আরেক রকম ● নবম বর্ষ উনবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ অক্টোবর, ২০২১ ● ১৬-৩০ আশ্বিন, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

জাতিভিত্তিক জনগণনা


দেশে এক নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রায় সমস্ত বিরোধী দল ২০২১ সালের জনগণনার প্রক্রিয়ার মধ্যে জাতি-ভিত্তিক জনগণনার দাবি জানিয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সমস্ত বিরোধী দলের নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতি গণনার দাবি জানিয়েছেন। বামপন্থীরা এই দাবির পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। এই বিষয় নিয়ে বিরোধী দলের সমস্ত দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছে যে জাতি-গত জনগণনা না করার নৈতিক সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে। আবার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দাখিল করেও কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে যে তারা জাতি-গত জনগণনা করার বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন হল জাতি-ভিত্তিক জনগণনার দাবি কতটা যৌক্তিক? দ্বিতীয়ত, বিজেপি এই জাতিগণনার এত তীব্র বিরোধিতা করছে কেন? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের একটু ইতিহাস ও ভারতের সংবিধানের কিছু মৌলিক পাঠ পড়ে নিতে হবে।

১৯৩১ সালে শেষবার ব্রিটিশ সরকার জনগণনা করার সময় জাতি-গত জনগণনা করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তফশিলী জাতি ও জনজাতির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হলেও জাতি-গত জনগণনা দেশের নেতারা করেননি, কারণ তারা হয়ত মনে করেছিলেন যে জাতি-গত জনগণনা সমাজে জাতিদ্বন্দ্ব বাড়াবে। বরং, আম্বেদকরের নেতৃত্বে তৈরি সংবিধানের মাধ্যমে দেশে জাতপ্রথা অবলুপ্ত হবে এরকম একটি ধারণা সেই সময়কার নেতৃত্বের মনে ছিল। তারই প্রেক্ষিতে সংবিধান তৈরি হওয়ার দশ বছর অবধি সংরক্ষণ ব্যবস্থা বহাল রাখার কথা বলা হয়েছিল। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সংরক্ষণ ব্যবস্থা চলছে শুধু তাই নয়, নতুন নতুন গোষ্ঠী সংরক্ষণের আওতায় আসতে চাইছে। এই ঘটনা পরম্পরা এই কথাই প্রমাণ করে যে দেশে জাতিভিত্তিক বৈষম্য এবং তথাকথিত নিম্নজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি উচ্চজাতের বৈরিতা ও ঘৃণা অনেকাংশেই রয়ে গেছে।

এমতাবস্থায় কল্যাণকামী রাষ্ট্র চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সংবিধানের ১৫(৪) নম্বর ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র তফশিলী জাতি ও জনজাতির বাইরেও বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণিকে সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চাদপদ বলে ঘোষণা করতে পারে। সংবিধানের এই ধারার শরণাপন্ন হয়েই ১৯৮০ সালে মণ্ডল কমিশন অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের জন্য সংরক্ষণের জন্য সুপারিশ করে, যা ভি পি সিংহ সরকার ১৯৯০ সালে প্রবর্তন করে। এই সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে সেই সময় দেশজুড়ে উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের যেই প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সংঘ পরিবার তথা বিজেপি-ও সামিল ছিল। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই কথাও মনে করেন যে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট ভিত্তিক ওবিসি বা অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের নীতির বিরুদ্ধে নতুন রাজনীতি আমদানি করার জন্যই রামমন্দির আন্দোলনকে সেই সময় জোরদার করে সংঘ পরিবার। অতএব, সংরক্ষণের রাজনীতি তথা অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের হকের লড়াই বিজেপি কোনোদিনই মন থেকে সমর্থন করেনি।

আজ মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ প্রবর্তন হওয়ার পরেও তিন দশক অতিক্রান্ত। এই তিন দশকে দেশে সংরক্ষণ নীতির ফলে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষেরা কতটা লাভবান হলেন? আর কোন কোন জাতি এখনও পশ্চাদপদতার অন্ধকারে নিমগ্ন রয়েছে, যাদের জন্য সংরক্ষণ নীতি চালু করা প্রয়োজন? এই সমস্ত গুরুতর প্রশ্নের কোনো তথ্যনিষ্ঠ উত্তর কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের কাছে নেই। অথচ প্রায় সমস্ত রাজ্যে সংরক্ষণের জন্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন বাড়ছে। মহারাষ্ট্রে মারাঠা, গুজরাটে পাতিদার, হরিয়ানার জাঠ, রাজস্থানের মিনা প্রভৃতি সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় সংরক্ষণের দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নেমেছে, যা অনেক সময় হিংসাশ্রয়ীও হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের ক্ষুদ্র স্বার্থে এই আন্দোলনগুলিকে হয় সমর্থন জুগিয়েছে অথবা তার বিরোধিতা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার একের পর এক সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ বোর্ড গঠন করেছে, তাদের উন্নয়ন করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই জাতি-গত গণনার মাধ্যমে ভারতের সমাজের বর্তমান চরিত্র কেমন, তার তথ্যনিষ্ঠ এবং বৈজ্ঞানিক আলোচনা করতে রাজি হয়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার জাতি-ভিত্তিক জনগণনা করলেও তার রিপোর্ট তারা প্রকাশ করেনি এবং বিজেপি সরকার পরিষ্কার জানিয়েছে যে তারা এই রিপোর্ট প্রকাশ করবে না। অথচ, গোটা দেশজুড়ে বিজেপি তথা বাকি প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল জাতির প্রশ্নে আম্বেদকর-গান্ধী-পেরিয়ার সবাইকে স্মরণ করলেও জাতিগত গণনার প্রশ্নে অধিকাংশ দলই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে না, আর বিজেপি তার বিরোধিতা করে। কিন্ত কেন?

ভারতের অধিকাংশ মানুষ তফশিলী জাতি ও উপজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমাজের অংশ। যদি আমরা সদ্য প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি সংক্রান্ত সমীক্ষার (২০১৮-১৯ সালে সম্পন্ন) দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে গ্রামীণ ভারতে ১২.৩ শতাংশ পরিবার তফশীলি জনজাতির অন্তর্গত, ২১.৬ শতাংশ তফশীলি জাতির অন্তর্গত, এবং ৪৪.৪ শতাংশ পরিবার অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)-র অন্তর্গত। অর্থাৎ, গ্রামীণ ভারতে ৭৮ শতাংশের বেশি মানুষ তথাকথিত নিম্নজাতির অন্তর্গত। বাকি যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা রয়েছেন। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে ভারতে তথাকথিত হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষের সংখ্যা আসলে নগণ্য। কিন্তু আপনার আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন - ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, ফিল্ম স্টার, নাট্যকার, কবি, অভিনেতা, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সেক্টর ফাইভে কর্মরত যুবক ইত্যাদি পেশায় আপনি এই পশ্চাদপদ অংশের প্রায় কোনো প্রতিনিধিকে খুঁজে পাবেন না। আপনার আশেপাশের উক্ত পেশার অধিকাংশ মানুষ হিন্দু উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। আবার রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের দিকে তাকান। কংগ্রেস, সিপিআই(এম), তৃণমূল, সিপিআই, সিপিআই(এম-এল), বিজেপি এই দলগুলির অধিকাংশ শীর্ষ স্থানীয় নেতা উচ্চবর্ণের হিন্দু সন্তান। এই যে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ জীবিকা, জমি অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করে জাঁকিয়ে বসে আছে, তার ব্যাখ্যা হিসেবে তারা ‘মেধা’ নামক একটি বায়বীয় তত্ত্বকে খাড়া করে থাকেন। কিন্তু মনস্তত্ত্ব, জিন, অর্থনীতি সমস্ত বিদ্যাই আজকের দিনে প্রমাণ করেছে যে মেধা বিষয়টি সামাজিক নির্মাণের অংশ। সমাজের পুঁজি, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় একটি ক্ষুদ্র অংশের মানুষের একচেটিয়া আধিপত্য আসলে দেখায় যে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি, বিপুল বৈষম্য রয়েছে।

এখন এই কথাগুলি সবাই জানে। কিন্তু গোটা দেশব্যাপীই যে এই ঘটনা ঘটেছে এবং আজও সমাজের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা-স্বাদ-আহ্লাদ-টাকাপয়সা-ক্ষমতা সবই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতেই রয়ে গেছে সেই কথা সবার কাছে প্রমাণ হয়ে যাবে যদি জাতি-ভিত্তিক জনগণনা করা হয়। তাই উচ্চবর্ণ ও শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে এই জাতি-গণনার বিরোধিতা আসবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু জাতি-ভিত্তিক জনগণনার একমাত্র উদ্দেশ্য এইটা নয় যে সমাজের এই বৈষম্যকে সবার সামনে তুলে ধরা। এই বৈষম্য যে রয়েছে তা সবাই জানে, কিন্তু মানতে চায় না। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই ধরনের বৈষম্য থাকলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব যারা অনগ্রসর তাদের জন্য বিশেষ নীতি গ্রহণ করে তাদের উচ্চগামিতাকে ত্বরাণ্বিত করা। জাতি-গত জনগণনা হলে আমরা জানতে পারব আসলে কোন জাতির মানুষ কতটা এগিয়ে আছে বা পিছিয়ে আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সংরক্ষণের যেই দাবিগুলি উঠছে তা আদৌ যৌক্তিক কি না। সর্বোপরি রাষ্ট্র তথা সরকার প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিক নীতি গ্রহণ করতে পারবে, যেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য বর্তমানে আমাদের হাতে নেই। জাতিগত জনগণনার ভিত্তিতে নীতি গ্রহণ করা হলে সেই নীতির স্বচ্ছতা বাড়বে এবং মানুষ বুঝতে পারবেন কেন সেই নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তথ্যভিত্তিক এই নীতি সামাজিক ন্যায়কে সুনিশ্চিত করার জন্য আবশ্যিক। মনে রাখতে হবে যে ভারতের সংবিধানের মুখবন্ধেই সমস্ত মানুষকে সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাজের প্রকৃত তথ্য হাতে না থাকলে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে কী করে? অতএব সংবিধান প্রদত্ত অধিকার-সমূহকে সুনিশ্চিত করার জন্যই জাতি-গণনা আবশ্যিক।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল বিজেপি জাতি-গণনার বিরোধিতা করছে কেন? বিজেপি জোর গলায় বলে থাকে যে রাষ্ট্রপতি দলিত, প্রধানমন্ত্রী ওবিসি সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসি এবং তফশীলি জাতি ও জনজাতির ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তারা উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং এমন কি পশ্চিমবঙ্গেও নতুন সামাজিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা সমাজের পশ্চাদপদ অংশের ভোট পেয়েছে। তাহলে তারা জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করছে কেন?

পশ্চাদপদ শ্রেণি তথা জাতির ভোট বিজেপি কোনো সামাজিক ন্যায়ের এজেন্ডাকে সামনে রেখে পায়নি। এই সম্প্রদায়ের সমর্থন তারা আদায় করেছে দুটি উপায়ে। প্রথমত, বিহার বা উত্তরপ্রদেশে ওবিসি অথবা তফশিলী জাতির মধ্যে যারা বেশি প্রতিপত্তিসম্পন্ন (বিহারে যাদব, উত্তরপ্রদেশে জাটব), তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য পশ্চাদপদ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ, উচ্চবর্ণ এবং নিম্নবর্ণের যেই সামাজিক বিভাজন, যার ভিত্তিতে হাথরসে দলিত নারীকে ধর্ষণ করে জ্বালিয়ে দেয় উচ্চবর্ণের পুরুষ, বিজেপি সেই বিভাজনকে পাশে সরিয়ে রেখে নিম্নবর্ণের বিভিন্ন জাতের মধ্যে যে পাওয়া-না-পাওয়ার টানাপোড়েন রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে সমর্থন আদায় করেছে। আম্বেদকরের জাতি বিলোপ অথবা পেরিয়ারের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনীতির থেকে বিজেপি শত-যোজন দূরে থেকেছে। তাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বরাবরই হিন্দু ধর্মের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী। আজ অবধি আরএসএস-এর প্রায় সমস্ত শীর্ষনেতা মারাঠি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু হিন্দু ধর্মের নামে রাজনীতি করতে হলে সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করলে ভোটের বৈতরণী পার করা সম্ভব নয়। অতএব, হিন্দু একতার নামে হিন্দু ধর্মের যেই মূল বিভাজিকা, অর্থাৎ জাতিপ্রথা, তাকে অতিক্রম করাই আরএসএস-এর হিন্দুত্ব রাজনীতির মূল চ্যালেঞ্জ। সামাজিক ন্যায়কে দূরে সরিয়ে রেখে নিম্নবর্ণের মধ্যে বিভিন্ন জাতিকে লড়িয়ে দিয়ে উচ্চবর্ণের আধিপত্য বজায় রেখেও নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বিজেপি।

এই প্রক্রিয়ায়, হিন্দু একতা সুনিশ্চিত করার সংঘের প্রকল্পে মূল অনুঘটকের কাজ করেছে মুসলমান বিদ্বেষ। অনগ্রসর শ্রেণি, জনজাতি বা তফশিলী জাতির মানুষকে আরএসএস-এর বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে তাদের মূল লড়াই উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়ের লড়াই নয়। তাদের মূল লড়াই হল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা তাদের চাকরি, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সমস্তই কেড়ে নিচ্ছে। আরএসএস-এর এই সামাজিক পরীক্ষা বহু বছর ধরে গুজরাটে চলেছে। এখন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাসিল করে দেশের এক বৃহদাংশে এই নীতি গ্রহণ করে মানুষকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু এই সুখের সংসার জাতি-ভিত্তিক জনগণনা হলে ভেঙে যাবে। কারণ জাতিভিত্তিক জনগণনা প্রমাণ করে দেবে হিন্দুত্বের নামে আরএসএস সমস্ত হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইলেও উচ্চবর্ণদের হাতেই রয়েছে জীবিকা-জমি-ক্ষমতার চাবিকাঠি। মুসলমানরা ভারতীয় সমাজের আরেকটি গরীব অংশ, যারা হিন্দু পশ্চাদপদ মানুষের শত্রু নয়, এই কথা প্রমাণ হয়ে যাবে। একবার যদি পশ্চাদপদ জাতি ও জনজাতির মানুষ সমাজের নিজেদের সামাজিক ন্যায় ও হকের লড়াই গড়ে তোলে, তবে হিন্দুত্বের নামে আরএসএস যেই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি মানুষকে ভুল বুঝিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে, তার পর্দাফাঁস হয়ে যাবে। অতএব, বিজেপি সরকার সুদৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে যে জাতি-ভিত্তিক জনগণনা তারা কিছুতেই করবে না।

দেশের বাম ও বিরোধী শক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে যে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবিটি একদিকে যেমন সামাজিক ন্যায়ের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে, তেমনি আরএসএস-এর পিছনে যেই পশ্চাদপদ জাতির মানুষ আপাতত ঢলে পড়েছেন, তাদেরকেও তাদের প্রভাব থেকে বের করে এনে এক বৃহৎ আন্দোলন এই প্রশ্নে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক শক্তিকে এও নিশ্চিত করতে হবে যে জাতিভিত্তিক জনগণনা হোক, কিন্তু জনগণনার মাধ্যমে এনপিআর-এনআরসি যেন কিছুতেই সরকার না করতে পারে।

আম্বেদকর-ফুলে-পেরিয়ার-হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের সামাজিক ন্যায়ের পতাকাকে উড্ডীন করে ভারতের সংবিধানে বর্ণিত সাম্যের প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করার দাবিতে এক বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠবে, এই আশা আমরা করব।