আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

নির্বাচন পরবর্তী বাংলার হিংসা ও হাইকোর্টের রায়


সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পরবর্তী খুন ও ধর্ষণের মামলাগুলোতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে অন্যান্য অপরাধগুলি খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য পুলিশের বিশেষ টিম বা সিট গঠনের। সিটের তদন্ত আদালতের নজরদারিতে হবে। সেজন্য সুপ্রিম কোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়োগ করা হয়েছে। কত দিনের মধ্যে তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দিতে হবে, তাও উল্লেখ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ছ'সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এবং সিটকে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় রাজ্যকে পুরোপুরি সহযোগিতা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে হাইকোর্ট জানিয়েছে, নয়া ডিভিশন বেঞ্চ গঠন করা হবে। যে মামলার শুনানি হবে আগামী ২৪ অক্টোবর। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে যে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছিল রাজ্য সরকার, তার কোনও ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে হাইকোর্ট। এই রায় নিয়ে স্বভাবতই উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে আক্রমণ করা হয়েছে এই রায়কে, যেহেতু নির্বাচন পরবর্তী হিংসার দায়ভাগ মূলত তাদের ওপরেই বর্তায়। বস্তুত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে ছত্রে ছত্রে তৃণমূলের প্রতি সমালোচনা ছিল। সেই সমালোচনাকেই কার্যত শিলমোহর দিল হাইকোর্ট।

এই রায় তৃণমূলের কাছে একটা ধাক্কা তো বটেই, সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে নির্বাচন পরবর্তী ভয়াবহ হিংসার দায় মূলত যে তাদেরই, সেটা অস্বীকার করবার জায়গা নেই। বিরোধী পার্টি করবার অপরাধে খুন, ধর্ষণ বা জমির ধান কেটে নেওয়া, গ্রামছাড়া করা, শালিসি সভা বসিয়ে জরিমানা আদায়, ইত্যাদি অজস্র ন্যক্কারজনক ঘটনা তৃণমূল সেই ২০১১ থেকেই করে আসছ। তখন আক্রমণ আসত বামপার্টিদের উপর, এখন বিজেপির উপর আসছে। বিজেপি একটি গা ঘিনঘিনে দল হতেই পারে, তার রাজনীতিও হতে পারে ততোধিক বিষময়, কিন্তু তাই বলে তার গরীব সমর্থকের স্ত্রীকে মিছিলে হাঁটা বা বুথে এজেন্ট হবার অপরাধে ধর্ষণ করার কোনও ন্যায্যতা যে থাকতে পারে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে কথা ভুলে গিয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে ২০১৮ সালেও পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এরকম ভয়াবহ সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল তৃণমূল, যে কারণে বহু জায়গাতেই বিরোধীশূন্য নির্বাচন হয়েছিল। মানুষ তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছিলেন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে গিয়ে, হাতের কাছে যে বিকল্প পেয়েছিলেন তা যতই বিবমিষা উদ্রেককারী হোক না কেন তাকেই বেছে নিয়েছিলেন তৃণমূলকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে। একই ভুল তৃণমূল আবার করছে। এ কথা যদিও অনস্বীকার্য যে তারা নির্বাচিত হয়ে এসেছে মানুষের বিপুল ভোট ও সমর্থনেই, কিন্তু সেটার ওপর ভরসা রাখতে সাহস পাচ্ছে না তারা। কারণ তারাও জানে যে যেদিন একটা শক্তিশালী বিকল্প আসবে সেদিন তাদের চুরি জোচ্চুরি দুর্নীতি ও গুণ্ডাবাজির রাজনীতিকে উড়িয়ে দেবে মানুষ। আর তাই যাতে সেই বিকল্প কখনো না আসে, গ্রামের পর গ্রামে তারা নামিয়ে আনছে হাড়হিম করা সন্ত্রাস। সেই সন্ত্রাসের নিরপেক্ষ তদন্ত সবসময়েই সাধুবাদ যোগ্য, কারণ বাংলায় বহুবছর ধরে হয়ে চলা রাজনৈতিক হিংসার সংস্কৃতিকে আটকাতে গেলে শুধু শুভবুদ্ধি দিয়ে হবে না, দরকার আইনের কড়া হাতুড়ি। এর আগেও বাম আমলে খানাকুল বা গড়বেতায় রাজনৈতিক সঙ্ঘর্ষ, হত্যা, বিরোধী পার্টি করার অপরাধে শাস্তি প্রদান এই ব্যাপারগুলো ঘটেছে। কিন্তু তৃণমূল এসে এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে, যেন এগুলোই রীতি। জঙ্গলমহলে একের পর এক বাম কর্মী ও সমর্থককে খুন করে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের মাধ্যমে এই সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছিল, সেই সন্ত্রাসকে তখন একশ্রেণির বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজ দুই হাত তুলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, কারণ সেখানে নাকি বিপ্লব চলছিল! আজ তাঁদেরই পোষা দানব বড় হয়ে উঠে তাঁদের গিলে ফেলতে চাইছে, আর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে বাংলার হিংসার সংস্কৃতি দেখে হাহাকার করছে নাগরিক সমাজ। ব্যাপারটা আয়রনিক হলেও, শুধুমাত্র আমাদের শ্লেষে এ সমস্যার সমাধান হবে না। আর তাই হাইকোর্টের এই রায় জরুরি। তৃণমূল একে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, আপিল করতে পারে উচ্চতর আদালতে, কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় তাদের সচেষ্টতার উপর যে সন্দেহের বাতাবরণ এই রায় ফেলে দিল, সেটা থেকেই যাবে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই রায়ের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার তথা সিবিআই যেভাবে মহীয়ান হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে তা কতটা ন্যায্য। হিংসা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিজেপি যে কারোর থেকে কম যায় না, সেটা কি এই মুহূর্তে হরিয়ানার সরকারের কৃষক আন্দোলনের ওপর নামিয়ে আনা সন্ত্রাস থেকেই স্পষ্ট নয়? সম্প্রতি হরিয়ানার কারনালে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর লাঠিচার্জ করার আগে মহকুমা শাসকের একটি ভিডিয়ো ঘিরে তোলপাড় রাজ্য থেকে জাতীয় রাজনীতি। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, এক দল পুলিশকর্মী দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং তাঁদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন কারনালের মহকুমা শাসক আয়ুষ সিনহা। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করলেই যেন মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। আরও বলেছেন যে, কোনও নির্দেশের অপেক্ষা করার দরকার নেই, এমন পরিস্থিতি এলে পুলিশ যেন হাতে লাঠি তুলে সজোরে আঘাত করে। যদি কোনও আন্দোলনকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়েও আসেন, তাঁর রক্তাক্ত মাথা দেখতে চান মহকুমা শাসক। মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর এবং রাজ্য বিজেপি-র প্রধান ওমপ্রকাশ ধনখড়-সহ দলের শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠক ছিল কারনালে। কৃষকরা রাজ্যের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। এরপর মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকস্থলের উদ্দেশে রওনা হতেই কৃষকদের আটকে দেয় পুলিশ। দু’পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয় এবং পরিস্থিতি ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এই ঘটনায় ১০ জন কৃষক আহত হয়েছেন। আক্রমণ নেমেছে উত্তরপ্রদেশেও। যোগী আদিত্যনাথ সরাসরি হুমকি দিয়েছেন কৃষকদের। এই সমস্ত ঘটনাই দেখিয়ে দিচ্ছে, বিজেপি তার প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে একচুলও নড়বে না। সেক্ষেত্রে তার পোষা সিবিআইকে পশ্চিমবঙ্গের ময়দানে তৃণমূলের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে বিজেপি যে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?

দুটি দলই, বিজেপি ও তৃণমূল, রাজনৈতিক প্রতিশোধের খেলায় মেতে বাংলার রাজনীতিকে অস্থির করে তুলছে। বিজেপি প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে, যেখানে প্রত্যক্ষ ক্ষমতায় আছে সেখানে হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে আনছে পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে। আর যেখানে নেই সেখানে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে লেলিয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে তৃণমূল তাদের পেশিশক্তি দিয়ে আক্রমণ নামাচ্ছে বিরোধীদের ওপর। দুই ক্ষেত্রেই হিংসার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই দুটি দলকেই প্রত্যাখ্যান করে যদি তৃতীয় বিকল্প সামনে না আসে, তাহলে বাংলার হিংসার সংস্কৃতি আপাতত থামবে না, বলাই বাহুল্য।