আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

শংকরাচার্য্যের মায়াবাদঃ ধারে কাটে কি ভারে!

রঞ্জন রায়


প্রস্তাবনা

[অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় দর্শনের আধুনিক যুক্তিসিদ্ধ বিশ্লেষণের নিষ্ঠাবান পথিকৃৎ। আমরা পেরিয়ে এসেছি তাঁর জন্মশতাব্দী। তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে আমাদের ঐতিহ্যবাহী দার্শনিক স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জীবনবিমুখ হল শংকরাচার্য প্রণীত অদ্বৈত বেদান্তদর্শন যাকে আমরা সবাই মায়াবাদ বলে জানি।

আজ যখন গোটা দেশ জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে কেবল হিন্দুধর্ম, এবং একপেশে ভাবে তার একটা খন্ডিত বিকৃত রূপের প্রচার হচ্ছে তখন একটা কথা বারে বারে হাটেবাটে শোনা যাচ্ছে, তা’হল ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’। কাজেই জরুরি হয়ে পড়েছে ওই ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ নামপদটির প্রচারক শংকরাচার্য্যের দার্শনিক উপস্থাপনা ‘মায়াবাদ’ কতটা যুক্তির কষ্টিপাথরে টেঁকে সেটা খুঁটিয়ে দেখা। সেই অর্থে এই সামান্য প্রবন্ধটি এক অর্থে অধ্যাপক দেবীপ্রসাদকে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।]

মনে করুন, আগামিকাল অফিসে গিয়ে দেখলেন - সব কিছু বদলে গেছে। ওটা আর আপনার চেনা অফিস নেই, হয়ে গেছে একটা রেস্তোরাঁ বা মল; কেমন লাগবে? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! গিয়ে জানতে পারলেন আসলে কোন একটা ভুলে আপনি ভুল নামে ভুল ঠিকানায় ভুল অফিসে এতদিন চাকরি করেছেন। এমনকি আপনি এতদিন নিজেকে যা ভাবতেন আদতে তাও নন। আপনার নাম-গোত্র-পিতৃমাতৃপরিচয় সব আলাদা। কম্পিউটারে আপনার বায়োডেটা, আইডিনটিটি, সিভি সব পালটে গেছে।

এতদিন ঘুমঘোরে ছিলেন, এখন জেগে উঠলেন। তারপর? হয় পাগল হয়ে যাবেন, নয় আত্মহত্যা করবেন!

আরেকটা তৃতীয় পথ খোলা আছে - জানতে চাইবেন আসলে আপনি কে? কোনটা আপনার সঠিক পরিচয় - আগের আপনি, নাকি আজকের? কিন্তু আগে তো ঠিক করতে হবে সঠিক/বেঠিক মাপার পদ্ধতি কী হবে, কী করে বোঝা যাবে কোনটা ভুল বা কোনটা নিশার স্বপন? তাও নাহয় হল, এরপরে জানতে চাইবেন এই বিভ্রমের জন্যে দায়ি কে? আপনি নিজে? নাকি অন্য কেউ? যদি নিজে হন, তো এর কারণ কি আপনার মধ্যেই নিহিত, যেমন ব্রেনে টিউমার বা চোখে ছানি - অথবা বাইরের কোন শক্তি যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে?

এই তৃতীয় পথটি দর্শনের ছাত্রের পথ।

এতসব ভণিতা কেন করছি? কারণটা হল ভারতে বেদে আস্থাবান ছ’টি ‘আস্তিক’ দর্শনের মধ্যে একটি ঠিক এমনই কথা বলছে - ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। বলছে আপনার চারদিকের যে নামরূপের জগৎ তা’ আসলে অস্তিত্বহীন, একটা বিভ্রম বা মিথ্যে। ঠিক যেমন আলো-আঁধারিতে আমরা রজ্জুতে সর্প দেখে আঁতকে উঠি বা মরুভুমির উতপ্ত বালুতে সরোবর দেখে খুশি হই। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়।

এই দর্শনটির নাম অদ্বৈত বেদান্ত। এর প্রবক্তা হলেন আদি শংকরাচার্য, যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গী ওঁর আগে বেদবিরোধী বৌদ্ধদর্শনের মহাযানী শাখার দুটি স্কুল - শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদে বিকশিত হয়েছে।তাই ওঁর অদ্বৈত বেদান্ত মতকে অনেকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত’ও বলে থাকেন।

ভারতে হিন্দু সমাজে সনাতন ধর্মচর্চার আজ সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক স্কুল হল এই অদ্বৈতবেদান্ত।

এই দর্শনের মূল কথাটা - ‘এ সংসারটা ধোঁকার টাটি’ যদি মেনে নেই তাহলে আমাদের দেশ-কাল-সমাজ-ইতিহাস, আমাদের সুখ-দুঃখ, দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম সব তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। আমাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। ‘কা তব কান্তা, কস্তে পুত্রাঃ’ অর্থাৎ ‘কে তোমার প্রিয়া, কে তোমার সন্তান’ ভাবলে আমাদের বাস্তব জীবনে দুঃখের নিদান খোঁজা অর্থহীন।যখন বাস্তবে বাহ্যজগতের অস্তিত্বই নেই তবে কিসের দুঃখ, কিসের জীবনসংগ্রাম? মাথাই নেই তো মাথাব্যথা!

মানুষ এই জীবনকে একটা স্বপ্নের ঘোরে থাকা ধরে নিয়ে অপেক্ষা করবে কবে তার মোহমায়া থেকে মুক্তি মিলবে।

কাজেই একটু খুঁটিয়ে দেখতে চাই যে শংকরের ‘মায়াবাদ’ দার্শনিক স্তরে কতটা যুক্তিসম্মত।

শংকরের মায়াবাদের মূল বিন্দুগুলোঃ

ব্রহ্ম কী?

শংকরের মায়াবাদ নামের দার্শনিক তত্ত্বকে এককথায় বলতে গেলে দাঁড়ায়ঃ “ব্রহ্ম সত্য জগন্মিথ্যা জীবোব্রহ্মৈচ নাপরঃ”।

অর্থাৎ, উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য, একমাত্র অস্তিত্ববান; অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমরা চর্মচক্ষে যে বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখি তা অবাস্তব, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী; আদৌ স্থায়ী শাশ্বত সত্যবস্তু নয়। জীব বা ব্যক্তি আত্মা সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের থেকে অভিন্ন, তার কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।

ব্রহ্ম হলেন অনাদি অনন্ত। তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তিনি সচ্চিদানন্দ, অর্থাৎ একমাত্র সত্য ও বিশুদ্ধ চেতনস্বরূপ।

সত্যি ও মিথ্যের মাপদন্ড কী ? কেন শুধু ব্রহ্মই সত্য, আর সব মিথ্যে?

যা সময়ের সঙ্গে বদলে যায়, যার অস্তিত্ব ক্ষণিক, অর্থাৎ যা উৎপন্ন হয়ে আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তা’ অন্তিম বিচারে অসত্য বা মিথ্যে। তাই এই নামরূপের পরিবর্তনশীল জগত হল মিথ্যে। যেমন দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পাওয়াটা ক্ষণস্থায়ী। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়। দড়ি আগে যা ছিল, পরেও তাই থাকবে। এখানে দড়ি হল সত্য, সাপ হল মিথ্যা।

আর যার জন্ম-মৃত্যু নেই, যা উৎপন্ন ও ধ্বংস হয় না, যা শাশ্বত তাই হল সত্যি। তাই নির্গুণ ব্রহ্ম হল একমাত্র সত্য। তাই একে কোনো গুণ বা উপাধি বা বৈশিষ্ট্যে বেঁধে ফেলা যায় না।কারণ সমস্ত বিশেষণ গুণদোষ - সব সীমাবদ্ধ, সব পরিবর্তনশীল।

এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা কে?

নির্গুণ ব্রহ্ম আদৌ কোনো এক ক্ষণে এই ব্রহ্মান্ড বা জগৎ সংসার এসব সৃষ্টি করেন না, এবং কোনো বিশেষ মুহুর্তে ধ্বংসও করেন না। যা সৃষ্টি হয়নি তার ধ্বংসের প্রশ্ন অবান্তর। এই বিশ্বের আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। এর মায়াবী অস্তিত্ব রয়েছে শুধু জীবের আবিল বা ময়লা হয়ে যাওয়া চেতনায়।

অর্থাৎ, প্রচলিত অর্থে সৃষ্টি বা ধ্বংস বলতে যা বুঝি তা বাস্তবে হয় না। যা হয় তাহল একটা ধোঁকা, একটা বিভ্রম।

অবিদ্যার প্রভাবে আমাদের মলিন চেতনায় এই মায়ার সংসারের বিভ্রম নির্মিত হয় এবং সত্য জ্ঞান হলে মায়ার কাজল মুছে গিয়ে চোখের থেকে পর্দা সরে যায়। তখন বুঝি এ’বাহ্যজগত বাস্তবে অস্তিত্বহীন। এ রয়েছে আমাদের খন্ডিত চেতনায়। যেমন দড়ি দেখে সাপ ভেবে ভয় পেলাম। তারপর যেই কাছে গিয়ে ভাল করে দেখলাম যে ওটা সাপ নয়, আসলে দড়ি - অমনই ভয় কেটে গেল।

তাহলে সাপটা কোথায় ছিল আর কোথায় গেল?

সাপ ছিল আমার ভ্রমিত চেতনায় ক্ষণেক তরে। সঠিক জ্ঞান হতেই সে নেই হয়ে গেল। তেমনই এই মায়ার সংসার আসলে নেই, তাই কারও এসে সৃষ্টি বা ধ্বংস করার প্রশ্নটি এই মডেলে অর্থহীন। এ শুধু জন্মায় জীবের ব্যক্তিচেতনায় বিভ্রমের ফলে, তার আয়ু ওই আমাদের ভুল ভাঙা অবধি।

যেমন জাদুকরের জাদুতে মঞ্চে একটা হাতি দেখছি। আবার ম্যাজিকের মোহ বা আচ্ছন্নভাব কেটে যেতেই সেই হাতি মিলিয়ে গেল।

যেমন, কাদার তাল থেকে তৈরি হাঁড়িকুড়ি সব ক্ষণস্থায়ী; যে মাটি থেকে এসেছিল ক’দিন পরে তাই হবে। এভাবে হাঁড়িকুঁড়িকে কাদার তাল হিসেবে দেখাটাই সম্যক দর্শন। ঠিক এভাবেই নামরূপের দুনিয়া আসলে ব্রহ্মের থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মেই মিলিয়ে যায়। মরুভূমিতে জল দেখাও ওইরকম। ব্রহ্মান্ডকে ব্রহ্মের থেকে আলাদা করে দেখাটাই ভুল বা বিভ্রম।

তাহলে মুক্তি কী? মুক্তির পথ কী? ঈস্বরের আরাধনা?

না; কারণ ঈশ্বরেরও কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। পুজোপাঠ, ভজনকীর্তন, আরাধনার মাধ্যমে ব্যক্তি নিরাকার পরব্রহ্মকে সগুণ ভাবে, ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ভাবে। ওই দর্শন অদ্বৈতবেদান্ত নয়। ওতে দ্বৈতবুদ্ধি অর্থাৎ ঈশ্বর ও ব্রহ্মান্ড স্বতন্ত্র এই ভেদ থেকে যায়। সগুণ ব্রহ্ম উপাসকদের ভক্তিবাদ হল ঘুরপথ। ওসব অবান্তর।

মুক্তি বা মোক্ষলাভ হল পরব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধ হওয়া, তারজন্যে দরকার ভেদবুদ্ধি ছেড়ে জীবের ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদ বোধ। উত্তম পন্থা হল সোজা জ্ঞানমার্গের পথে সম্যকদৃষ্টি অর্জন। এই জ্ঞান অর্জনের জন্যে চাই শাস্ত্রের অধ্যয়ন।

পুজোপাঠের বদলে শাস্ত্রের অধ্যয়ন? কোন কোন শাস্ত্র? ধরুন ন্যায়শাস্ত্র (logic) পাঠে, মানে প্রত্যক্ষ অনুভব (perception), আর তার ভিত্তিতে যুক্তির প্রয়োগে অনুমানের (inference) মাধ্যমে কি পরব্রহ্মকে জানা যায় না?

না; প্রত্যক্ষ অনুভূতির সত্য আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্যজগত বা পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সত্য। আর পরিবর্তনশীল দুনিয়া নিজেই ক্ষণস্থায়ী, কাজেই অসত্য। এই ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তিপরম্পরা শুধু ব্যবহারিক সত্যের ক্ষেত্রে খাটে, পারমার্থিক সত্যের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়। তাই ব্রহ্মকে বা পারমার্থিক সত্যকে জানতে হলে শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ, বেদাদি শ্রুতি এবং মনু-পরাশর-যাজ্ঞবল্ক্য আদি স্মৃতির অধ্যয়নেই অজ্ঞান দুর হয়ে জ্ঞানের আলো দেখতে পাওয়া যায়।

অবিদ্যা কী? অবিদ্যা ও মায়া কী আলাদা? দুটোর কাজ কী?

অবিদ্যা হচ্ছে সেই দোষ যার জন্যে চেতনা মলিন হয়ে একমাত্র সত্য বস্তু ব্রহ্মের জায়গায় বাহ্যজগৎ বা মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, পাহাড়, নদী ইত্যাদি স্থাবর ও জঙ্গম বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সত্য বলে মনে হয়। যেমন চোখের দোষে আকাশে দুটো চাঁদ দেখা যেতে পারে বা আজকাল থ্রি-ডি ফিল্মে উপযুক্ত চশমা না পরলে দু’তিনটে মাথাওলা মানুষ দেখা যেতে পারে তেমনই অবিদ্যার প্রভাবে সত্যির বদলে মিথ্যাবস্তুর দর্শন হয়।

অবিদ্যার দুটো কাজ। এক, আসল রূপকে আবৃত করা। যেমন মেঘ এসে সুর্যকে ঢেকে দেয়। দুই, মায়াজালের মত কাল্পনিক কিছু সৃষ্টি করা।

যেমন সর্প-রজ্জু উদাহরণে বিভ্রান্তির ফলে দড়ির আসল চেহারা আবৃত হয়। তারপর সেখানে সর্প বলে এক ইমেজ সৃষ্টি হয় যা আসলে ওখানে নেই, যা পুরোপুরি কাল্পনিক।

অবিদ্যা ও মায়া একই প্রক্রিয়ার দুটো অংশ। অবিদ্যার ফলে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, সত্য আবৃত হয় আর তার জায়গায় যা দেখতে পাওয়া যায় তাই হল মায়া।

অবিদ্যা হল অনাদি, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে অবিদ্যার নাশ হয়। চেতনার মলিনতা ধুয়ে গিয়ে সমস্ত কিছু ব্রহ্মময় জ্ঞান হয়। যেন কুয়াশা সরে গিয়ে রোদ উঠল, আর মায়ার দুনিয়াটা ‘কোথায় বা কি ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’।

মায়াবাদের দার্শনিক কাঠামোঃ কিছু সমস্যা

শংকরাচার্য্য নির্মিত অদ্বৈত বেদান্ত বা মায়াবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোটি দেখা যাক। এতে আছে ব্রহ্ম, জীব, বাহ্যজগত, মায়া এবং অবিদ্যা। এদের পারস্পরিক সম্পর্কটি কীরকম?

প্রথমে রয়েছে পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম। তিনি নির্গুণ; তাঁকে কোনও বিশেষণে বাঁধা যায় না। তিনি বাক্য ও মনের অতীত। কিন্তু তিনি সর্বব্যাপী, অথচ দেশকালের সীমার বাইরে। তিনিই একমাত্র অস্তিত্ব বা সৎ, তাঁকে ছাড়া আর কিছুই নেই।

তাহলে বাকিরা?

বাহ্যজগতের অস্তিত্বই নেই। যা অনবরত প্রত্যক্ষ করা যায় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগত আসলে মায়ার খেলা। এই মায়া কি ব্রহ্মের শক্তি? না, এ হোল চেতনায় অবিদ্যার মালিন্যের ফলে সাময়িক বিভ্রম। সঠিক জ্ঞানের বোধ হলে অনিত্য দুনিয়া অস্তিত্বহীন হবে।

তাহলে এই দুনিয়া বাস্তবে ছিল না? এর অস্তিত্ব কেবল কারও চেতনানির্ভর? প্রশ্ন ওঠে কার চেতনা? অবশ্যই জীবের। ব্যক্তি আত্মার চেতনায়।

তাহলে অসংখ্য জীবের চেতনায় অসংখ্য মায়ার দুনিয়া? এবং যাদের তত্ত্বজ্ঞান হয় নি, তাদের চেতনায় বিশ্বব্রহ্মান্ড টিঁকে থাকবে আজীবন? এতে বেশ কিছু সমস্যা দেখতে পাচ্ছি।

এক, অবিদ্যার বা মায়ার শক্তি হল অদ্ভুত নতুন কিছু নির্মাণের, খানিকটা পি সি সরকারের ম্যাজিকের মত। কিন্তু অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন দেখছে তাজমহল, কুতুবমিনার বা আইফেল টাওয়ার। কয়েক দশক বা শতক ধরে কোটি কোটি মানুষ এদের অবিকৃত একই চেহারায় দেখছে। কেউ নিজস্ব আইফেল টাওয়ার বা তাজমহল দেখছে না। তাহলে এদের স্বতন্ত্র বাহ্য অস্তিত্ব স্বীকার না করে পারা যায়?

দুই, জীবাত্মার সংখ্যা বিগত তেরশ’ বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে সর্বত্র বেড়ে চলেছে - শংকরাচার্যের জন্মভূমিতে, গোটা ভারতবর্ষে এবং সমগ্র বিশ্বে। তাহলে কি এতগুলো বছর ধরে সমান্তরালে কয়েক’শ কোটি মায়ার বিশ্ব বা জগতও সৃষ্টি হয়ে চলেছে? কারণ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কোথায়? যদি থাকেনও, মানে যাদের চেতনায় অবিদ্যার ময়লা সরে গিয়ে ব্রহ্মান্ড লুপ্ত হয়েছে, তাদের সংখ্যা মাইক্রোস্কোপে দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। অষ্টম শতাব্দীতেই শংকর আফসোস করেছিলেনঃ
বালকাঃ সর্বে ক্রীড়াসক্তা,
তরুণাঃ সর্বে তরুণীরক্তা,
বৃদ্ধাঃ সর্বে চিন্তাবিলগ্ন
পরম্ব্রহ্মপর কোঅপি মগ্নঃ।।


বালকের দল মেতেছে খেলায়,
তরুণ-তরুণী বালুকাবেলায়
বুড়োদের বুঝি ধরেছে মাথা,
ব্রহ্মকে নিয়ে নেই কারও ব্যথা।।

আর চেতন জগতের মধ্যে শুধু মানুষ কেন? মানুষ ছাড়াও অসংখ্য প্রাণী রয়েছে, তাদের চেতনায়ও রয়েছে বাহ্যজগত। তাদের খন্ডিত অনুভবের উপর ভিত্তি করে তারা খাদ্যসংগ্রহ করে বেঁচে থাকে এবং নতুন সদস্যদের জন্ম দিয়ে নিজেদের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে। শংকরাচার্যের মডেলে এদের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো কথা নেই, যেমন নেই উপনয়ন না থাকার ফলে বেদ অধ্যয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত জনসংখ্যার অধিকাংশ সদস্য শূদ্র ও নারীদের কথা।

তিন, আর এই মডেলে শংকরাচার্য নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে? স্পষ্টতঃই এই স্ট্রাকচারের বাইরে এক স্বতন্ত্র মানুষ বা জীব হিসেবে। নইলে উনি কী করে দেখছেন সর্বব্যাপী ব্রহ্মকে এবং অসংখ্য জীবাত্মাকে আর সন্দেহ প্রকট করছেন বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে? উনি ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বা লীন হয়ে গেলে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য ও শিবাষ্টক স্তোত্র লিখতে পারতেন না।

‘লুনের পুতুল সাগর মাপতে গিয়েছিল। ফিরে এসে খপর দেয় নাই’ (কথামৃত)।

চার, ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে আধুনিক দর্শন চিন্তার জনক ফরাসী দার্শনিক রনে দেকার্ত যেমন বলেছিলেন - Cogito ergo sum (I think, therefore I exist.)! আমি চিন্তা করছি মানে আমি আছি, আমার অস্তিত্ব আছে। নইলে চিন্তা করছি কী করে? একই ভাবে শংকরাচার্য বিচার করছেন - ব্রহ্ম নিয়ে, জীবের ও বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব নিয়ে, মায়ার খেলা নিয়ে। এটাই প্রমাণ যে ওঁর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। ফলে ব্রহ্মের সাথে অভেদ হওয়ার তত্ত্ব, একাত্ম হওয়ার তত্ত্ব ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্বের প্রশ্নে এক নয়, বহুর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে।

সৎ বা অস্তিত্বের অদ্বৈতরূপ বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদের ধারণার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ শংকরাচার্য নিজে। যদি শংকরাচার্যের অস্তিত্ব মায়াবদ্ধ জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়, তবেই তিনি স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী হতে পারেন।অন্য ভাবে দেখলে বলা যায়, জগৎ মায়াময় কথাটি সিদ্ধ বাক্য্ হতে পারে তখনই যখন দ্রষ্টা নিজে এই মায়াময় জগতের ঊর্ধ্বে বিরাজমান হন। মায়ার জগতে দাঁড়িয়ে "এই জগৎ মায়াময়" তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা যুক্তি হিসাবে বিফল হতে বাধ্য (negation of negation)।

পাঁচ, প্রশ্ন ওঠে - উনি নিজে কতখানি বিশ্বাস করতেন নিজের তৈরি ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ মডেলটিকে? ব্যক্তিজীবনে উনি কিন্তু আদৌ ব্যবহারিক সত্যের এই দুনিয়াকে তাচ্ছিল্য করেননি। চষে বেরিয়েছেন ভারতবর্ষের এ’মাথা ও’মাথা; স্থাপন করেছেন চার-চারটে মঠ, গড়ে তুলেছেন সন্ন্যাসীদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করে দশনামী সম্প্রদায়। তারপর মাত্র ৩২ বছর বয়সে চলে গেছেন এই ‘মায়ার ভুবন’ ছেড়ে।

দেকার্ত আরও বলেছিলেন - মানুষ চিন্তাশীল জীব। মানুষের অস্তিত্ব ততক্ষণই আছে যতক্ষণ সে চিন্তা করছে। একই ভাবে শংকরাচার্য যেই অল্প বয়সে তাঁর মায়ার ভুবন ছেড়ে চলে গেলেন তখন তাঁর ভুবন এমনিতেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল। আলাদা করে ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমে অবিদ্যা দূর করা অর্থহীন হয়ে পড়ল। অর্থাৎ দেহের অবসানেই চেতনারও(তার অবিদ্যাজনিত মালিন্য সমেত) অবসান হচ্ছে। এটি শংকরের মডেলে অনুপস্থিত। কারণ তাহলে দেহের বাস্তব অস্তিত্ব এবং বাহ্যজগতের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। এও স্বীকার করতে হয় যে জীবের দেহধারণের সঙ্গে তার চেতনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

শংকরের প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বৈতবাদী ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা দেহ ও বাহ্যজগতের অস্তিত্ব স্বীকার করে এই ফাঁদে পড়েননি।

ছয়, অবিদ্যা - এই তত্ত্বটি শংকরের মডেলের অ্যাকিলিস হীল। এ ব্রহ্মের মতই অনাদি। কিন্তু যখন কোনো জীবের ব্রহ্মজ্ঞান হয় তখনই তার নাশ হয়। কিন্তু জীব তো গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানী ক’জন? বাকি কোটি কোটি মানুষের জীবৎকালে তাদের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত এই অবিদ্যা যে ভাইরাসের মত বেঁচে রয়েছে এবং ধ্বংস হবার বদলে মিউটেট করে টিকে রয়েছে। তাহলে নিত্যনতুন সৃষ্টি করার ক্ষমতায় এ তো প্রায় ব্রহ্মের প্রতিদ্বন্দ্বী।

অতএব, যেমন ‘গো করোনা, গো’ বলে যজ্ঞ করলে বা থালা বাজিয়ে শাঁখ ফুঁকে নিশ্চিন্ত হলে করোনা যায় না, বরং দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসে তেমনই সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম বলে ভেবে নিলেই বাহ্যজগত এবং তার দৈনন্দিন সমস্যাগুলো গায়েব যায় না বরং আরও করাল রূপ নেয়।

মোদ্দা কথা, অষ্টম শতাব্দীতে কেরালার কালাড়ি গ্রামে জন্মানো আদি শংকরের নিজস্ব ভুবন ছিল অত্যন্ত সীমিত। তাঁর দর্শনের মডেল এই বিশাল ডায়নামিক বিশ্বের প্রকৃতিকে বুঝতে অক্ষম হয়ে সোজাসুজি তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। কিন্তু চেতনাসম্পন্ন অসংখ্য জীব, শংকর নিজেও যার অংশ, তার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং লাগাতার বৈচিত্র্যময় বিস্তারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জাহির করছে যে জীব ও বস্তুজগত দস্তুরমত বাস্তব।

বাস্তব জীবনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল প্রয়োগ। যদি আমরা অতীতের অনুভব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার ভিত্তিতে বর্তমানে কোনো প্রয়োগ করে ভবিষ্যতে ফল পাই তাহলে মানতেই হবে বাহ্যজগত আছে, তার অনুভব মিথ্যে নয়। নইলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাই সার হত।

মানুষ আজ চাঁদের বুকে পা রেখেছে। এ জিনিস স্পষ্টতঃ শংকরের কল্পনার বাইরে। ব্রহ্মের অস্তিত্ব দার্শনিক স্পেকুলেশনের বিষয়, শাস্ত্রবচন ছাড়া যার কোনো স্বতন্ত্র বা যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাহ্যজগতের স্পন্দনকে তেরশ’ বছর আগের তুলনায় আজ অনেক বেশি করে টের পাওয়া যাচ্ছে এই প্রয়োগের মাধ্যমে।

স্পেকুলেটিভ ফিলজফির তত্ত্ব প্রয়োগের কষ্টিপাথরে বারবার যাচাই করে শোধন না করলে তা’ অসার প্রকল্প বা বুদ্ধিবিলাস (sophistry) হয়ে যায়। শংকরের মায়াবাদের মডেলেও নির্গুণ ব্রহ্ম, অসংখ্য জীব, অনাদি অবিদ্যা এবং মায়া তাদের আপাত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে প্রকট। তাদের এড়িয়ে গিয়ে সমস্তই ব্রহ্মময় প্রকল্পটি দার্শনিক স্তরে একটি জোড়াতালির বেশি মনে হচ্ছে না।

আর একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

মজার ব্যাপার হল, রামানুজ দেখিয়েছেন যে ‘অবিদ্যা’ - যার অস্তিত্ব আছে আবার নেই, মানে যা বাস্তবও নয়, অবাস্তবও নয় - এমন কোনো সংজ্ঞা বেদে বা উপনিষদে কোথাও নেই। এটি শংকরাচার্য্যের সৃষ্টি যাতে তাঁর মায়াবাদের মডেলটি দাঁড়ায়।

কিন্তু ‘মায়া’ শব্দটি আছে। মায়া অসত্য বা মিথ্যা নয়। মায়া হল বিস্ময়কর কিছু সৃষ্টি করার শক্তি। সৃষ্টিশীল প্রকৃতিকেই মায়া বলে সম্বোধন করা হয়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, ‘মায়াধারী ঈশ্বর মায়ার শক্তিতে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত জীব মায়ার বাঁধনে বদ্ধ’। স্পষ্টতঃ ‘মায়া’ ঈশ্বরের কোনো ‘অভাব’ বা ‘বিকৃতি’ বা ‘অবিদ্যা’ নয় বরং জীব মায়ার অধীন। বৃহদারণ্যক বলছে “ঈশ্বর মায়ার শক্তিবলে এক থেকে বহু হলেন’। এখানে মায়া বলতে ঈশ্বরের বহুমাত্রিক শক্তির কথা বলা হয়েছে।

তাহলে শংকর যুক্তিতর্কের বদলে সর্বোচ্চ প্রমাণ বলে যে বেদ-উপনিষদের দোহাই দিচ্ছেন সেখানেও নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের সমর্থন নেই। বরং এই বিশ্বব্রহ্মান্ডকে ঘোর বাস্তব বলেই বর্ণনা করা হয়েছে।

মায়াবাদের যুক্তিপরম্পরাঃ দুই সত্যঃ শাস্ত্র সর্বোচ্চ প্রমাণ

শংকরের দর্শনের যুক্তিপরপম্পরার বিচার করতে বসলে খেয়াল রাখা দরকার উনি প্রথমেই ন্যায়শাস্ত্রের যে কাঠামো, প্রত্যক্ষ (perception) - অনুমান (inference) - প্রমাণ (proof) তাকে খারিজ করে শাস্ত্রবচনকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

উনি জানেন যে প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা বাইরের জগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ে সংযোগে প্রাপ্ত সংবেদন (perception) হল শ্রেষ্ঠ প্রমাণ, কারণ এটাই অনুমানের (inference)তথা সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এবং শাস্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুভবের বিরোধ হলে প্রত্যক্ষকেই গুরুত্ব দেয়া হবে।কিন্তু উনি মনে করেন বেদ আদি শ্রুতি এবং মনু আদি স্মৃতিশাস্ত্র হল এই নিয়মের ব্যতিক্রম।কারণ ওরা অপৌরুষেয়, স্বতঃপ্রকাশ, এবং নিজেরাই স্বতন্ত্র জ্ঞানের উৎস। যদিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ব্যাখ্যায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রত্যক্ষ অনুভব সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে শ্রুতি ও স্মৃতিকে বেশি মানতে হবে। এর পরে উনি ব্রহ্মসূত্রের মূল ভাষ্যে বলছেন শাস্ত্রবচনকেই মেনে নেওয়া উচিত, তর্কবিচারকে নয়। কারণ তার্কিকরা নিজেরাই যে সহমত নন। এমনকি কপিল, কণাদের মত দার্শনিকরাও সত্যের স্বরূপ নিয়ে সহমত হননি। কাজেই যুক্তি যত ভালই হোক, তা’ যদি শাস্ত্রবচনকেই খন্ডন করে তখন শাস্ত্রকেই মানতে হবে। কারণ ব্রহ্মকে বুঝতে হলে শাস্ত্রই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ।

কিন্তু এখানেই শংকরের মুশকিল শুরু। ওঁর যুক্তি ওঁরই বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে বেদ ও স্মৃতির অনেক শ্লোক পরস্পরবিরোধাভাসী এবং তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদে অনেক দার্শনিক স্কুল গজিয়ে উঠেছে। এমনকি একই ব্রহ্মসূত্র এবং তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক আদি উপনিষদে আস্থাশীল দার্শনিকেরাও নিরাকার ব্রহ্মের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন না। মহাভারতের বনপর্বে বকরূপ ধর্মের কঃ পন্থা প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন - “বেদাঃ বিভিন্নাঃ, স্মৃতয়োর্বিভিন্না, নাসৌমুনির্যস্য মতংনভিন্নম”। এককথায় নানা মুনির নানা মত।

এছাড়া বিরুদ্ধবাদীরা এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন - যদি কিছু যুক্তি তোমার ভিত্তিহীন বলে মনে হয়, তার থেকে কী করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে ওই ধরনের সব যুক্তিই ভিত্তিহীন?

লক্ষণীয়, এখানে শঙ্করাচার্য্য নিজেও inductive generalisation-এর logic ব্যবহার করছেন, যে logic তিনি আগে খারিজ করেছেন।

এভাবে যদি সমস্ত যুক্তিতর্ক ব্যাপারটাকেই(প্রত্যক্ষ থেকে অনুমান হয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া) খারিজ করে দেওয়া হয় তাহলে বাস্তব মানবজীবন থমকে দাঁড়াবে। কারণ মানুষ পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই জীবনে কোনো পদক্ষেপ নেয়। তার উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখের থেকে মুক্তি এবং আনন্দ পাওয়া।

আর এটা কোনো যুক্তি হল না যে বড়ভাই যদি হাবা বা মূর্খ হয় তবে ছোটজনও তাই হবে।

এখানে লজিকের বিরুদ্ধে শংকরের যুক্তিটি এরকমঃ
কিছু যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত ভুল এবং নির্ভরযোগ্য নয়।
মায়াবাদ খন্ডনও একটি যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
অতএব, মায়াবাদ খন্ডনের যুক্তিটি নির্ভরযোগ্য নয়।

এভাবে যুক্তিতর্কের জায়গায় শ্রুতি ও স্মৃতিকে অন্তিম প্রমাণ বললেও শংকরকে রামানুজের সগুণ ব্রহ্ম এবং সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈনমত খন্ডনের জন্যে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছে। কারণ, উনি বিশেষ একটি দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠা করতে চান। ব্রহ্মসূত্রের শাংকরভাষ্যের দ্বিতীয়ভাগের পুরোটাই অন্যমত খন্ডনে নিযোজিত।

সেখানেও শংকর প্রতিপক্ষের যুক্তিতে কোণঠাসা হলেই শাস্ত্রবিরোধী তর্ক স্বীকৃত নয় বলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। এ যেন আদালতে প্রমাণ করতে না পারলে কাউকে দেশদ্রোহী বলে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আইনে জেলে পুরে দেয়া। অনেকেরই মনে পড়বে জনকসভায় গার্গীর প্রশ্নের উত্তর দিতে অসমর্থ হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের ধমক - অধিক প্রশ্ন করলে মাথা খসে পড়বে!

স্থানাভাবে মাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ বিরোধীপক্ষ বলছেন - ব্রহ্মকে সৃষ্টির আদি বা উপাদান কারণ বললে মানতে হয় যে ক) সমগ্র ব্রহ্ম সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাহলে আর ব্রহ্ম রইল কোথায়? কেবল সৃষ্টিই রইল। কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী ব্রহ্ম তো অবিনশ্বর, তাহলে?

খ) যদি বলা হয় গোটা ব্রহ্ম নয়, তার অংশমাত্র সৃষ্টিতে রূপান্তরিত, কাজেই বাকি অংশ তো বেঁচে রইল, (ছান্দোগ্য, ৩.১২.৬)।

তাহলে মানতে হয় ব্রহ্ম অনেকগুলো টুকরো বা খন্ড দিয়ে তৈরি। কিন্তু শ্রুতি তো ব্রহ্মকে অখন্ডমন্ডলাকার বলে, তাহলে শাস্ত্রও পরস্পরবিরোধী কথা বলে? এ তো অযৌক্তিক।

তখন শংকর যুক্তি ছেড়ে সোজাসুজি বলেন, মানছি কিন্তু এ’ব্যাপারে শাস্ত্রে বলা আছে ব্রহ্মই সৃষ্টির আদিকারণ, ব্যস।

শেষে শংকর পেশ করেন দুই সত্যের তত্ত্ব - ব্যবহারিক সত্য ও পারমার্থিক সত্য। একটা আপেক্ষিক (relative),অন্যটি পরম (absolute)। উনি আরও বলেন যে প্রচলিত ন্যায়পদ্ধতি শুধু দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সত্যের বেলায় খাটে। পারমার্থিক সত্য বা ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে কেবল শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই প্রমাণ।

রামানুজ দুই সত্যের তত্ত্ব মানেন না। ওঁর বক্তব্য হল দুটো পরস্পরবিরোধী জিনিস একসাথে সত্য হতে পারে না এবং সে’ক্ষেত্রে শাস্ত্রবাক্যের চেয়ে প্রত্যক্ষ অনুভব উত্তম প্রমাণ।

রজ্জুতে সর্প দর্শনের ভ্রান্তি

বলা হচ্ছে যে দড়ি হল সত্যি, কিন্তু আলোআঁধারিতে যে সাপ দেখছি সেটা অবিদ্যা বা মায়ার নির্মাণ। কেন? আসলে দড়ি কিন্তু দেখলাম সাপ। ওখানে দড়িই আছে, সাপ নেই। এটাই মায়ার খেলা। তেমনই আসলে রয়েছে ব্রহ্ম, আমরা অবিদ্যার ফলে দেখছি মায়াজাল, দেখছি নানারঙের এই দিনদুনিয়া।

এখন আরিস্ততলীয় ত্রিপদী লজিকের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব ভারতীয় ন্যায় হল পঞ্চপদী। মানে তাতে পাঁচটি বাক্য, তিন নম্বরটি উদাহরণ। দেখুনঃ
পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। (সাধ্য বা যা প্রমাণ করতে হবে)
যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন। (হেতু বা কারণ)
যেমন, রান্নাঘরে। (হেতুর বাস্তব উদাহরণ)
পাহাড়ে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। (হেতু ও সাধ্যের সমাবেশের উল্লেখ)
তাহলে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। (সিদ্ধান্ত)

এই সিস্টেমে তিন নম্বর মানে উদাহরণ হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপনি যদি এই উদাহরণের একটিমাত্র ব্যতিক্রম দেখাতে পারেন, অর্থাৎ এমন একটা বাস্তব উদাহরণ যাতে ধোঁয়া থাকলেও আগুন নেই, তাহলেই যুক্তিটি বাতিল মনে করা হবে। অর্থাৎ দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পাওয়ার উদাহরণে যদি দেখা যায় যে উদ্ভট কল্পনা ছাড়া কোথাও সাপ বলে কিছু নেই বা থাকলেও সাপকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তবেই মায়ার সাপ যুক্তিটি দাঁড়ায়, নইলে নয়।

তাই উদাহরণটি খুঁটিয়ে দেখা যাক।

এক, যদি এই ভ্রান্তি ম্যাজিশিয়ানের মত মায়ার খেলা হত, তাহলে সবাই একসঙ্গে ওখানে সাপ দেখত, দড়ি নয়। কিন্তু একই সময়ে কেউ কেউ সাপ দেখবে, অন্যেরা দড়ি। এটা নির্ভর করবে স্থান-কাল, আলো-আঁধারি, যে দেখছে তার চোখের অবস্থা সব মিলিয়ে।

দুই, যে কখনও সাপ দেখেনি সে কি বাঁকা হয়ে পড়ে থাকা দড়িতে সাপ দেখবে? আদৌ নয়। তাহলে যারা সাপ দেখছে তারা আগে সাপের বাস্তব অস্তিত্ব দেখেছে। মানে সাপটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক বা উদ্ভট কিছু নয়।

তিন, দড়িতে সাপই কেন দেখে? হাতি কেন নয়? তার মানে কোথাও সাপ ও দড়ির মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।

চার, এই দেখার ভ্রান্তি যদি অবিদ্যা বা মায়ার খেলা হত তাহলে এমন সব অদ্ভুত জিনিস দেখা যেত যার সঙ্গে দড়ির কোনো সম্পর্ক নেই।

পাঁচ, সাপকে পুরোপুরি মিথ্যে বলছি কী করে? আমাদের অভিজ্ঞতায় সাপ রয়েছে, তার ছোবলমারার স্বভাব এবং বিষের প্রভাব জানার ফলে ভয় রয়েছে।খালি সাপটা সেই সময় সেই জায়গায় নেই, ওইটুকুই।

ছয়, কেবল রজ্জুতে সর্পভ্রম কেন? সর্পে রজ্জু ভ্রমও তো হয়।বাস্তব জীবনে দড়ি ভেবে সাপের ছোবল খেয়েছে এমন অভিজ্ঞতা বিরল নয়। এর দার্শনিক তাৎপর্য হল দড়ি ও সাপ উভয়েই বাস্তব, কোনটাই মায়া নয়। দুটোরই দার্শনিক স্ট্যাটাস সমান - অভিজ্ঞতালব্ধ বাহ্যবস্তু। ভুলটা সাপের বা দড়ির নয়, তৃতীয় ব্যক্তির দেখার। তাই ও দুটোর সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানতে হবে। অর্থাৎ, সর্প-রজ্জু-ন্যায় অনুসরণ করলে ব্রহ্ম (রজ্জু), বাহ্যজগত (সর্প) এবং ব্যক্তিজীবটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।

স্বপ্নো নু, মায়া নু, মতিভ্রমো নুঃ দুই দুনিয়ার তত্ত্ব

অদ্বৈত বেদান্ত বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব খারিজ করতে গিয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ নিয়ে আসে। তাহল স্বপ্ন।

মোদ্দা কথা, আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের চেতনার বা অনুভূতির বাইরে কোনো বাহ্যজগত আছে?

কেন পারি না? আমরা প্রতিনিয়ত ইন্দ্রিয়ের সংযোগে ছুঁয়ে দেখে শুনে চেখে যে অনুভূতি পাচ্ছি তা কি মিথ্যে হতে পারে?

হ্যাঁ, পারে। তুমি খালি অনুভূতিই পাচ্ছ, কিন্তু কী করে নিশ্চিত হচ্ছ যে অনুভূতির পেছনে বা বাইরে কোনো বস্তু রয়েছে?

এটা কী কথা হল? এখন ঘরে এই টিভিসেটটা দেখতে পাচ্ছি। আমি যদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাই তাহলে কি সেটটা ওখানে থাকবে না?

কী করে নিশ্চিন্ত হচ্ছ? যদি কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে?

আরে তাহলেও তো আবার যখন ঘরে গিয়ে দেখব তখন টের পাব যে ওটা নেই, তখন থানায় গিয়ে ডায়েরি করব।কিন্তু টিভিসেটের অস্তিত্ব যদি আমার চেতনার উপরই নির্ভর করত তাহলে আমি ঘরেই থাকি বা বাইরে, টিভিটা সবসময় দেখতে পেতাম। কারণ টিভি আমার ঘরে নেই, চেতনায় রয়েছে।

এই প্রশ্নে - অর্থাৎ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব কি কেবল ব্যক্তিমানুষের চেতনায় - আইন্সটাইন ও রবীন্দ্রনাথের চিত্তাকর্ষক কথোপকথন রয়েছে। তাতে অবশ্য আইনস্টাইন বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব ব্যক্তিনিরপেক্ষ বলে জানিয়েছিলেন।রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের অনুপস্থিতিতে বস্তুর অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত হতে পারে না।

মনে করুন, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে”।

মায়াবাদী বলবেন - সমস্যাটা বুঝতে পারছ না। দেখ, স্বপ্নেও অমন অনুভূতি হয়, যেন আমি কোন বস্তু ছুঁতে দেখতে শুনতে বা চাখতে পারছি, তার মানে কি ওটা আছে? জেগে টের পাচ্ছ সব ভোঁ-ভাঁ, - ‘নিশার স্বপনসুখে সুখী যে কী সুখ তার, জাগে সে কাঁদিতে’। তেমনই এই যে নামরূপের বাহ্যজগত, হতে পারে আসলে তুমি স্বপন দেখিছ, জাগিয়া দেখিবে ওটা মিথ্যা। কাজেই ইন্দ্রিয়য়ানুভূতি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে বাহ্যজগত আছে, ওটা কোনো পাক্কা প্রমাণ নয়। শাস্ত্রবাক্য শোনঃ ‘ইন্দ্রজালমিব মায়াময়ম, স্বপ্নমিব মিথাদর্শনম’।

এই মিথ্যাদুনিয়া হল ইন্দ্রজালের মত মায়াময়, যেমন স্বপ্নে টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা প্রত্যক্ষানুভূতি সত্যের কোনো গ্যারান্টি নয়, অমন অনুভূতি স্বপ্নেও হয়। আর জেগে উঠলে ভুলটা টের পাওয়া যায়। মানে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হল স্বপ্নলব্ধ জ্ঞান অথবা হ্যালুসিনেশনের মত প্রমাণ - নির্ভরযোগ্য নয়; কেবল শাস্ত্রের জ্ঞানই ভরসা করার মত।

এই যুক্তিটির দুটো স্টেপ।

এক, স্বপ্নে বা হ্যালুসিনেশনে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে যে অনুভূতি হয় সেটা মিথ্যে বা ধোঁকা। দুই, কাজেই বস্তুজগতের অস্তিত্বের ব্যাপারে যত প্রত্যক্ষানুভূতি সব ওই স্বপ্নের মত মিথ্যে বা ধোঁকা।‘এ সংসারটা ধোঁকার টাটি’(কথামৃত)।

উত্তরপক্ষঃ আমাদের দুটো আপত্তি।

এক, কয়েকজন মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছে। তার মানে কি আদালতে সবার সাক্ষ্য মিথ্যে? কোনো কোনো পুলিশ ঘুষ খেয়েছে। তার মানে কি সব পুলিশ ঘুষ খায়?

দুই, স্বপ্নের অনুভূতিকে মিথ্যা বলছ কিসের ভিত্তিতে? তার মানে জাগ্রত অনুভূতিকে সত্যি বলে মানছ। একটাকে সত্যি না বললে আরেকটাকে মিথ্যে বলছ কী করে? তোমরা তো স্বপ্নের উদাহরণ দিয়ে সব অনুভূতিকেই খারিজ করে দিচ্ছ।

মায়াবাদীঃ মূল পয়েন্ট মিস করছ। তুমি জেগে আছ নাকি ঘুমিয়ে রয়েছ তাই বা বুঝছ কেমন করে? হতে পারে যে এই বিতর্কটি স্বপ্নের ঘোরে করছ? স্বপ্ন এবং জাগ্রত দুটো অবস্থার অনুভূতিতে এত মিল যে ফারাক করা মুশকিল। হতে পারে যে বিশ্বে তুমি রয়েছ সেটা স্বপ্নের দুনিয়ায় অবস্থিত। আসল বিশ্ব ব্রহ্মজ্ঞান হলে চিনতে পারবে।

‘গোরী চুনরিয়া আত্মা মোরী মৈল হ্যায় মায়াজাল।
ও দুনিয়া মোর বাবুলকে ঘর, এ দুনিয়া শ্বশুরাল’।।

উত্তরপক্ষঃ
এক, স্বপ্নে অনুভূতির সময় অপেক্ষিত ইচ্ছেপূরণ (সুখপ্রাপ্তি বা বেদনার উপশম)হয় না। জাগ্রত অনুভূতিতে সেটা হয়।এটা দিয়ে তফাৎ বোঝা যায়।যেমন স্বপ্নে গেলাস গেলাস জল খেলেও তেষ্টা মেটে না। জেগে উঠে জল খেলে মেটে।

দুই, ন্যায়শাস্ত্র অনুযায়ী একটি প্রমাণ পরবর্তী কোনো ওজনদার বিপরীততথ্য বা প্রমাণের জোরে খারিজ না হলে তাকে সত্য বলে মানতে হবে। যেমন স্বপ্নের অনুভূতিকে জাগ্রত অনুভূতি খারিজ করে দেয়। তারপর যদি কোনো অনুভূতি জাগ্রত অনুভূতিকে খারিজ না করে তাহলে বুঝতে হবে দ্বিতীয় অনুভূতিটি সত্যি, মানে জেগে আছি। একে বৌদ্ধ দার্শনিক শুভগুপ্ত বলছেন ‘অবিসম্বাদদৃষ্টি’।

পূর্বমীমাংসার কুমারিল ভট্টের মতে ‘স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাহ্যজগতের ব্যাপারে যা অনুভব করি তা’ সত্যি। কারণ এটা এমন জ্ঞান যাকে অন্য কোনো পরবর্তী জ্ঞান এসে খারিজ করেনি। যেমন জাগ্রত অবস্থার অনুভূতি স্বপ্নের অনুভূতিকে খারিজ করে।

উপসংহার

উপরের আলোচনার ভিত্তিতে এটা দেখতে পাচ্ছি যে শংকরের মায়াবাদের মেটাফিজিক্যাল স্ট্রাকচার বা অন্টোলজি বেশ গোলমেলে। রামানুজের মত সোজাসুজি মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তাঁর সচেতন ইচ্ছার ফল বললে মডেলটা বেশ আঁটোসাটো হত। কিন্তু উনি আনলেন এক অতিরিক্ত ধারণা ‘অবিদ্যা’ যে ব্রহ্মের মতই অনাদি কিন্তু ব্রহ্মের অংশ বা মহিমা নয়। অথচ সে এমন শক্তিশালী যে চেতনাকে আবিল করে গোলাপি হাতি দেখাতে পারে। সে বাস্তব(সৎ) বা অবাস্তব কোনোটাই নয়। সে যে কী তাও পরিভাষায় ধরতে না পেরে উনি ‘অনির্বচনীয়’ বা ভাষায় বলা যায় না বলে কাটিয়ে দিলেন।

জ্ঞানতত্ত্বের কথায় বলতে হয় যে উনি যুক্তির ব্যাপারে মুশকিলে পড়লে শাস্ত্রবাক্যের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য স্কুলের আস্তিকেরা দেখিয়েছেন যে তাঁর ব্যাখ্যাই উপনিষদের শ্লোকগুলোর সর্বমান্য ব্যাখ্যা নয়।‘অবিদ্যা’ শব্দটি উপনিষদে নেই।

তাহলে কি এটি শংকরের নিজস্ব ইন্টেলেকচুয়াল সংযোজন? তা’নয়, এই অবিদ্যা এবং দৃষ্টিবিভ্রম, দু’রকম সত্য ও স্বপ্নের উদাহরণ আগেই ভারতীয় দর্শনের আঙিনায় এসে গেছল, যদিও বৈদিক সাহিত্যে নয়।

এনেছিলেন মহাযানী বুদ্ধিজমের দুই দিকপাল দার্শনিক - নাগার্জুন (শূন্যবাদ) এবং বসুবন্ধু (বিজ্ঞানবাদ)। এবং তাঁরা ও ধর্মকীর্তি শংকরের কয়েক শতাব্দী আগে ওই প্রশ্নগুলোকে নিজের নিজের অবস্থান থেকে আরও ভালভাবে পেশ করেছিলেন।

আরেকটি কথা। শংকর বারবার মনুস্মৃতিকে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। তাই শাস্ত্রকে সঠিক জ্ঞানের একমাত্র উৎস(শাস্ত্রয়োনিত্যাৎ) বলেও মনুর কথা মেনে সমাজের খেটে খাওয়া বড় অংশ শূদ্রদের ওই জ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত রাখার বিধান দিয়ে গেছেন। কারণ যাদের উপনয়ন-সংস্কার হয় না (শূদ্র ও সমস্ত বর্ণের নারীরা) তারা বেদপাঠের অধিকারী নয়।

শুধু তাই নয়, মনুস্মৃতি মেনে অনুমোদন করছেন যে শূদ্র যদি কান দিয়ে বেদ শোনে তবে শাস্তিস্বরূপ তার কানে গরম সীসে ঢেলে দিতে হবে, বলা বাহুল্য অন্য শাস্তিও অনুমোদিত - “শ্রবণাধ্যয়নার্থপ্রতিষেধাৎ শৃতেশ্চ”।

আমার প্রশ্ন যদি সবই ব্রহ্মময় হয়, যদি ব্রহ্মের সঙ্গে নম্বুদ্রিব্রাহ্মণ শংকরাচার্য্য ও শূদ্রের কোনো ভেদ না থাকে তাহলে তাদের জ্ঞানপ্রাপ্তির প্রচেষ্টায় শাস্তি দেওয়ার বিধান কেন? তাহলে কি ব্যবহারিক দুনিয়া শংকরাচার্য্যের জন্যেও বিশেষভাবে অস্তিত্ববান?

আর দার্শনিক স্তরে যদি জাগ্রত ও স্বপ্নের দুনিয়ার মধ্যে ফারাক করা কঠিন হয় এবং রজ্জুতে সর্পভ্রমের মত সর্পে রজ্জুভ্রমেরও সমান সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ব্যবহারিক দুনিয়া যে সত্যি এবং পারমার্থিক দুনিয়া স্বপ্নবৎ হবে না সেটা কে বলতে পারে?

______________________________

1. ভারতীয় পরম্পরায় ‘আস্তিক’শব্দের অর্থ বেদে আস্থাবান, দর্শনটি ঈশ্বরবিশ্বাসী হোক বা না হোক। তাই বেদকে নির্ভুল বা স্বতঃপ্রমাণ মানে যে ছয়টি দর্শন - সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত) হল আস্তিক দর্শন। যদিও এদের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক ও পূর্বমীমাংসা নিরীশ্বরবাদী; কিন্তু বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসা ঈশ্বরবাদী। বলা যেতে পারে যে ন্যায় সৃষ্টির আদিকারণ বা ‘মেটিরিয়াল কজ’ হিসেবে ঈশ্বরকে স্বীকার করে না বটে, কিন্তু নিমিত্তকারণ বা ‘এফিশিয়েন্ট কজ' হিসেবে স্বীকার করে।

অথচ তিনটে দর্শন - চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ - শুধু বেদবিরোধী বলে নাস্তিকের তকমা পেয়ে গেল।

2. বীরেশ্বরানন্দ সম্পাদিত ‘ব্রহ্মসূত্র” (শাংকরভাষ্য),অধ্যাস, পৃঃ ১, (অদ্বৈত আশ্রম প্রকাশিত)।
3. বিভিন্ন উপনিষদ যেমন বলছেঃ
“ব্রহ্ম হলেন সত্য,জ্ঞান ও অনন্ত”, (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.১.১)।
“ব্রহ্ম হলেন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ”, (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩.৯.২৮)।
“হে শ্বেতকেতু, তুমিই ব্রহ্ম-তত্ত্বমসি” (ছান্দোগ্য, ৬.৮.৭)।
“আমিই ব্রহ্ম - অহম ব্রহ্মোস্মি” (বৃহদারণ্যক, ১.৪.১০)।

শেষ দুটো বর্ণনার অর্থঃ ব্যক্তি জীব ব্রহ্মের থেকে আলাদা স্বতন্ত্র কিছু নয়। সম্যক জ্ঞান হলে আমি-তুমি-পরব্রহ্ম সব এক এবং অভেদ।

4. ব্রহ্মসূত্র, শ্রীভাষ্য, জিজ্ঞাসাধিকরণম, প্রথম অধ্যায়, সূত্র ১, পৃঃ ৩৩।

5. ব্রহ্মসূত্রের শ্লোক ১.১.১-এর শ্রীভাষ্যে (রামানুজ) আপত্তি। ব্রহ্মসূত্র, অদ্বৈত আশ্রম এডিশন, স্বামী বীরেশ্বরানন্দ সম্পাদিত; পৃঃ ৭২।

6. শ্বেতাশ্বতর, IV, 9.

7. ঐ, অধ্যাস, পৃঃ ৭।

8. কপিলঃ সবচেয়ে প্রাচীন দার্শনিক মত সাংখ্যের প্রণেতা

9. কণাদঃ প্রাচীন আণবিক দর্শন বা বৈশেষিক সূত্রের প্রণেতা।

10. ব্রহ্মসূত্র, শাংকরভাষ্য, অদ্বৈত আশ্রম সংস্করণ, শ্লোক ২.২.১১।

11. দেবীপ্রসাদ, ‘হোয়াট ইজ লিভিং অ্যান্ড হোয়াট ইজ ডেড ইন ইন্ডিয়ান ফিলজফি”, পৃঃ ২০৪।

12. বৃহদারণ্যক উপনিষদ; ৩.৬.৯।

13. ব্রহ্মসূত্র, শাংকরভাষ্য, শ্লোকঃ ২.১.২৬ এবং ২.১.২।

14. ব্রহ্মসূত্র, শ্রীভাষ্য, দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রীবলরাম ধর্মসোপান, খড়দহ; পৃঃ ৩৮।

15. মৈত্রী উপনিষদ, ৪.২।

16. শুভগুপ্ত, ‘বাহ্যার্থ-সিদ্ধি’, পৃঃ ৩।

17. কুমারিল ভট্ট, ’শ্লোকবার্তিক’, পৃঃ ৭৯-৮০।

18. ব্রহ্মসূত্র, শাংকরভাষ্য, শ্লোক ৩.৯.৩৮।