আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮
প্রবন্ধ
ভারত, চিন এবং অলিম্পিক
স্বপন ভট্টাচার্য
টোকিও অলিম্পিক ২০২০’এর অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার শেষতম দিনে এল আমাদের জন্য সবচেয়ে খুশির খবর। ১৯০০ সালে প্যারিসে পরাধীন ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে দুটো রূপো এনেছিলেন নর্ম্যান প্রিচার্ড। স্বাধীন ভারতে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে কোন পদকই আসেনি, সোনা তো দূরের কথা। ‘উড়ন্ত শিখ’ উপাধি পাওয়া মিলখা সিং ১৯৬০'এর রোম অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান আর পি টি ঊষা’র ১৯৮৪ লস এঞ্জেলেসে ওই চতুর্থ স্থান - এই ছিল এতাবৎকাল আমাদের অলিম্পিক গৌরবের ‘হইয়াও হইল না’ গল্প। এবারে টোকিও ২০২০ গেমসে নীরজ চোপড়া যে কান্ডটা ঘটালেন তা চোখ রগড়ে দেখেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। জ্যাভেলিনের মত একটা ইভেন্টে, যেখান, এই বছরেই ঠিক অলিম্পিকের আগে, ৯৬.২৯ মিটারের প্রকান্ড থ্রো করে আসা ইয়োহানেস ভেটারের মত প্রতিযোগী আছেন, সেখান থেকে নীরজ সোনা নিয়ে আসবেন এ আমাদের অতিদূর কল্পনাতেও ছিল না। তবে এ নেহাতই আমাদের ‘ঘর পোড়া গরু’ প্রতিবর্ত থেকে বলা, নয়তো নীরজ অনেকদিন ধরেই একটার পর একটা ভালো পারফর্মেন্স করে আসছেন। বিশ্ব অ্যাথলেটিকস জগতে তাঁর নাম সমীহের সঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই এবং অলিম্পিকে ৮৭.৫৮ মিটারের থ্রো’টি করবার আগেই জ্যাভেলিনে তাঁর বিশ্ব র্যাংকিং ছিল চতুর্থ। ২০১৬’তে নীরজ বিশ্ব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন, ওই বছরেই এশিয়ান জুনিয়র এবং সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনা জেতেন, ২০১৮’তে এশিয়ান গেমস ও কমনওয়েলথ গেমস চ্যাম্পিয়ন হন নীরজ। সুতরাং নীরজকে নিয়ে ভরসা করার মত জায়গা আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের হল আশা জাগিয়েও আশা অপূর্ণ রেখে দেবার ট্র্যাডিশন। তীরন্দাজিতে দীপিকা কুমারী বিশ্ব মঞ্চে সমীহ করা নাম, কিন্তু এই নিয়ে তৃতীয় বার অলিম্পিকের মঞ্চে ব্যর্থ হলেন। ভিনেশ ফোগত কুস্তিতে তাঁর ওজন বিভাগে এক নম্বর ছিলেন, কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল লড়াইটার সময়েই ব্যর্থ হলেন। এবারে নীরজ সেই ট্র্যাডিশনে একটা অভাবনীয় এবং মধুর ঝাঁকি দিয়েছেন।
নীরজ চোপড়া
_______________________________________________________
আমাদের মহিলা ও পুরুষ হকি দলের ফলও চমকে দেবার মতই। দুটো হকি দল বাদ দিলে বরাবরই ভারতের অলিম্পিক ডেলিগেশনে প্রতিযোগীর সংখ্যা নগণ্য, কর্মকর্তা তার চেয়ে বেশি বই কম থাকে না। সেই দুটো টিম ইভেন্ট থেকে আমাদের সত্যি কথা বলতে কি তেমন কোনও প্রত্যাশাই থাকে না, প্রাপ্তির কথা আমরা প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল হল, ভুলে গেছি। অথচ ভারতের সাকুল্যে দশটার মধ্যে আটটা স্বর্ণপদক ফিল্ড হকি থেকেই। এই টোকিওতেই ১৯৬৪ অলিম্পিকে পাকিস্তানকে হারিয়ে সোনা জেতার পর থেকে যখন ইয়োরোপীয় দেশগুলো হকি খেলতে শুরু করল এবং যখন থেকে ঘাসের মাঠের জায়গা নিল অ্যাস্ট্রো টার্ফ, সেই তখন থেকেই আমরা পিছিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তবুও ১৯৭২-এ পুরুষদের প্রথম হকি বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল তারা। ১৯৮০’তে মস্কোর ভাঙা অলিম্পিকের সোনাও পেয়েছিল ভারত, কিন্তু বিশ্ব স্তরে তখনই তাদের জায়গা হল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন বা স্পেনের পিছনে চলে গেছে। সে হিসেবে টোকিও ২০২০'এর ব্রোঞ্জ পদক, তাও আবার জার্মানিকে হারিয়ে, এক মধুর প্রত্যাবর্তন বটে। মেয়েদের হকি দল, যার অধিকাংশ সদস্যই দলিত, আদিবাসী তথা ‘পিছড়ে বর্গ’ জনজাতি ঘরের মেয়ে, তারা পদক না জিতলেও চোখ রগড়ে দেখার মত ঝকঝকে পারফর্মেন্স দিয়েছে। দুটো রূপো এসেছে যথাক্রমে নর্থ ইস্টের মীরাবাই চানু এবং হরিয়ানভি কুস্তিগীর বজরং পুনিয়ার হাত ধরে। পি ভি সিন্ধু ব্যাডমিন্টনে ব্রোঞ্জ পেয়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার পোডিয়াম ফিনিশ করলেন - সেটাকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগই নেই। আসামের মেয়ে লাভলিনা বরগোঁহাই এবং কুস্তিতেই রবি দাহিয়া এনেছেন আরো দুটো ব্রোঞ্জ। গলফ এ বছরেই প্রথম সংযোজিত হয়েছিল প্রতিযোগিতার লিস্টে এবং টিনএজার গলফার অদিতি অশোক যাঁর বিশ্ব র্যাঙ্কিং দুশোরও নীচে, তিনিও যে চতুর্থ হয়ে শেষ করবেন এ ভাবাই যায়নি। সব মিলিয়ে নীরজের সোনা নিয়ে এবারের সাতটি পদক আমাদের একশো বিশ বছরের অলিম্পিক অংশগ্রহণের ইতিহাসে সেরা পদকতালিকা এবং সেখানেই ভারতবর্ষ নামক দেশটিকে নিয়ে বিশ্ব ক্রীড়া জগতের এবং ক্রীড়াপ্রেমীদের অপরিসীম বিস্ময়। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেখলে এই বিস্ময়বোধ অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভারত এবং চীন জনসংখ্যার নিরিখে পৃথিবীর যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী দেশ। সারা দুনিয়ার মনূষ্যকুলের ৩৭ শতাংশই এই দুটি এশীয় দেশে বাস করে। টোকিওতে চীন যেখানে ৩৮টি সোনাসহ মোট ৮৮টি পদক নিয়ে পদক তালিকায় দ্বিতীয় সেখানে প্রায় তুল্যমূল্য জনসংখ্যার দেশ ভারতকে দূরবীন দিয়ে দেখতে হচ্ছে বাহামাস, কসোভো, ভেনেজুয়েলার নীচে, চৈনিক হংকং-এর ঠিক ওপরে ৪৮তম স্থানে।
অলিম্পিকে চিন
অলিম্পিকে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না (PRC)’র অংশগ্রহণের ইতিহাস আসলে একটি ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে চিনা প্রতিনিধিদল অংশ নিয়ে আসছে সেই ১৯২৪-এর প্যারিস গেমস থেকেই এবং তখন তাদের পরিচয় ছিল রিপাবলিক অফ চায়না (ROC)’র প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯৪৯’তে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না’র পত্তন ঘটলে এবং রিপাবলিক অফ চায়নার চায়নার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ক্ষমতা চিনা তাইপেই’তে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে মেইনল্যান্ড চায়না’র স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবেই প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। ১৯৫২ সালের হেলসিংকি গেমসে মূল ভূখন্ড এবং চিনা-তাইপেই উভয়েরই অংশ নেবার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় অলিম্পিক কমিটি এবং মাত্র একজনের দল পাঠিয়ে চিনের ক্যমুনিস্ট নেতারা তা বাম হাতে ফুল ছোঁড়ার মত করে মেনে নিলেও ১৯৮০'এর শীতকালীন অলিম্পিকের আগে PRC আর কখনও অংশ নেয়নি। ফলে ১৯৫২ থেকে ১৯৮০'এর শীতকালীন অলিম্পিক পর্যন্ত সময়কাল চিনের নামে যে প্রতিনিধিত্ব ছিল অলিম্পিকে তা বস্তুতঃ তাইওয়ানের প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭৯ সালে অলিম্পিক কমিটি প্রথমবার চিন নামে 'পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না'র এবং 'চিনা তাইপেই' নামে রিপাবলিক অফ চায়নার প্রতিনিধিত্বের অধিকার স্বীকার করে নেয়, যদিও ১৯৮০'এর মস্কো অলিম্পিক আমেরিকা ও ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মত তারাও বয়কট করে। ফলে ১৯৮৪'র লস এঞ্জেলেস অলিম্পিক থেকেই আজকের স্পোর্টস সুপারপাওয়ার চিনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবির্ভাব বলা যায়। ১৯৮৪’তে তারা ২১৬ জনের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ১৫টি সোনাসহ ৩২টি পদক জিতে নেয় এবং চতুর্থ স্থানে থাকে। ১৯৮৮ সিওল গেমসে ২৭৩ জনের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে তারা মাত্র পাঁচটি সোনা জিততে পেরেছিল এবং নেমে গিয়েছিল একাদশতম স্থানে। কিন্তু ১৯৯২ সালের বার্সিলোনা গেমসে তারা আবার চতুর্থ স্থান ফিরে পায় এবং তার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। ২০০৮'এর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আয়োজক ছিল তারাই এবং ৪৮টি সোনা সহ সব মিলিয়ে একশোটা পদক নিয়ে সেই একবারই তারা শীর্ষে ছিল মেডেল তালিকায়। টোকিওতে তাদের স্থান দ্বিতীয়। লক্ষ করবার মত বিষয় হল চিনের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক থেকে এতাবৎকাল প্রাপ্ত ৬৩৪টি পদকের মধ্যে ২৬২টি, অর্থাৎ ৪১ শতাংশেরও বেশি হল সোনা। কিছু কিছু খেলায় তাদের একাধিপত্য প্রায় প্রতিষ্ঠিতই বলা যায়।
১৯৮৪ থেকে আজকের ২০২০ অলিম্পিক পর্যন্ত তাদের পদকের সংখ্যা চোখ ধাঁধানো হয়েছে মুখ্যত ডাইভিং, জিমন্যাস্টিকস, ভারোত্তোলন, শুটিং, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস এবং সাঁতারের দৌলতে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্য খেলাগুলো থেকে তারা খালি হাতে ফিরেছে। সাইক্লিং, রোয়িং, ফেন্সিং, ক্যানোইং, ভলিবল, বক্সিং, কুস্তি, টেনিস - যেগুলো তাদের ট্র্যাডিশনাল ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, সে সব বিভাগ থেকেও চিন সোনা এনেছে এই সময়কালে। মেয়েদের হকিতে তাদের একটা রৌপ্যপদকও আছে যদিও আমরা হয়ত জানিই না চিনের মেয়েরা হকিও খেলছে। এই যে ময়দানের বাইপোলার লড়াইয়ে ঢুকে পড়ে চিন আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্যকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে তার কারণ চিন হল বিশ্বের সব থেকে আগ্রাসী স্পোর্টিং নেশন। ২০০৮'এর বেজিং’এ অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিল তারা ২০০১ সালে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা হাতে নেয় তাদের আজকের বিখ্যাত ক্রীড়া প্রকল্প - প্রজেক্ট-১১৯, মতান্তরে যা প্রজেক্ট-১১৮ বলেও পরিচিত। ২০০১'এ দায়িত্ব পাবার পর চিন পাখির চোখ করে বিভিন্ন খেলার ১১৯টি স্বর্নপদককে। উদাহরণ হিসেবে রোয়িং-এর কথাই বলি। প্রথাগতভাবে রোয়িং-এর পদকগুলি ইউরোপ আমেরিকার বাঁধা থাকত বরাবর। চিন রোয়িং’কে প্রজেক্ট ১১৯-এর আওতায় আনার পর যা করল তা প্রায় অকল্পনীয়। সাংহাই’এর অদূরে ‘থাউস্যান্ড আইল্যান্ড লেক’ অঞ্চলে তারা গড়ে তুলল অত্যাধুনিক রোয়িং প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বিদেশী কোচ আনালো নানা দেশ থেকে এবং ২০০৭’এ অ্যামস্টারডামে আয়োজিত 'রোয়িং রেগাটা'তে চিনা দল প্রথম হয়ে শেষ করে জানালো তারা তৈরি। এমন নয় যে চিনের ১১৯ টার্গেট পূর্ণ হয়েছিল বেজিং গেমসে, এমনকি রোয়িং-এও তারা সেই গেমসে একটি মাত্র সোনা পেয়েছিল, কিন্তু প্রজেক্ট-১১৯ তাদের আন্তর্জাতিক স্তরে সমানে সমানে লড়বার জন্য তৈরি করে নিচ্ছিল। সেই সদ্য হাতে নেওয়া রোয়িং-এ এবারের গেমসকে নিয়ে চিনের পদক সংখ্যা বারো। এই প্রকল্প ২০০৮'এর পরেই পাততাড়ি গুটোয়নি তো বটেই, বরং তাদের জাতীয় ক্রীড়ানীতির অঙ্গ হয়ে গেছে। একটু ভালো করে ভেবে দেখলে নজরে আসবে পদকের জন্য চিন বরাবর লক্ষ রেখেছে ‘মাল্টিমেডেল ডিসিপ্লিন’-এ অর্থাৎ যেসব খেলায় অনেকগুলো পদক রয়েছে জিতে নেবার। রোয়িং, ক্যানোয়িং, ডাইভিং, সাঁতার এগুলোতে মেডেল ফুটবল, হকি বা গলফের থেকে অনেক বেশি, এমনকি একজন প্রতিযোগীই অনেকগুলো সোনা আনতে পারে। প্রজেক্ট-১১৯-এর বাজেট ছিল ৫৮৬ মিলিয়ন ডলার। মানে, ২০০৮'এ প্রাপ্ত ৪৮টি সোনার প্রতিটির জন্য তারা ১১ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং ১০০টি পদকের প্রতিটির জন্য ৫.৮৬ মিলিয়ন ডলার। বছরকার হিসেব নিলে দেখতে পাব, ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষে এই খাতে চিনের সরকার নিজে ব্যয় করেছিল ৮০০ মিলিয়ন RMB যার ভারতীয় টাকায় মূল্যমান দাঁড়ায় ৫০৭ কোটি টাকা। ওই একই বছর ভারতের ক্রীড়া বাজেট ছিল কত জানেন? ১,১১১ কোটি টাকা। সুতরাং টাকা খরচের দিক থেকে তখন যে খুব বেশি পিছিয়ে ছিলাম তা নয়, কিন্তু কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া খরচের ফল হয়েছিল এই যে বেজিং অলিম্পিক থেকে ভারতের অভিনব বিন্দ্রা প্রথম একক সোনা এনেছিলেন বটে কিন্তু মেডেল কাউন্ট ছিল মাত্র দুই।
চিন এগিয়ে কোথায়?
চিনের অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াক্ষত্রে সফলতাকে পাখির চোখ করেছিল সমান গুরুত্ব দিয়ে। কী তারা পারে যা তুল্যমূল্য জনসংখ্যা নিয়ে আমরা পেরে উঠি না। আলোচনার সুবিধের জন্য দশটা জায়গাকে আমরা চিহ্নিত করে দেখতে পারি।
ক্যাচ দেম ইয়াং
_______________________________________________________
১। ক্যাচ দেম ইয়ং: সারা দেশের প্রতিটি বাচ্চার স্বাস্থ্য, বৃদ্ধির হার এবং ক্রীড়া-পারদর্শিতার সহজাত সূচকগুলি তাদের এই 'ক্যাচ দেম ইয়ং' ডেটাবেসের অন্তর্গত। অত্যন্ত আধুনিক এবং শিশুশরীরের পক্ষে সহজসাধ্য নয় মোটেই - এমন ট্রেনিং মডিউলকে চিন তার শিশুশিক্ষার অঙ্গ করে নিয়েছে। সেখান থেকেই তারা তুলে আনে ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন। তারা সাধারণ স্কুল ছেড়ে চলে যায় স্পোর্টস একাডেমিতে যেখানে সপ্তাহের সাতদিনই ৮ থেকে ১২ ঘন্টার কঠিন ট্রেনিং শিডিউলের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। শুনলে অবাক হতে হয় যে, প্রজেক্ট-১১৯ হাতে নেবার আগেই তাদের দেশে ৪৪,০০০ স্পোর্টস একাডেমি তৈরি ছিল। ভারতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্যই কোনও ডেটাবেস নেই। আনুমানিক ৪৩ শতাংশ বাচ্চার ওজন আনুপাতিকভাবে কম। তাদের বড় অংশই আবার নিরামিষাশী পরিবারের। খাদ্যে পরিপূরকতা আনতেই তেমন কোন উদ্যোগ নেই, ক্যাচ দেম ইয়ং তো দুরস্ত।
স্পোর্টস স্কুল
_______________________________________________________
২। পরিকাঠামোঃ ক্রীড়া পরিকাঠামোর দিক থেকে কোনও তুলনাই হয় না চিনের সঙ্গে আমাদের। সে দেশে প্রতিযোগিতা সম্ভব এমন ময়দানের সংখ্যা ৮,৫০,০০০, স্টেডিয়ামের সংখ্যা ৬,৫০,০০০। সারা দেশে প্রতি বছর ৩,৭৩,০০০ বাচ্চাকে স্পোর্টস একাডেমিতে আবাসিক রেখে ট্রেনিং দেবার পরিকাঠামো আছে। সারা দেশে বছরে অন্তত ৪০,০০০ উল্লেখযোগ্য স্তরের প্রতিযোগিতা হয় এবং পেশাদার অ্যাথলিটের সংখ্যাই ৪৬,৭৫৮ জন। এদের মধ্যে জাতীয় অ্যাথলিট হিসেবে স্বীকৃত ১৫,৯২৪ জন এবং স্বীকৃত কোচের সংখ্যা ২৫,০০০-এর বেশি। সুতরাং, তুলনায় গেলে কেবল সংখ্যাই বাড়বে। আমাদের দেশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি অর্থাৎ একাধিক খেলায় কাজে লাগার মত ক্রীড়াঙ্গন অন্ততপক্ষে প্রতিটি জেলাসদরে গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হতে পারে সময় নষ্ট না করে। সেখানেও এক ঘরপোড়া গরু আছে, সেটা হল নয়াদিল্লির কমনওয়েলথ গেমসের টাকা থেকে অভূতপূর্ব চুরির নজির। ফলে ক্রীড়াক্ষেত্রে সরকারি খরচকে ‘পিঞ্চ অফ সল্ট’ দিয়েই হজম করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা।
কঠিন ট্রেনিং প্রোগ্রাম
_______________________________________________________
৩। দুর্বলতায় বাড়তি নজরঃ চিনের প্রজেক্ট-১১৯-এর ক্যাচওয়ার্ড ছিল যেসব খেলায় তারা সত্যিই দুর্বল সেগুলোতে বাড়তি নজর দেওয়া। রোয়িং-এর উদাহরণ দিয়েছি। মেয়েদের বক্সিং বা কুস্তিতে নজর দিয়ে আমরাও কিছুটা সাফল্য পেয়েছি। চিন বিশেষভাবে ঝাঁপিয়েছে মেয়েদের খেলাগুলো থেকে পদক তুলে আনতে। রোয়িং, সেইলিং, ক্যানোয়িং এসব গেমসের অস্তিত্ব বা ঐতিহ্য সে দেশে প্রায় ছিলই না অথচ সেখান থেকে পদক এনেছে তাদের মেয়েরা। আমাদের ক্রিকেটপ্রেম ছাপিয়ে অন্য গ্ল্যামারহীন ক্রীড়ায় কোনও অভিরুচি জন্মালো না তেমনভাবে আজও।
৪। সাফল্য ধরে রাখাঃ চিন যেসব খেলায় সাফল্য পেয়েছে, পেয়ে আসছে, সেগুলোতে পিছিয়ে পড়াকে ওরা জাতীয় বিপর্যয় মনে করে। ডাইভিং, টেবল টেনিস, ভারোত্তোলোন বা ব্যাডমিন্টনের মত খেলায় চিনের সাফল্য ও পারদর্শিতা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সেগুলোতে রাশ আলগা করতে ওরা ঘৃণা করে। আমাদের দেশে লিম্বারামকে নিয়ে তীরন্দাজিতে যে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল তা দীপিকা কুমারী বা অতনু দাসে এসেও অপূর্ণ থেকে গেল তার কারণ কী? মনোবিদের অভাব বা উপযুক্ত ইন্সট্রুমেন্টের অভাব আর এখন অতটা নেই, তবুও কেন হচ্ছে না তা নিয়ে ভাবে যারা তারা কী আদৌ ক্রীড়াক্ষেত্রের লোক? ব্যাডমিন্টনে সাইনা, সিন্ধুর পরের প্রজন্ম কোথায়? চিনে এই ব্যাটন কাদের হাতে তুলে দিয়ে যাবে পূর্বজরা এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়াই অকল্পনীয়।
সাঁতারু সান ইয়াং-এর অস্ট্রেলিয়ান কোচ ডেনিস কট্রেল
_______________________________________________________
৫। বিদেশী কোচঃ চিনের সাফল্য কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার আড়ালে নয়, বরং তাদের চোখের সামনেই এসেছে। সাফল্যের ক্ষেত্রগুলোর সেরা কোচ তাদের নিজেদের দেশেই আছে। তবু বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা কোচদের তারা নিয়ে এসেছে। সাঁতারে অস্ট্রেলিয়ার ডেনিস কট্রেল বা কেন ঊডের মত কোচকে নিয়ে কাজ করেছে তারা। ফেন্সিং, বেসবল, ভলিবল - যেসব খেলায় তাদের ট্র্যাডিশনাল সাফল্য নেই সেখানে তো বটেই, অন্য খেলাতেও বিদেশী কোচিং স্টাফ কিন্তু তাদের সাফল্যের বড় অংশীদার। আমাদের দেশে হালে ব্যক্তিগত বিদেশী কোচ রাখার এবং বিদেশে ট্রেনিং করার রেওয়াজ সরকারী স্তরে অনুমোদন পাচ্ছে। নীরজ চোপড়ার সাফল্যর পিছনে তার জার্মান কোচের, তার বায়োমেকানিক ট্রেনিং-এর অবদান ভুললে চলবে না। সুতরাং, বিদেশি কোচ মানে বিলাসিতা - এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।
৬। পুরস্কারঃ মেডেল বা আর্থিক পুরস্কার শুধু নয়, চিনে জাতীয় স্তরের অথবা সম্ভাবনাময় অ্যাথলিটকে কোনভাবেই চাকরি-বাকরির কথা ভাবতে হয় না। আমাদের দেশে বেতনভোগী ক্রিকেটার আছে যারা বিসিসিআই থেকে অনুদান পান, কিন্তু নিয়ম করে অন্য ক্রীড়াক্ষত্রের প্রতিযোগীদের জন্য, তাদের পরিবার পরিজনের জন্য অর্থভাবনা দেশ ভাবছে এমন সুদিন এখনও এখানে আসেনি। শিশু বা কৈশোর বয়সের সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে বিকশিত হতে দেখতে চাইলে এ ভাবনা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে বৈকি!
৭। ক্রীড়া কতটা জাতীয় গর্বের বিষয়? চিনকে এ ব্যাপারে কোনও কোনও সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর তকমাও দেওয়া হয়েছে। খেলাধূলায় সাফল্য সেখানে প্রায় মিলিটারি সাফল্যের সমার্থক। ১৯৮৪’তে অলিম্পিকে স্বনামে অংশগ্রহণের অধিকার পাবার পরে দেং শিয়াও পিং বলেছিলেন, একটা দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ও সভ্যতার চরিত্রলক্ষণগুলোর সমার্থক হল তাদের জাতির কাছে ক্রীড়ার গুরুত্বঃ "It looks like the impact and influence of sports are so great that they reflect a country's economy and civilisation, we need to improve our sport." এই জাতীয় নীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এককভাবে যে কোনও ক্রীড়াবিদের পক্ষে আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক মনে হতে পারে। চিনা জুডোকা জিয়াং ডংমেই-এর উদাহরণ দেওয়া যায়। এক বছরের শিশুপুত্রকে প্রতি পনেরো মাসে একদিনের জন্য দেখতে পেতেন তিনি। কোচদের এই একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পারফর্ম অর পেরিশ। সাধে কী আর জার্মান কায়াকিং কোচ জোসেফ ক্যাপুশেক বরখাস্ত হবার পরে বলেন, "Chinese sport is like the military, with a big hierarchy. The athlete is the lowest in the hierarchy." ভারতবর্ষ সেই নিরিখে এখনও ওয়ান স্পোর্টস নেশন। আমাদের জাতীয় গর্ব বা শোক সবই ওই ক্রিকেটকে ঘিরে।
৮। উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্বকারী দলঃ প্রতিনিধিত্বকারী দলের পরিধি একটা দেশের ক্রীড়া পরিকাঠামোর সমার্থক। সকলেই জানি অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে ন্যূনতম যোগ্যতামান পেরোতে হয়। অন্ততপক্ষে সে মান পার করে একটা দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে মানানসই প্রতিনিধিদল আমরা আজও পাঠাতে পারলাম না।
৯। ক্রীড়াসংস্থার মাথায় কারা? ক্রীড়াসংস্থা চিনেও পার্টির নজরদারির বাইরে নয় কিন্তু তারা খেলাধুলার সঙ্গে সম্পর্কহীন এমনটা হবার সুযোগই নেই সেখানে। আমাদের এখানে এই মুহুর্তে একটা মাত্র অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশনের মাথায় একজন প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ রয়েছেন, বাকি সবাই রাজনীতিবিদ। ভারতীয় লোকদলের চৌথালা ভাইদের উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। তারা বারো বছর ধরে টেবল টেনিস ও বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের মাথায় থাকার পরে অজয় চৌথালা শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে ধরা পড়ে জেলে যায়। তার ছেলে দ্যুশ্যন্ত চৌথালার এর পরেও সে সংস্থায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে অসুবিধে হয়নি।
১০। ক্রীড়া বাজেটঃ অলিম্পিকের বছরে ক্রীড়া বাজেট কমানোর ভাবনা ভারতেই সম্ভব। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের ক্রীড়া বাজেট পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় আট শতাংশের বেশি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৫৯৬.১৪ কোটির মধ্যে ২৫৪৯.৪১ কোটিই হল কর্মচারীদের মাইনে বাবদ তুলে রাখা খরচ আর মাত্র ৪৬.৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পরিকাঠামোয়, ভাবা যায়? একটা ধনুকের দাম কয়েক লক্ষ টাকা, একটা অলিম্পিক মানের রেসিং সাইকেলের দাম আধ কোটি টাকা ছুঁতে পারে। প্রজেক্ট-১১৯-এর মত একটা ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম অনেক উৎসাহ নিয়ে চালু করেছিল ক্রীড়া মন্ত্রক যার নাম ‘খেলো ইন্ডিয়া’ প্রজেক্ট। তার বাজেট এক লপ্তে এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজে না দিলে রাখার কোন যুক্তিও নেই কিন্তু খরচের সঙ্গে সাফল্য কবে আর সমার্থক হল এ দেশে?
যেখানে আজ শুরু করলে কম করেও দশ বছর পরে ফলের আশা করাই মোটামুটিভাবে যুক্তিসঙ্গত, সেখানে আমাদের নীরজ চোপড়ার মত একটা দুটো নিয়েই খুশী থাকতে হবে যদি না খেলা কোনদিন ভারতবাসীর জাত্যাভিমানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ভবিষ্যতে। সাফল্য আনতে গেলে খরচ করতে হবে এবং কর্পোরেট ভারতের সামনে এই প্রশ্ন রাখতেই হবে কেন ক্রীড়াক্ষেত্রে তাদের ব্যয় নামমাত্র যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা ফি'বছর কোটি কোটি টাকা দিয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি খাতে কর্পোরেট ভারতকে খেলাধুলায় খরচ করাটা বাধ্যতামূলক করা হোক এবং সেটা অবিলম্বে। আজ শুরু করলে ফল পেতে আরো দুটো অলিম্পিক পার করতে হবে হয়তো। তবু ভারতকে বুঝতে হবে ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য ছাড়া কোনও দেশকে কেউ সুপারপাওয়ার তকমা দেবে না এবং তা আশা করাও উচিত নয়।