আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮
সমসাময়িক
হাট বসেছে নর্থ ব্লকে
২৬,৭০০ কিলোমিটার রাস্তা
২৮,৬৯৮ কিলোমিটার বিদ্যুৎবাহী তার ও যন্ত্রপাতি
৬,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
৮,১৫৪ কিলোমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন
৩,৯৩০ কিলোমিটার পেট্রোজাত পণ্যের পাইপলাইন
২১,০০০,০০০ মেট্রিক টন ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম
৪০০টি রেল স্টেশন
৯০টি যাত্রীবাহী ট্রেন
২৬৫টি রেলের গুদামঘর
কোঙ্কান রেলওয়ে এবং ফ্রেট করিডর
২,৮৬,০০০ কিলোমিটার ইন্টারনেট ফাইবার এবং ১৪,৯১৭টি টেলিকম টাওয়ার
২৫টি বিমানবন্দর
৯টি বৃহৎ বন্দরের ৩১টি প্রজেক্ট
২টি জাতীয় স্টেডিয়াম
মুদিখানার ফর্দের মতই এটি সরকারী সম্পত্তির একটি ফর্দ, যা দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছেন, আগামী পাঁচ বছরে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে সম্পত্তির মালিকানা সরকারের হাতেই থাকবে। বেসরকারী ক্ষেত্রকে এই সম্পদ নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ইজারা দেওয়া হবে। যার বিনিময়ে সরকারকে কোম্পানিগুলি এককালীন টাকা দেবে। এই বিপুল সম্পত্তি ভাড়া খাটিয়ে সরকার আগামী পাঁচ বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করবে বলে দাবি করছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এই সম্পদের মূল্য এই টাকার তুলনায় বহুগুণ বেশি।
এই প্রক্রিয়ার তিনটি দিক রয়েছে যা নিয়ে আলোচনা জরুরি। প্রথমত, কোভিড জনিত লকডাউনের ফলে অর্থব্যবস্থার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। সরকারী রাজস্ব আদায়ও কমেছে। সরকার সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার কোনো প্রকল্প ঘোষণা করেনি। অথচ, দেশের কর্পোরেট ক্ষেত্র এই সময়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা কামিয়েছে, যা আগের দশ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। দেশে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তির মালিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে কোভিড-কালে। অথচ, কর্পোরেট ক্ষেত্র থেকে আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ জিডিপি-র অনুপাতে কমেছে, কারণ সরকার কর্পোরেটদের বিপুল কর ছাড় দিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে, যদি সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্রের উপর স্বল্প পরিমাণের কর বৃদ্ধি করে তবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু তা করলে সরকার তথা বিজেপি-র মিত্র যারা দলের তহবিলে কোটি কোটি টাকার জোগান দেয়, তাদের অসুবিধা হবে। অতএব, ধনী ও কর্পোরেটদের হাতে সরকারী সম্পত্তি তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ, এলআইসি-র বেসরকারীকরণ, বিপিসিএল-এর মতন লাভজনক সংস্থার বেসরকারীকরণ, এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারীকরণের সঙ্গে এবার প্রায় গোটা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকেই বেসরকারী পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার।
দ্বিতীয় যেই বিষয়টি নিয়ে সরকার পক্ষের তরফে আপাতত কোনো ঘোষণা কর হয়নি তা হল এই বিপুল সরকারী সম্পত্তি কোন দামে বেসরকারী ক্ষেত্রকে ইজারা দেওয়া হবে। অন্যদিক দিয়ে দেখলে কর্পোরেট ক্ষেত্র এই সম্পত্তি কত দাম দিয়ে ইজারা নেবে? এই দাম নির্ভর করবে আগামীদিনে এই সম্পত্তি থেকে তারা কতটা মুনাফা তুলতে পারবে তার উপরে। যদি দাম খুব বেশি ধার্য করা হয়, তবে বেসরকারী ক্ষেত্র এই সম্পত্তি ইজারা নেবে না, কারণ আগামীদিনে তাদের আয়ের তুলনায় তা বেশি হয়ে যেতে পারে। যেই দামেই তারা কিনুক না কেন, অর্থনীতির নিয়ম মেনে তারা সেই দামই ধার্য করবে, যা তাদের আগামীদিনের মুনাফা নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, এই সম্পত্তি বিক্রি ঘোষণা করার মাধ্যমেই সরকার আসলে বলছে যে এদের ব্যবহার করে আগামীদিনে মুনাফা করা সম্ভব। তা করতে হলে হয়ত কিছু পরিবর্তন করতে হবে এদের পরিচালনা করতে। কিন্তু মুনাফা অর্জন সম্ভব। এটি দুইভাবে হতে পারে। প্রথমত, সম্পত্তিগুলি ইজারা দেওয়ার দাম যদি কমিয়ে রাখা হয়, তবে বেসরকারী ক্ষেত্রের সুবিধা হবে। আবার সম্পত্তিগুলি যদি নিলামের মাধ্যমে সর্বাধিক দাম যে দেবে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলেও বোঝা যাবে এই সম্পত্তি থেকে মুনাফা সম্ভব হবে। তাই যদি হয়, তবে সরকারী ক্ষেত্রে থাকলেও এদের সুচারুভাবে ব্যবহার করে সরকারী আয় বাড়ানো সম্ভব। সরকার তা না করে এই বিপুল পরিমাণ সরকারী সম্পত্তি আগামীদিনে বেসরকারী মুনাফা বাড়ানোর জন্য তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। দেশের জনগণের সম্পত্তি ব্যবহার করে কর্পোরেট ক্ষেত্রে মুনাফা কামাবে আর সরকার তার কৃতিত্ব নেবে। মোদী জমানায় এই নীতিই আপাতত চলছে।
বলার জন্য বলা হচ্ছে যে সরকারী সম্পত্তি বিক্রি করা হচ্ছে না। ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ইজারা নেওয়ার পরে এই সম্পত্তি সরকার ফেরত নেবে না। আবারও বাজারে তা ইজারা দেওয়ার জন্য খোলা হবে। যদি সরকার ঘোষণা করে যে তারা ফেরত নিয়ে নেবে তবে সম্পত্তিগুলিকে নিঙড়ে যতটা পারা যায় মুনাফা তোলার চেষ্টা করবে বেসরকারী ক্ষেত্র। অতএব আগামীদিনে এই সম্পত্তির মান পড়বে। আর সরকার যদি বলে যে বেশ কিছু বছর পরে এগুলি অন্যের হাতে ইজারা দেওয়া হবে, তাহলেও বর্তমান ইজারাদার সম্পত্তিগুলির থেকে সর্বাধিক মুনাফা কামানোর চেষ্টায় তার মূল্য নিঙড়ে নেবে। তাই মুখে বিক্রি করা হচ্ছে না বলা হলেও, আসলে সম্পত্তিগুলি সরকারী খাতায় আর ফিরবে না। বেসরকারী ক্ষেত্র এই সম্পত্তিগুলিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে তার মান কমিয়ে দিতে পারে। ধরা যাক, আপনি একটি মোবাইল টাওয়ার ভাড়া নিয়েছেন। আপনি জানেন যে ১০ বছর পরে আপনার হাত থেকে এটি নিয়ে নেওয়া হতে পারে। তাই আপনি দিনের ২৪ ঘন্টা, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই এটিকে ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করতে চাইবেন। ১০ বছর পরে হয়ত দেখা যাবে যে মোবাইল টাওয়ারটির মূল্যের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ইতিমধ্যে আপনি অবশ্য প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ফেলেছেন। অতএব এই সম্পত্তিগুলিকে সরকার ব্যবহার না করে বেসরকারী হাতে তুলে দিলে সম্পত্তির লাভ সরকার পাবে না, তা শুধুমাত্র বেসরকারী মুনাফা বাড়াবে। অন্যদিকে, এদের ইজারা দেওয়ার মূল্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকটাই কম হবে। তাই সরকারের তাৎক্ষণিক লাভের আশাও পূর্ণ না হতে পারে।
তৃতীয় যেই বিষয়টি ভাবা দরকার তা হল এই সম্পত্তিগুলি কিনবে কারা? আরেকবার উপরের ফর্দটিতে চোখ বোলান। প্রচুর টাকার ইন্টারনেট ফাইবার এবং মোবাইল টাওয়ার বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বর্তমানে গোটা মোবাইল পরিষেবা শিল্প সংকটাপন্ন। একটি মাত্র কোম্পানি বাজার দখল করেছে। কোম্পানির নাম - জিও, মালিক মুকেশ আম্বানি, মোদীজির বন্ধু। গ্যাস পাইপলাইন, পেট্রোপণ্যের পাইপলাইন ইজারা দেওয়া হবে। ভারতে গ্যাস শিল্পে পাইপলাইন ব্যবহার করে প্রকৃত পক্ষে দুটি কোম্পানি - রিলায়েন্স ও আদানি - মালিকদ্বয় মোদীজির বন্ধু। পেট্রোলিয়ামের ক্ষেত্রেও বেসরকারী ক্ষেত্রের বৃহৎ শিল্প রয়েছে রিলায়েন্সের কাছেই। ২৫টি বিমানবন্দর বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে। কোন কোম্পানিগুলি বেসরকারী বিমানবন্দরের বরাত পেয়েছে নিকট অতীতে? উত্তরঃ আদানী। ৯টি বন্দরের ৩১টি প্রজেক্ট বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হবে। কোন কোম্পানি ভারতে বেসরকারী পোর্টের সর্ববৃহৎ কোম্পানি? আদানি। লজিস্টিক শিল্প, অর্থাৎ গুদাম ও মজুত করার কাজে ভারতের যেই বৃহৎ কোম্পানি যুক্ত তার নামও আদানি। অর্থাৎ, এই সরকারী সম্পত্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দেশের ১-২টি বৃহৎ পুঁজিপতির হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে একচেটিয়া পুঁজিবাদকে আরো মজবুত করবে এই ধরনের নীতি।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলি যথার্থভাবেই এই নীতির বিরোধিতা করছে। কিন্তু সেই বিরোধিতা রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না। নব-উদারবাদী অর্থনীতির ফলে মানুষের মনে এই কথা প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে যে ‘বেসরকারী হলে পরিষেবা ভালো হয়’। কিন্তু দেশের সম্পত্তি কতিপয় কিছু ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়া হলে দেশের অর্থব্যবস্থা এবং জনগণের ক্ষতি হবে। দেশের মানুষের অর্থ, নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায় তৈরি সম্পত্তি সরকার বেসরকারী হাতে তুলে দিচ্ছে, এই বেসরকারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।