আরেক রকম ● নবম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কেমন আছে কাবুল?


আফগানিস্তানে গত ১৫ই আগস্ট ২০২১ শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে। মাত্র ঘন্টাখানেক আলোচনার পর ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট কুর্শি ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেন। দুই দশক পর আবার তালিবান শাসন ব্যবস্থা আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হল। প্রচারমাধ্যমে নিরন্তর প্রচার করে চললেও বাস্তবে কাবুলের পতন হয়নি। তালিবান কাবুল দখল করেনি। হয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তর।শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় বিবদমান কোনো পক্ষই জয়ী হয়নি। অথবা কারো পরাজয় ঘটেনি। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে বা পরে তেমন কোনো ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের খবর পাওয়া যায়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফল যে সেই দেশের জন্য ভালো হয়নি, তা আজ প্রমাণিত। ২০০১ সালে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল মার্কিন ও ন্যাটো সেনা। বলা হয়েছিল, তালিবান ও উগ্রপন্থাকে উৎখাত করে সেখানে গণতন্ত্রের আমদানি হবে। অথচ কুড়ি বছর সেই দেশ দখল করে রেখে লাখো মানুষের মৃত্যুর পরে, সেই তালিবানের হাতেই, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে, আফগানিস্তানকে তুলে দিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন যে কতটা ক্ষতিকর, মানবতা বিরোধী এবং স্বার্থান্বেষী হতে পারে, তার প্রমাণ আফগানিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকার সময়, আফগানিস্তানে মৃত্যু হয় ১,৭৪,০০০ মানুষের যাদের মধ্যে প্রায় ৫১,০০০ সাধারণ মানুষ, ৬৯,০০০ হাজার সৈন্য ও পুলিশ এবং ৫১,০০০ তালিবান যোদ্ধা। (সূত্রঃ ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, কস্ট অফ ওয়ার প্রজেক্ট)। আপাতদৃষ্টিতে চুক্তির নিক্তিতে হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পশ্চাদপসরণ বাস্তবত পরাজয়েরই সামিল।

আফগানিস্তান সরকারের কোনো প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়াই কাতার-এর রাজধানীর দোহা-য় ২০২০-র ২৯শে ফেব্রুয়ারি তালিবানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
(সূত্রঃ https://www.state.gov/wp-content/uploads/2020/02/Agreement-For-Bringing-Peace-to-Afghanistan-02.29.20.pdf)

এই চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী চোদ্দো মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ ২০২১-এর ৩০শে এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার কথা ছিল। একই চুক্তিপত্রের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা হয়েছে আল-কায়েদা সহ অন্য কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি আফগানিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টাকে তালিবান দমন করবে। অর্থাৎ দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষার শর্ত স্বীকার করে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে দোহা-য় চলতে থাকা আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ন, পাকিস্তান ও রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও আফগানিস্তান সরকার পুরোপুরি উপেক্ষিত ছিল। স্বভাবতই দোহা-র আলোচনার ফলাফল হিসেবে যে চুক্তিপত্র রচিত হয় তাতেও আফগানিস্তান সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না।

দোহা বৈঠকের পরবর্তী আলোচনায় প্রথমে ৩১শে মে এবং পরে ৩১শে আগস্ট, ২০২১ তারিখকে চূড়ান্ত দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেনা অপসারণের ব্যাপারে এই তারিখের উপর প্রথম থেকেই জোর দিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে তিনি সুর বদলানোয় তালিবান গলা উঁচিয়ে ৩১শে আগস্ট তারিখের বিষয়ে জোর দেয়। এবং হুঁশিয়ারি বার্তা পাঠাতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র অধিকর্তা গোপনে কাবুলে এসে তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে যে তারপরই পেন্টাগনের পরামর্শে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ৩১শে আগস্টের সময়রেখা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়রেখা নির্ধারিত হওয়ার পরেই বিশেষতঃ মে মাস থেকে দেশের উত্তর প্রান্তের সীমান্ত এলাকা জুড়ে তালিবান বিভিন্ন প্রদেশের দখল নেওয়া শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া আধুনিকতম আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত আফগানিস্তানের সরকারি সেনাবাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মসমর্পণ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বেতন না পেয়ে আফগান বাহিনীর সৈন্যদের মনোবল এমনিতেই তলানিতে ঠেকেছিল। তার উপরে দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের ওপর তাদের কোনো ভরসা ছিল না। তালিবান ক্রমশঃ পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এমনকি হেরাটের নেতা যিনি এককালে মুজাহাদিন বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন ও পরে হামিদ কারজাই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন এবং যাঁর নিজস্ব সৈন্যবাহিনী আছে বলে শোনা যায়, তিনিও তালিবানের সঙ্গে কোনো বিবাদ-বিতর্ক-সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ে সমঝোতার রাস্তায় হেঁটেছেন। উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশগুলি মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দখল করার পর তালিবান দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের পাকিস্তান সীমান্তের প্রদেশগুলির দিকে নজর দেয়। জুলাই মাসের শেষ দিকে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যে উত্তরের তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান পশ্চিমের ইরান এবং দক্ষিণ ও পূর্বের পাকিস্তান সীমান্তের প্রায় সব ক'টি প্রদেশে তালিবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান থেকে ডাল, আটা ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী আনার জন্য সম্ভবতঃ ১৫ই আগস্ট কাবুলে পৌঁছনোর কয়েক ঘন্টা আগে পর্যন্ত জালালাবাদ এলাকার পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত তোরহাম সীমান্ত তালিবান নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেনি। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে চলতে থাকা দেশ দখলের পরিক্রমায় কোথাও তেমন কোনো বড়ো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সংবাদ পাওয়া যায়নি।

ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশের আগামী দিনের রূপরেখা তালিবান এখনও পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। কিছু কিছু হুকুমনামা জারি করেছে। এছাড়া ১৯শে আগস্ট সরকারি ভাবে দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেনি। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯১৯-এর ১৯শে আগস্ট আফগানিস্তান পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এ বছর স্বাধীনতা দিবসে আফগানিস্তানের মানুষ দুয়ারে তালা দিয়ে ঘরের মধ্যে আতঙ্কে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। নিষ্প্রদীপ নিষ্প্রাণ শহরে এই ঐতিহাসিক দিনেই নিঃশব্দে বদলিয়ে গেল দেশের চরিত্র। ইসলামিক রিপাবলিক অফ্ আফগানিস্তান হয়ে গেল ইসলামিক এমিরেট অফ্ আফগানিস্তান। প্রজাতন্ত্র থেকে শাহীতন্ত্র।

প্রজাতন্ত্র থেকে শাহীতন্ত্র প্রবর্তনের লগ্নে কাবুলের বিভিন্ন চহরাই বা চার রাস্তার মোড়ে লাল-সবুজ-কালো রঙের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ১৯১৯-এর ১৯শে আগস্টের অর্জিত স্বাধীনতার ১০২তম বার্ষিকী উদযাপন করলেন একদল স্বাধীনচেতা মহিলা। অবশ্যই তাঁরা বোরখা পরিধান করেছিলেন। এবং কোনও অঘটন ঘটেনি।

তালিবান শাসনের প্রথম সংস্করণের অভিজ্ঞতা স্মরণ করেই দেশের মানুষ তো বটেই সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তার মানুষ শঙ্কিত। প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তানের মানুষ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনের প্রথম সংস্করণের শাসনের অনেক আগে থেকেই তালিবান এবং সমগোত্রীয় কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদের কীর্তিকলাপের সঙ্গে পরিচিত। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের উপস্থিতি উৎখাত করার জন্য ১৯৮৫ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় সংগঠিত মুজাহিদিন বাহিনী উৎপাত শুরু করে। তখন থেকেই প্রকারান্তরে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

সাধারণ মানুষের উপর মুজাহিদিন বাহিনীর নিয়মিত হুমকির ফলে দেশের মহিলাদের প্রকাশ্যে চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বাধ্যতামূলকভাবে বোরখার প্রবর্তন হয়। বোরখা না পরে প্রকাশ্যে চলাফেরার সময় বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকজনকে হত্যার পর মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই ভীতি সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই আফগান মহিলা বোরখার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এমনকি তালিবান শাসনের প্রথম সংস্করণের অবসানের পরও আফগান মহিলা সেই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেননি। প্রথমতঃ দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা পরিহার করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। দ্বিতীয়তঃ গত দুই দশকে আফগানিস্তান কখনও সন্ত্রাস মুক্ত ছিল না। সেই কারণেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাজধানী কাবুল সহ সমস্ত বড়ো শহরগুলিকে মুড়ে রাখা হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে, প্রান্তিক এলাকায় ভয় দেখাতে বন্দুকের গুলি খরচ করতে হয় না। সাদামাটা হুমকিতেই মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখা যায়। পক্ষান্তরে শহরাঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টির জন্য নিয়মিত বোমা-বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছে। যে কোনো হত্যাকাণ্ড বা বিস্ফোরণের পর ন্যাটো বাহিনীর পরিক্রমায় মানুষ আরও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতায় বেঁচে থাকতে থাকতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা-আশঙ্কা নিয়ে জীবনযাপন রপ্ত করে নেয়। কাজেই ১৫ই আগস্ট ২০২১ থেকে হঠাৎ করে বোরখার প্রবর্তন হয়েছে বলে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যেরকম ভাবে অবিরাম প্রচার চলছে তা মোটেও বাস্তবভিত্তিক নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত তাড়াতাড়ি সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা-ও যথার্থ নয়। প্রথমতঃ তালিবানের সঙ্গে ২০২০-র ২৯শে ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য এ বছরের ৩০শে এপ্রিল প্রত্যাহারের কথা ছিল। কোনো দায়িত্বশীল সরকার সাধারণত আন্তর্জাতিক চুক্তির শর্ত অস্বীকার করে না। বরং করোনা জনিত কারণে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে চুক্তির সময়রেখার পর আরও চার মাস বাড়তি সময় পাওয়া যায়। নির্ধারিত সময়ে হয়তো মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আফগানিস্তানে আর নতুন করে বিনিয়োগের সম্ভাবনা নেই। এমনকি আফগানিস্তানে অবস্থিত সেনা শিবির রক্ষণাবেক্ষণ ও বাহিনীর ভরণপোষণের জন্যও খরচ করে যাওয়া ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পড়ছিল। সর্বোপরি ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে আড়াই হাজারেরও বেশি সৈন্যর মৃত্যু হওয়ার পর নতুন করে আর কোনো সৈন্যের প্রাণের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয় বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা সত্যি সত্যিই চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে পড়ে থাকতে পারে বিশাল অস্ত্র ভান্ডার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে গত দুই দশকে যে সোয়া দুই লক্ষ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে তার অধিকাংশই যুদ্ধের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য সাজসরঞ্জাম কেনার জন্য খরচ হয়েছে। অস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলি এই সুবাদে গত দুই দশক তো বটেই তার অনেক আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। প্রশিক্ষণের পর আফগানিস্তানের সরকারি সেনাবাহিনীর প্রায় তিন লক্ষ সৈন্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এই বিপুল সংখ্যক অস্ত্রের একটা অংশ। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনাবাহিনী যে সব যুদ্ধাস্ত্র, ফৌজি গাড়ি, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার ইত্যাদি ব্যবহার করত তাও ফেলে রেখে আফগানিস্তান পরিত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে যে তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে থেকে গেল বিপুল অস্ত্রসম্ভার।

খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে যে ২০১৩ থেকে ২০১৬-র মধ্যে আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী বা আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সকে ৬ লক্ষেরও বেশি লাইট ওয়েপন বা বন্দুক-রাইফেল জাতীয় হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধে ব্যবহৃত ৮০ হাজারের বেশি অত্যাধুনিক মাইন নিরোধক গাড়িও দেওয়া হয়। এ ছাড়া নাইট ভিশন চশমা, ম্যানপ্যাক পেয়েছিল আফগান সৈন্য। এর পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে ২ বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ হাজার মেশিনগান, যে কোনও রাস্তায় চলতে পারে এমন ৪ হাজার ৭০০টি হামভি গাড়ি এবং ২০ হাজারের বেশি গ্রেনেড সরবরাহ করেছে আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সকে। এছাড়া বড়ো অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দু’হাজার সাঁজোয়া গাড়ি ও প্রায় ৪০টির কাছাকাছি বিমান-হেলিকপ্টার, যার মধ্যে রয়েছে ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার, স্ক্যান ইগলের মতো ছোট ড্রোনও। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সবই এখন তালিবানের হাতে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি নিজের দেওয়া সমরাস্ত্র ধ্বংস করতে বিশেষ কোনও অভিযান চালাবে?

এই বিশাল অস্ত্রসম্ভার আফগানিস্তানে থেকে গেলে তা হবে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এই অঞ্চলের দেশগুলির পক্ষে চিন্তার বিষয়। আফগানিস্তান এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই কোনো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। দেশের মধ্যেকার বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেও এত বিপুল অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার সম্ভব নয়। তাহলে এই অস্ত্রসম্ভার কোথায় যাবে? আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার জন্য এই বিপুল অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার করা অসম্ভব নয়। বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয়। এই বিপুল সমরাস্ত্রের অংশ বিশেষ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ যাওয়ার বেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় উপমহাদেশ সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্থায়ী সমস্যার উপাদান ও উপকরণ রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।

গত দুই দশকে আফগানিস্তানের ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি সম্ভবত সেই কারণে নতুন তালিবান প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করছে না। বরং অনেকেই প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছে। আফগানিস্তানের মাটির গভীরে জমে থাকা মহার্ঘ সম্পদের দিকে সকলের নজর। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তামার আকরিক জমা রয়েছে আফগানিস্তানের মাটির গভীরে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে আফগানিস্তানের ভূগর্ভস্থ তামা উত্তোলন ও নিষ্কাশনের দায়িত্ব পেয়েছে চিন। কাবুলের দক্ষিণে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আইন্যাক-এ খনি থেকে তামার আকরিক উত্তোলন ও নিষ্কাশনের প্রকল্প চিন চালু করে দিয়েছে। উৎপাদিত তামা সরাসরি চিনে চলে যায় অথবা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা হয়।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান এখনও বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটি। প্রায় চার কোটি মানুষের দেশ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই এখনও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। অথচ এই দেশের মাটির নীচে জমা হয়ে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ। বর্তমানে অনুমান করা হচ্ছে তিন লক্ষ কোটি ডলার সমমূল্যের খনিজ সম্পদের ভান্ডার আফগানিস্তানের মাটির তলায় জমা রয়েছে।

সোনা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, নিকেল ছাড়াও লিথিয়াম, তামা আর কোবাল্টের মতো মূল্যবান খনিজের আধার আফগানিস্তান। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩০ মিলিয়ন টন ব্যবহারযোগ্য তামার ভান্ডার মজুত রয়েছে। অনাবিষ্কৃত আরও ২৮ মিলিয়ন টন। যার মূল্য কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। ২ বিলিয়ন টন লোহার আকরিক, ১.৪ মিলিয়ন টন রেয়ার আর্থ, ২ হাজার সাতশো কেজি সোনা মজুত আছে আফগানিস্তানে বলে অনুমান করা হয়।

গজনিতে আছে অতি মূল্যবান খনিজ লিথিয়ামের বিশাল ভান্ডার। ইলেকট্রিক গাড়ি, মুঠোফোন থেকে শুরু করে ব্যাটারিচালিত নানা প্রযুক্তিতেই কাজে লাগে লিথিয়াম ভিত্তিক ব্যাটারি। এজন্য আফগানিস্তানকে 'লিথিয়ামের সৌদি আরব' আখ্যা দেওয়া হয়।

আফগানিস্তানের এমন প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ নেই যাতে অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই দেশে খনি শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে। বিদেশি সংস্থা কাজ করতে চাইলে তালিবান নিজস্ব কট্টর মৌলবাদী মানসিকতা পরিত্যাগ করে খনি শিল্প স্থাপনের অনুমতি দেবে কিনা তা এই মুহূর্তে অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ ব্যবহারের জন্য উন্নত বিদেশি শক্তিগুলি তালিবানের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। বাস্তবে কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

তালিবান প্রতিদিনই নতুন করে তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করে চলেছে। ইতিমধ্যেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং প্রাক্তন উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ আবদুল্লাহকে গৃহবন্দী করেছে। টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে। মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরোনোর বিষয়ে ফতোয়া জারি করেছে। কাজেই তালিবানের বর্তমান সংস্করণের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম যে প্রশস্তি নিরন্তর প্রচার করে চলেছে তা মোটেও বাস্তব নয়। অনেক দেশ এবং সংগঠন প্রচার করে চলছিল যে তালিবানের চরিত্রে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসব অলীক কল্পনা। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদ বাস্তবে মানবতা বিরোধী একটি নিষ্ঠুর মতবাদ।

এই পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কী হবে বলা কঠিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির কর্মীবাহিনী ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান থেকে চলে গেছে। শেষ ব্রিটিশ বিমানে চলে গেছেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং তাঁর স্বদেশী সহকর্মীদের পোষ্য শ’দুয়েক কুকুর, বিড়াল। ব্রিটিশ দূতাবাসের আফগান কর্মীদের সেই বিমানে জায়গা থাকা সত্ত্বেও উঠতে দেওয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার কয়েক সৈন্য এখনও কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ করছে। ইতিমধ্যে ২৬শে অগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত আরও কয়েকশো। মৃতদের মধ্যে তেরো জন মার্কিন সৈন্য। এই হামলার বদলা নিতে ২৮শে আগস্ট মার্কিন ড্রোনের আক্রমণে জনাকয়েক সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে হামলা ও পাল্টা আক্রমণ। অর্থাৎ তালিবান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। আর একবার চুক্তি ভঙ্গ শুরু হলে ক্রমশঃ অভিযোগ এবং পালটা অভিযোগ চলতেই থাকবে। দু'পক্ষের হাতেই রয়েছে প্রভূত অস্ত্র। সেক্ষেত্রে অভিযোগ মুখে নয় অস্ত্র দিয়ে চলতে থাকবে। কাজেই দেশের মধ্যে ফতোয়া জারি করে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার পাশাপাশি মার্কিন সেনার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ তালিবানকে করতে হবে। সঙ্গে রয়েছে পঞ্জশির এলাকার লড়াই। সবমিলিয়ে ক্ষমতাসীন তালিবান এখন এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। জন সমর্থনহীন এক কট্টরপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী কতদিন এই অবস্থা সামলাতে পারবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। এমনকি নতুন করে মার্কিন আক্রমণের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে সবসময় আতঙ্ক-আশঙ্কা মাথায় নিয়ে মানুষের জীবন অতিবাহিত হবে।