আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

শিক্ষকদের মর্যাদা দিক রাজ্য সরকার


পশ্চিমবঙ্গবাসী নিজেদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন কম করেনি। রাজধানী কলকাতার অপর নাম মিছিল নগরী। কিন্তু গত ২৪ আগস্ট কলকাতার রাজপথ সাক্ষী রইল এক হৃদয় বিদারক ঘটনার। পশ্চিমবঙ্গের পাঁচজন শিক্ষিকা বিকাশ ভবনের বাইরে আন্দোলনরত অবস্থায় বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন।

কারা এই শিক্ষক? এঁরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও মধ্য শিক্ষা কেন্দ্রে কর্মরত চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক। বর্তমানে রাজ্যে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র (এসএসকে)-র সংখ্যা ১৬,০০০, যেখানে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এবং মধ্য শিক্ষা কেন্দ্র (এমএসকে)-র সংখ্যা ১,৯৬০টি যেখানে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ দান করা হয়। এই দুই কেন্দ্র মিলিয়ে প্রায় ৪৮-৫০ হাজার শিক্ষক কর্মরত। গত বছর পর্যন্ত এদের বেতন ছিল ৫,৬০০-৮,০০০ টাকা। রাস্তায় নেমে দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের ফলেই শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে কর্মরত শিক্ষকদের বেতন বেড়ে হয় ১০,৩৪০ টাকা এবং মধ্য শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠদানরত সম্প্রসারক সম্প্রসারিকাদের বেতন দাঁড়ায় ১৩,৩৯০ টাকা। একই কাজ করা স্থায়ী শিক্ষকদের বেতনের তুলনায় যা অনেকটাই কম।

মূলত চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক থেকে স্থায়ী শিক্ষক হওয়ার দাবিতে এবং স্থায়ী শিক্ষকদের মতোই পেশাগত সুযোগ সুবিধা ও অবসরকালীন প্রাপ্যর দাবি নিয়ে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়া ‘শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ’ গড়ে লড়াই আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। মঞ্চের বক্তব্য অনুযায়ী দাবীগুলি নিয়ে আলাপ আলোচনা করবার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তারা বারবার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন কিন্তু মন্ত্রীর তরফ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। ইতিমধ্যেই আন্দোলনরত একজন প্রাথমিক শিক্ষক ও ষোল জন চুক্তিভিত্তিক শিক্ষককে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। প্রথমত, তাদের চাকরির শর্তে বদলির কোনো স্থান ছিল না। দ্বিতীয়ত, বর্তমান রাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতিই হল শিক্ষককে তার বাড়ির নিকটবর্তী জায়গায় কাজের সুযোগ করে দেওয়া যাতে শিক্ষাদানের মান উন্নত হতে পারে। এক্ষেত্রে তাও অগ্রাহ্য করা হল। মঞ্চের বক্তব্য অনুযায়ী, আসলে আন্দোলন করার শাস্তিস্বরূপ তারা বদলির নির্দেশ পেলেন। আর সেই বদলির নমুনাগুলি কেমন? মুর্শিদাবাদ-এর বাংলা মাধ্যমের শিক্ষিকাকে পাঠানো হল জলপাইগুড়ি জেলার হিন্দি মাধ্যমের শিক্ষা কেন্দ্রে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নামখানা অঞ্চলের শিক্ষিকাকে কোচবিহারের দিনহাটায় বদলির নির্দেশ দেওয়া হল। স্বভাবতই সরকারী বদলি নীতিকে অস্বীকার করে নিজ বাসস্থানের অন্তত পাঁচশ থেকে আটশ কিলোমিটার দূরে বদলির এই সিদ্ধান্ত অনৈতিক ও অমানবিক। এই অবস্থায় আন্দোলনকারীরা যখন পুনরায় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান তখনও বাধা দেওয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে বচসার সময় বদলির নির্দেশপ্রাপ্ত পাঁচজন শিক্ষিকা বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বর্তমানে তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের তরফ থেকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার চেষ্টা, সরকারী আধিকারিকদের আক্রমণ, সরকারী কাজে বাধাদান সহ বিভিন্ন জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এরাজ্যে শিক্ষকদের আন্দোলন নতুন নয়। পার্শ্বশিক্ষকদের পেশাগত দাবিতে লাগাতার আন্দোলন, প্রাইমারি, আপার প্রাইমারিতে তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন, এমনকি অধ্যাপকদের আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ। কিন্তু আর পাঁচটা আন্দোলনের থেকে এই ঘটনাটি আলাদা। প্রকাশ্য দিবালোকে ভরা রাস্তায় আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম। এর আগে তেলেঙ্গানায় পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের সময় নিজের গায়ে আগুন দেওয়াকে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া কিংবা তামিলনাড়ুতে একের পর এক কৃষক আত্মহত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনরত কৃষকদের জ্যান্ত ইঁদুর খাওয়া বা আত্মহত্যা করা কৃষকদের খুলি-দেহাংশ নিয়ে প্রতিবাদের কথা মনে আসে। কিন্তু নিজেকে আঘাত করে এহেন প্রতিবাদের ধরনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যোগ ছিল না। আরেকটি কথা বিশেষভাবে নজর করবার মতো যে আত্মহত্যার চেষ্টা করা প্রত্যেক শিক্ষকই কিন্তু মহিলা। সামাজিক এবং পারিবারিক সূত্রে মহিলাদের দায়বদ্ধতা পুরুষের থেকে কোনো অংশে কম নয় বরং বেশি। ফলে মহিলারা কোন তীব্র অসহায়তা থেকে এই পথ বেছে নিলেন তা বোঝাও বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। যে সরকার তার বিভিন্ন ঘোষিত প্রকল্প দিয়ে বারবার মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলছে সেই রাজ্যে মহিলা শিক্ষকদের আন্দোলনে নেমে চূড়ান্ত পথ বেছে নেবার কারণ খুঁজতে হবে।

শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে কর্মরত সহায়ক-সহায়িকা বা মধ্য শিক্ষা কেন্দ্রে কর্মরত সম্প্রসারক-সম্প্রসারিকাদের কাজ প্রাথমিক শিক্ষকদের মতোই। বিদ্যালয় চালানোর উপযোগী সমস্ত কাজই তারা দায়িত্ব সহকারে পালন করেন। তাদের কাজের পরিমাণ, কাজে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা সবই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মাইনে বা ভাতা মাসে ১০ থেকে ১৪ হাজারের মধ্যেই। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে ‘সম কাজে সম বেতন’-এর দাবিকে মান্যতা দিয়েছে সেখানে এক্ষেত্রে তা তো মানাই হয়নি উপরন্তু আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে শাস্তিমূলক বদলির খাঁড়া। একে বেতন কাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সীমিত অন্যদিকে নিজ বাসস্থানের থেকে বহু দূরে বদলি - যুগপৎ এই আক্রমণের সামনে দিশেহারা শিক্ষকরা বারবার চেষ্টা করেছেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু তাদের কথা কানে পৌঁছয়নি শাসন কর্তাদের। ফলে বাংলার রাজপথ সাক্ষী থাকল এই মর্মস্পর্শী ঘটনার।

উলটো দিকে কী দেখা গেল? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় জানালেন বাম আমলের থেকে শিশু ও মধ্য শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকদের ভাতা কতটা বেড়েছে এবং চাকরির ক্ষেত্রে কী কী সুযোগ সুবিধা পাবার আধিকার তারা লাভ করেছেন তার ফর্দ। যা জানা গেল না তা হল স্থায়ীকরণ, সম কাজে সম বেতন, অনৈতিক শাস্তিমূলক বদলির মত বিষয়গুলিতে তাঁর সরকারের মতামত। সবশেষে তিনি জানালেন এত কিছু পাওয়ার পরেও যারা আন্দোলন করছেন তারা শিক্ষক নন বিজেপির ক্যাডার!

বাম আমল অতিক্রান্ত হয়েছে এক দশক আগে। তারপর প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্বতন সরকারের সঙ্গে তুলনা টানা একটি অত্যন্ত ক্লিশে হয়ে যাওয়া পদ্ধতি। মানুষ নতুন কিছু প্রত্যাশা করেছে বলেই গণতান্ত্রিক ভাবে সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম কাজই হল বিরোধী স্বর তা সে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা। গণতন্ত্রে বিরোধী স্বর থাকবেই এবং তাকেও সমান গুরুত্ব দিয়েই বিচার করতে হবে। এখানে সেই যৌক্তিক পরিসরটিরই বিপুল অভাব দেখা গেল। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল সরকারের যে কোনো বিরোধী স্বরকে রাজনৈতিক রঙ লাগানোর কুৎসিত ঝোঁক অব্যাহত। নাগরিকের নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার ন্যায্য দাবি - সে রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে হোক বা না হোক তা বিচার্য হবে তার দাবির নিরিখেই। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে নস্যাৎ করার এই প্রবণতা আখেরে গণতন্ত্রের সার্বিক পরিকাঠামোয় আঘাত এবং অবক্ষয়কেই স্পষ্ট করে। সংখ্যা গরিষ্ঠতার দম্ভে রাজ্যের শাসক দল গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বারবার পদদলিত করার যে ক্ষতিকর নিদর্শন এক দশক ধরে বজায় রেখেছে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের আত্মহত্যার চেষ্টার পরেও তাঁদের আন্দোলনকে দলীয় রাজনীতির সীমানায় টেনে এনে সেই পথেই আরেকটি কুৎসিত মাইল ফলক পুঁতলেন।

বর্তমান সরকারের স্থায়ী চাকরির পরিমাণ সর্বত্র কমিয়ে কম পারিশ্রমিকে চুক্তিভিত্তিক কাজে নিয়োগ করার মধ্যে দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার দিকটিকে অবহেলা করার মানসিকতা ক্রমবর্ধমান। স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক চাকরি সবসময়ই শাসকের কাছে অধিক পছন্দের কারণ সেখানে চাকরি চলে যাবার আশঙ্কা থেকে চাকরিজীবীকে সরকারের অনুগত থাকতে হয়। ফলে ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই সীমিত হতে থাকে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাজ্যে তা কখনোই কাম্য নয়। তাই সরকারকে স্থায়ী চাকরি না দিয়ে স্বল্প খরচে বেশি কাজ করিয়ে নেবার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতেই হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে এসএসকে ও এমএসকে শিক্ষকদের বিষয়টি মানবিকভাবে বিচার করতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের বারবার কেন আদালতের পথই বেছে নিতে হবে, কেন সরকার সরাসরি নিজের দায়িত্ব পালনে যত্নবান হবে না সে প্রশ্ন উঠছেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর উচিত অসুস্থ শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুস্থতা কামনা করা এবং চাকরি ক্ষেত্রের সমস্যাগুলি শুনে তা দূরীকরণে মানবিকভাবে আগ্রহী হওয়া। অন্যথায় রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিসরটি ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকবে যা রাজ্যের ভবিষ্যতের পক্ষেও অত্যন্ত উদ্বেগজনক।