আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' ও উন্নয়ন


পশ্চিমবঙ্গে আবার দুয়ারে সরকার হাজির। সরকারী ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ২৮ আগস্ট অবধি রাজ্যের বিভিন্ন ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরে হাজির হয়েছেন ১ কোটি ৭৯ লক্ষ ৪৪ হাজার ৬৬৯ জন। রাজ্যের বর্তমান জনসংখ্যা যদি ১০ কোটি ধরে নেওয়া হয়, তবে ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ এই পরিষেবা গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে প্রকল্পটি জনপ্রিয় হয়েছে।

এই জনপ্রিয়তার একটি প্রধান কারণ ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারী চাকুরিরত অথবা পেনশন প্রাপক বাদ দিয়ে রাজ্যের প্রত্যেক মহিলাকে মাসে ৫০০ টাকা এবং তফশিলী জাতি ও উপজাতির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা করে নগদ দেওয়া হবে। এই প্রকল্পের সুবিধা নিতে বিভিন্ন শিবিরে প্রবল ভিড় হচ্ছে যার থেকে অনেকেই মনে করছেন যে করোনার প্রকোপ বাড়তে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই ধরনের প্রকল্পের নেপথ্যে কি অর্থনীতির যুক্তি যথেষ্ট রয়েছে?

বেশ কিছু বছর ধরে এই কথা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে বিশ্বায়নের যদি কোনো লাভ থেকে থাকে তবে তা কুক্ষিগত করেছে সমাজের ধনী শ্রেণি। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা গরীব মানুষের কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ও সরকারী নীতির জন্য কর্মসংস্থানের হাল বেশ খারাপ। প্রকৃত মজুরি নিম্নগামী এবং আর্থিক বৈষম্য ঊর্ধ্বগামী। এই পরিস্থিতিকে আরো বেশি সংকটাপন্ন করে তুলেছে করোনা অতিমারি এবং লকডাউন। লকডাউনের ফলে গরীব মানুষ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, বেসরকারী শ্রমিক এবং সমাজের বৃহৎ অংশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে সর্বনাশ নেমে এসেছে। এই প্রেক্ষিতে প্রায় সমস্ত অর্থনীতিবিদ ভারতের সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন গরীব মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। বাম-সহ বিরোধী দলের দাবিসমূহেও এই কথার উল্লেখ রয়েছে।

অতএব, আপাতভাবে 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' প্রকল্পের ভাবনায় গলদ নেই। একদিকে যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় (Uniform Basic Income)-এর কথা উঠে এসেছে, ভারতেও যেখানে সমস্ত বিরোধী দল মানুষের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে, সেখানে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের বিরোধিতা করা বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিরপক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে যেখানে মহিলাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই প্রকল্পের মৌলিক ভাবনার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রথমত, যেই বিপুল সংখ্যায় মহিলারা সরকারী শিবিরে উপস্থিত হয়ে এই প্রকল্পের আওতায় আসার চেষ্টা করছেন তার থেকেই পরিষ্কার যে সাধারণ মানুষের জীবনে মাসিক ৫০০ টাকা বা ১,০০০ টাকা আজকের দিনে বেশ মূল্যবান। এর প্রধান কারণ হল লকডাউন জনিত আর্থিক ক্ষতি। আমাদের রাজ্যে ২০২০ সালের লকডাউনের হিসেব ছেড়ে দিলেও, ২০২১ সালের মে মাসের ৫ তারিখ থেকে লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধ এখনও চলছে। এর ফলে মানুষের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি করছেন যে প্রত্যেক পরিবারকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা দেওয়া হোক। অথচ নিজের রাজ্যে তিনি মহিলাদের মাসিক ৫০০ ও ১,০০০ টাকা দিয়েই নিজের দায় ঝেড়ে ফেলছেন। এই যৎসামান্য টাকা রাজ্যের মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে তিনি হাততালি কুড়োচ্ছেন, কিন্তু এর বেশি টাকা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি দিচ্ছেন না। সমাজের গরীব অংশের মানুষের হাতে আরো বেশি ক্রয় ক্ষমতা পৌঁছে দিতে হলে এই মন্দাবস্থায় তাদের হাতে আরো বেশি নগদ টাকা তুলে দিতে হবে। বিশেষ করে বিগত ৪ মাস লকডাউনের দরুণ কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে এই কয়েক মাসের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেক পরিবার যারা আয়কর সীমার নীচে, তাদের মাসিক ৭,৫০০ টাকা করে দেওয়া উচিত। এই প্রশ্নে বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যখন বিবৃতি দিচ্ছে তখন নিজেদের রাজ্যেও এই নীতি গ্রহণ করার কথা তাদের ভাবা উচিত।

দ্বিতীয় সমস্যা হল অর্থের জোগান। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন যে 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করার জন্য বাকি সমস্ত দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজের খরচের উপর রাশ টানতে হবে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' প্রকল্পের জন্য খরচ হবে মাসিক ১,১০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৩,০০০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকার সংস্থান করতে হলে অন্য দপ্তরের উন্নয়নমূলক খরচ যদি কাটছাঁট করা হয়, তাহলে তা জনগণের ক্ষতি করবে। সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের ধারণার এটিই সবচেয়ে বড় গলদ। যদি মানুষের হাতে কিছু নগদ টাকা তুলে দেওয়ার বিনিময়ে সরকারী খরচ কমানোর নামে সরকারী পরিষেবা সংকুচিত করা হয় তবে জনগণের, বিশেষ করে গরীব মানুষের আখেরে ক্ষতি হতে পারে। ধরুন আপনি একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন যেখানে বিশেষ শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। এবারে আপনার গ্রামের প্রত্যেক মানুষকে সরকার মাসে ১,০০০ টাকা করে দিল। কিন্তু সেই অজুহাতে গ্রামের স্কুল ও সরকারী হাসপাতালটি বন্ধ করে দিল। খাতায় কলমে সরকারী খরচ কমল না, কারণ গ্রামের মানুষকে টাকা দেওয়া হল। কিন্তু মানুষ আর সরকারী পরিষেবা পাবে না। ওই প্রত্যন্ত গ্রামে আর কোনো স্কুল বা হাসপাতাল নেই। আপনার হাতে ১,০০০ টাকা থাকল কিন্তু তার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মৌলিক পরিষেবা সরকার নিয়ে নিল। এই পরিস্থিতিতে আপনার উন্নয়ন বাড়বে না, বরং তা কমবে।

অবশ্যই রাজ্য সরকার বলেনি যে তারা স্কুল বা হাসপাতাল বন্ধ করে 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের' খরচ বহন করবে। কিন্তু অন্যান্য খাতে যে খরচ কমানো হবে সেই কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। এর ফলে কিছু সরকারী পরিষেবা যে ব্যাহত হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভাষায় বলতে হয় যে সরকারী পরিষেবা বজার রেখে মানুষের হাতে নগদ টাকা দিলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রগতি দেবে। কিন্তু সরকারী পরিষেবা কমিয়ে এই টাকা দেওয়া হলে তা সার্বিকভাবে সমাজকল্যাণ নাও বাড়াতে পারে। অতএব, রাজ্য সরকার যদি সার্বিক সমাজকল্যাণের বৃদ্ধি চান, তবে অন্যান্য খাতে সরকারী খরচ কমানো অনুচিত হবে।

কিন্তু তাহলে এত টাকা আসবে কোথা থেকে? এখানেই রাজনীতির প্রশ্ন আনতে হবে। জিএসটি প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে রাজ্য সরকারগুলির রাজস্ব আদায় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে কারণ তারা নিজেদের রাজ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী করের হার নির্ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয়, 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' বা অন্য কোনো প্রকল্পের জন্য নতুন করের হার চালু করা। এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে অতিমারির ফলে কর সংগ্রহের পতন। তাই সরকারের কোষাগারের উপর চাপ বাড়ছে। এমতাবস্থায় ঋণ করে অথবা অন্যান্য খরচ ছেঁটে খরচ করতে সরকার বাধ্য হচ্ছে। তিনটি বিষয় নিয়ে সরকার অবিলম্বে না ভাবলে আগামীদিনে রাজ্যে অর্থনৈতিক সংকটের সমস্যা বাড়বে।

প্রথমত, পাড়ার ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্তে বদল আসা জরুরি। মোটামুটি হিসেব করলে দেখা যাবে যে এই নীতির ফলে শাসক দলের দামাল ছেলেরা আড্ডা মারার জন্য একটি করে পাকা বাড়ি পেয়েছে, যা আবার বিবাহের কাজে ভাড়াও দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারী খরচে আড্ডা মারা বা ক্যারাম খেলা অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে না। অতএব, দয়া করে ক্লাবগুলিকে টাকা দিয়ে অযথা সরকারী টাকা খরচ করবেন না। ওই টাকা যদি গরীব মহিলারা পায় তাতে বরং তাদের জীবনে কিছু সুরাহা হবে।

দ্বিতীয়ত, সার্বিকভাবে কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের বিষয়টি রাজনৈতিক আঙিনার কেন্দ্রে আবারও নিয়ে আসার সময় এসে গিয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্র আর্থিক-সহ সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে। রাজ্যগুলিকে উন্নয়নমূলক খরচের সিংহভাগ বহন করতে হয়। কিন্তু তাদের রাজস্ব আদায় করার ক্ষমতা সীমিত। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা প্রেরিত নীতিসমূহ রাজ্যের উপর চাপিয়ে চলেছে। এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের আশু কর্তব্য হওয়া উচিত রাজ্য সরকারগুলির ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়াই আন্দোলন শুরু করা। ভারতের বহুত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাঁচানোর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মজবুত করার দাবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তৃতীয়ত, শুধুমাত্র মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দিলেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। আমাদের রাজ্যে বেকারত্বের সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। রাজ্য ছেড়ে দলে দলে মানুষ ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন কাজ ও বর্ধিত মজুরির সন্ধানে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না করতে পারলে মানুষের সমস্যা বাড়তেই থাকবে। অতএব কর্মসংস্থানমুখী আর্থিক নীতিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মুশকিল হচ্ছে যে কর্মসংস্থান বললেই সরকার এবং বিরোধী পক্ষ শুধুমাত্র বড় শিল্প বোঝে। বড় শিল্পের যে কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, তা নয়। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বাজারে বড় শিল্পে খুব বেশি কর্মসংস্থান হওয়ার নয়। প্রয়োজন বাংলার গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্পকে পঞ্চায়েত ও সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত করা। প্রয়োজন রয়েছে বিভিন্ন ছোট-বড় কলকারখানা তৈরি করার। বন্ধ কারখানার জমিকেই ব্যবহার করা উচিত নতুন কারখানা বানানোর জন্য, এতে চাষীদের থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন কমে। এবং সর্বোপরি প্রয়োজন সরকারী ক্ষেত্রে সমস্ত শূন্য পদে কর্মী নিয়োগ করা। কর্মসংস্থানমুখী নীতি গ্রহণ না করে শুধুমাত্র 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' প্রকল্প মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদী জনমুখী উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হবে।