আরেক রকম ● নবম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৮
প্রবন্ধ
আয়ারাম গয়ারাম
অম্বিকেশ মহাপাত্র
ভারতীয় রাজনীতিতে প্রচলিত এবং বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত শব্দবন্ধ ‘আয়ারাম গয়ারাম (Ram has come Ram has gone)’। উৎপত্তি কোথায়, কীভাবে? স্বাধীনতা লাভের প্রায় ১৯ বছর পর, ১লা নভেম্বর ১৯৬৬। পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে নতুন রাজ্য হরিয়ানা’র আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৭ সালে ৮১ আসন বিশিষ্ট হরিয়ানা বিধানসভার প্রথম নির্বাচন। কংগ্রেস দল হাসনপুর (তপশিলি সংরক্ষিত) বিধানসভা আসনে প্রত্যাশী গয়া লালকে প্রার্থী করেনি। গয়া লাল তুরন্ত কংগ্রেসে ইস্তফা দিয়ে নির্দল প্রার্থী এবং নির্বাচনে জয়লাভ। যেমনটি পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সিঙ্গুর বিধানসভা আসনে প্রত্যাশী মাষ্টারমশায় রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করেনি। মাষ্টারমশায় তুরন্ত বিজেপিতে এবং প্রার্থী। প্রথম হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৪৮ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। বিধানসভার ১৬ জন নির্দল বিধায়কের মধ্যে গয়া লাল কংগ্রেস সরকারে যোগদান করেন। সরকার গঠনের ৬ দিনের মাথায় গয়া লাল সহ ১২ কংগ্রেস বিধায়ক সরকার ও দল ছাড়লেন। গড়লেন নতুন দল ‘হরিয়ানা বিকাশ পার্টি’। কয়েকদিন পর গয়া লাল ফের কংগ্রেসে! ৯ ঘন্টার মধ্যে মন বদল সহ আবার দল বদল! ফের ‘হরিয়ানা বিকাশ পার্টি’তে! অর্থাৎ ১৫ দিনের মধ্যে গয়া লালের তিনবার দল বদল সহ চারবার আনুগত্য বদল! ইতিহাস সৃষ্টি! সেই থেকে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে নবতম সংযোজিত প্রবচন ‘আয়ারাম গয়ারাম’।
আজ দখিন দুয়ার খোলা। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯, মাত্র দু’বছরে। ১৯৬২ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিধায়ক এবং ৩১৩ জন নির্দল বিধায়ক দল বদল করেন। অর্থাৎ নীতির শ্রেষ্ঠ বা রাজা রাজনীতিতে অনৈতিক এবং নীতিহীন কর্মকাণ্ডে ‘আয়ারাম গয়ারাম’-এর জোয়ার সহ জলোচ্ছ্বাস!এই নীতিহীন প্রচেষ্টা রোধে ওয়াই বি চ্যবন কমিটি, তার রিপোর্ট। ১৯৭৩ সালে দলত্যাগ রোধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উমাশঙ্কর দীক্ষিতের প্রচেষ্টা। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণের প্রচেষ্টা। কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। অবশেষে ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে ৫২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দলত্যাগ বিরোধী আইন লাগু হয় এবং ১০ম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এবার আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আসি। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৭ জন বিধায়কের দল বদল; এবং সরকারের পতন। ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গঠন, শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যের ১নং নাগরিক তথা মহামান্য রাজ্যপাল তথা সাংবিধানিক প্রধান ধরমবীরা। এরপর ২০১১ পর্যন্ত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গহীন ও নিকৃষ্ট রাজনৈতিক খেলা ‘আয়ারাম গয়ারাম’ মুক্ত ছিল। দেশের সামনে আমাদের রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাদের রাজ্যে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ প্রবাদের সার্থক রূপায়ন সহ দলবদলু, যোগদান মেলা, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, দমবন্ধকর অবস্থা, সমাজের জন্যে কাজ করা যাচ্ছে না, বিজেমূল, খেলা হবে... প্রভৃতি নতুন নতুন শব্দবন্ধ ধেয়ে আসছে! দল বদল এখন বাংলায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন পেয়েছে। সরকার গড়তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে দলবদল? না। মধ্যবর্তী সময়ে সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে; সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দলবদল? না, তাও না। তাহলে? রাজ্যে বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভার জন্যে। নির্বাচনে সবরকমের অসৎ উপায় অবলম্বন এবং প্রয়োগ করেও ‘বিরোধীশূন্য’ করার প্রয়াস সফল না হলে? কেয়া বাত, রয়েছে দলবদল। তার জন্যে অর্থের প্রলোভন, সুযোগ সুবিধা প্রদান, ভীতি প্রদর্শন, মিথ্যা মামলা দাও, গ্রেফতার কর, পরিবারকে নানান ভাবে হেনস্থা কর, মারধর সহ প্রয়োজনে খুন, কত রকম রাস্তা খোলা আছে।
২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলা-পরিষদ তৃণমূল কংগ্রসে সরাসরি জিততে পারেনি। ৭০ আসন বিশিষ্ট মুর্শিদাবাদ জেলা-পরিষদে তৃণমূল কংগ্রেস ১টি আসন জিতেছিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদ সহ সব জেলা-পরিষদ দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে? গণতন্ত্রের অন্তর্জলিযাত্রা। আপনি অবাক হচ্ছেন? অবাক হবেন না। আরও অনেক কাহিনি বাকি আছে। গত ১০ বছরে প্রায় তিন ডজন বিধায়ক (দীপালি বিশ্বাস, মানস রঞ্জন ভূঁঞ্যা, শম্পা দরিফা, শঙ্কর সিং, তুষার কান্তি ভট্টাচার্য্য, দুলাল চন্দ্র বর, কৃষ্ণেন্দু নারায়ন চৌধুরী... প্রমুখ) দল বদল করেছেন। দল বদলের আগে নৈতিক কারণে পদত্যাগ করে? না। তাহলে কি বিধানসভার অধ্যক্ষ মহোদয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে, দলত্যাগ বিরোধী আইনে বিধানসভার সদস্যপদ বাতিল করেছেন? না, তাও না। সকলেই বিধানসভার পুরো মেয়াদ বহাল তবিয়তে থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। দলত্যাগ বিরোধী আইনে অধ্যক্ষ মহোদয়, যিনি পেশায় আইনজীবী, আইনি প্রক্রিয়ায় তারিখের পর তারিখ শুনানি নিয়ে গেছেন! শোনা যাচ্ছে মাননীয় দীপালি বিশ্বাসের সদস্যপদ বাতিলের জন্য মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয় ২৩ বার শুনানি নিয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি! অধ্যক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলবদলু নীতিহীন জনপ্রতিনিধি তথা বিধায়ক বিধানসভার মেয়াদ শেষ করে নতুনভাবে নির্বাচনী ময়দানে সামিল হয়েছেন!
সর্বশেষ টাটকা উদাহরণ - ২রা মে ২০২১, মুকুল রায় পদ্মফুল প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে ১১ই জুন ২০২১ সর্বভারতীয় দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে, দলীয় কার্যালয়ে, জাতীয় সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে, দিবালোকে ঘাসফুলে যোগদান করলেন! বিধানসভার সদস্যপদে পদত্যাগ না করে! এই অবস্থায় বিধানসভার অধ্যক্ষ মহোদয় দলত্যাগ বিরোধী আইনে সদস্যপদ বাতিল না করে পাবলিক একাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করেছেন। ‘বিধানসভার প্রচলিত এবং যুক্তিসঙ্গত রীতি, বিরোধীদলের কাউকে পাবলিক একাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়’ - সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে সর্বভারতীয় দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সদর দপ্তর ‘নবান্ন’ থেকে বললেন - ‘মুকুল রায় বিজেপির পার্টি মেম্বার’! একই সুরে সাংবাদিকদের বললেন - শাসকদলের মহাসচিবও!
এই নীতি-নৈতিকতাহীন রাজনীতি রাজ্যে প্রাত্যহিক ঘটনায় পর্যবসিত। গণতন্ত্রের প্রহরী অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম তাকে মান্যতা দিতে মরিয়া প্রয়াসে এগোচ্ছে। নবজাগরণের বাংলায় আজকের এই গভীর সংকট সামাজিক জীবনকে নানানভাবে প্রভাবিত করছে। এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বার করতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক মানুষজনদের। এবং সর্বোপরি খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ সহ সাধারণ মানুষের।