আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

বিরোধী ঐক্য ও বিকল্প রাজনীতি


দিল্লির বর্ষাকালে চলছে বিরোধী ঐক্যের হাওয়া। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতার কারণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন, স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু, দেশের অর্থব্যবস্থার বেহাল অবস্থা ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যার মধ্যে সরকার পক্ষকে যে বিরোধীরা সংসদে চেপে ধরবেন তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু পেগাসাস সফ্টওয়ারের মাধ্যমে দেশের সমস্ত বিরোধী পক্ষ, পুলিশ, বিচারপতি সবার ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরে বিরোধীরা বুঝতে পারে যে জল মাথার উপর দিয়ে বইছে। অতএব, জোট বাঁধো, তৈরি হও।

কিন্তু জোট কতটা দৃঢ় হল? এই প্রশ্ন উঠবেই, কারণ জোট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেতৃত্ব নিয়ে মতানৈক্য স্পষ্ট। রাজ্যের শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রী দিল্লিতে নিজেদের পায়ের জমি শক্ত করতে চাইছেন। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মিটিং করছেন। কিন্তু রাহুল গান্ধী মিটিং ডাকলে যাচ্ছেন না। কৃষক আন্দোলন জন্তর মন্তরে ধরনা দিচ্ছে। বিরোধী দলের নেতারা একসঙ্গে সেই ধরনা মঞ্চে গেলেন। কিন্তু তৃণমূল অনুপস্থিত। তাঁরা আলাদা করে ধরনা মঞ্চে গেলেন। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী এবং অখিলেশ যাদব কোনো ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। অতএব, বিরোধী ঐক্যের মধ্যেই যে ফাটল রয়ে গেছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

এই কথা অনস্বীকার্য যে বিজেপি বিরোধী শক্তিদের এক মঞ্চে এসে একটি শক্তিশালী বিরোধী ঐক্য তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা আছে, যা দেশের মানুষের সামনে একটি রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজেকে হাজির করতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র সংসদে ‘ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট’ করলে সেই বিরোধী ঐক্য বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠবে না।

বিজেপি সরকারকে উৎখাত করতে হলে নিছক নির্বাচনী জোট করলে তা যথেষ্ট নয়। উত্তরপ্রদেশে বিগত নির্বাচনের ফলাফল থেকেই এই কথা পরিষ্কার। আসলে প্রয়োজন রয়েছে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক এবং জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক গণআন্দোলন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়েছে যে বিরোধী দলগুলি সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ। দেশে গত কয়েক বছরে যে ক'টি বড়ো আন্দোলন বিজেপি-র বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে তার কোনোটিরই নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ছিল না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া অথবা পুণের ফিল্প ইনস্টিটিউটের ছাত্র আন্দোলনে বিরোধী দলের নেতৃত্ব ছিল না। একইভাবে, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বিরোধী দলগুলি মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। জনগণ নিজেদের মত এই আন্দোলনগুলি করেছে বা করছে, শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও। বিরোধী দলগুলি এই আন্দোলনগুলির সঙ্গে সংহতি জানালেও তারা কখনই এই আন্দোলনগুলির কাছে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। এই না পারার মধ্যে জনগণের তরফে আসলে বিরোধী দলগুলির প্রতি একটি বার্তা রয়েছে। সেই বার্তাটি হল এই যে বিরোধী দলগুলিকে তারা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে না। এই অবিশ্বাসের নেপথ্যে রয়েছে অনেক জটিল কারণ। যার মধ্যে প্রধান হল বিরোধী দলগুলির স্বার্থান্বেষী রাজনীতি এবং কর্মসূচীগত ঐক্যের অভাব।

২০১৯ সালে রাম মন্দির বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত রায় আসার পরে কংগ্রেসের তরফে তাকে স্বাগত জানানো হল। মায়াবতী বলছেন যে, তিনি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় এলে রাম মন্দির বানানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করবেন। এনআরসি-র প্রশ্নে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস অসমে এনআরসিকে সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি কংগ্রেসের তরফ থেকে এই দাবিও করা হয় যে আসলে এনআরসি-র জনক তারাই। ছাত্রদের উপর নিপীড়ন নামিয়ে আনার প্রশ্নে কোনো বিরোধী দলের ইতিহাসই ইতিবাচক নয়। আবার আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নবউদারবাদী বেসরকারীকরণমুখী, কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে সংকোচনের নীতির জনক কংগ্রেস দল। তাই আর্থিক নীতির প্রশ্নেও জনগণ মনে করে না যে বর্তমান সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীদের অবস্থান চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার যোগ্য। অতএব, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই, সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন অথবা আর্থিক নীতি বিরোধী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে বিরোধীদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে এবং তাদের নিজেদের নীতি অনেক সময়েই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে তারা দেশে জাতীয়তাবাদের একটি বিকৃত ধারণা মানুষের সামনে হাজির করেছে। এই ধারণা সংখ্যাগুরুবাদের মাধ্যমে এই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে ভারতীয় হতে হলে হিন্দু হওয়া আবশ্যিক। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমরা বর্তমানে যেই স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি উদযাপন করছি, সেই আন্দোলনে যেই স্বাধীন ভারতের কল্পনা করা হয়েছিল, সেখানে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে সমানাধিকার দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। সমস্ত ধর্ম ও জাতির সমন্বয়ে নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠিত হবে যেখানে সরকার দরিদ্রতম অংশের মানুষের উন্নতি সাধন করবে, যার মাধ্যমে প্রত্যেক ভারতীয় ভারতের উন্নয়নের সুফল লাভ করতে সক্ষম হবে।

আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতের এই ধর্মনিরপেক্ষ সমানাধিকারের কল্পনাকে নস্যাৎ করেছে। তাই তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদত করতেও পিছপা হয়নি। দুঃখের বিষয় এই ব্রিটিশ পদলেহনকারী শক্তি বর্তমান ভারতে নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে 'ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচাতে হবে' বলা বাদ দিয়ে কোনো বিকল্প রাজনীতির দিশা দেখাতে পারেনি।

এই ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলির নবউদারবাদের প্রশ্নে অবস্থান। সমস্ত রাজনৈতিক দল আসলে নবউদারবাদকে অভ্রান্ত হিসেবে মেনে নিয়েছে। বামপন্থীরা এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তাদের সরকারের গৃহীত অনেক নীতির মধ্যেই নবউদারবাদের ছাপ স্পষ্ট ছিল। নবউদারবাদী নীতি গ্রহণের ফলে ভারতে আসলে দুটি দেশ গড়ে উঠেছে। বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য একদিকে মহাধনীদের জন্ম দিয়েছে, আর অন্যদিকে দেশের বিপুল অংশের মানুষ দারিদ্রে নিমগ্ন রয়েছে। আবার একটু ঘুরিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে এই ধনী সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসলে উচ্চ বর্ণের হিন্দু পুরুষ। ভারতের ডলার বিলিয়নেয়ারদের তালিকা দেখলেই এই কথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে।

কিন্তু ধনীদের এই গণতন্ত্র নির্বিঘ্নে পরিচালনা করার জন্য শ্রমিকদের অধিকারকে সংকুচিত করা আবশ্যিক। নবউদারবাদী নীতির ফলে শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন অথবা ছাত্র আন্দোলন দুর্বল হয়েছে। পুঁজির দাসত্ব করার জন্য নবউদারবাদী সরকারগুলি সমস্ত ধরনের যৌথ সংগঠনকে দুর্বল করেছে। ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র সংগঠন, কৃষক সংগঠন সবই দুর্বল হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের দাবিদাওয়া শত আন্দোলন করলেও বাস্তবায়িত হয় না। কিন্তু তাই বলে তো নবউদারবাদী পুঁজিবাদের প্রবণতা থেমে থাকে না, তা বৈষম্য বাড়াতেই থাকে। এই বাড়তে থাকা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়াও স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ক্ষোভকে সংগঠিতভাবে রাষ্ট্র তথা পুঁজির বিরুদ্ধে পরিচালিত করার জন্য যেই সংগঠনের প্রয়োজন সেই সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই দুর্বল। কিন্তু পড়ে থাকে জাত ভিত্তিক, ধর্ম ভিত্তিক সংগঠন সমূহ। অতএব, হিসেব করলে দেখা যাবে যে এই সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্ত নবউদারবাদী নীতির সময়কালে বেড়েছে। একই সঙ্গে নবউদারবাদী দর্শন মানুষকে শেখায় যে ব্যক্তির উন্নতিই সমাজের উন্নতি। অতএব, আগে নিজের কথা ভাবো। যৌথ সংগঠন দুর্বল, মানুষ হয়ে যাচ্ছে একা, ব্যক্তিস্বার্থ যখন দর্শনে পর্যবসিত তখন মানুষ বেছে নিচ্ছে ধর্মীয় সংগঠন, জাত ভিত্তিক সংগঠন, যেখানে সে নিজের মতই আরো বহু মানুষকে কাছে পাচ্ছে।

এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসেবে দেশের উন্নতি পর্যবসিত হচ্ছে পুঁজিপতিদের উন্নতিতে। এত শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি হলেই আমরা শক্তিশালী রাষ্ট্র। সেই বৃদ্ধির সিংহভাগ যে সমাজের একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি পকেটস্থ করছে তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। এই শক্তিশালী রাষ্ট্রের ধারণাকে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ।

অতএব, নবউদারবাদ বিরোধী স্বচ্ছ কর্মসূচী যদি বিরোধী দলগুলি গ্রহণ করে তার বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে প্রচার এবং আন্দোলন না করতে পারে তবে শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে বিজেপিকে হারানো সম্ভব হবে না। কিন্তু বিরোধী দলগুলির মধ্যে যে শুধু এই বিষয়ে মতৈক্য নেই তা নয়, তারা এই বিষয় নিয়ে আদৌ কি চিন্তিত?

নবউদারবাদ বিরোধী কর্মসূচীর রূপরেখা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা অন্যত্র করা যাবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে বলা যায় সবার শিক্ষা, সবার কাজ, কৃষকদের ফসলের দাম, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্যকে মানুষের মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া, ধনীদের আয় ও সম্পত্তির উপর বাড়তি কর চাপিয়ে সরকারী খরচ বাড়ানো ইত্যাদি নীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বামপন্থীরা এই বিষয়ে অনেক বছর ধরে বলছেন, লড়ছেন। সময় এসেছে সমস্ত বিরোধী দলের যৌথ ন্যূনতম কর্মসূচী গ্রহণ করার যার মূল ভিত্তি হবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমানাধিকার সহ নবউদারবাদ বিরোধী এই বিষয়গুলি। তা যদি না হয়, বিরোধী ঐক্য সুন্দর ছবি মুহূর্ত হয়েই থেকে যাবে।