আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

মূলে আঘাত চাই


প্রয়াতা নাট্যব্যক্তিত্ব ঊষা গাঙ্গুলি একটা সাহসী নাটক করেছিলেন, হিন্দিতে, 'কোর্ট মার্শাল'। তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন এক দলিত সেনা জওয়ান দৌড়ে প্রথম হয়ে তাঁর আগের চ্যাম্পিয়ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উচ্চবর্ণের এক ব্যক্তিকে দৌড়ে হারিয়ে দেওয়ায় কীভাবে ওই কর্মকর্তার দ্বারা ব্যক্তিগত ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অফিসারের বাড়িতে ডিউটি দিয়ে অসম্মানজনক ব্যক্তিগত কাজ দেওয়া হয়। পরে আবার সেন্ট্রি পদে ফিরে এলে তাকে জাত ও মা তুলে গাল দিতে থাকেন অফিসার। দলিত জওয়ান গুলি চালিয়ে দেন। এতে তাঁর কোর্ট মার্শাল হয়ে সাজা হয়।

সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আইএএস হন টিনা দাবি। উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় প্রথম দিন।

টিনা দাবি পরে মুম্বাইয়ে আম্বেদকর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় বলেন, পরদিন থেকেই মিডিয়া আমার জাত জানতে চায়। যেহেতু আমার পদবী তাঁদের চেনা বৃত্তের নয়।

টিনা দাবি একজন দলিত। তাঁর বক্তব্যে হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়া দলিত ছাত্র গবেষক রোহিত ভেমূলার কথাও উল্লেখ করেন।

২০১৭'তে আরেকটি ঘটনা ঘটে। আইআইটি-র প্রবেশিকা পরীক্ষায় সম্পূর্ণ নম্বর ১০০% পেয়ে প্রথম হন কাপিট ভিরাওয়াল। তখনও তাঁর দলিত জাতি-পরিচয় নিয়ে আলোচনা হয়। ভিরাওয়াল একজন সাধারণ কম্পাউন্ডারের ছেলে। দলিত হিসাবে সংরক্ষণের সুযোগ পেয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রথম দিকে পড়াশোনায় অসাধারণ ছিলেন না। সুযোগ পেয়ে বিকশিত করেছেন নিজেকে। দেশে প্রথমবার ১০০% পেয়ে আইআইটি-র পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের অরূপ দাস, চাকদহে বাড়ি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম হন।

রাজ্যে এই নজির প্রথম। অরূপ দাস ছিলেন দলিত। কিন্তু দলিত ছেলে প্রথম হয়েছেন এটা আলোচনায় আসেনি। অথচ শুনতে হয়, কোটার জন্য সর্বনাশ হচ্ছে শিক্ষার।

ভারতে ক্রীড়াক্ষেত্রে যাঁরা অবদান রাখেন তাঁদের বড়ো অংশই গরিব এবং দলিত শ্রেণির। এঁরা কেউ কোটায় অলিম্পিকে যান না, যান যোগ্যতায়। ওঁরা যখন সফল তখন কেউ ওদের জাতি-পরিচয় তোলেন না। বলেন না পাঞ্জাবি খেলোয়াড়রা হকিতে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বা মণিপুরী মহিলা অলিম্পিকে পদক নিশ্চিত করেছেন। বলা হয়, ভারতীয় জিতেছেন। কিন্তু কৃষক আন্দোলন হলে ওঁরা পাঞ্জাবি হয়ে যান। পোশাক বা ভিন্ন রুচির কারণে কাউকে বলা হয় 'চিঙ্কি', মণিপুরে জারি করে রাখা হয়েছে আজও আফস্পা - বিশেষ ক্ষমতা আইনে যাকে খুশি যখন খুশি আটক করা যায়।

উত্তরপ্রদেশ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষায়, সে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী। অজয় কুমার বিস্ট নামের এই ভদ্রলোক নিজেকে যোগী আদিত্যনাথ বলে পরিচয় দেন।‌ অনুগত বা বিরোধী (দূরবীণযন্ত্রে দ্রষ্টব্য) প্রচারমাধ্যমও তাই লেখে। ইনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আগের মুখ্যমন্ত্রী যাদব বংশীয় বলে তাঁর বাসভবনকে দমকল বাহিনী পাঠিয়ে গঙ্গাজল দিয়ে 'শুদ্ধ' করেন। দলিত জনের বাড়ি গেলে তাঁদের সাবান ও শ্যাম্পু পাঠানো হয় এবং যাওয়ার পর নিরাপত্তারক্ষীরা পিছন থেকে ধরে থাকেন, কেউ যাতে তাঁকে ছুঁয়ে না ফেলে।

উন্নাও, হাথরস সব মিলিয়ে প্রতিদিন একাধিক নারী ধর্ষিতা হন। খুব কমই তালিকায় আসে। যা আসে তাতেও দেশের শীর্ষে। এনকাউন্টার তথা ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত্যু উত্তরপ্রদেশে জলভাত। ১,০০০ জনের বেশি নিহত। বেশিরভাগ দলিত ও সংখ্যালঘু। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরাও আছেন এঁর মধ্যে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরেছে বিজেপি। কিন্তু মেরে ধরে দখল করেছে বেশিরভাগ হেরে যাওয়া পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদ। মিছিল সভা করলেই দেশদ্রোহী বলে দেখে নেওয়া। মিথ্যা মামলা করে জরিমানা করা জলভাত। ১৩ আগস্ট কানপুরে এক রিকশাচালককে ছোট্ট মেয়ের সামনে 'জয় শ্রী রাম' বলতে বাধ্য করা হয়েছে।

দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ সবচেয়ে বেশি। দলিত নারীদের অবস্থা ভয়াবহ। কতটা ভয়াবহ, তার জ্বলন্ত উদাহরণ - অলিম্পিকের হকি খেলোয়াড় বন্দনা কাটারিয়ার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা। বন্দনা কাটারিয়া দরিদ্র দলিত পরিবারের মেয়ে। অতি কষ্টে হকি খেলোয়াড় হয়েছেন। অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। খেলায় হ্যাটট্রিক করেছেন। কিন্তু শেষ খেলায় ভারতীয় মহিলা দল হেরে যাওয়ায় তাঁর পরিবারের ওপর চড়াও হয়েছে তথাকথিত উচ্চবর্ণের একদল অমানুষ। গালিগালাজ বিদ্রূপ করা হয়েছে। বাড়ি আক্রমণ করে বলা হয়েছে, ছোটোলোকদের দলে নেওয়াতেই এই হার।

মজার বিষয়, ভারতের হয়ে অলিম্পিকে এবার পদকপ্রাপ্তদের বড়ো অংশই দলিত। গোটা পৃথিবী জুড়েই দেখা যায় দরিদ্র অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা পৃথিবীতে ক্রীড়া বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান বেশি রেখেছেন। তথাকথিত উচ্চবর্ণ বা উচ্চবর্গের চেয়ে।

পেলে, মারাদোনা, মেসি, জিদান, গ্যারি সোবার্স, মহম্মদ আলি, জেসি ওয়েন - সবার ইতিহাস এক।

আমাদের একটা সমস্যা হচ্ছে, আর্য ধারণা মনুবাদী ধারণার বিরুদ্ধে যে লড়াই করা খুব জরুরি ছিল তা আমরা করিনি।‌১৯৯৫-এ পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্মেলনে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, জাত ও শ্রেণি দুটো লড়াই-ই একসঙ্গে লড়তে হবে। কিন্তু তা হয়নি। কিছু দলিত ব্যক্তি ও সংগঠন এ নিয়ে লড়েছেন, কিন্তু সর্বভারতীয় কোনো দল এ'নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। তাই একদা সংরক্ষণের তীব্র বিরোধিতা করে মণ্ডল কমিশন ঠেকাতে কমণ্ডলু রাজনীতি করে দেশে রাম মন্দিরের হাওয়া তুলে দেশ দখল করে ফেলল ভারতীয় জনতা পার্টি। কিন্তু এই কথা সেভাবে কেউ বলেন না। কারণ মনে মনে অনেকেই সংরক্ষণের বিপক্ষে।

এদেশে দ্রোণাচার্য পুরস্কার চালু আছে। চরম দলিত বিরোধী একজন শিক্ষক হওয়ার যোগ্য নন। গুরু হতে পারেন যদিও। গুরু একটি মনুবাদী ধারণা। তাই দলিত একলব্যকে অন্যায়ভাবে শাস্তিদানকারী দ্রোণাচার্য শিক্ষক নন, উচ্চবর্ণের গুরু হয়েই থেকে যান।

মতাদর্শের দেখানেপনা নয়, মতাদর্শগত লড়াইটা লড়তে হবে ভেতর থেকে। তবেই বন্দনা কাটারিয়ারা মুক্তি পাবেন অবমাননা থেকে। মূলে আঘাত চাই, ডালে নয়।