আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

সঙ্ঘ পরিবারঃ দায় ও দায়হীনতা

প্রবুদ্ধ বাগচী


রাজ্যের বিধানসভার ভোটে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর বামপন্থী মহল থেকে কৌশলে একটা কথা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে রাজ্যে বিজেপি পরাজিত হলেও আরএসএস নাকি তাতে অখুশি নয়। কারণ, তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনো নাকি তাঁরা ‘দুর্গা’ বলে অভিহিত করেছিলেন, স্বভাবতই ‘দুর্গা-বাহিনী’র জয়ে তাঁরা খুশি। আরএসএস-এর অন্দরমহলের খবর বামপন্থীরা কীভাবে পেলেন সেই প্রশ্নে গিয়ে কাজ নেই। তবে এটা ঠিক কোনো এক সময়ে তৃণমূল নেত্রী আরএসএস-কে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং হয়তো সেই সৌজন্যের প্রত্যুত্তরে আরএসএস তাঁকে ওই নামে চিহ্নিত করেছিলেন। আরএসএস সেই অর্থে রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও তাদের একটা রাজনৈতিক অভিমুখ আছে। তাই সেই পরিপ্রেক্ষিত ভুলে আরএসএস-কে দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়া নিশ্চয়ই ভুল। তবে রাজনীতির জগতটা এমনই যে ‘ঠিক’ আর ‘পলিটিকালি ঠিক’ দুটো আলাদা পরিভাষা সেখানে পাশেপাশে অবস্থান করে।

এটা যে সময়ের কথা তখন রাজ্যে বামফ্রন্টকে সরানোর জন্যে তৃণমূল-এর দরকার ছিল একটা পোক্ত সর্বভারতীয় দলের প্রশ্রয় - কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল প্রতিষ্ঠা করায় এই সমর্থন কংগ্রেসের থেকে পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তাই বিজেপি। তৃণমূল নেত্রী অবশ্য মনে করেন যে, বাজপেয়ী জমানার বিজেপি ছিল আজকের থেকে অনেক উদার ও গুণগতভাবে ভাল। অনেকেই এমন ধারনায় বিশ্বাসী । এমন মতের শরিক আমরা অনেকেই নই। আজকের মোদী-শাহ জমানা নিশ্চয়ই আগ্রাসনে, মানসিকতায় মাত্রাছাড়া উগ্র ও বিপজ্জনক। কিন্তু বাজপেয়ীও সারাজীবন সঙ্ঘঘনিষ্ঠ ছিলেন, তবু তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল মোদীর মতোই। মানসিকতার দিক থেকে হয়তো তিনি খানিকটা উদার মনের ছিলেন, কিন্তু বিজেপি মানে শুধু বাজপেয়ী এমন নয়। আদবানি, মুরলী মনোহর জোশী, উমা ভারতী, গিরিরাজ কিশোর এইসব কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতারা বাজপেয়ীর প্রশ্রয়ই পেয়েছিলেন। সরকারে এসেই পরমাণু বোমা ফাটানো, কারগিল যুদ্ধ এইসব ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেহারা বাজপেয়ীর কথায় বার্তায় যে প্রকাশ হয়নি তা নয়। তাছাড়া মোদীর রাজনৈতিক উত্থান তো বাজপেয়ী জমানাতেই আদবানির অভিভাবকত্বে। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক সুস্থিতির প্রয়োজনে বিজেপির হাত ধরলেও অনেকবার তাদের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছিল তৃণমূল নেত্রীর। আর আজ এত বছর পরে সেই বিজেপিই তাঁর মূল প্রতিপক্ষ। বাংলার মসনদ ঘিরে তাদের লম্ফঝম্প ও কদর্য আচরণ তাঁর প্রবল জয়ে আজ একেবারেই কালিরামের ঢোলের মতোই ফেটে চৌচির। এতে আরএসএস-এর প্রাণে পুলক লেগেছে, এটা নিতান্তই কষ্ট-কল্পনা শুধু নয়, সম্ভবত অসত্য। বামপন্থীদের নিজেদের বিপর্যয়কে আড়াল করা ও আত্মসমীক্ষা এড়িয়ে থাকার একটা হাস্যকর চেষ্টা।

গত কয়েক মাসে অবশ্য বামপন্থী মহলের নেতারা স্বীকার করে নিয়েছেন বিজেপি নিয়ে তাদের প্রচারকৌশলের দিগভ্রান্তি। কাল্পনিক এক ‘বিজেমূল’ চরিত্র ঘিরে তাঁরা যে মঞ্চে মঞ্চে পথে পথে ও সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে পণ্ডশ্রম করেছেন এখন নতুন বিবেচনার আলোয় তাঁরা নাকি সব চিনতে পারছেন। সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে তাদের চেতনায় যে নতুন সূর্য উঠেছে এটা মঙ্গলের কথা। দিন বদলের পালায় এবার তাঁদের কী ভূমিকা হয় তা নিশ্চয়ই আমরা খেয়াল রাখব। কিন্তু কেউ কেউ আছেন যারা ভাঙেন তবু মচকান না। এইসব আলো-অন্ধকারের মধ্যেও একটা প্রচার এখনও জীবন্ত। তা হল, গত দশ বছরে আরএসএস-এর প্রভাব ও তাঁদের পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নাকি বেড়েছে। এখানে ‘নাকি’ শব্দটা ব্যবহার না করে উপায় নেই কারণ সংখ্যায় বৃদ্ধি মেপে দেখা যায়, ‘প্রভাব’ এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংখ্যাবৃদ্ধি কতটা তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনই হাতের কাছে নেই, তবে আরএসএস পরিচালিত স্কুল বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু এটা কেমন ভাবে প্রতিহত করা যেত তার চেহারা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। শিক্ষা যৌথ তালিকার বিষয়। রাজ্য ও কেন্দ্র রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও নিজেদের আওতায় স্কুল পরিচালনা করার বিশেষ অধিকার আছে। মিশনারি স্কুল ও মাদ্রাসা সেইভাবেই পরিচালিত হয়। একইভাবে ভারত সেবাশ্রম বা আনন্দমার্গ সারা রাজ্যেই স্কুল চালায়। এদের পরিচালিত স্কুলগুলি বাম আমল থেকেই রাজ্যে চালু আছে। সম্ভবত এইসব স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিধি সরকারের হাতে সেইভাবে নেই। কারণ এঁরা সরকারি অনুদান নেয় না, তাই স্কুল পরিচালক কমিটিতে কোনো সরকারি প্রতিনিধি রাখার দায়বদ্ধতা এদের নেই। মনে থাকতে পারে, রামকৃষ্ণ মিশন-এর সঙ্গে তাঁদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ে পূর্বতন বাম সরকারের একটা সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, তাতে মিশন জিতে গিয়েছিল। আরএসএস-এর প্রথাগত শিক্ষার সর্বভারতীয় সংগঠন ‘বিদ্যা ভারতী’ স্কুলগুলি পরিচালনা করে - এইসব স্কুলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় বোর্ড সিবিএসই-র অনুমোদন প্রাপ্ত। এই ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির কী করার আছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভার বাইরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন ১২৫টি আরএসএস পরিচালিত স্কুলকে ‘নো অবজেকশন’ দেওয়া হবে কি না বিবেচনা করা হচ্ছে, কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে শিক্ষার ছদ্মবেশে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। তার পরে কী হয়েছিল তা আর জানা যায়নি । এই ধরনের ‘অভিযোগ’ তদন্ত করে প্রমাণ করা খুব সোজা নয় এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ আদালতে গেলে সরকারের পক্ষে তার ফলাফল ইতিবাচক হওয়া মুস্কিল। মনে থাকতে পারে, সদ্য বিধানসভায় হারের পর যখন বিজেপি আইটি সেল উত্তর-নির্বাচনী সন্ত্রাসের নানা ভুয়ো খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিতে আরম্ভ করে তখন তিন বছরের পুরোনো এই খবরটাকেও তারা রং চড়িয়ে পরিবেশন করে লিখেছিল, সরকার ১২৫টা স্কুলের অনুমোদন বাতিল করেছে। স্মরণে আসছে, বাম আমলেও অনুমোদনহীন মাদ্রাসা নিয়ে বিজেপি এই ধরনের অভিযোগ তুলত। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদবানি এই নিয়ে বহুবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং একবার তো বুদ্ধবাবু তার সঙ্গে একমত হয়ে বিবৃতিও দিয়েছিলেন - পরে এই নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হয়নি। পাশাপাশি, এটাও খেয়াল রাখা দরকার, সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু অনুমোদনহীন মাদ্রাসার সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগের কথা প্রকাশ্যে এসেছিল। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রটা ঠিক কী ছিল?

২২ মার্চ ১৯৩৯, কলকাতার মানিকতলা এলাকায় তেলকল মাঠে আরএসএস এই রাজ্যে তাঁদের প্রথম শাখার সূচনা করে। এখন এই রাজ্যে তাঁদের শাখা সংখ্যা ১,৬০০ (এটা ২০২০ সালের তথ্য)। কিন্তু এই আট দশকের যাত্রাপথে তাঁদের কিছু চড়াই-উতরাই আছে অবশ্যই। যার প্রথম পর্ব ১৯৩৯-১৯৫৩। এই সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আরএসএস-এর যোগাযোগ এবং সঙ্ঘের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ভারতীয় জনসঙ্ঘের উত্থান। ১৯৫৩-য় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে এই জোয়ারে ভাটা আসে। দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা আরএসএসের মাটিকে এই রাজ্যে শক্ত করতে পারেনি তার কারণ সেই সময় বামপন্থী শক্তি দেশত্যাগী উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে তাঁদের সাম্প্রদায়িক শিবিরে যোগদান থেকে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করে। মূলত স্বাধীনতা-উত্তর গণ-আন্দোলনগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বামপন্থীরা আর তাঁদের পেছনে থেকেছেন লাখে লাখে দেশহারা মানুষ। এই ঐতিহাসিক সত্যকে ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এর আড়ালে আরএসএস যে তাদের সব সংগঠন বন্ধ করে দিয়েছিল এমন নয়। কলকাতার দীর্ঘদিনের আরএসএস সংগঠক প্রবাসী জীববিজ্ঞানী পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অভিজ্ঞতালব্ধ বই ‘ঘটি কাহিনি’তে তার কিছু কিছু উল্লেখ করেছেন। যদিও এখন অনেকেই জানেন, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আরএসএস সংসর্গ ত্যাগ করে বিদেশে পড়াশোনা করতে চলে যান। বিগত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি বিভিন্ন ফোরামে আরএসএস-এর বিপদ সম্পর্কে নানা মন্তব্য করেছিলেন।

সাতের দশকের শেষ দিকে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রায় সর্বত্রই বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির প্রভাব বেড়ে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসনে সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের আরএসএস-এর সঙ্গে কিন্তু বামপন্থীদের কোনও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ তেমনভাবে হয়নি, যা বারবার ঘটেছে কেরালায়, এখনও যার অবসান হয়নি। রাজ্যে যে ধরনের রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে তা মূলত কংগ্রেস দলের সঙ্গে, পরে তৃণমূল কংগ্রেস দলের সঙ্গে, কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে এসইউসিআই বা নকশালপন্থীদের সঙ্গে। হতে পারে এইসব দলগুলি বামফ্রন্টের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বলেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ছিল তীব্র - তুলনায় আরএসএস চেহারায় অন্তত রাজনৈতিক ছিল না যদিও চেতনা ও মতাদর্শের বিচারে বাম মতাদর্শের প্রধান প্রতিপক্ষ হতে পারত তারাই। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার এইসবের মধ্যেও নিজেদের উদ্যোগ চালিয়ে গেছে। রাজ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৪-তে, ‘বিদ্যা ভারতী’ (আরএসএস এর প্রথাগত শিক্ষা বিষয়ক সর্বোচ্চ সংগঠন) কাজ শুরু করে ১৯৭০-এ। অন্য সব প্রান্তীয় সংগঠনের মধ্যে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করা ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’ রাজ্যে শাখা তৈরি করে আশির দশকের গোড়ায়, ‘একাল অভিযান’ (প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার সংগঠন) ও ‘সেবা ভারতী’ (সমাজসেবা মূলক কাজের সংগঠন) নিজেদের প্রভাব বাড়াতে থাকে আশির দশকের শেষ দিক থেকে। এখানে খেয়াল করার বিষয়, সরাসরি আরএসএস সংগঠনের বদলে তাদের শাখা সংগঠনগুলোর মধ্যে দিয়েই তারা কিন্তু রাজ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর কাজটা শুরু করেছিল। যদিও এইসব সংগঠনের নেপথ্যে ছিলেন তাদের স্বয়ংসেবক বা প্রচারকরা। এমন কিছু দীর্ঘদিনের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ‘লড়াকু’(!) প্রচারকদের নাম সামনে এসেছে কলকাতার এক সাংবাদিকদের গবেষণামূলক প্রতিবেদনে, যারা কেউ কেউ সেই আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই গ্রামেগঞ্জে আরএসএস সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়কালে বামফ্রন্ট সরকার অনেক ধরনের জনমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই - কিন্তু রাজনৈতিক চেতনার বিস্তারের ক্ষেত্রে তার কোনও অভিক্ষেপ পড়েছিল কি না সেই বিষয়ে খুব সহজে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। ব্যাপক আকারে কোনও সংঘর্ষ না হলেও এই তথ্য রয়েছে যে গ্রামে আরএসএস এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা বাম কর্মীদের রোষের মুখে পড়েছেন, তাদের ও তাদের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, কোথাও কোথাও বাড়িছাড়া করা হয়েছে। ‘আনন্দমার্গী সংগঠন’ নিশ্চয়ই ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না কিন্তু বিজন সেতুতে তাঁদের ‘সন্ন্যাসীদের’ জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সঙ্গে যেভাবে স্থানীয় বাম বিধায়কদের নাম জড়িয়েছিল সেটা মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। আজও এই ঘটনা নিয়ে বামপন্থীদের আক্রমণ করা হয়। এগুলোর কোনোটাকেই রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত মোকাবিলা বলে চিহ্নিত করা যাবে না, বরং এতে আক্রান্তের মধ্যে আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, যার পরিণতি আদপে ভাল নয়। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি রাজনৈতিক সন্ত্রাস যে পরে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তার উদাহরণ বামফ্রন্টের শেষ পর্বে আমরা মনে করে দেখতে পারি।

শুধু গবেষণামূলক তথ্যের বাইরে আরো কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক। ‘ই-স্পার্টাকাস’ নামক একটি সংগঠন গত মার্চ মাস (২০২১) থেকে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করছেন যার ছাব্বিশটি পর্ব ইতিমধ্যে সম্প্রচারিত। এই অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয়ের একটা বড় অংশের ফোকাস মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ইত্যাদি। এখানে ইতিমধ্যে বক্তব্য রেখেছেন সারা রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরের প্রথিতযশা অধ্যাপক বা সমাজকর্মীরা। এঁদের মধ্যে ইতিমধ্যে তিনজন অধ্যাপক, যাদের স্কুলজীবন কেটেছে কলকাতার বাইরে গ্রাম বা মফস্বলে, তাঁরা প্রত্যেকে জানিয়েছেন, নব্বই দশকে তাদের গ্রাম বা মফস্বলে তাঁরা আরএসএস-এর নাম ও তাদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে জানতেন এবং নিজেদের এলাকায় তাদের কাজকর্ম দেখেছেন। মেদিনীপুর শহরে বেড়ে ওঠা একজন অধ্যাপক জানান, আশির দশকের শেষাশেষি তার চোখের সামনেই বজরং দল সেই শহরে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল । আশির দশকের প্রথমার্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একজন ইংরিজির মাস্টারমশাইকে চিনতাম যিনি আমাদের স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে এসেছিলেন হাওড়ার এক গ্রামাঞ্চল থেকে - তিনি আরএসএস-এর কর্মী ছিলেন, আজও আছেন। রাম মন্দির আলোড়নের সময় যখন 'রামশিলা' নিয়ে অযোধ্যা যাওয়া বা 'করসেবা' করার ধুম পড়ে গিয়েছিল তখন অনেক উদ্বাস্তু আন্দোলনের বাম নেতা ও কর্মীকে দেখেছিলাম তাঁরা কেমন রাতারাতি ভোল পালটে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের করসেবক সদস্য হয়ে গেলেন। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাম দুর্গ বলে পরিচিত দমদম লোকসভা কেন্দ্রে কোন জাদুবলে বিজেপির প্রার্থী জয়লাভ করেছিল আজও তা একটা পরম রহস্যের বিষয় হয়ে আছে। এই মুহূর্তে রাজ্যের দু'জন হেভিওয়েট বিজেপি নেতা - দলের প্রাক্তন ও বর্তমান রাজ্য সভাপতি অনেক দিন ধরেই সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত - তাঁদের বেড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই আর তার সময়কাল সত্তর বা আশির দশক, যা তাঁদের বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়।

ফলে, আরএসএস ও তাদের মতাদর্শ কেবলমাত্র গত দশ বছরেই রাজ্যে প্রচারিত হচ্ছে, তার আগে তাদের কিছুই প্রভাব ছিল না এই কথাটা আদপে সত্যের অপলাপ। তবে এটা ঠিক, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সারা রাজ্যে বামশক্তির বিপুল পরাজয় এবং পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে (২০০৯) আরো বিপর্যয় রাজ্যের মাটিতে বামপন্থীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। এর পেছনে অনেক কারণ যা আজ আর নতুন করে উল্লেখ করার দরকার নেই। তবে বামপন্থীদের রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনাগত অবক্ষয় এবং সেই সঙ্গে সাংগঠনিক দুর্বলতা আরএসএস-এর পক্ষে অনুকূল হতে থাকে। আরএসএস-এর ছড়িয়ে পড়ার প্রশ্নে এই উত্তর-২০০৯ একটা ভিন্ন পর্ব। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এক ধরনের ‘রামধনু’ জোট করলেও তার রাশ মূলত তাঁদের হাতেই ছিল এবং জোটের প্রধান শরিক ছিল কংগ্রেস। ছোট ছোট নকশালপন্থী গোষ্ঠী, এসইউসিআই, বিক্ষুব্ধ বাম, আড়ালে মাওবাদী শক্তি বা ছদ্ম-বিজেপি সবই সেখানে ছিল। কিন্তু জনমত তখন এতটাই বামফ্রন্টের প্রতিকূলে যে এইসব বিষয় নিয়ে কোনো রাজনৈতিক লড়াইই দানা বাঁধেনি। কালক্রমে দেখা গেছে নিজেদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কায়েম রাখতে সাময়িক বন্ধুদের হাত ছেড়ে দিতে তৃণমূলের কোনো অসুবিধেই হয়নি। এই প্রক্রিয়ায় কংগ্রেস বা অন্যেরা সরাসরি শাসক দলের বৈরী শক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে, চলেছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। আর ২০১৪ সালের আগে থেকেই বিজেপি দল রাজ্যে ও কেন্দ্রে ক্রমশ তৃণমূলের প্রধান শত্রু হিসেবে উঠে এসেছে - আজ (২০২১) তার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে।

তাই প্রধান রাজনৈতিক শত্রু যাদের আশ্রয়ে নিজেদের সংগঠন পোক্ত করতে পারে সেই আরএসএসকে শাসক দল জায়গা ছেড়ে দেবে এটা একটা আত্মঘাতী প্রস্তাব। কবে কোন আরএসএস-এর নেতা তৃণমূল নেত্রী বিষয়ে কী বলেছিলেন সেটা এই সূত্রে উল্লেখ করা তাই একরকম অপ্রাসঙ্গিক। বরং খেয়াল করে দেখা যেতে পারে, সদ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন দলে দলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিজেপিতে যোগদান করছিলেন তখন বিজেপির একদল পুরনো নেতা-কর্মী প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছিলেন, এঁরা মূলত আরএসএস শিবির থেকে তৈরি হওয়া কর্মী। এই স্তরের কর্মী বা নেতারা শুধু দশ বছরেই বেড়ে উঠেছেন আদৌ তেমন নয়। আগেও তাঁরা ছিলেন, হয়তো আড়ালে। তাছাড়া, রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পরেও তো প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে গিয়ে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এই প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গে একটা সময়ের পর বামফ্রন্টের নেতারা অতিরিক্ত আহ্লাদিত ছিলেন, অথচ দ্বিতীয় বামফ্রন্টের সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে নজিরবিহীনভাবে তিনি রাজ্যের ন্যায্য আর্থিক পাওনা আটকে দেন।

আসলে সমস্যাটা মতাদর্শের। আরএসএস-এর দক্ষিণপন্থী মতবাদ ও বিভাজনের আগ্রাসী চেহারাকে প্রতিহত করতে দরকার বিপরীত একটা উদার মতবাদ। বামপন্থার তাত্ত্বিক চেহারা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও সামগ্রিকভাবে তার একটা উদার কাঠামো আছে - অন্তত বামপন্থা মানুষে মানুষে বিভেদের কথা বলে না, সকলের সমান উন্নতি চায়। একসময় সরকারে ও সংগঠনে মজবুত থাকার সুবাদে সেই সুযোগ থাকলেও বামপন্থীরা একটা সময় পর সেইভাবে মানুষের কাছে নিজেদের চেতনার মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। অন্যদিক দিয়ে তৃণমূল দল বামপন্থীদের মতো রেজিমেন্টেড দল নয় - আজকের দুনিয়ায় এতটা রেজিমেন্টেশন আদৌ প্রয়োজন কি না তা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে - তবে কোনো পোক্ত মতাদর্শ তাঁদের নেই। কিন্তু মোটামুটি একটা উদার মানসিকতা তাঁদের নেতারা পোষণ করেন, একটা সার্বিক জনকল্যাণমুখী ভাবনা দলের আছে (দুর্নীতি ইত্যাদি মেনে নিয়েও) যা দিয়ে তাঁরা মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছেন ও অনেকটাই সফল হয়েছেন। হয়তো কংগ্রেসের দলছুট হিসেবে মৌলবাদের শরিক না-হওয়াটাও তাঁদের একরকম রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। এই অবস্থান থেকে আরএসএসকে মোকাবিলা করা কিছুদূর অবধি হয়তো অসম্ভব নয়। কারণ বাংলার মাটি মূলগতভাবে অসাম্প্রদায়িক, তার সংস্কৃতি বহুত্বে সমৃদ্ধ। এখানে তাই বাইরে থেকে নিয়ে এসে বিষবৃক্ষের চাষ করতে হয়। সেই চাষে যে গোলা ভরা ফসল খুব সহজে ওঠার নয় তা বিগত বিধানসভা নির্বাচনে প্রমাণিত। তবু বিষ তো থেকেই যায়, বৃহৎ অট্টালিকার কার্নিশ ফাটিয়ে বেড়ে ওঠে বটের চারা - তাই সতর্কতার পাশাপাশি চাই নিরন্তর বিকল্প খোলা হাওয়ার চাষবাস। জনকল্যাণ পরিত্যাজ্য হতে পারে না, কিন্তু তাই বলে একমাত্র সমাধানও হতে পারে না দক্ষিণপন্থার। বামফ্রন্ট আমলে একটা সময় অবধি মানুষ সরকারি সুযোগ সুবিধে অনেক পেয়েছেন কিন্তু শুধু তার ভারে বাম চেতনাকে বিস্তৃত করা যায়নি। কারণ ওই সময়টায় আরএসএস নিজেদের মতাদর্শকে আড়াল করে নিজেরাও সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছিল, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এই দুইয়ের প্রভেদ বুঝতে পারেননি। তাই লড়াইটা একটা বড় পাল্লার, দীর্ঘ তার ব্যাপ্তি। আর এই লড়াইয়ে বামপন্থী চেতনার অগ্রগণ্য বাহিনীকেই প্রধান অধিনায়কের ভূমিকায় আমরা দেখতে চাই। সেটা কীভাবে হবে, কেমন চেহারায় হবে সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। তাই বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ আছে কি না সেটা বামপন্থী বন্ধুরা ভেবে দেখতে রাজি আছেন কি?


সহায়ক সূত্রঃ

● Understanding The BJP's Rise In West Bengal by Shreya Sarkar (The Wire.in)
● Bengal Elections and Beyond by Ravi Joshi (The Wire.in)
● From Nowhere to Everywhere - How RSS Grew in West Bengal to Benefit BJP by Snigdhendu Bhattacharya (The Print.in)