আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

অসম-মিজোরাম সীমান্ত সংঘর্ষ


সীমান্তে সংঘর্ষ। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নয়। দেশের দুই রাজ্যের পুলিশ রীতিমতো গোলাগুলি নিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করেছে। অসমের ছয়জন পুলিশের মৃত্যু ঘটেছে। অসমের একজন পুলিশ সুপার গুরুতর আহত। তাঁকে চিকিৎসার জন্য তড়িঘড়ি মুম্বাই পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অসমের আরও জনা পঞ্চাশেক পুলিশ শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই পরিস্থিতিতে চলছে দুই মুখ্যমন্ত্রীর টুইট বিতর্ক।

এ যেন কাকতলীয় ব্যাপার। ২৫শে জুলাই অসম, মিজোরাম সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সবকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে শিলং-এ বৈঠক করলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সকলেই তাঁর দলের সহকর্মী অথবা সহযোগী দলের নেতা। এমনকি শিলং থেকে চলে আসার আগে অসম এবং মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই আলোচনার বিষয়বস্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। তারপর কী এমন হল যে রাত পোহাতে না পোহাতেই অসম আর মিজোরামের পুলিশ প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল।

স্থানীয়দের দাবি, নিজেদের রাজ্যের ভূখণ্ডের মধ্যে একটি ছাউনি তৈরি করছিল অসম পুলিশ। সেই ঘটনাকে ঘিরেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে এলাকায়। অসম এবং মিজোরাম পুলিশের মধ্যে আলোচনার সময় মিজোরামের একদল লোক পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। অসমের স্থানীয়রা পালটা পাথর ছোঁড়ে। এরপরই খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। তারপরেই নাকি দু' পক্ষের পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এসব খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে দুই রাজ্যের মুখ্য সচিব ও পুলিশ প্রধানদের দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনার পর একটি সমঝোতাপত্র প্রণয়ন করে। দুই মুখ্যসচিব সেই সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। সমঝোতাপত্র অনুযায়ী এখন থেকে অসমের কাছাড় জেলার ইনার লাইন সংরক্ষিত অরণ্য ঘেরা লায়লাপুর ও মিজোরামের ভাইরেংটির মধ্যবর্তী বিতর্কিত ৪ কিলোমিটার এলাকায় আর দুই রাজ্যের পুলিশ নয়, এ বার থেকে শুধু কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীই মোতায়েন থাকবে।

এদিকে দুই রাজ্যের সীমানায় সংঘর্ষের ঘটনায় অসমের মুখ্যমন্ত্রী সহ চার শীর্ষ পুলিশ আধিকারিক, দু’জন আধিকারিক এবং ২০০ জন অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করেছে মিজোরাম পুলিশ। অবিশ্যি ঘটনার দিনই মিজোরামের এক পুলিশ ইনস্পেক্টর এফআইআর দায়ের করেন এঁদের বিরুদ্ধে। ভারতীয় দণ্ডবিধির একাধিক ধারা, অস্ত্র আইন এবং মিজোরাম কনটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রিভেনশন অব কোভিড-১৯ অ্যাক্ট ২০২০-তে মামলা রুজু করা হয়েছে।

এফআইআরে মিজোরাম পুলিশ জানিয়েছে, অসম পুলিশের আইজিপি-র নেতৃত্বে ২০০ জনের সশস্ত্রধারী একটি দল জোর করে তাদের পুলিশ ক্যাম্প দখল করতে এসেছিল। মিজোরামের পুলিশ সংখ্যায় কম থাকায় ওই দলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। খবর পেয়েই মিজোরামের কোলাসিব জেলার পুলিশ সুপার তাঁর দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং অসম পুলিশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বোঝাপড়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু অসম পুলিশ তাতে কান না দিয়ে জানিয়ে দেয় যে বিতর্কিত অসমের মধ্যে পড়ে বলেই সেখানে পুলিশ চৌকি তৈরি করা হচ্ছে।

অসমের মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হওয়ার আগেই এই ঘটনার তদন্তে যোগ দেওয়ার জন্য মিজোরাম পুলিশকে নোটিস পাঠায় অসম পুলিশ। ২৬শে জুলাইয়ের সংঘর্ষের ঘটনায় অসমের পাঁচ পুলিশকর্মী এবং এক নাগরিকের মৃত্যুর তদন্তে মিজোরামের সহযোগিতা চেয়ে নোটিস পাঠায় কাছাড় থানার পুলিশ।

মুখ্যমন্ত্রীদের টুইট বিতর্ক, পুলিশের দায়ের করা মামলার আবহে অসম সরকার রাজ্যের মানুষকে মিজোরামে যেতে নিষেধ করে নির্দেশিকা জারি করেছে। তারপরেই দুই রাজ্যের সীমানায় চেকপোস্ট বসিয়ে মিজোরাম থেকে আসা সমস্ত যানবাহনে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে আসা যানবাহনের মতো তল্লাশি শুরু করেছে অসম পুলিশ। অসম পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, মিজোরামে সক্রিয় ড্রাগ পাচারচক্রকে ঠেকাতে এই উদ্যোগ। মিজোরামের ড্রাগ মাফিয়ারা নিয়মিত অসমে ড্রাগ পাচার করছে বলেও জানিয়েছেন অসম পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশক। তাঁর দাবি, গত দু’মাসে ড্রাগ পাচারের ৯১২টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১,৫৬০ জনকে। পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে জনগণকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এমন কড়া তল্লাশির কথা আগে কখনও শোনা যায়নি। সম্ভবত সাম্প্রতিক সংঘর্ষের জেরেই অসম সরকারের এই সিদ্ধান্ত।

মিজোরামগামী সড়ক ও রেললাইনে অবরোধ করে হাইলাকান্দিতে মিজোরামের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দেওয়া হয়েছে। ক্ষুব্ধ জনতা অসমের বদরপুর থেকে মিজোরামের একমাত্র রেল স্টেশন বাইরবি সেকশনের মাহমদপুর এবং জামিরা এলাকায় রেললাইনের একাংশ উপড়ে ফেলায় মিজোরাম কার্যত অবরুদ্ধ। হাইলাকান্দি-আইজল জাতীয় সড়কেও অবরোধ চলায় মিজোরাম আপাততঃ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহ বন্ধ। এর ফলে মিজোরামের জনগণ বিপাকে পড়েছেন। দুই রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সেদিকে নজর নেই।

১৮২৬-এ অসম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় রাজস্ব আদায়ের জন্য ভূমি সমীক্ষা। অবশেষে ১৮৭৫-এর ২০শে অগস্ট অসমের অন্তর্গত লুসাই হিলস্ জেলা হিসেবে এখনকার মিজোরামকে চিহ্নিত করা হয়। তখনকার বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন (বিইএফআর) অ্যাক্ট, ১৮৭৩ অনুসারে এই চিহ্নিতকরণের কাজ সম্পন্ন হয়। স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয়েছিল যে পার্বত্য এলাকা লুসাই হিলস্ জেলা হিসেবে অভিহিত হবে। আর সংলগ্ন বরাক উপত্যকার সমভূমি কাছাড় জেলা বলে স্বীকৃতি পায়। স্থিতাবস্থা দীর্ঘদিন বজায় ছিল। ১৯৩৩-এ নতুন করে লুসাই হিলস্, মনিপুর এবং কাছাড় জেলার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা না করেই সীমানা চিহ্নিত করার জন্য ১৯৩৩-এর মানচিত্রে মিজোদের আপত্তি। অথচ ১৯৭২-এর ২১শে জানুয়ারি অসম থেকে লুসাই হিলস্ জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে মিজোরামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তখন কিন্তু ১৯৩৩-এর মানচিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি ১৯৮৭-র ২০শে ফেব্রুয়ারি মিজোরামকে রাজ্যে পরিণত করা হয় তখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

তবে মিজোদের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে একটা চাপা ক্ষোভ সাধারণ ভাবে বিরাজ করে। অসমের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার সঙ্গে মিজোরামের আইজল, কোলাসিব ও মামিট এলাকার মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। ২০২০ থেকেই হঠাৎ করে হাইলাকান্দি ও কোলাসিব-এর মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় অসমের কয়েকটি গ্রামে মাঝেমাঝেই দুষ্কৃতিদের আচমকা হামলা চলছে। ২০২১-এর জুন মাসেও হাইলাকান্দির গুটগুটিয়া-গল্লাচের গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। দুষ্কৃতীরা কখনও ধরা পড়ে না। দুই রাজ্যের আধিকারিক পর্যায়ের বৈঠক হয়। এবং আপাততঃ শান্তি-কল্যাণ বজায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

এবার ব্যতিক্রমী ঘটনা কী এমন ঘটলো যে হঠাৎ করে দুই রাজ্যের সরকারি বাহিনী মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু করে দিল। একটা সম্ভাবনার কথা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দুই রাজ্যের মধ্যকার ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে অবস্থিত ইনার লাইন সংরক্ষিত অরণ্য এলাকাকে কেন্দ্রীয় এক্তিয়ারে নিয়ে আসার জন্য এই সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটানো হতে পারে। কারণ, সেই ১৮৭৫ থেকে ২০২১-এর ২৬শে জুলাইয়ের আগের দিন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা অক্ষুন্ন থাকার পর এমন কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি যার জন্য দুই রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে পারে। কোনো প্ররোচনা ছাড়াই এমন লড়াই সম্ভব নয়। তবুও ঘটেছে। শেষপাতে তাই প্রশ্ন থেকে যায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক্তিয়ার সম্প্রসারণের জন্য এই সংঘর্ষ ঘটানো হয়নি তো? স্থান-কাল-পাত্র বিশ্লেষণ করলে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।