আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দেশভাগঃ স্মৃতি-বিস্মৃতি

পবিত্র সরকার


।। ১ ।।

শ্রীমতী প্রতিভা বসু আংশিক স্মৃতিকথা লিখেছিলেন ‘স্মৃতি সততই সুখের’ এই নাম দিয়ে। হয়তো তাই সত্য এক দিক থেকে - বহুদিনের ব্যবধানে দুঃখ-কষ্টের স্মৃতির ওপরে এক ধরনের আস্তরণ পড়ে যায়। পরের জীবন একভাবে সেই ধূসরতাকে সাহায্য করে - কখনও পরে অর্জিত ও প্রাপ্ত সুখ ও সাফল্য তাকে কিছুটা কোমল করে তোলে; কখনও নতুন ও অব্যাহত দুঃখ-কষ্ট আর জীবনসংগ্রাম আগের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার স্মৃতিকেই অবান্তর করে দেয়, নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়াকেই বেশি জরুরি করে তোলে। আর আমাদের বয়সের যে লোকজন মূলত স্মৃতিকে সম্বল করে বেঁচে থাকে এবং যাদের বিপুল স্মৃতির বোঝা বইতে হয়, তারা ইতিবাচক নেতিবাচক দু'রকম স্মৃতিরই কোনও একটা স্পষ্ট অর্থ করতে পারে না, সেগুলোর সামনে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে দাঁড়ায়।

এই যেমন দেশভাগ, পনেরোই আগস্টের ‘স্বাধীনতা-দিবসে’র সঙ্গে যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেই জোড়া চিনা মৎস্যপ্রতীক ইয়ান আর ইন্-এর মতো। এক দিকে বিপুল উল্লাস, কলকাতার রাস্তায় দুই সম্প্রদায়ে মধুর কোলাকুলি, জনতার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ, বাড়ির ছাদে ছাদে শত শত তেরঙ্গা নিশান, অন্যদিকে আগেও পরে সেই অভিশপ্ত দেশের নানা অঞ্চলে মর্মান্তিক দাঙ্গা, যা পরে ভারত ও পাকিস্তান হিসেবে চিহ্নিত হবে। যিনি এই দেশভাগের গূঢ় অভিসন্ধিকে প্রথম মাথায় এনেছিলেন এবং যাঁরা এই অভিসন্ধিকে (ভাবী ক্ষমতার লোভে?) মেনে নিয়েছিলেন, জীবিত অবস্থায় তাঁরা কোনও ব্যক্তিগত দায়িত্ব নেননি, মৃত্যুর পর আর দায়িত্ব কে নেয়? দেশভাগের পরে যে বিপুল মানবিক আর সামাজিক বিপর্যয়, তার দায়িত্বই বা কে নেবে - যে মহাত্মা বলেছিলেন তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে দেশভাগ হবে তিনিই বা কতটুকু নেবেন? স্মৃতি আর স্মৃতি, অভিযোগ, অভিমান; এক দেশের জায়গায় দু'দেশ, দু'দেশের জায়গায় তিন দেশ হল, আরও কত কত ব্যক্তিগত আর ইতিহাসের স্মৃতি জমে উঠল - সে সব কোন্ মহাফেজখানায় জমা হবে কে জানে? আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিও বহুবার বলা হয়েছে নানা সূত্রে, ‘আরেক রকম’-এর জন্য আর-একবার বলি। অনেকের স্মৃতির সঙ্গে কিছুটা মিলবে, কিছুটা বা অনেকটা মিলবে না।

।। ২ ।।

বয়েস তখন নয় পার হয়েছে, সেই ঢাকা জেলার উত্তরপ্রান্তে, ধামরাইয়ের লাগোয়া, বংশাই নদীর ধারে ‘পঞ্চাশ’ গ্রামে। বাড়িতে ‘অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকা’ আসে ডাকবাহিত হয়ে, চার ভাঁজে পাট-পাট। বালিয়াটি বা বালিহাটির জমিদারের এক ছোট তহশিলদার বা নায়েব আমার পালক-পিতার কাছারি ঘরে গ্রামের হিন্দু মধ্যবিত্ত গৃহকর্তারা তা পড়তে সন্ধেবেলায় জমায়েত হন, সুগন্ধি তামাক পোড়ে, হুঁকোতে ‘বুড়বুড়’ শব্দ ওঠে। মন্বন্তরের ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও’ আর্তনাদ কিছুদিন আগে থেমেছে, যুদ্ধের উত্তেজনাও আর নেই, যদিও সেই দূর গ্রামের আকাশে এরোপ্লেনের অচেনা আওয়াজ কখনও কখনও পাওয়া যায়, আমরা বালকবালিকারা প্লেন দেখতে ছুটে বেরোই। তখন বাবার কাছারি ঘরে আলোচনা পার্টিশন - দেশ ভাগ হতে চলেছে। অদ্ভুত অদ্ভুত নাম সব উচ্চারিত হয়, গান্ধি, নেহেরু (ওই উচ্চারণে), জিন্না, প্যাটেল ইত্যাদি। সুভাষ বোসের অনুপস্থিতি নিয়ে সমাবেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কে তাঁরা, আমাদের জীবনে কী তাঁদের ভূমিকা। ধামরাই হার্ডিঞ্জ স্কুলে যাই, ক্লাস থ্রি থেকে সবে ফোরে উঠেছি। আবছা শুনি যে দেশ ভাগ হবে, একটা ‘হিন্দুস্থান’, আর-একটা ‘পাকিস্থান’। আর আমরা যে দেশে আছি সেটা নাকি ‘পাকিস্থানে’ পড়বে। আমাদের পঞ্চাশ গ্রাম হিন্দুসর্বস্ব, কিন্তু দক্ষিণদিকে গায়ে লাগা মুসলমানসর্বস্ব ইসলামপুর গ্রাম থেকে বাবার মুসলমান বন্ধুরাও আসেন, ভিন্ন হুঁকোয় তামাক খান, এবং এই একই আলোচনায় মগ্ন হন। হিন্দু প্রতিবেশীদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে তাঁরা আমল দেন না, বলেন, ‘কই জাইবেন জন্মের ভিটা ছাইরা? আমরা আছি কী করতে?’ কিন্তু গুজব হাওয়ায় ছড়ায়, সংবাদপত্রেও কোনও আশ্বাসের খবর নেই। র্যা ডক্লিফ সাহেব যে তখন ছুরি শানাচ্ছেন সে খবর আমরা ছোটরা কেউ রাখি না।

উনিশ-শো সাতচল্লিশের জুন-জুলাই হবে। স্কুলের ক্লাসে বন্ধুরাও এই আলোচনা করে। দেশে নাকি আর থাকা যাবে না। সেকেন্ড বয় সন্তোষ বসু যাবে ত্রিপুরার খোয়াইয়ে, থার্ড বয় সতীশ ঘোষদের দুধের ব্যবসা, তারা কোথাও যাবে বলে এখনও ঠিক করেনি। এই সব কথাবার্তা চলে, তার মধ্যে ক্লাসে একদিন একটা ঘটনা ঘটল। বাংলা পড়াতেন মৌলবি সাহেব, রবীন্দ্রনাথের মতো সাদা লম্বা দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি পরে আসতেন। তাঁর বাড়ি খুলনায়। গল্প করছিলেন, সেখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, আর শীতকালে খেজুর গুড়। আমাকে স্নেহ করতেন, হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘জাইবা নাকি সরকারমশয় এই পূজার ছুটিতে আমার লগে আমার গেরামে, খুব মাছ আর খাজুর গুড় খাইয়া মোটা হইয়া আসবা।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে চকিত-প্রতিক্রিয়ায় উত্তর দিলাম, ‘না মৌলবিসাব, আপনের লগে গেলে মুসলমানরা আমারে কাইট্যা ফালাইব!’

সমস্ত ক্লাস স্তব্ধ। মৌলবিসাব বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে খানিকটা তাকিয়ে রইলেন, তার পর তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘হায় আল্লা, দ্যাশটারে তুমি কী কইর্যাে ফালাইলা।’ আমার দিকে তাকিয়ে আর্ত গলায় বললেন, ‘তুই আমাতে এত বড় একটা কথা কইলি বাপ!’ আমার বোকামি আমি তখন আদৌ বুঝতে পারিনি। বুঝিনি যে, কথাটা আমাকে দিয়ে সময় বলিয়েছে। আগের বছরও যে ব্যাপক দাঙ্গা হয়ে গেছে পদ্মার এপারে ওপারে, তার এলোমেলো খবর মাথার কোথাও ছিল।

এই সূত্রেই আমাদের পঞ্চাল-ইসলামপুর জোড়া গ্রামের একটা প্রথার কথা মনে পড়ে গেল। পঞ্চাশের হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সমবয়সি ইসলামপুরের মুসলমান ছেলের একটা ‘দোস্তালি’ পাতানোর প্রথা ছিল। সে এক উৎসব দুই গ্রামের। দুটি ছেলেকে দারুণ সাজে সাজিয়ে, পালকিতে চড়িয়ে বিলিতি বাদ্য বাজিয়ে দশখানা গ্রাম ঘোরানো হত, এই ঘোষণা করে যে, অমুক দাস আর অমুক মিঞার ছেলে আজ থেকে আজীবন বন্ধু হল। পতিতপাবন সরকারের (পালক)-ছেলে আমার সঙ্গে কটুনি ব্যাপারীর ছেলে রহমানের এই রকম বন্ধুত্ব পাতানো হয়েছিল আমাদের দুজনের পাঁচ বছর বয়সে। পরে বুঝতে পারি, দুটো দীর্ঘকালীন প্রতিবেশী সমাজ পরস্পরের মধ্যে মিলনের নানা সূত্র খুঁজেছে, এই বালকে বালকে দোস্তালি পাতানো তার একটা। আমার পালক পিতার সঙ্গে কটুনি ব্যাপারীরও তাঁদের বাল্যকালে এই দোস্তালি পাতানো হয়েছিল। যাঁরা বাবাকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কটুনি চাচা, আলিমুদ্দিন নানা - এই সব মানুষ।

এর মধ্যে নেহরু সাহেবের Tryst with destiny ঘটে গেল ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে। কিন্তু তার একদিন আগে পাকিস্তানেরও ভাগ্যের সঙ্গে মোলাকাত ঘটে গেছে। তেরো তারিখে কিছু লিগের লোক এসে আমাদের স্কুলে আমাদের লাড্ডু খাইয়েছে, আর আনন্দের জন্যে মাথাপিছু দু'খানা করে পটকা দিয়ে গেছে। নেহরুজির মোলাকাতের আগে আমরা অন্ধকার বারান্দায় সে পটকা ফাটিয়ে গুরুজনদের বিশাল ধমক খেয়েছি।

তবু দেশ ছাড়তে হল। একদিন মাঝরাত্রে গ্রামের কাছাকাছি ‘নারা’ উঠল, আমরা বাকসো-প্যাঁটরা নিয়ে পাশের এক জঙ্গলে পালিয়ে রাত কাটালাম। পরদিন কটুনি চাচা বললেন, ‘ঢ্যাহার থিকে কয়টা লিগের পোলা আইসে সমস্যা করতাছে, ব্যাপার ভাল বুঝতাছি না।’

তাঁরই পরামর্শমতো একদিন রাত ভোর না হতেই (গ্রামের কেউ টের পাবে না) এক নৌকায় ছোটমা (ছোটপিসিমা) আর আমি কাকার সঙ্গে পশ্চিমবাংলার দিকে যাত্রা করলাম। এটা বলতে অসুবিধে নেই যে, বালকের মন তখনও বিশ্বাস করেনি যে, চিরকালের জন্য দেশ, বাড়ি গ্রাম ও স্কুলের বন্ধুবান্ধব, খেলার মাঠ ও নদী, এমনকি পোষ্য প্রাণীদের ছেড়ে যাচ্ছি। বড়রাও নাকি বিশ্বাস করতেন অরবিন্দের কথা, দশ বছর পরে আবার ‘হিন্দুস্থান-পাকিস্থান’ এক হবে। ফলে দু'দিনের নৌযাত্রা সে বেশ উপভোগ করেছে। নৌকাযাত্রার শেষে মানিকগঞ্জ থেকে ঘোড়ার গাড়িতে আরিচাঘাট, আরিচাঘাট থেকে গোয়ালন্দে পৌঁছে হঠাৎ একটা বিপ্লব ঘটে গেল। স্টিমার ঘাটে ভিড়তে না ভিড়তেই শত শত বিহারী কুলি যেন আক্রমণকারী দস্যুদলের মতো নেমে এল স্টিমারে, এসে প্রত্যেকে এক-একটি যাত্রীপরিবারের মালপত্র হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অর্থাৎ এরা তার দখলে। তারপর স্টিমারে গ্যাওয়ে লাগানো হওয়া মাত্র সেই কুলির হাত ধরে মিটিমিটি আলোয় আমাদের অচেনা লক্ষ্যে যাত্রা, পড়িমরি করে। ট্রেনগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, কুলিটি ‘আইয়ে আইয়ে’ বলে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না, অন্ধকারে বেলেমাটির ওপরে পাতা রেলের লাইনে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে আমি, কাকা আর ছোটমা ছুটছি। শেষে কুলি একটি অন্ধকার ট্রেনে উঠে পড়ল, উঠে খালি সিটের ওপরে বাক্সো-বিছানা ফেলে ছোটমাকে হাত ধরে তুলল, কাকা আর আমি উঠে গেলাম অন্ধকার কামরায়। তখনকার তৃতীয় শ্রেণির।

একটু পরে একটা মিটমিটে বাল্‌ব জ্বলল। দেখলাম কামরা ভর্তি ভাঙাচোরা মুখ, কারও চোখে জলের ধারা তখনও শুকোয়নি। মেয়েরা কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাকারও মুখে কথা নেই। বাচ্চারা কেঁদে উঠলে বীভৎসভাবে ধমকে উঠছে বাবা, ‘এই চুপ্ কর্, মাইরা ফালাইমু নাইলে!’ বাচ্চাকে মা মুখ চাপা দিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে।

ঢাকা মেল ছেড়েছিল রাত দশটা নাগাদ, সে রাত্রে ঠাসাঠাসি করে বসে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ঘুমের আর দুঃস্বপনের মধ্যে আমি নানা সুররিয়ালিস্টিক ছবি দেখছিলাম, জ্যোৎস্নালোকিত মাঠ-বন-লোকালয়ের দৌড়ে চলে যাওয়ার। কিন্তু দর্শনা স্টেশনে এসে আর ঘুম রইল না। পাকিস্তানি পুলিশেরা হুড়মুড় করে কামরায় উঠে এল, মেয়েপুরুষদের টেনে নামাল, সুটকেস বাকসো-প্যাঁটরা খুলতে বলল, কে কোথায় টাকাকড়ি, গয়নাগঁটি লুকিযে নিয়ে চলেছে তার নির্দয় সন্ধান চলল, মেয়েদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। তবে দুর্নীতি একটি আদিম বাণিজ্যিক পন্থা, কাজেই কাকা, যিনি শহরে বাজারের হালহকিকত জানেন, পুলিশকে ঘুষ দিয়ে রেহাই কিনলেন, মায়ের গায়ে বা ট্রাঙ্কে হাত পড়ল না। ভোর হল রানাঘাটের একটু আগে। কাকা রানাঘাটের পানতুয়া কিনে খাওয়ালেন। শেয়ালদাতে পৌঁছোলাম সাড়ে ন'টায়। প্ল্যাটফর্মে একজোড়া এদেশীয় সাহেবমেম দেখে আমি তাদের পেছনে পেছনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম, কাকা অনেক ডাকাডাকি করে উদ্ধার করে আনেন।

এই আমার বালককালের সীমারেখা।

।। ৩ ।।

এই গল্পটার আর একটা পিঠ আছে। আমি একটি পরিবার থেকে পোষ্য হয়ে এসেছিলাম অন্য পরিবারে। এটা তাদের গল্প। সে গল্পে খুব ভয়ংকর কিছু নেই, নানা লড়াই, সমস্যা-সংকট আর আমার ছোটমা বা ছোটপিসিমার ছেলের শিক্ষার জন্যে জেদের ঘটনা আছে, যার সুফল আমি ভোগ করছি। কিন্তু দেশভাগের সঙ্গে মৃত্যু, ধ্বংস, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, উদ্বাস্তু শিবির বা কলোনি নির্মাণ আর কলোনিবাসের কোনও গল্প নেই।

যে পরিবার আমি ছেড়ে এসেছিলাম তার কথা একটু বলি। আমার জন্মদাতার মৃত্যু হয় দেশভাগের ঠিক পরেই। বিধবা মা একটি দু'বছরের ছেলে, এগারো বছরের মেয়ে (আমার যমজ বোন, লীলা)-কে নিয়ে আতান্তরে পড়েন। অভিভাবক বলতে আমার ষোলো বছরের দাদা, তিনি মাঝে-মাঝেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন, লেখাপড়া সম্বন্ধে প্রবল বিতৃষ্ণার কারণে ক্লাস ফোরের বেশি এগোতে পারেননি। তাঁর কথা আমি আমার ‘অল্প পুঁজির জীবন’-এ লিখেছি। ১৯৫০-এর দাঙ্গায় এঁরা বাসভূমি এবং আমার জন্মস্থান মুসলমান-প্রধান বলিয়ারপুরের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিযে ঢাকার উপান্তে ডগাইরে আমার মামাবাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু মামাবাড়িতে ব্যবহারের তারতম্য লক্ষ করেন, ফলে এক বিধবা মাসি ও মা বাকিদের নিয়ে ঢাকায় আর-এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে আসেন এবং একটি সুতাকলে কাজ নেন। ছোট ছেলে পরিতোষকে পাশের জগদ্‌বন্ধু আশ্রমে গ্রহণ করা হয়, স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে আশ্রমের নানা জিনিস পথে-ঘাটে-ট্রেনে ফিরি করে বিক্রি করতে থাকে। দাদা ভবেশদা কখনও কাচের কারখানায়, কখনও বিড়ি বেঁধে কিছু উপার্জন করতে থাকেন, এবং ১৯৫৫ নাগাদ আবার নিরুদ্দেশ হন। মামারা এই উপকার করেছিলেন যে, বোনটিকে রেখে তার বারো বছরে এক গ্রামীণ চাষি গৃহস্থের বাড়িতে তার বিয়ে দেন। এবং সেখানে পরে একটি পুত্রসন্তানকে নিয়ে সে বিধবা হয়। ‍১৯৫৭-তে নিরুদ্দিষ্ট দাদা হঠাৎ চিঠি দেন যে তিনি ভারতে আলিপুরদুয়ারে আছেন এবং মা ও ছোটভাই যেন কোনও ভাবে তাঁর কাছে চলে যায়। মাসি ও ঢাকার আত্মীয়ের সহায়তা নিয়ে তাঁরা চলে যান। সেখানে ভাই স্কুলে ভর্তি হয়, এবং সেই সঙ্গে সপ্তাহশেষের বাজারে নানা জিনিস বিক্রি করতে থাকে।

অনেক পরে আমি উপার্জনক্ষম হলে ভাইকে খড়্গপুরে নিয়ে আসি। সে এমএ পাশ করে এবং পরে ডক্টরেট হয়ে কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে অবসর নেয়। দাদা এদিকে চলে আসেন, এবং তখন অধ্যাপক হিসেবে চাকুরিরত আমারই জোগাড় করে দেওয়া ক্লাস এইট পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে পুলিশ কন্‌স্টেবলের চাকরি পান, এবং সেই হিসেবেই অবসর নেন। তিনি মারা গেছেন স্ত্রী ও একটি কন্যা রেখে।

বোনটি বাংলাদেশেই মানিকগঞ্জের কাছে একটি অজ গ্রামে থেকে যায় এবং জমিজমা দেখতে দেখতে সন্তান আর দুই নাতিকে লালন করতে থাকে, সন্তানটিও সময়ের অনেক আগে চলে যায়। নাতিরাও সোনার দোকানে ও মোটর গ্যারেজে কাজ করতে থাকে, কেউ বা রাঁধুনি হয়ে দুবাই যাবার কথা ভাবে। সে ক্রমে হিন্দু-মুসলমান চাষি গ্রামের ‘দিদা’ হয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে ২০১২ সালে প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়, ঢাকার বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক প্রয়াত শামসুজ্জামান খানের সৌজন্যে।

এক পুত্র ভারতের ১৪৫ বর্গের ভিআইপি (উপাচার্যদের ভিআইপি মর্যাদার ক্রম, মুম্বাই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জের তালিকায় দেখেছিলাম ১৯৯৬ নাগাদ), এক পুত্র কলেজের অধ্যক্ষ, এক পুত্র পুলিশ কন্‌স্টেব্‌ল, আর কন্যা একটি চাষি পরিবারের গৃহিণী - একই পরিবারের এই অসম বিকাশের জন্য দেশভাগকে কৃতিত্ব দেব না দায়ী করব তা ঠিক বুঝতে পারি না।