূহ নিয়ে আন্দোলন করে কৃষকদের জীবন-জীবিকা সুনিশ্চিত করতে হবে।