আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

নিউটাউন এনকাউন্টার এবং নগরায়নের ভাবনা

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


গত দেড় বছর ধরে করোনার একঘেয়েমি আশঙ্কায় আতংকিত মানুষের মনে হঠাৎ নতুন আশঙ্কার জন্ম নিয়েছিল খোদ শহর কলকাতার উপকণ্ঠে - সেই আতঙ্ক হল জঙ্গি আতঙ্ক। মাস দুই-এক আগে নিউটাউনের অভিজাত আবাসনে দুই জঙ্গি পুলিসের সাথে এনকাউন্টারে নিহত হয়েছিল। দিনে দুপুরে ধৃত না হলেও মৃত জঙ্গিদের ঘটনা দেশ বা রাজ্যের গোয়েন্দা পুলিশের সাফল্যকে তুলে ধরলেও জন্ম দিয়েছে শহরের নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে বহু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের। প্রশ্নের গুরুত্ব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে রাজ্যের খাগড়াগড় থেকে নিউটাউনে এমন জঙ্গি সমাগমের কার্যক্রম দেখেই। মৃত জঙ্গিদের একজন উচ্চপদস্থ পুলিস কর্তার সন্তান এবং জাতীয় স্তরের কৃতি অ্যাথলেট হলেও দ্রুত পাঞ্জাবের শীর্ষ জঙ্গি তালিকায় নিজেদের তুলে আনতে পেরেছে। একদা খালিস্থান আন্দোলনে অশান্ত পাঞ্জাব আপাতদৃষ্টিতে শান্ত হয়ে এলেও সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসাবে সেখানকার যুবকদের একাংশের ড্রাগ, মাদক চোরাচালান এবং অস্ত্র যোগের হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল বিগত কয়েক বছর ধরেই। ফলে অপরাধের শুরু দেশের পশ্চিম সীমান্ত পঞ্জাবে হলেও তার শাখা-প্রশাখা দেশের পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে যেতে চলেছে এমন আশঙ্কাই প্রমাণ হচ্ছে নিউটাউনের 'সুখবৃষ্টি'তে গুলি বৃষ্টির ঘটনায়। বাস্তবে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর যত বেশি জঙ্গি দৌরাত্ম্য বাড়ছে সেসবের চারণভূমি হয়ে উঠছে মূলত ঘনবসতির শহরাঞ্চলগুলি। মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ দেশের মেগাসিটির কোনটাই আজ এমন আশংকার বাইরে নয়। এই প্রেক্ষিতে প্রয়োজন জঙ্গি কার্যকলাপের দোকানঘর হিসাবে নগর-উপনগরীকে বেছে নেওয়ার কার্যকারণ সম্পর্ক।

কোনো সন্দেহ নেই যে এদেশেও উত্তরোত্তর দ্রুত নগরায়ন ঘটে চলেছে আর পাঁচটা উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের মতোই। দেশের জিডিপির দুই তৃতীয়াংশ এখন তৈরি হচ্ছে শহরের অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। ফলে প্রযুক্তি-নির্ভর উন্নত কাজের খোঁজে গ্রাম, শহরতলী থেকে এখন মানুষ ভিড় জমাচ্ছে শহর কিংবা তার উপকণ্ঠে। সেই কারণে শহরে বাড়তি মানুষের চাপ সামলাতে তৈরি হচ্ছে বহুতল আবাসন। আর কলকাতার মত প্রাচীন অপরিকল্পিত শহরে স্থানাভাবের কারণে এই চাপ সামাল দিতে তৈরি হয়েছে উপনগরী। শহর বেড়েছে উচ্চতায়, সীমানা ঘেসা উপনগরীতে। ফলে মূল কলকাতা লাগোয়া সল্টলেক থেকে শুরু করে রাজারহাট-নিউটাউন এমন নতুন এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে অজস্র আবাসন, সরকারি, বেসরকারি এবং যৌথ অংশীদারিত্বে। কিন্তু এমন নতুন তৈরি হওয়া আবাসনে স্থায়ী, নিয়মিত বাসিন্দার সংখ্যা এগুলির ধারণ ক্ষমতার বহুক্ষেত্রে অর্ধেক বা তারও কম। কার্যত বহুক্ষেত্রে এই আবাসনের ফ্ল্যাটগুলি হয়েছে বিনিয়োগের ক্ষেত্র। কারণ রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ এদেশে অন্যান্য তুলনীয় বিনিয়োগের চেয়েও বেশি অর্থকরী এবং কার্যকরী হিসেবে বিবেচিত হত কিছুকাল আগেও। পাশাপাশি এমন আবাসনে রক্ষনাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা কেন্দ্রীয়ভাবে পেশাদার সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় বলেও বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি নিশ্চিন্তে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছরের রিয়েল এস্টেট বাজারে মন্দার কারণে এমন আবাসনের ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এখানেই তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তার মূল সমস্যা। কারণ বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার সময় যতরকম বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে ফ্ল্যাট কেনার এবং তাতে থাকার অধিকার সরকারের থেকে অর্জন করতে হয়, তার কণামাত্রের প্রয়োজন পড়ে না বাড়ি ভাড়া দেওয়া কিংবা নেওয়ার ক্ষেত্রে। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল শহরের কাঠামোয়, অতি অবশ্যই ভাবা প্রয়োজন আবাসনে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার আইনসন্মত বিধি প্রণয়নের। কারন ফ্ল্যাটের বা বাড়ির মালিকের একশো শতাংশ অধিকার আছে তার বাড়ি ভাড়া দেওয়া অথবা না দেওয়ার। কিন্তু তিনি যদি ভাড়া দেন তখন সেটি নিঃশর্ত হতে পারে না। কারণ কে বা কারা ভাড়া নিচ্ছে, তারা কতোটা নিরাপদ, কোন পেশায় কি ভাবে সেই ফ্ল্যাটের জায়গা ব্যবহার হবে এর কোনোটাই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। নিউটাউনের ঘটনায় প্রকাশ পাচ্ছে, যে সেখানকার আবাসনে মূল ভাড়াটে আবার সেই ফ্লাট ভাড়ায় খাটাচ্ছে অন্যদেরকে, এমনকি একটা ফ্লাট দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ ভাড়া নিচ্ছে এমন ঘটনাও সামনে আসছে। যেমন আবাসের স্থান কেবল বাড়ির বা ফ্ল্যাটের মালিকের ইচ্ছায় বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে না, যেমন কৃষির জমি মালিকের ইচ্ছায় বাস্তু জমিতে পরিণত করা যায় না সরকারি অনুমতি ব্যতিরেকে, তেমনি বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রটিও শর্ত সাপেক্ষ হওয়া উচিত। আর এখানেই প্রয়োজন উপযুক্ত সরকারি বিধি প্রণয়নের আর সেই বিধি রূপায়নের দায়িত্বে থাকবে সংশ্লিষ্ট পুরসভা এবং আবাসনের কমিটি। এই বিধি প্রয়োজন আয়করে স্বচ্ছতার স্বার্থে, আবাসনের বাসিন্দাদের পরিচয়ের স্বচ্ছতার প্রয়োজনে এবং সর্বোপরি নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু খেয়াল রাখা উচিত যে এমন বিধি যেন ব্যক্তি নাগরিকের অধিকারে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল তৈরি না করে।

নগরায়নের এই পর্যায়ে পরিযায়ী পেশাদারদের কোন বড় শহরে বসবাসের মেয়াদ সাধারণভাবে পাঁচ থেকে সাত বছর। আজ যে কলকাতায় আছে কাল সে বাঙ্গালুরু ছুটবে এটাই এখন রীতি। ফলে এমন যাযাবর মধ্যবিত্তের নতুন শহরে বাড়ি খোঁজায় এখন সবচেয়ে দাপুটে ভূমিকা পালন করে জমি বাড়ির দালাল গোষ্ঠী। বলাই বাহুল্য রাজারহাট নিউটাউনের মত এলাকায় ইট-বালি-সিমেন্টের সিন্ডিকেট যতটাই দাপুতে ছিল নগরীর নির্মাণকালীন পর্যায়ে সেই নগরীর নির্মাণ শেষে ঐ বাহুবলি সিন্ডিকেটের বড় অংশ এখন জমি বাড়ির দালালিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। যেহেতু এমন দালালদের হাত ধরেই আবাসনে নতুন বাসিন্দার প্রবেশ ঘটে ফলে প্রথমেই প্রয়োজন এমন দালালদের অপর নিয়ন্ত্রণের ভাবনা। শেয়ার বাজারে ‘ব্রোকার'রা যেমন ‘সেবি'র মত নিয়ামক সংস্থার তত্ত্বাবধানে দালালির কাজ করে এক্ষেত্রেও প্রয়োজন দালালদের জন্য পুরসভার রেজিস্ট্রেশন। এমন 'রেজিস্ট্রেশন বিধি' চালু হলে দালালদের দায়বদ্ধতা, তাঁদের দালালির অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ উভয়ই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অন্যথায় ‘জোর যার মুলুক তাঁর’ এই বিধি পালনে বাধ্য হবে ভাড়াটে-মালিক উভয় পক্ষই। শহরে অজানা অচেনা মানুষের ছদ্মবেশে আসা অপকর্মের কারবারিদের ওপর অনেকটাই চাপ বাড়ানো সম্ভব এপথেও। অন্যথায় বিহারের ফ্ল্যাট মালিক, বাঙালি দালাল আর পাঞ্জাবি জঙ্গি এমন বহু সমীকরণেই জড়িয়ে পড়বে শহরের নাগরিক জীবন - আবাসনের বাস্তুতন্ত্র। কারণ শহরের ভিড়ে মিশে থেকে, উন্নত যোগাযোগের সুযোগকে ব্যবহার করে সীমান্তবর্তী রাজ্যের বড় শহরগুলো হয়ে উঠতে পারে চোরাচালান আর জঙ্গিহানার আঁতুড়ঘর। সেই দিক থেকে এই শহরের আবাসনের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বোঝা দরকার যে এমন বড় বড় মেগা সাইজের আবাসনের নিরাপত্তা কেবল সিসিটিভি আর ভাড়াটে সান্ত্রি দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। আবাসনের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও বড় প্রেক্ষিতে বিচারের প্রয়োজন। দ্রুত নগরায়নের ধাক্কায় শহর জুড়ে নতুন মানুষের স্রোত বাড়ছে আর হারিয়ে যাচ্ছে বহু পুরানো মানুষ। ফলে শহর জুড়ে একদা তৈরি হওয়া গোষ্ঠী জীবনের ছন্দ কেটে চলেছে। ফলে আবাসনের চার দেওয়ালের মধ্যে, একটা দোলের দিন কিংবা দুর্গাপুজোর চারটে দিন আবির মেখে ঢোল বাজিয়ে ‘community life’ গড়া সম্ভব নয়। পুরোনো 'পাড়া কালচার’, রকে বসে সপ্তাহান্তের আড্ডা, চায়ের দোকানে ‘পিএনপিসি’ হারিয়ে যাওয়া নতুন শহরে তুলে আনছে একটা সামাজিক বিচ্ছেদের করুণ চিত্র। তাই পাশের ফ্লাটের বৃদ্ধার দেহ যতক্ষণ না পচে গিয়ে দুর্গন্ধে পাড়া মাতাচ্ছে ততক্ষণ প্রতিবেশীর চোখে সেই শূন্যতা ধরা পড়ে না। তাই ঘোর করোনাকালে আবাসনে কে কবে বাইরে থেকে এলো গেলো, গৃহে বন্দী আদৌ রইলো কিনা এসবই পড়ে থাকে সবার অলক্ষ্যে। আর এই পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা আজ জন্ম দিচ্ছে আরেক নতুন নিরাপত্তাহীনতার। সেটাই আজ ভাবিয়ে তুলছে একটা নতুন শহরকে, শহরের মানুষকে।