আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ইয়েলিং ও হেলসিংগর

অমিয় দেব


১৯৯৬-এর আগস্টে একবার ডেনমার্ক গিয়েছিলাম। তখন আমি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। (১৯৫৫-তে প্রতিষ্ঠিত) আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্য সংস্থার (ICLA/AILC) কর্মসমিতির এক সভা ছিল ওডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ে। (আইসিএলএ-এর কংগ্রেস ত্রিবার্ষিক। প্রতি কংগ্রেসের শেষে তাতে নির্বাচিত কর্মসমিতির প্রথম সভা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সভা হয় অন্তর্বর্তী দু'বছরে। শেষ সভা পরবর্তী কংগ্রেসের সূচনায়। বলা বাহুল্য সেই কংগ্রেসে পরবর্তী কর্মসমিতিও নির্বাচিত হয়। ১৯৯৪-এর এডমন্টন কংগ্রেসে নির্বাচিত কর্মসমিতিতে আমার অন্তর্ভুক্তি ঘটে অন্যতম সহসভাপতি রূপে। অতএব ১৯৯৬-এর আগস্টে আমি ওডেন্সেতে। এর আগের বছর, অক্টোবরে, গিয়েছিলাম বেইজিং-এ, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে।) কর্মসমিতির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সভার কেজো চেহারা আলোকিত হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট তুলনামূলক সাহিত্য সম্মিলনে। তাতে যেমন কর্মসমিতির সদস্যরা যোগ দেন, তেমনি যোগ দেন কাছে-দূরের অন্য তুলনামূলক সাহিত্যবেত্তারাও।

বেইজিং সম্মিলন ছিল তিন দিনের। আর তার বিষয় ছিল 'কৃষ্টিতে-কৃষ্টিতে সংযোগ ও কৃষ্টিতে-কৃষ্টিতে বিভ্রান্তি'। পরে তা সিডনি থেকে বই হয়েও বেরোয়। সম্পাদনা করেন মেবেল লী ও মেং হুয়া। সেই বইয়ের (Cultural Dialogue and Misreading, 1997) সাক্ষ্যেই বলছি, এক উন্নত মানের সম্মিলন আয়োজন করেছিলেন চৈনিক তুলনাবিদেরা। ১৯৯৬-এর ওডেন্সে সম্মিলন ছিল 'সাহিত্যে প্রকৃতি' নিয়ে, দু'দিনের। তাও বই হয়ঃ Nature: Literature and its Otherness/La litterature et son autre, 1997; সম্পাদনা করেন স্ভেন্ড এরিক লার্সেন, মোর্টেন নয়গর ও আন্নালিসে বাল্লেগর পেটেরসেন; প্রকাশক ওডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য আমরা কেউ কেউ ওই সম্মিলনে প্রবন্ধ না পড়ে, একদল স্বেচ্ছাবৃত সাহিত্যশিক্ষকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে, পাঠ্যবস্তু সামনে রেখে, পাঠপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলি।

অন্যদিকে, ওডেন্সেতে কর্মসমিতির এক মুখ্য কাজ হয় ২০০০-এর আইসিএলএ কংগ্রেসের স্থান নির্ধারণ। প্রস্তাব এসেছিল চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। দু'পক্ষেই জোর যুক্তি ছিল - একদিকে বেইজিং সম্মিলনের প্রামাণ্য সার্থকতা; অন্যদিকে এক নতুন মহাদেশে পদার্পণ। শেষে মতাধিক্যে দক্ষিণ আফ্রিকাই সাব্যস্ত হয়ঃ ২০০০-এ আমরা যাব প্রিটোরিয়ায়। এশিয়ায় আগে একবার হয়ে গেছে কংগ্রেস-১৯৯১-তে টোকিওয়। তবুও ১৯৯৭-এ ভারতে হতে পারত, কিন্তু গ্রীষ্মশেষের প্রতিকূল আবহাওয়া হেতু যখন আমরা তার বদলে শীতের গোড়ায় অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিই, কর্মসমিতি রাজি হয়নি। আমাদের পরিবর্তে তখন এগিয়ে আসে হল্যান্ডের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ২০০৩-এর কংগ্রেস কিন্তু হতে যাচ্ছে হংকং-এ।

ডেনমার্ক গিয়ে নামি কোপেনহাগেনে। আমার ইতিহাসবিদ বন্ধু প্রদীপ সিনহার মেয়ে মৈত্রেয়ী ও তার ডেনীয় বর সরেন কোপেনহাগেনে থাকে। তারা আগেই খবর পেয়েছিল। আতিথ্যে সরেন মৈত্রেয়ীর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। তা উপভোগ করে আমার ডেনমার্কে প্রথম রাত্রি কাটল। পরের দিন ওডেন্সে যাত্রা। ট্রেনে কর্স্যর পর্যন্ত গিয়ে স্টীমারে সমুদ্র পেরোনো। সমুদ্রসেতু, 'দি গ্রেট বেল্ট ব্রিজ'-এর নির্মাণ তখনও শেষ হয়নি (এখন তো শুনেছি দিনে কয়েক হাজার গাড়ি পেরোয় ওই সেতু দিয়ে)। ওপারে নাইবোর্গ গিয়ে আবার ট্রেনে চাপতে হবে। এদিকে, স্টীমারে দেখা হয়ে গেল আইসিএলএ-র কর্মসমিতির আরেক সদস্য মার্গারিদা লোসা-র সঙ্গে। খোলামেলা মানুষ। হৃদ্যতার সম্পর্ক আমাদের। আসছেন লিসবন থেকে। সঙ্গে তাঁর ভারতীয় স্বামীর পুত্র। বাকি পথ গল্প করতে করতে কেটে গেল।

ছোটো দেশ ডেনমার্ক। সমুদ্রশাসিত। একদিকে বাল্টিক সাগর, অন্যদিকে নর্থ সী। কোপেনহাগেন পুবে, বাল্টিক-তীরে 'হাভন', বন্দর। ওডেন্সে মধ্যদেশে। কিন্তু ওডেন্সে হান্স খ্রিশ্চিয়ান আন্ডেরসেনের শহর। আমার বন্ধু মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই যে লিখেছিলেন, ছাত্রাবস্থায়, ‘এমনকি, আজ পর্যন্ত, ডেনমার্ক যেন রূপকথার দেশ’ তার ভিত্তি তো এই ওডেন্সেতেই। ফাঁক পেলেই একবার ঘুরে আসা যায় আন্ডেরসেন জাদুঘর। জাদুঘরই, দেখে দেখে যেন আর ফুরোয় না। গল্পগুলি সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে। অথচ আমরা কিনা ওডেন্সে এসেছি সভা করতে? ক্লাসিক হয়ে যাওয়ার এই কি বৈশিষ্ট্য - নিত্য, কিন্তু প্রাত্যহিক নয়।

আবার পশ্চিমে, নর্থ সী উপকূলে কিছু ভাইকিংদের চিহ্ন রয়ে গেছে। মস্ত লম্বাটে নৌকার মতো একটা জাহাজ যেন কোথায় দেখলাম। সেটা কি রিংকোবিং-এ প্রদর্শিত ছিল? না, তেমন কোনও দূরের ফিয়র্ডে যাইনি যেখানে ভাইকিং জাহাজকে জল কাটতে দেখা গেল। তাও, সভা শেষ হয়ে গেলে পর ওডেন্সের উদ্যোক্তারা আমাদের জন্য খানিক ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাতেই তো ইয়েলিং যাই। কী দেখেছিলাম ইয়েলিং-এ? অনেকগুলি মাটিতে প্রোথিত পাথর, হাজার বছরের পুরোনো। তাদের গায়ে এক অচেনা লিপিতে নানান বার্তা খোদিত। সেই লিপির নাম 'রুন', রোমক লিপি আমদানির আগে জার্মান ও সংশ্লিষ্ট উত্তর ইউরোপীয় ভাষা সমূহ এতেই লেখা হত। লিপিবিদদের কাছে এই 'রুনীয়' পাথরগুলি অপার কৌতূহলের সামগ্রী। ডেনীয় তথা স্ক্যান্ডিনেভীয় তথা নর্স পুরাতত্ত্বেরও আকর। টলকিন-এর 'হবিট' বা 'লর্ড অব দি রিংস' কি একসময় আমার মতো সাধারণ পাঠকের তৃষ্ণা মিটিয়েছে? (ইন্দ্রজিৎ তো প্রায় 'হবিট' খুঁড়ছিল। সে-বই কি এখনো এবাড়ির তাকে আছে?)

দেশের ফেরার প্লেন ধরতে কোপেনহাগেন ফিরে আসি। আবার মৈত্রেয়ী-সরেনের অতিথি। একটু সময়ও ছিল হাতে। ঈষৎ ঘুরে বেড়াই ওই বন্দর শহরে। ওডেন্সের আশেপাশে কাকে যেন একবার বলেছিলাম, সমৃদ্ধ দেশ তোমাদের - গোলা উপচে পড়ছে - কিন্তু একটাই অভাব। লোকের। বলো তো কিছু লোক পাঠিয়ে দিতে পারি আমাদের দেশ থেকে। সে বলেছিল, না না, আমরা যথেষ্ট আছি। কোপেনহাগেনে অবশ্য লোকের অভাব নেই, যদিও ঘিঞ্জি নয় আদৌ। সরেন একটা পাড়ায় নিয়ে গেল যেখানে ডেনীয় কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বাস। বোধকরি কারিগর। কুশলী, কিন্তু নিত্যনতুন যন্ত্রের দাপটে বিপন্ন। বেড়াতে বেড়াতে কোথাও কিছু পুরোপুরি ডেনীয় খাবারও খেলাম। আমার প্রিয় সবুজ সোয়েটার ওখানেই কেনা - খুব নরম উলের। মৈত্রেয়ীর নেতৃত্বে আমার ডেনীয় সওদা।

।। ২ ।।

কোপেনহাগেনের অদূরেই হেলসিংগর, ট্রেনে যেতে এক ঘন্টাও লাগে না। বস্তুত ডেনমার্ক এসেই হঠাৎ খেয়াল হল যে 'হ্যামলেট' তো শুধু 'হ্যামলেট'ই নয়, 'হ্যামলেট' 'প্রিন্স অব ডেনমার্ক'ও। এবং এই হেলসিংগরই শেক্সপিয়রের এলসিনোর। আর হেলসিংগরতটে যে ক্রনবর্গ কেল্লা তা-ই এলসিনোর প্রাসাদ। এমনতর কেল্লার প্রহরা চত্বরে দাঁড়িয়েই উচ্চারিত হয়েছিল 'Who is there?' - সেই প্রশ্ন যা নিয়ে শুরু শেক্সপিয়রের নাটক। শেক্সপিয়র ডেনমার্ক আসেননি, হেলসিংগরের ক্রনবর্গ কেল্লা (এই কেল্লানির্মাণ, আসলে নবনির্মিত ক্রনবর্গ, শেষ হয় ১৫৮৪-তে) দেখেননি। কিন্তু ডেনমার্কের রাজকাহিনি খানিকটা জানতেন। দ্বাদশ শতকের ডেনীয় যাজক সাক্সো গ্রাম্মাটিকুসের ওই ডেনীয় ইতিহাসের কোনও কোনও অংশ কি বেলফরের ফরাসি চেহারায় (আমব্লে-কাহিনি) বা অন্যথা তাঁর কাছে পৌঁছয়নি - সেই যে রাজ্যলোভে এক কনিষ্ঠ ভ্রাতার তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে হত্যা ও ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ, এবং প্রতিহিংসায় প্রত্যাদিষ্ট ভ্রাতুষ্পুত্রের নানা ফাঁদ পেরিয়ে তা শেষ পর্যন্ত চরিতার্থ করা?

কোপেনহাগেনে এসে হেলসিংগর যাব না তা কি হতে পারে? এবং হেলসিংগর গেলে ক্রনবর্গ দেখব না? আর ক্রনবর্গ গেলে তার প্রহরা চত্বরে দাঁড়িয়ে দূরে সমুদ্রের অন্য তটে একটু সুইডেন দেখব না - সেই ফর্টিনব্রাসের সুইডেন যার হাতে নাটকের সমাপন? শুনেছি ক্রনবর্গের অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণে মুক্ত আকাশের তলায় মাঝে মাঝেই শেক্সপিয়র অভিনীত হয়, আর তাঁর যে-নাটক সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয় তা 'হ্যামলেট, প্রিন্স অব ডেনমার্ক'। বস্তুত, হেলসিংগর শহরে বিস্তর শেক্সপিয়ার-চিহ্ন। অবাক হব না যদি হাঁটতে হাঁটতে কোনও যুবককে বিড়বিড় করতে শুনি, 'To be or not to be, that is the question'।


কৃতজ্ঞতাঃ স্যমন্তক দাশ