আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

বেসরকারীকরণ রুখতে হবে


সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার একটি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের উপর সিলমোহর দিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারতের বিখ্যাত জীবন বিমা নিগমের শেয়ার খোলা বাজারে বেচে তার বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ভারতের সর্ববৃহৎ বিমা কোম্পানি যেখানে কোটি কোটি মানুষের সঞ্চয় গচ্ছিত রয়েছে তা বেচে দিতে চলেছে ভারত সরকার। অন্যদিকে, ২০২১ সালের বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকেও ধাপে ধাপে বেচে দেওয়া হবে। আপাতত দুটি ব্যাঙ্কের বিলগ্নীকরণের কথা হাওয়ায় ভাসছে।

ভারতের জীবন বিমা নিগম এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বহু সাধারণ আমানতকারী তাদের জীবনের সঞ্চয় গচ্ছিত রাখেন এই নিশ্চয়তায় যে কেন্দ্রীয় সরকার কখনও ঋণখেলাপী করবে না, তাই তাদের টাকা সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারী হাতে তুলে দিতে চায়। অন্যদিকে, আরো যে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে সেগুলিকেও সরকার বেচে দিতে চায়। ২০২১ সালের বাজেটে বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার ১৭৫০০০ কোটি টাকা বাজার থেকে আয় করবে বলে হিসেব করেছে।

কিন্তু বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে সরকারকে টাকা তুলতে হবে কেন? হিসেব করলে দেখা যাবে যে ভারতের কর্পোরেট ট্যাক্স ও জিডিপি-র অনুপাত লাগাতার কমছে। এই অনুপাতকে যদি না কমিয়ে দুই বছর আগের হারে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে বিলগ্নীকরণের মধ্যে দিয়ে সরকার যত টাকা তুলবে বলে আশা করছে, তার থেকে বেশি টাকা তারা আদায় করতে পারে। কিন্তু দেশের ধনী এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে তাদের উপর করের হার বাড়িয়ে মোদী তার মিত্রদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চান না। অতএব, তেলা মাথায় তেল মাখানোর মানসিকতা নিয়ে সেই বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতেই সস্তায় দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার।

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে সরকারের অর্থনৈতিক বিষয় নাক না গলানোই ভাল। বিমা, ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারীকরণ করে দেওয়াই ঠিক নীতি। কিন্তু এই বক্তব্য একটি বিশাল গলদ রয়েছে। আজকে জীবন বিমা নিগম বেচে সরকার যত টাকাই ঘরে তুলুক, তা শুধু এই বছরেই সে পাবে। কিন্তু জীবন বিমা নিগমের মতন লাভজনক সংস্থা আগামী বহু বছর তার মালিককে মুনাফা দেবে। সরকারের হাতে থাকলে তার থেকে লাভবান হবে সরকার, আর বেসরকারী হাতে চলে গেলে তার লাভ নেবে কর্পোরেট-রা। আজকে সংসারের টানাটানির জন্য বাড়ির গয়না বিক্রি করা আর এই বেসরকারীকরণের নীতির মধ্যে তাই বিশেষ কোনো তফাত নেই।

ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে অনাদায়ী ঋণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে দেউলিয়া আইনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সংস্থাকে অন্য কোনো সংস্থার হাতে বেচে তার টাকা ব্যাঙ্কগুলোকে ফেরত দিয়ে ২০২১ সালের মার্চ মাস অবধি মোট অনাদায়ী ঋণের মাত্র ৩৯ শতাংশ টাকা উদ্ধার করা গেছে। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ টাকা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কারা টাকা নিয়েছিল? বেসরকারী ক্ষেত্র। কারা টাকা ফেরত দেয়নি? বেসরকারী ক্ষেত্র। কিন্তু এখন সরকারী নীতি মেনে সেই ঋণ খেলাপী বেসরকারী ক্ষেত্রের হাতেই ব্যাঙ্কগুলিকে তুলে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করছে মোদী সরকার। এর ফলে দেশে একচেটিয়া পুঁজির দাপট আরো বাড়বে, বাড়বে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

আমরা ভুলে গেছি যে ১৯৬৯ সালের আগে ভারতের অধিকাংশ ব্যাঙ্ক ছিল বেসরকারী ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে ঋণের জোগান বাড়ানো যাচ্ছিল না, পুঁজিবাদী উন্নয়নেও ঋণের জোগানের সমস্যা মিটছিল না। তদুপরি, কৃষি ক্ষেত্র, ছোট ও মাঝারি ক্ষেত্র, প্রান্তিক মানুষ ছিল মহাজনদের হাতের মুঠোয়, কারণ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তারা ঋণ পাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তদুপরি, ব্যাঙ্ক মালিকদের ফাটকাবাজি এবং অবিমৃশ্যকারিতা বহু ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া করে দিয়েছিল।

এহেন পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাঙ্কগুলির রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে। এর প্রভাব আমাদের দেশে সুদূরপ্রসারী হয়েছে। একদিকে শিল্পে ঋণের জোগান বেড়েছে, যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী উন্নয়ন হয়েছে। অন্যদিকে কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষরা সস্তায় ঋণ লাভ করেছে। গ্রামীণ এলাকায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা এবং ঋণের জোগান বেড়েছে। যার ফলে দেশের অর্থব্যবস্থা গতি লাভ করেছে।

এখন ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়ার নামে ভারতের অর্থব্যবস্থাকে ১৯৫০-৬০ এর দশকে নিয়ে যেতে চাইছে দেশের সরকার। এখনও আমরা যদি বেসরকারী ব্যাঙ্কের ঋণের পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব যে এরা কৃষি বা ক্ষুদ্র শিল্প বা গ্রামীণ এলাকায় বিশেষ ঋণ দেয় না। মুদ্রা যোজনা, যা মোদী তার সরকারের একটি প্রধান প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, তার থেকেও ঋণ প্রদান করে না বেসরকারী ব্যাঙ্ক। সামাজিক ব্যাঙ্কিং-এর সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করতে হয়েছে রাষ্ট্রায়্ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে। যার ফলে তাদের শুধুমাত্র মুনাফার লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু বেসরকারী ক্ষেত্র শুধুমাত্র মুনাফার লক্ষ্যে ব্যবসা করেছে। এখন তাদের মুনাফার হারকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তুলনায় বেশি দেখিয়ে সরকারী ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়া আসলে দেশে সোশ্যাল ব্যাঙ্কিং-এর উপরে কুঠারাঘাত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারী করে দিলে আসলে পুরোনো গ্রামীণ মহাজনদের পরিবর্তে দেশের মানুষকে ঋণ দেওয়ার গুরু দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে সংগঠিত বৃহৎ পুঁজির মহাজনদের হাতে। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সাধারণ মানুষ।

বর্তমানে সংসদে পেগাসাস কান্ড নিয়ে জোর প্রতিবাদ ও হইহট্টোগোল চলছে। ন্যায্যভাবেই বিরোধী পক্ষ এই ইস্যু তুলেছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক তথা বিমার বেসরকারীকরণ দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্ষতি করবে। আমরা আশা করব বিরোধীরা, বিশেষ করে বামপন্থীরা, শীঘ্রই বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলন গড়ে তুলবেন।