আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

মারী ও মন্দার বিশ্বায়ন

জয়ন্ত আচার্য


১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ছয় মাস ধরে প্যারিস শহরে ঐতিহাসিক ভার্সাই রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠিত হল পৃথিবীর ৩২টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি যুগান্তকারী সম্মেলন। চার বছর আগে যে বিধ্বংসী ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি শান্তি চুক্তি করার জন্য এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি সহ বিজয়ী পক্ষের রাষ্ট্রনায়কেরা। বিজিত পক্ষের জার্মানি, তুরস্ক সহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরাও হাজির। আসন্ন চুক্তির সম্ভাবনা ঘিরে শুধু প্যারিসেই নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষের প্রত্যাশা বিপুল। তবে এই মহা সমারোহের চাকচিক্য ও ঢক্কানিনাদের মাঝে কারোরই তেমন নজর নেই একজন ছত্রিশ বছর বয়সী যুবকের দিকে যিনি সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের দলের সদস্য হয়ে বৃটিশ অর্থমন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে। বয়সে নবীন হলেও ইতিমধ্যেই কেমব্রিজে অধ্যাপনা করে সুনাম অর্জন করেছেন তিনি - জন মেনার্ড কেইনস। সম্মেলন কিছুদিন এগোতেই যে খসড়া চুক্তি পেশ করা হলো এবং যে সব শর্ত এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি বিজিত দেশগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করতে লাগলেন মহাবলী রাষ্ট্রনেতারা, তাতে বিচলিত হয়ে উঠলেন অর্থনীতিবিদ কেইনস। তাঁর মনে হলো এই চুক্তি সমগ্র ইওরোপের দুর্দশা ও অধোগতির কারণ হয়ে উঠবে। বিরক্ত হতাশ বিপর্যস্ত কেইনস তাঁর সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে ইংল্যান্ডের সাসেক্সের একটি খামার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন কিছুদিনের জন্য। ঐ নিভৃতবাসেই লিখে ফেললেন ১৫০ পাতার একটি চমকপ্রদ বই - “দি ইকনমিক কনসিকোয়েন্সেস অফ পীস”। সাড়া ফেলে দিল বিভিন্ন দেশে মহাদেশে। শান্তি চুক্তির অধিনায়ক আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন বৈঠকে জোর দিয়ে বলেছিলেন, এই শান্তি চুক্তির কোনও বিজয়ী পক্ষ নেই। এবার যুদ্ধহীন উন্নত পৃথিবীতে বাস করব আমরা। কিন্তু কেইনসের দূরদর্শিতা বিশ্বকে জানিয়ে দিল, শান্তি চুক্তির পরিণাম আবারও যুদ্ধ, আরও সঙ্কট।

সেই ভয়াবহ সঙ্কট সত্যিই এসে গেল দশ বছরের মধ্যেই। প্রথমে আমেরিকা, তারপর ক্রমে ক্রমে ইওরোপ এবং অন্য মহাদেশেও সঙ্কটের কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ল। অভূতপূর্ব অপ্রত্যাশিত এই মন্দা। শিল্পবিপ্লবের জাদুস্পর্শে যে দেশগুলিতে কলকারখানা ভিত্তিক উৎপাদনের ব্যাপক প্রসার ঘটলো, ব্যবসা বাণিজ্যের অবাধ বিকাশ হলো, নগরে বন্দরে রাজপথ জুড়ে বিপুল পণ্যরাশির কেনাবেচা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকল, সেই উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেই কোথা থেকে এল মন্দার কালো মেঘ? গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষের বছরগুলোতে বন্ধ হতে লাগলো একের পর এক কারখানা। বাজারে দোকানে কারখানায় জমতে থাকল অবিক্রীত পণ্যের স্তূপ। শিল্পে, খেত খামারে, ব্যবসায়ে, ব্যাঙ্কে, সর্বত্রই শ্রমিকরা কাজ হারানোর ফলে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকারে দেখা দিল। আমেরিকাতেই ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় জনসংখ্যার শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। ইওরোপের অন্যান্য দেশেও বেকার মানুষের লাইন দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। অথচ আমরা জেনে এসেছি অবাধ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এমন একটি আদর্শ ব্যবস্থা যেখানে শ্রমিক বেকার থাকবে না, কোনও সম্পদ যন্ত্র অব্যবহৃত অলস হয়ে পড়ে থাকবে না। এই ব্যবস্থায় চাহিদার কিছুমাত্র ঘাটতি বা অপ্রতুলতা দেখা দেবে না, জোগান এই ব্যবস্থায় তার চাহিদা নিজেই সৃষ্টি করে। তা সে পণ্যের জোগান হোক বা শ্রমের।

এই অর্থনীতিই তো পড়ানো হয়ে এসেছে দেশে দেশে, ইওরোপ আমেরিকায় কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির দর্শনেই তো দীক্ষিত উন্নত আধুনিক দেশগুলির প্রশাসন মহল এবং রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু এই অর্থনীতির ‘অর্থোডক্স’ পুঁথিপত্রে ও দর্শনে তো কোনও উত্তর মেলে না এই সঙ্কট কেন ঘটলো এবং কোন পথেই বা মুক্তি হতে পারে সে প্রশ্নের। কেইনস দেখালেন দেশের বেশিরভাগ মানুষের চাহিদা কমে যেতেই অর্থনীতির সর্বত্র এই মন্দা দেখা দিয়েছে। যে উপায়েই হোক, চাহিদা যাতে বাড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং প্রধানত দেশের সরকারকেই এই কাজটি করতে হবে। মহামন্দার ধাক্কায় টালমাটাল ইওরোপ, আমেরিকায় ত্রিশের দশক শেষ না হতেই রণদামামা বেজে উঠল - পৃথিবী দেখল আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ। মহামন্দা ও তার সঙ্গী মহাযুদ্ধ এই দেশগুলিকে দিল বিশেষ নতুন ভূমিকা। সব দেশেই সরকার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে শুরু করল। কলকারখানার উৎপাদন বাড়াতে, রেল, বন্দর নির্মাণে, অস্ত্রশস্ত্র, জাহাজ, এয়ারক্রাফ্ট উৎপাদনে, কখনও বা সরাসরি জনগণের হাতে আয় হস্তান্তর করে, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনে ঋণ নিয়ে বাজেটে ঘাটতি তৈরি করার মাধ্যমে দেশে চাহিদা বৃদ্ধি করা। যাতে হৃতসর্বস্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জনের হাতে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে। মৌলিক বার্তাটি হচ্ছে, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অধোগতির ব্যাধি অবাধ প্রতিযোগিতার বাজারের স্বতঃস্ফূর্ত চলার উপর ভরসা করে থাকলে সারবে না। সমাজে বুর্জোয়া এবং শ্রমের দাবির বিরোধ ঘটলে ইংল্যান্ডের এডওয়ার্ডীয় আভিজাত্যে লালিত কেইনস বুর্জোয়াদের পক্ষ অবলম্বন করার অঙ্গীকার করলেও, মুক্ত অবাধ বাজারের অপারগতা ও ব্যর্থতাকে সম্যক চিহ্ণিত করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধশেষেও বিধ্বস্ত অর্থনীতিগুলির পুনর্গঠন ও উজ্জীবনের জন্য গৃহীত ‘মার্শাল প্ল্যান’, ব্রেটন উডস্ পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে পৃথিবীর দেশে দেশে নানা মুদ্রা, উন্নয়নের নানা স্তর ও সম্পদের বৈষম্যের মধ্যেও আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্য আনার পরিকল্পনাতে বাজার ব্যবস্থার অক্ষমতার স্বীকৃতিই স্পষ্টভাবে ঘোষিত।

আজ শতবর্ষ পার হয়ে পৃথিবীর আবার অসুখ, গভীরতর অসুখ। মহামারী ও মহামন্দার উদ্যত আঘাতে উন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশের মানুষ ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ এর জুন মাস পর্যন্ত ১৮ কোটি মানুষ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে বহু লক্ষ জনের। ইতিহাসে অতীতের কিছু ভয়ঙ্কর মহামারীর বর্ণনায় শুনি এর চেয়ে অনেক বেশি জীবনহানির কথা। প্রথম মহাযুদ্ধের সমসাময়িক যে মহামারী ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ - তার আক্রমণে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান মহামারীর বিধ্বংসী ক্ষমতার পরিচয় শুধুমাত্র মৃত মানুষের সংখ্যার মাপকাঠি দিয়ে পাওয়া যাবে না। এর অনন্যতা মানুষের স্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতি-কে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুদূরপ্রসারী ক্ষমতার মধ্যে নিহিত। কারণ ভাইরাসের প্রকৃতি ও প্রভাব ছড়ানোর কৌশলের কারণে সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র পদ্ধতিই হচ্ছে মানুষকে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। এই দাওয়াই সর্বজনীন, দেশে মহাদেশে, উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধে সর্বত্রই এক। ইতিহাসের দুর্জ্ঞেয় পরিহাস হচ্ছে এই যে, সামাজিক জীব মনুষ্য প্রজাতিকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যথাসম্ভব গৃহ অন্তরালে থাকা, ‘আইসোলেশনে’ থাকা, দূরত্ব বিধি মেনে চলা বা পরস্পর নিকট সংযোগ না রাখা। মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটবার পর থেকে দেশে দেশে সব সরকারকেই এই বিধিনিষেধগুলি আরোপ করতে হয়েছে। তাই গত ২০ মাস ধরে অর্থনৈতিক কাজকর্ম, ব্যাবসা বাণিজ্য, বিনিময়, লেনদেন, রেল ও আকাশপথে যাতায়াত, কলকারখানার উৎপাদন, ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক গবেষকদের মধ্যে শিক্ষা বা চিন্তার আদানপ্রদান সব কমবেশি বন্ধ। দূরাগত বার্তা চালাচালির মধ্যে ব্যবসায়িক বৌদ্ধিক পৃথিবী এখন চলছে। বাকি সব স্তব্ধ। মহাকালদর্শী রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে তাঁর ‘পৃথিবী’ কবিতায় একটা ছবি দিয়েছিলেন - “অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী”। ঠিক যেন আজকের পৃথিবীর অবিকল বর্ণনা।

তাহলে মহামারীর এই বিশিষ্টতাই কী পৃথিবীজোড়া মহামন্দার সূচনা করল? নাকি ধনতন্ত্রের অন্তর্গত দুরপনেয় ব্যাধি থেকেই কী সংকট, সমৃদ্ধি, কর্মহীনতা, মন্দার অনিবার্য চক্রাকার আবর্তন? দুয়ের যুগলবন্দি কী পৃথিবীর সব উজ্জ্বলতা শুষে নেবে একসময়? এ সব প্রশ্নের সমাধান যথাসময়ে হোক। কিন্তু এখন প্রয়োজন মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞানের কীর্তি, সম্পদ, মেধা, প্রযুক্তি সমবেত ও সংহত করে পৃথিবী জোড়া অভিযান শুরু করা। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে, মানব সমাজ, মানব স্বাস্থ্য ও সভ্যতা বাঁচাতে হবে। এক বছর আগে আমেরিকার সরকার মহামারী ও মহামন্দা ক্লিষ্ট আমেরিকাবাসীর জন্য ৪ ট্রিলিয়ন ডলার-এর পরিত্রাণ চালু করেছে যা বিশ্বের বহু দেশের জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি। এবার সারা পৃথিবীর জন্য, বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার বহু দরিদ্র দেশ, অতি অনগ্রসর দেশগুলোর জন্য আমেরিকা, ইওরোপের দেশগুলি সহ রাশিয়া, চীন, ভারত প্রভৃতি এই বিশ্বের ২২৩টি দেশ মিলে এক ঐতিহাসিক কর্মসূচী নিক আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে ‘অচল অবরোধ’ মুক্ত করে, অসুখ সারিয়ে জীবনকে প্রতিষ্ঠা করতে। একবিংশ শতকে এই কাজে নেতৃত্ব দিক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিত্তশালী দুটি দেশ - আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন গণপ্রজাতন্ত্র।