আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

লাল সংকেত, বিপন্ন মানব সভ্যতা এবং

অনিন্দিতা রায় সাহা


সত্তরের দশক তেলের দশক। ভূগর্ভস্থ খনিজ তেলের বিপুল সম্ভার খুঁজে পেয়ে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি আর রাজনীতির চাকা ঘুরে গেল। সেই থেকে অতিদ্রুত চলতে লাগল যাতায়াতের চাকা, অর্থনৈতিক প্রগতির চাকা। শুরু হয়েছিল সেই আড়াইশো বছর আগে - কয়লা, বাষ্পশক্তি, শিল্প বিপ্লব। পৃথিবীর বুক খুঁড়ে জীবাশ্ম জ্বালানি বের করে মানবজাতির প্রগতির রথ অবিরাম চলছে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন আর ভোগের পথ ধরে। আরো বেশি, আরো দ্রুত। একের পর এক আবিষ্কার, মানুষের অগ্রগতি, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের সন্ধান তাকেই আরো উস্কে দিলো। এর পর আশির দশক শক্তি নিয়ে গবেষণার দশক, তেলের পরিবর্ত খোঁজার দশক, তৈলখনির মালিক দেশগুলির একচেটিয়া প্রভাব থেকে মুক্তি খোঁজার দশক। তার ফলে অর্থশাস্ত্রের নতুন ধারা শক্তির অর্থনীতি (Energy Economics) তৈরি হল। অর্থনীতি আর রাজনীতির বাইরে সেই সময়টা আরো এক সচেতনতার সময়, পরিবেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তার জন্মলগ্ন। ১৯৮৭ সালের ব্রান্টল্যান্ড কমিশনের রিপোর্ট Our Common Future টেঁকসই উন্নয়নের ধারণা আনলো। পরিবেশের ওপর মানুষের ক্রিয়াকলাপের দীর্ঘস্থায়ী ফল এবং তার ফলে মানুষের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আলোচনা শুরু হল। সৃষ্টি হল অর্থশাস্ত্রের আরেকটি ধারা, পরিবেশের অর্থনীতি (Environmental Economics)। পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদের সীমিত পরিমাণ আর তার দ্রুতহারে ব্যবহার তৈরি করবে সম্পদের অপ্রতুলতা। অন্যদিকে ভোগ আর উৎপাদনের অবশিষ্ট প্রকৃতির বুকে এমনভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হয় যা প্রকৃতিতে মেশে না। দুইয়ে মিলে পরিবেশের সমস্যা। পৃথিবীর বুকে মানুষের পদচিহ্ন যে আরও সমস্যা সৃষ্টি করে, সেই উপলব্ধি এলো ধীরে ধীরে, এলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা। শীত, গ্রীষ্ম, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলাভাব, বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়া - এক দীর্ঘ তালিকা। দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বিপুল জনসংখ্যা, ভোগ ও চাহিদার লাগামছাড়া বৃদ্ধি এইসব মিলিয়ে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে গোটা বিশ্ব জুড়ে, তা নিয়ে ঘন্টা বাজলো। ১৯৮৮ সালে তৈরি হলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সংস্থা Intergovernmental Panel for Climate Change (IPCC) যার সদস্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করে তারা পরিস্থিতির মূল্যায়ণ, বৈজ্ঞানিক উপদেশ আর বিপদের আগাম সংকেত জানিয়ে দেয়। পৃথিবীর দরবারে IPCC একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। ১৯৯০ সালের প্রথম রিপোর্ট থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তারা রিপোর্ট দিয়েছে বিস্তর। সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টটি (Climate Change 2021: The Physical Science Basis) সেই ধারায় নবতম সংযোজন।

যে বিপদ সঙ্কেতটি ঘোষিত হয়েছে, তার রং লাল। অর্থাৎ আগামী দিন ভয়ঙ্কর। রিপোর্টটির অন্যতম লেখক লিন্ডা মিয়ার্ন্স বলেছেন, পৃথিবীর কোনো প্রান্তই আর নিরাপদ নয়, পালাবার পথ নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে ফেলতে না পারলে আরো বাড়বে প্রকৃতির রোষ। জলবায়ুর খামখেয়ালি ধারা কোথাও ভাসিয়ে দেবে অতিবৃষ্টিতে, কোথাও অনাবৃষ্টিতে। মৌসুমী বায়ুর গতিবিধি বদলে যাবে, হিমবাহ গলে যাবে, তাপপ্রবাহ প্রবলতর হবে, তটভূমিতে আছড়ে পড়বে ঘূর্ণিঝড়। শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর। এই মুহূর্তে গ্রীসের মাটিতে আগুন জ্বলছে, বিধ্বস্ত মানুষ বলছেন তাঁদের প্রপৌত্র-প্রপৌত্রীরা যদি এ জমিতে আবার আবাদি করতে পারে, তাই হবে অনেক পাওয়া। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ক্যালিফোর্নিয়া, কিংবা আমাদের উত্তরাখন্ড, অগ্নিগ্রাসে বিধ্বস্ত খাণ্ডবপ্রস্থ। ভারতের উপকূলে আইলা, বুলবুল, আমফান, নিসর্গ, যশ ঘন ঘন আছড়ে পড়ছে। একের পর এক ধ্বস আর আকস্মিক বন্যার আঘাতে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন। জার্মানি কিংবা চীন, আসাম কিংবা মহারাষ্ট্র - বন্যার কবলে কে যে কখন পড়বে, তার কোনো পূর্বানুমান নেই আর। লাল বিপদের সংকেতটি বুঝতে আমাদের এতটুকু অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা প্রলয়কালে পৌঁছে গিয়েছি। ভারতবর্ষে সমস্যার মাত্রা বহুমুখী। বিপুল জনসংখ্যা, মৌসুমী বায়ু-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা, অশিক্ষা, অপুষ্টি আর অনগ্রসরতা, অন্যদিকে বিকাশের মাঝপথে শিল্প, অপরিণত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষমতা, শহর-মুখী গ্রাম, অপর্যাপ্ত উন্নয়ন। জলবায়ুর পরিবর্তন আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভারতের কৃষিভিত্তিক গ্রাম-প্রধান অর্থনীতির ওপর ধ্বংসের তান্ডব বয়ে আনতে পারে। সীমিত ও ক্রমহ্রাসমান সম্পদ আর তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিধ্বংসী ফল, দুই দিক থেকে যুগপৎ আক্রমণ হানবে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর, ভারতবাসীর জীবন ও জীবিকার ওপর। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের জায়গায় পৃথিবীর উষ্ণায়ন যদি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তবে ফল হবে আরো ভয়ঙ্কর। তাপপ্রবাহ বেড়ে যেতে পারে ১৪ গুণ, সমুদ্রস্তর বেড়ে যেতে পারে ১-২ ফুট। এবং অনুমান করা হচ্ছে, যা ভাবা হয়েছিল, তার আগেই পৃথিবী ১.৫ ডিগ্রির সীমায় পৌঁছবে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমান ১.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের ফলে। তাহলে, আমাদের হাতে রইল কেবল ০.৪ ডিগ্রির সুযোগ। তার সদ্ব্যবহার করতে না পারলে এই শতাব্দীর শেষে, ২১০০ সালের মধ্যে বাঁধতে হবে নোয়ার আর্ক, বৈবস্বত মনুর নৌকা।

IPCC রিপোর্ট পাঁচটি বিকল্প দৃশ্যকল্প দেখিয়েছে। (ক) সবচেয়ে ভয়ানক পরিস্থিতি হবে যদি বর্তমান কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হার ২০৫০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে শতাব্দী শেষে ৪.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যাবে পৃথিবীর উত্তাপ। (খ) এই নিঃসরণ হার দ্বিগুন হতে যদি ২১০০ সাল অবধি সময় পাওয়া যায়, তবে শতাব্দী শেষে উষ্ণায়ন হবে ৩.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। (গ) যদি এই হারটি আপাতত মোটামুটি এমনই থাকে এবং ২০৫০ নাগাদ কমতে শুরু করে, কিন্তু ২১০০ সালের মধ্যে পুরোপুরি শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণ (Net zero emission) সম্ভব না হয়, তবে শতাব্দী শেষে উষ্ণায়ন হবে ২.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণ প্রক্রিয়ার অর্থ জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Renewable energy) ব্যবহার, সবুজ করে তোলা পৃথিবীর অর্থনৈতিক বিকাশের অভিমুখ। (ঘ) আর যদি নিঃসরণ কমানো শুরু হয় ২০৫০ সালের মধ্যে এবং তার কিছু পরে ২১০০ সালের কিছু আগেই শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়, তাহলে ১.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস মাত্রায় পৌঁছে টেঁকসই উন্নয়নের পথে পা বাড়ানো যাবে। (ঙ) স্বপ্নের মতো আশাবাদী শেষ দৃশ্যকল্পটি ২০৫০ সালের মধ্যে শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণ করার কথা বলে। সে ক্ষেত্রে তাপমানের দিক থেকে হতে পারে কেল্লা ফতে। কিন্তু এর আগেই এমন কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, যা আর বদলানো যাবে না, ফিরে পাওয়া যাবে না সেই প্রাক-শিল্প বিপ্লব স্বচ্ছ পরিবেশ। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়তো কমবে না। কিন্তু প্রতিরোধ প্রস্তুতির সাহায্যে তার সঙ্গে যুঝে ওঠার শক্তি থাকবে মানবসমাজের।

প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের ইতিহাস মানবসভ্যতারই ইতিহাস। আদিম মানব থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবী গ্রহের অধীশ্বর হয়ে ওঠা আসলে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ইতিহাস, কৃষি-উদ্বৃত্ত থেকে মালিকানার জন্ম হওয়ার ইতিবৃত্ত, সংঘবদ্ধ সমাজ আর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করার স্মৃতিপঞ্জী। সহস্রাব্দের যাত্রা আমাদের সমাজে এনেছে আবিষ্কারের কাহিনী, অগ্রগতির কাহিনী। এই একমুখী প্রগতির রথ চালিয়েছে জমি, শ্রম, মূলধন আর মুনাফার নীতি। সেখানে স্থান হয়নি পরিবেশের, প্রকৃতির, পশুপাখি-গাছপালা মিলিয়ে একটি সামগ্রিক বেঁচে থাকার লক্ষ্যের। প্রাধান্য পায়নি আপামর মানুষ, পুষ্টি-শিক্ষা-বাসস্থান, মানব উন্নয়ন। আজকের পরিস্থিতি সেই যাত্রাপথের অনিবার্য ফলশ্রুতি। পরিবেশের অর্থনীতির পরে এসেছে পারিস্থিতিক অর্থনীতি (Ecological Economics)। মানুষ যে এই জীবমণ্ডলের (Biosphere) একটি সামান্য প্রজাতি, তার বাঁচা-মরা নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর, আর সকল প্রজাতির সঙ্গে সহাবস্থানের ওপর, সে কথাটা আমরা ভুলে ছিলাম। মানুষের কার্যকলাপে বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য নিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। তাই চরম ভারসাম্যের বিন্দুটিতে পৌঁছতে হলে জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতিকেও (Economics of Biodiversity) আমাদের সাথে নিতে হবে। মানব সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে, জীবজন্তুর প্রতি নির্দয়তা তত বেড়েছে, এটাই সভ্যতার ইতিহাস। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, যথেচ্ছাচার আর মানবসম্পদের ওপর অন্যায় আধিপত্য, ঔপনিবেশিক পৃথিবীর এই দস্তুর সভ্যতার বিজয়কেতন উড়িয়েছে। আর এইসব ঐতিহাসিক ভুলের মাশুল আজ বিপদের ঘন্টা হয়ে বাজছে। তাই এই ত্রাহি ত্রাহি রব।

মানুষ প্রকৃতির সৃষ্ট সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। তাই সমস্যা সমাধানের খোঁজ পড়েছে। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সেই প্রয়াস চালাতে হবে নিরন্তর। চাই সংঘবদ্ধতা, চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাই IPCC রিপোর্ট পড়ে বিশ্বের তাবৎ সুধীজন বিচলিত। বলা হচ্ছে, এমন সমাজ গড়তে হবে যেখানে অর্থনৈতিক বিকাশের জায়গা নেবে সমাজ কল্যাণ, ব্যক্তিগত পুঁজির মালিকানার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃতিক সম্পদকে স্বীকার করবে মনুষ্যজাতির পুঁজি হিসেবে। সেই আন্তর্জাতিক সমাজ পৃথিবী জুড়ে আর্থ-রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করে গড়ে তুলতে পারে একটি সুষম ব্যবস্থা যেখানে ভালোবেসে বেঁধে থাকাই বেঁচে থাকা। সেই শুভবুদ্ধি জাগ্রত হলে সব দেশকেই কমাতে হবে পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক আগ্রাসন। এমন সব ভাবনাচিন্তা মাথায় নিয়েই রিপোর্ট বলছে, শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণের লক্ষ্য সকলের লক্ষ্য। ১৯৯২ সালের রিও সম্মেলন থেকে ২০১৫'র প্যারিস চুক্তি - আন্তর্জাতিক প্রয়াসের দীর্ঘ ইতিহাস। একের পর এক অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনা, মন্ট্রিলে ওজোন নিয়ে, তো কিয়োটোতে গ্রীন হাউস গ্যাস নিয়ে। বার্লিন, জেনেভা, বুয়েনোস এইরেস, বন, দ্য হেগ, মারাকেশ, মিলান, বালি, কোপেনহাগেন, ডারবান, দোহা, ওয়ারশ, লিমা - আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টার পদচিহ্ন এতগুলো দেশের মাটিতে। সারা পৃথিবী সমাধান খুঁজছে। নিজের অপকর্মের সমাধান, বাঁচার রাস্তা, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এখানেই। চীন এবং ভারত বলছে সকলের সাধারণ কিন্তু পৃথক দায়িত্বের (Common but differentiated responsibility) কথা। সর্বাধিক নিঃসরণের জন্য দায়ী বলে তাদের ওপর চাপ বেশি। সকলের জন্য নির্ধারিত সাধারণ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে তাদের জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমাতে হবে অন্যদের চেয়ে বেশি হারে। তাতে ব্যাহত হবে তাদের শিল্পায়নের গতি, কারণ তারা দৌঁড় শুরু করেছে পরে। উন্নত দুনিয়ার ঐতিহাসিক দায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ভারত ও চীন। শিল্প বিপ্লবের গরিমা, পৃথিবীব্যাপী সম্পদ আহরণের ইতিহাস, উচ্চ আয় ও ভোগের মাত্রার বর্তমান মান, সবই তো উন্নত দুনিয়ার ঝুলিতে। তাই তাদের বেশি দায়িত্ব নিতে হবে বই কি! আগামীতে গ্লাসগোয় যে আসর বসতে চলেছে, তাতে প্যারিস চুক্তিকে বলবৎ করা হবে। সেখানে প্রশ্ন উঠুক, বিতর্ক হোক, ন্যায্য নীতি নির্ধারণ হোক। যদি সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে এল নিনো হয়ে ভারতবর্ষের ৭৫১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ তটভূমির কোথাও বিপর্যয় ঘনায়, তবে তার দায়িত্ব নিক বিশ্বের সব দেশ। উন্নয়নশীল দেশে প্রতি বছর জলবায়ু শরণার্থী (Climate Refugee) হয়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার জন্য তৈরি করা হোক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (Global Resilience Fund) । যদি বলা হয় শুদ্ধ শূন্য নিঃসরণের জন্য সবুজ কারিগরী জ্ঞান চাই, তবে বিনামূল্যে তা সরবরাহ হোক উন্নত থেকে উন্নয়নশীল আর অনুন্নত দেশে। কার্বন ট্রেডিং-এর চালাকি বন্ধ হোক। সকলের জন্য সমান নয়, ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হোক। সহস্রাব্দের উন্নয়নের অষ্টম লক্ষ্যটি ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। ১৭ নম্বর টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্যটিও বলে ভাগিদারীর কথা। সে ক্ষেত্রে সব দেশের উপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া, পরস্পরের সহযোগিতা করা আর একসংগে এগিয়ে চলা নির্ভর করবে ব্যক্তিগত স্বার্থ আর লাভের উর্দ্ধে উঠে সর্বাঙ্গীন কল্যাণকে সর্বোত্তম করার সদিচ্ছার ওপর। উন্নত, অনুন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের সকলকে একসঙ্গে অথচ পরিস্থিতি অনুযায়ী পৃথকভাবে দেখে নীতি প্রণয়ন করার কথা কিন্তু IPCC রিপোর্ট বলছে না। যতক্ষণ উন্নত বিশ্ব এই সহজ সত্য মেনে নেবে না, ততক্ষণ রাজনীতির পরাক্রম মানব কল্যানের পথ রোধ করে থাকবে।

পরিবেশের ওপর মানুষের পদচিহ্ন (Ecological Footprint) কম করতে হলে ভোগ কম করতে হবে সকলকে। মানুষের বেলাগাম অর্থনৈতিক বিকাশ পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতা ও জৈবিক ক্ষমতা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এ যাবৎ যে পরিমাণ সম্পদের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তা মেটাতে একটি ১.৭ গুণ বড় পৃথিবীর প্রয়োজন। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন জীবনযাপন ও ব্যবহারের পরিবর্তন চাই। সে দায়টিও সারা পৃথিবীর সকলের হতে হবে। তৈরি হতে হবে সব দেশকে, তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে। সম্প্রতি প্রকাশিত The Economics of Biodiversity: The Dasgupta Review-তে সে বিষয়ে দিকনির্দেশ আছে। পরিবেশ সংক্রান্ত শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষার জন্য বিনিয়োগ আর জীবনযাপন প্রণালীর বদলের জন্য সচেতন প্রয়াস - এই ত্রিমুখী সমাধানসূত্র ছাড়া মানুষের উদ্ধারের আর কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। আশা আছে, মানুষ করবে, মানুষ পারবে। ইতিহাস বলে, আমরাই একমাত্র প্রজাতি যারা ভাবনা, মনীষা আর বোধের দ্বারা সংঘবদ্ধ হতে পারি। ধর্মীয়, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে একত্র হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল নয়। তেমনি আজ যে বিপদের ডাক শোনা যাচ্ছে, তাতে একত্রিত হয়ে মানুষকে বাঁচার লড়াই করতেই হবে। প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু, জীবজগৎ সব মিলে মিশে পৃথিবীব্যাপী এক বৃহৎ অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ বারে বারে তৈরি করেছে তার নিজের লক্ষ্য, অতিক্রম করেছে তার সীমা। তাই আজকে বিপদসংকেত শুনে মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, সে ভরসা আমরা রাখবো। বিশ্বের তাবৎ দেশের সরকার, শিল্পসংস্থা, নীতি নির্ধারক আর জনসাধারণ একযোগে এগিয়ে এসে সমাধান আনবে, মানুষের সেই বিচারের ওপর আমরা আশাবাদী। সাম্প্রতিক অতিমারী আমাদের শিখিয়েছে, যতক্ষণ প্রতিটি মানুষ নিরাপদ নয়, ততক্ষণ কেউই নিরাপদ নয়। ব্যক্তির বাঁচার স্বার্থে সমষ্টির নিরাপত্তা প্রয়োজন। আর সেটাই প্রকৃত সমাজ কল্যাণ। বিপদের লাল সংকেত মানুষকে সচেতন করুক, দায়িত্ববান করুক। জয় হোক মানুষের চেতনার, জয় হোক মানুষের শুভ বুদ্ধির, স্থায়ী হোক প্রকৃতির মহৎ সৃষ্টি।