আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পরিবেশ পর্যালোচনার ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক রিপোর্ট-২০২১

স্বপন ভট্টাচার্য


ছোটবেলার যে স্মৃতি এখনও প্রকৃতির নিয়মেই ফি বছর ধরা দেয়, হাত ধরে টেনে নামায় খোলা উঠোনে বা পাগলের ঘুঙুর পায়ে পরিয়ে তুলে নেয় খোলা ছাদে তা হল বর্ষার। আষাঢ়ের প্রথম বর্ষণে মাটি থেকে উঠে আসে উদ্বায়ী শিকড়ের ঘ্রাণ আর আমরা এখনও ছুটে যেতে চাই মাঠে ময়দানে, যেখানে আকাশ এসে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। যেতে চাই, কিন্তু পারি না। নিজেরা না পারলে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ছোটরা আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে অঝোরে ভিজে গান গাইছে - আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, কিন্তু পারি না তাদেরও ছাড়তে, মন চাইলেও সাবধানী থাকি পাছে তারা নিজেদের খুশিতে সওয়ার হয়ে বসে। ভয়ের কারণ বজ্রপাত।

ছয় দশক কাটিয়ে ফেলা এ জীবনে এতগুলো বর্ষা কাটিয়ে দেবার পরে আজকে বর্ষায় বজ্রাহত হবার ভয় চেপে বসল, এ অনুভূতি নেহাতই গ্লানির, তবে এ বাস্তবও বটে। এত বাজ পড়তে জীবনে দেখিনি, বাজে এত মৃত্যুও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ফি বছর বঙ্গোপসাগরে এত ঘন ঘন এত ভয়ঙ্কর সব টর্নাডো বা সাইক্লোনও কি আমরা হতে দেখেছি? আমরা কি জানতাম সাইবেরিয়াতেও দাবানলে অরণ্য খাক হয়ে যায়? আমরা কি কল্পনাও করতে পারি উত্তর মেরুবর্তী কানাডার মত একটা দেশে দিনমানে গড়পড়তা তাপমাত্রা দাঁড়াতে পারে পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস? আমরা কি ভাবতে পেরেছিলাম, যে সব জায়গার সাথে প্রকৃতির সখ্য এত মধুর যে সেখানে লোকেদের বাড়িতে পাখা লাগানোর পর্যন্ত চল নেই, সেখানে তাপপ্রবাহে মরে যেতে পারে হাজারে হাজারে লোক? বন্যা অবশ্য আমাদের বছরকার সঙ্গী সে ম্যানমেডই হোক আর হড়পা বান যাই হোক না কেন, কিন্তু আমরা কি ভাবতে পেরেছি কোনদিন জার্মানি, বেলজিয়াম বা ফ্রান্সের ছবির মত শহরগুলোতে বন্যায় মানুষ মরছে শ’য়ে শ’য়ে?

আসলে আমরা প্রকৃতির কিছু অপরিবর্তনীয় বদলের সাক্ষী হচ্ছি এবং সে সব বদল এত বাস্তব যে আমাদের আমল না দেবার কোনো সুযোগই নেই। পরিবেশে চর্চাকে শিক্ষিত সমাজের একাংশ যে সখের জমিদারি বলে মনে করে থাকেন তা আমরা দিব্য জানি। আমরা এও জানি রাষ্ট্রের পরিবেশ নীতি আশু লাভ-লোকসানের উপর নির্ভরশীল, পঞ্চাশ বছর পরে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে আজকে ভাবতে বসবে কেন সমাজ যদি রাষ্ট্রই এত অপরিণামদর্শী হয় যেমন হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। কয়লা বেচে যে দেশ পুঁজি কামায় সে দেশ ফসিল ফুয়েল নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে এটা হলে তো গ্রেটা থুনবার্গের মত বালিকা এত প্রচার পাবার সুযোগই পেত না। তাদের বক্তব্য, পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে অনেক রেড ফ্ল্যাগ তোলা হয় বটে আদতে সে সব কিছুই ঘটে না। কিন্তু ঘটনা এই যে পরিবেশের কিছু কিছু উপাদান একবার গেলে আর ফেরে না। উত্তরমেরুর পার্মাফ্রস্ট অঞ্চলের বরফ যা গলছে তা আর ফিরবে না। হিমালয়ের বরফের আস্তরণ যা গলে যাচ্ছে তা আর কোনদিনই আগের ঘনত্ব অর্জন করবে না। যে গ্লেসিয়ার গলে যাচ্ছে তা আর নতুন করে কোনদিন তৈরি হবে না। ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সমুদ্রতল প্রতি বছর ৩.৭ মিলিমিটার করে বেড়ে চলেছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে বলে। মানুষ যতটা তাৎক্ষণিকতায় বাঁচে ততটা আগামীতে নয়। সুতরাং এ হারে বাড়লে আগামী দু'হাজার বছরে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে এ গ্রহের অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কের কোন মাথাব্যাথা থাকার কথা নয়, কিন্তু গড় তাপমাত্রা যদি এখনকার তুলনায় দ্বিগুন হারে বাড়তে থাকে তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরেই পৃথিবীর উপকূলভাগের মানচিত্র বদলে যাবে এবং মানুষকে সমতলভূমি ছেড়ে ক্রমশ টিলার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে একথাও সত্যি। সে পৃথিবীর অধিবাসীরা যে আমাদেরই উত্তরপুরুষ এ কথা জেনেও আমরা এখনও অবধি আমাদের জন্যই বাঁচবো ঠিক করেছি, তাদের জন্য বিশেষ মাথাব্যাথা আমাদের নেই।

গত ৯ আগস্ট রাষ্ট্রসঙ্ঘের ছাতার তলায় ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) প্রায় চার হাজার পাতার এক বিপুলাকায় রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন যা এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের ষষ্ঠ রিপোর্ট । রিপোর্টটির মুখ্য প্রতিপাদ্য, মুখ্য মাথাব্যাথাও বলা যায় যাকে, তা হল উষ্ণায়ন। উল্লেখ করা যেতে পারে পরিবেশ নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের যে চুক্তিটিকে ভিত্তি মেনে বর্তমান স্টেটাস রিপোর্টটি তৈরি করা হল সেটি ২০১৫-এর 'প্যারিস এগ্রিমেন্ট' বলে খ্যাত। প্যারিসে আয়োজিত পরিবেশ সম্মেলনে মোটামুটি সর্বসম্মতভাবে যে চুক্তিটি সবার সম্মতির জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল তার মূল কথাটা ছিল এই যে, এই শতাব্দীতে বিশ্বের বায়ুমন্ডলীয় গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারকে শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী তাপমাত্রার থেকে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে দেওয়া চলবে না এবং আরো বিশদে বলা হল ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করতে হবে। বলা ভালো, এটা প্যারিস চুক্তির দীর্ঘকালীন লক্ষ আর স্বল্পমেয়াদী লক্ষ বলতে যা মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তা হল এই যে, গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রাকে যত দ্রুত সম্ভব অনতিক্রম্য সীমায় বেঁধে ফেলতে হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলির দায় যে এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় বেশি থাকবে তাও মেনে নেওয়া হয়েছিল। আজ প্রায় পাঁচ বছর পরে ১৯৫টি দেশের সম্মিলিত রিপোর্ট যা বলছে তা ভীতিপ্রদ হলেও সম্পূর্ণ নিরাশাব্যঞ্জক বলতে তাদের বেধেছে। এই বাধ্যবাধকতার কারণ কিছু তো থাকবেই যেখানে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির কার্বন জ্বালানি জনিত দূষণায়নের প্রবণতা কিছুই কমেছে বলে মালুম হচ্ছে না। রিপোর্টে বলা হয়েছে বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী তাপমাত্রার তুলনায় ১.১ ডিগ্রি হারে বাড়ছে এবং প্রতিশ্রুত ব্যবস্থাগুলো যদি নেওয়া যায়, কয়লা ও পেট্রলের মত জীবাশ্ম জ্বালানি যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা হলে ১.৫ ডিগ্রির সীমাদদ্ধতা আগামী কুড়ি বছরেই অর্জিত হতে পারে। IPCC-2021 রিপোর্টের সারাংশটুকু নিয়েই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে হবে কেননা আগেই বলেছি সমগ্র রিপোর্টটি প্রায় চার হাজার পাতার এবং অঞ্চলভিত্তিক খুঁটিনাটিতে ভারাক্রান্ত।

পরিবেশের বর্তমান অবস্থাঃ এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই প্রকৃতির তাপ-ভারসাম্য নষ্ট করেছে মানুষ। মানুষই বায়ু, সমুদ্র এবং মাটির দ্রুত এবং ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং শীতপ্রধান অঞ্চলের, তুষারাবৃত অঞ্চলের চরিত্রই বদলে দিয়েছে তারা। এখনকার বদল, যা মানুষের হাত ধরে এসেছে, তা আগামী শত শত বছর ধরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলীয় বিপর্যয় ঘটিয়ে যেতে সক্ষম। রিপোর্টে বলা হয়েছে প্যারিস চুক্তি পরবর্তী কালে তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, খরা, সাইক্লোন সবকিছুরই অভূতপূর্ব বাড়াবাড়ি দেখা গিয়েছে এবং এর কোনটাই মানুষের প্রভাব বিবর্জিত নয়। এখনকার প্রযুক্তিতে আমরা আদি পরিবেশের তুলনায় এখনকার পরিবেশের পরিবর্তনগুলিকে কমপিউটার সিমুলেটেড মডেলে অনুধাবন করতে পারি। দেখা যাচ্ছে গত পাঁচ বছরে পরিবেশের যা কিছু অর্জন তার প্রায় পুরোটাই ঋণাত্মক এবং তাপমাত্রার বড়জোর ৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি সহ্য করবার ক্ষমতা আজকের পৃথিবীর আছে। তাপমান এর চেয়ে বেশি বাড়লে তা জীবকূলের পক্ষে অপরিবর্তনীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে। গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর এখনকার মাত্রা গত আট লক্ষ বছরে দেখা যায়নি এবং বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের এই হার গত দু'কোটি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৭৫০ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৪৭.৩ শতাংশ বেড়েছে। মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে এই একই সময়ে ১৫৭ শতাংশেরও বেশি। গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণে বহুগুন বৃদ্ধি ঘটিয়েছে প্লাস্টিক দূষণ। ১৯৫০-এর পর থেকে ভূত্বকে জমা হয়েছে ৮৩০ কোটি টন প্লাস্টিক, ভাবা যায়? বাতাসে ভাসমান এরোসলের পরিমাণ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উত্তর গোলার্ধে কমেছে কিন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় বেড়েছে। রিপোর্টে শিল্পবিপ্লব পরবর্তীকালে মানুষের প্রভাবে পরিবেশের মুখ্য যে সব পরিবর্তন এসেছে তার উল্লেখ ও সম্ভাব্যতার উল্লেখ রয়েছে। সারনি ১-এ এগুলির মোটামুটি একটা তালিকা দেওয়া গেল।

সারণি ১ - শিল্পবিপ্লব পরবর্তীকালে পরিবেশের যে সব পরিবর্তনগুলি মানুষের প্রভাবে ঘটেছে

বায়ুমন্ডল সমুদ্র তুষারমন্ডল কার্বন দূষণ ভূত্বকীয় আবহাওয়া মোট ফলাফল
১৮৫০ থেকে ভূত্বকের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১৯৭০ থেকে সমুদ্রের তাপমান বেড়ে চলা ১৯৭৯ থেকে উত্তরমেরুতে বরফের স্তর ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়া ১৯৬০ থেকে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি ১৮৫০ থেকে অন্তত ৪০% বেড়েছে শিল্পবিপ্লবের পরে সারা ভূমন্ডলের ক্রমান্বয়ে উষ্ণতা বৃদ্ধি
ট্রোপোস্ফিয়ার স্তরে ১৯৭৯ থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সমুদ্রজলে লবনাক্ততার হার বৃদ্ধি ১৯৫০ থেকে উত্তর গোলার্ধে বসন্তকালীন তুষারপাতে ঘাটতি অ্যাসিড বৃষ্টি সমুদ্রতলের অম্লতা বেড়ে চলা -
বায়ুমন্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে তাপমাত্রা হ্রাস ১৯৭০ থেকে সারা বিশ্বে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে চলা ১৯৯০ থেকে গ্রীনল্যান্ড তুষারস্তরে লাগাতার ক্ষয় ১৯৭০ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য তিন গুণ বেড়ে গেছে -
অতিবৃষ্টি ও বাতাসে আর্দ্রতা বৃদ্ধি - ১৯৯০ থেকে দক্ষিণমেরুতে বরফের স্তরে ক্ষয় প্লাস্টিক জনিত গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণে লাগাতার বৃদ্ধি -
১৯৮০ থেকে বিষুব অঞ্চল থেকে মেরুবর্তী উষ্ণ বায়ু প্রবাহের হার বৃদ্ধি - বিশ্বজুড়ে গ্লেসিয়ারের গলন - -


পরিবেশের ভবিষ্যৎ রিপোর্টে এই শতাব্দীতে পরিবেশের সম্ভাব্য পরিণতিগুলোর সম্পর্কে যে সাবধানবাণী দেওয়া হয়েছে তা এক কথায় ভীতিপ্রদ। যদি কয়লা বা পেট্রলের মত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর উন্নত দেশগুলির নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে না কমানো যায় তাহলে এই শতাব্দীতেই মানুষ গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখার লাল ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলবে যার পরিণাম ভয়াবহ। এমনকি গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের এখনকার হারকেও যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলেও ২০৫০ সাল অবধি পৃথিবীর গড় তাপমান বাড়তেই থাকবে। এর ফলে যে সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় একেবারেই এড়ানো যাবে না তার লিস্টি লম্বা। সাইবেরিয়ায় দাবানল যদি একটা নমুনা হয় তাহলে চিলি’তে খরা পরিস্থিতিতে জলের জন্য হাহাকার আর একটা। শুধু কৃষিক্ষেত্রের জন্য অনুপযোগী খরা নয়, পরিবেশগত খরা যেমন একদিকের মানুষকে ভোগাবে তেমনই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ও বন্যায় অন্য দিকের জীবন দুর্বিষহ হবে। ‘এল নিনো’ গোছের সামুদ্রিক উষ্ণ স্রোত এবং সমুদ্রবক্ষে তৈরি হওয়া উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি করবে ভয়ংকর সব সাইক্লোনের। উত্তরমেরুর সমুদ্রে বরফের স্তর গলতে থাকবে, পার্মাফ্রস্ট বা সারা বছর বরফের চাদরে মুড়ে থাকা অঞ্চলগুলি বরফ গলে ন্যাড়া হতে শুরু করেছে এবং হতে থাকবে, এমনকি হিমালয়ের শ্বেতশৃঙ্গগুলোর ওপর বরফের আস্তরণ হালকা হয়ে আসবে। উষ্ণায়ন ভূমন্ডলীয় জলচক্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে চলেছে। এর ফলে যেমন খরার তীব্রতা বাড়বে তেমনই বৃষ্টিপাতের হারও অস্বাভাবিক বাড়বে। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে চলার প্রধান কারণ হল পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে চলা। ফসিল জ্বালানির উপর নির্ভরতা যদি না’ও বা বাড়ে, তা হলেও এখনকার হারের সঙ্গে এই গ্রহের কার্বন ‘সিংক’ অর্থাৎ পরিবেশের মুক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডকে বেঁধে রাখবার, জমিয়ে কার্যকরী জীবনদায়ী যৌগে রূপান্তরিত করার যে ব্যবস্থা প্রকৃতিই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে তা আর তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে মুখ্য তিনটি হল সবুজ উদ্ভিদ, সমুদ্র এবং মাটি। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নেয়, মাটি জৈব পদার্থের গলনে পচনে তৈরি হওয়া কার্বন মাটিতে জমিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি বছর ধরে যার জন্যই ভূগর্ভে তৈরি হয়েছে কয়লা বা পেট্রলের ভান্ডার আর সমুদ্র বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিচ্ছে সমুদ্রতলে ভাসমান ফাইটোপ্ল্যাংক্টনের মাধ্যমে এবং তাকে রূপান্তরিত করছে উপকারী কার্বন উৎসে যাকে আজকাল ‘ব্লু কার্বন’ বলা হয়ে থাকে। এই সিংক আর সোর্সের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় থাকলে ভাবনার কিছু ছিল না কিন্তু বিধি বাম বলে পার পাবার উপায় নেই কারণ মানুষই এই ভারসাম্য বিপর্যস্ত করেছে অনিয়ন্ত্রিত হারে ফসিল জ্বালানি পুড়িয়ে। শুধু পেট্রল-কয়লাই একমাত্র কারণ নয় উষ্ণায়নের, এর সঙ্গে রয়েছে রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে শীতাতপনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লুওরো কার্বন (CFC) এর মত গ্রীনহাউস যৌগগুলোর অপরিমিত ব্যবহার যার ভার বইতে পারা এই নীল গ্রহটির পক্ষে ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠছে। আছে অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিক নির্ভরতা এবং অনুমান এই যে ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু প্লাস্টিকজাত ১৩৪ কোটি টন গ্রীনহাউস গ্যাস বাতাসে মিশবে। ভবিষ্যত সম্ভাবনাগুলোর কথা যখন বলি আমরা তখন সাধারণত উদ্ধার পাবার সম্ভাবনাগুলিও মাথায় রাখি, কিন্তু ঘটনা এই যে, যা গেছে তা আবার তৈরি হয়ে উঠবে এমনটা অন্তত মেরু-বরফের ক্ষেত্রে বা পাহাড়শীর্ষের গলে যাওয়া বরফ স্তরের ক্ষেত্রে বা গলে যাওয়া গ্লেসিয়ারের ক্ষেত্রে হবার নয়। এগুলো স্থায়ী ড্যামেজ, তুষারশৃঙ্গ ন্যাড়া হয়ে গেলে আবার কোনদিন যদি বরফে ঢাকা পরে তাহলে তা হবে ভবিষ্যৎ কোন হিমযুগে যখন মানুষ বলে কিছু থাকার সম্ভাবনাই অবলুপ্ত হবে।

আগাম অনুমানঃ IPCC রিপোর্টটি পেশের উদ্দেশ্য হল ক্ষতির একটা বিজ্ঞানভিত্তিক আগাম অনুমানপদ্ধতি ঠিক করে ফেলা। অনুমানই, কেন না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ক্ষতির খতিয়ান সব সময় আগাম হিসেবের সঙ্গে মেলে না, তবু মডেলের সাহায্য নিয়ে গাণিতিক হিসেব নিকেশ করে আজ থেকে পঞ্চাশ একশো বছর পরে পরিবেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা নিয়েই করা হয়েছে ‘রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’। সে অংক বলছে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়ার হার যদি টার্গেট ১.৫ ডিগ্রি থেকে মাত্র ০.৫ ডিগ্রি বেড়ে ২ ডিগ্রিতে পৌঁছায় তা হলেই পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। এবং এক অঞ্চলের বিপর্যয় অন্য অঞ্চলকে বিপর্যস্ত করতে বাধ্য। একই কারণে আর্কটিকে বরফ গললে বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের ভয় থেকে যায়। বুঝতে হবে, এ জগতে মালার মত একে অন্যের সঙ্গে গাঁথা পরিবেশের প্রতিটি উপাদান। এর কোথাও টান পড়লে মালা ছিঁড়ে যাবে - এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে বিশেষ করে সেই সব দেশকে যারা বাকি দুনিয়ার ভালো মন্দকে আধ শতাব্দী পরে কী হবে ভেবে কোনো রেয়াৎ করার পক্ষপাতী নয়। রিপোর্টে উষ্ণতা বৃদ্ধির তিন রকম সম্ভাবনার ছবি আঁকা হয়েছে এবং তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ঠিক কী হতে পারে তার একটা গাণিতিক বিশ্লেষণও রাখা হয়েছে। সারণি ২-তে সেই সম্ভাবনাগুলির একটা হদিশ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

সারণি ২ - উষ্ণতা বৃদ্ধির নিরিখে আগামী দিনের পৃথিবী

প্রাকৃতিক পরিমাপক সমূহ বর্তমান বৃদ্ধির হার ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস যদি ১.৫ ডিগ্রি হারে বাড়ে যদি ২.০ ডিগ্রি হারে বাড়ে যদি ৪.০ ডিগ্রি হারে বাড়ে
তাপমাত্রা ভূমন্ডলীয় তাপমান প্রতি দশকে ১.২০C বাড়তে পারে ভূমন্ডলীয় তাপমান প্রতি দশকে ১.৯০C বাড়তে পারে ভূমন্ডলীয় তাপমান প্রতি দশকে ২.৬০C বাড়তে পারে ভূমন্ডলীয় তাপমান প্রতি দশকে ৫.১০C বাড়তে পারে
খরা দ্বিগুন হবে ২.৪ গুন বাড়বে ৩.১ গুন বাড়বে ৫.১ গুন বাড়বে
বৃষ্টিপাত ১.৩ গুন বাড়বে ১.৫ গুন বাড়বে ১.৮ গুন বাড়বে ২.৮ গুন বাড়বে
তুষারপাত ১ শতাংশ কমবে ৫ শতাংশ কমবে ৮ শতাংশ কমবে ২৫ শতাংশ কমবে
সাইক্লোন অপরিবর্তিত ১০ গুন বাড়বে ১৩ গুন বাড়বে ২৫ গুন বাড়বে
সমুদ্রতলের উচ্চতা ২০ সেমি এখনই বেড়েছে। ২১০০ সালের মধ্যে আরো ৩০ সেমি থেকে ১ মিটার বাড়তে পারে আগামী ২০০ বছরে ৩ মিটার বাড়বে আগামী ২০০ বছরে ৬ মিটার বাড়বে আগামী ২০০ বছরে ১৮ মিটার বাড়বে


যা করা দরকারঃ সব চাইতে আগে দরকার কার্বন জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমানো। সোর্স ও সিংকে ভারসাম্য না এলে মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণে জিরো ব্যালান্সে পৌঁছানো সম্ভব নয়। পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে, আমাদের পরের, তারও পরের প্রজন্মের জন্য একটা বসবাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে চাইলে কার্বন ডাই অক্সাইডের নেট জমা হওয়ার হারকে শুন্যে নিয়ে যেতে হবে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে মিথেন এবং অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণের হার। এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে প্লাস্টিকের ব্যবহার। শুধুমাত্র ভারতেই রোজ ১৫,০০০ টন প্লাস্টিকবর্জ্য বাতাসে মিশছে। রিপোর্টে সাবধানবাণীর সঙ্গে সঙ্গে একটা আশার বাণীও আছে। বলা হয়েছে, যদি আমরা বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ সমস্ত গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা অন্ততপক্ষে বেড়ে চলার হারটাকেও আটকে দিতে পারি তাহলে আগামী বিশ বছরেই একটা বিশুদ্ধতর পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারব এবং হয়ত শত শত বছর লাগলেও, অনেকগুলো অঘটন ঘটনকারী প্রাকৃতিক শর্তকেও নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা যাবে।

এই হল IPCC রিপোর্টের সহজবোধ্য সারাংশ, যদিও রিপোর্টটি মডেল ভিত্তিক এবং এতে যে কোন অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, নগরায়নের হার এমনকি সামাজিক স্তরে মেলেমেশার হার সবই গণনার আওতায় আনা হয়েছে। সুতরাং আশার যা বাণী তা সবই ‘বেস্ট কেস সিনারিও’ ভিত্তিক অনুমান, বাস্তবে পরিস্থিতি কিন্তু বিপদঘন্টা বাজানোর মত। আট বছর আগে যখন এই প্যানেলের পূর্ববর্তী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার তুলনায় কিন্তু ‘প্রেজেন্ট কেস সিনারিও’ জটিল। অনুমান করা যায়, বর্তমান হারেও ২০৫০ সালের মধ্যে অন্তত গ্রীষ্মকাল এমন হবে উত্তরমেরুতে যে, সমুদ্র থেকে ভাসমান বরফ অন্তর্হিত হবে। বরফবিহীন মেরুসমুদ্র রমণীয় তো নয়ই, উপরন্তু তার প্রভাব আমরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতা, কোথাও যে এড়াতে পারবো এমন আশা নেই। উপকূলবর্তী বহু শহর বন্দর জনপদ স্থায়ীভাবে চলে যেতে পারে জলের তলায়। আর যদি আরও খারাপ হয় তা হলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি তাপমান ২ ডিগ্রির মাত্রা ছাড়িয়ে ২.৪ ডিগ্রি বাড়বে এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৪.৪ ডিগ্রি থেকে ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং পরিবেশ নিয়ে যত কথা দেওয়া নেওয়াই হয়ে থাকুক না কেন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে, এখনও পর্যন্ত কেউ কথা রাখেনি অবস্থা বজায় আছে। গতবারের রিপোর্টের তুলনায় আর একটা বদল এই রিপোর্টে পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হল, গ্লোবাল অ্যাভারেজ ইমপ্যাক্টের থেকে সরে এসে অঞ্চলভিত্তিক ইমপ্যাক্টের দিকে নজর দেওয়া। স্বাভাবিক, কেননা পৃথিবীর এক এক জায়গায় উষ্ণায়নের এক এক রকম প্রভাব। আর্কটিকে বরফ গলছে তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে, দক্ষিণ আমেরিকায় এবং আফ্রিকায় খরা হচ্ছে, এশিয়ায় ঘন ঘন ঘুর্ণাবত্য তৈরি হচ্ছে।

পাঁচ-সাত বছর পর পর এই যে পরিবেশের ক্ষতি খতিয়ে দেখা তাতে মানুষের ভূমিকার কথা যেভাবে ‘ইতি গজ’ প্রকরণে পরিবেশিত হয় তা জানলে কিঞ্চিৎ কৌতুকের সঞ্চার হতেও পারে। প্রথম প্রথম বলা হত মানুষের ভূমিকা আনসার্টেন - অনিশ্চিত, ২০১৩-তে বলা হয়েছিল ‘ক্লিয়ার’ - পরিষ্কারভাবেই প্রতীয়মান এবং এই সদ্য পেশ করা প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে - আনইকুইভোক্যাল - তর্কাতীত। এই শব্দের জাগলারি বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই মানতে পারছেন না। আসলে বিজ্ঞানীরা ভাষাচয়নে বরাবর অতি সাবধানী এবং বোধহয় স্টেট ফান্ডিং-এর খাঁচায় আটকে পড়া তাঁদের প্রাণপাখি উড়তে চাইলেও পারে না। পরিষ্কারভাবে যা বলা দরকার তা কোনো ভণিতা ছাড়া বললে বলতে হয় বিশ্বমানবতার বিপদঘন্টা রীতিমতো বাজছে এবং এখনকার বিপদের সঙ্গে তুলনীয় কোনো বিপদের সম্মুখীন মানবজাতি ইতিপূর্বে হয়নি। সুতরাং সময় কম, এখনই ব্যবস্থা না নিলে প্রকৃতি তার নিজের ইতিহাস নিজেই লিখবে, একটা সময়ের পর মানুষের তাতে আর বিশেষ কিছু করার থাকবে না।


সুত্রঃ

U.N. Intergovernmental Panel on Climate change (August 2021)
https://www.ipcc.ch/report/ar6/wg1/