আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

শিক্ষা ও কাজের সংকট


পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পরে সামাজিক মাধ্যমে বিরল প্রতিভাদের সন্ধান পাওয়া গেল। এঁরা নিজেদের ছাত্রজীবনে বিরাট পণ্ডিত ছিলেন, মিম বানানোয় ওস্তাদ, অতএব কম বয়সী ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় সবাই পাশ করে গেছে, এই নিদারুণ সংবাদ পড়ে তাঁরা যারপরনাই বিরক্ত। বিশেষ করে কোভিড আবহে পরীক্ষা না দিয়ে সবাই পাশ করে যাওয়াতে ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’-দের প্রবল আপত্তি। কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ার দায় তো ছাত্রদের নয়। সেই দায় কোভিড-জনিত পরিস্থিতি ও অপদার্থ সরকারের। কিন্তু সমাজের নিয়ম মেনেই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে নয়, পণ্ডিতদের টার্গেট নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীরা।

বিগত দেড় বছর ধরে কোভিড পরিস্থিতির দরুণ সমস্ত স্কুল বন্ধ। অধিকাংশ পরিবারের হয় কাজ চলে গেছে, অথবা আয় কমেছে। বহু বাড়িতে স্থান অকুলান। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট অথবা স্মার্ট মোবাইল ফোন নেই। তবু, অনলাইন শিক্ষার নামে সরকার তথা সমাজের মাথারা সমস্ত দায় চাপিয়ে নিদ্রা দিয়েছেন। পড়াশোনার মতন ছোটখাট বিষয় নিয়ে তারা আর মাথা ঘামাবেনই বা কেন? বহু পরিবার সন্তানদের কাজ করতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে, মোবাইল ফোন কিনে দিতে পারেনি। তারা পড়াশোনার জগত থেকে সরে গিয়েছে। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক স্তরে কোনো আন্দোলন তো দূরের কথা প্রায় কোনো আলোচনাই নেই। চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা। শুধু ফল বেরোনোর পরে পণ্ডিতদের হুঙ্কারে কান পাতা দায়।

রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু সংক্রান্ত দপ্তর (ইউনিসেফ)-এর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ১৫ লক্ষ স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, ২৫ কোটি শিশুর শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে লকডাউনের ফলে। ভারতে মাত্র ২৫ শতাংশ শিশুর কাছে ইন্টারনেট রয়েছে। অতএব অনলাইন শিক্ষার থেকে তারা বঞ্চিত। এমতাবস্থায় আমাদের রাজ্যের বহু শিশুও যে পাঠ নিতে পারেনি, স্কুল ছুট হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার একটি তথ্যে এই ছবি পরিষ্কার। যারা এই বছর মাধ্যমিক দিল তাদের ক্ষেত্রে নবম শ্রেণিতে নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১১ লক্ষ ১২ হাজার। আগের বছর অকৃতকার্য পড়ুয়াদের ধরলে আরো দুই লক্ষ, অর্থাৎ মোট ১৩ লক্ষ পড়ুয়ার এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করেছে ১০৭৯৭৪৯ জন। অর্থাৎ দুই লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীরা যারা নথিভুক্ত ছিল তারা ফর্ম পূরণ করেনি। কেন? অনুমান করা যেতে পারে, এদের মধ্যে একটি অংশ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, মেয়েদের হয়ত বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, বা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল পণ্ডিতদের এই সংখ্যা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাঁরা শিশুদের ফেসবুকে বিদ্রূপ করেই নিজেদের দায় সেরেছেন।

রাজ্যে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের ফল পরীক্ষা ছাড়াই প্রকাশিত হল, তার নম্বর দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে অসন্তুষ্ট পড়ুয়া এবং তাদের আত্মীয়দের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন এই প্রক্রিয়া যে সম্পূর্ণ সন্তোষজনক নয়, তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে এর দায় সম্পূর্ণভাবেই শিক্ষাব্যবস্থার ও সরকারের, পড়ুয়াদের নয়। বরং আমরা সামাজিকভাবে এই পড়ুয়াদের সমস্যার সমাধানসূত্র খুঁজে বার করতে বিফল হয়েছি।

আমাদের সেই ব্যর্থতা এখনও চলছে, কিন্তু সমাজের কেষ্টবিষ্টুরা তা নিয়ে বিচলিত নন। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে প্রায় সব কিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে, বাজার-হাট-শপিং মল-বিউটি পার্লার-পানশালা-রেস্তোরাঁ-সিনেমা হল ইত্যাদি সবই খোলা। কিন্তু স্কুল-কলেজ বন্ধ। অনেকে ভাবছেন যে অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির জন্য বাকি সব খুলে রাখা জরুরি। কিন্তু স্কুল-কলেজ আপাতত ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ধারণাটি ভ্রান্ত। আজকে যারা ছাত্র, কাল তারা দেশের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক-শ্রমিক-কেরানি ইত্যাদি। তাদের শিক্ষা যদি অসম্পূর্ণ থাকে, তবে আগামীদিনে তা যে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতি করবে তাই নয়, অর্থব্যবস্থারও ক্ষতি করবে। তাই স্কুল-কলেজ খোলার জন্য সরকারের তথা শিক্ষাব্যবস্থার পদক্ষেপ নেওয়া একান্তভাবে জরুরি।

আমরা কিছু বিকল্পের কথা ভাবতে পারি। প্রথমত, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জরুরি ভিত্তিতে টিকাকরণ করে তাদের জন্য শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে আগামীদিনে তারাই ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’। অতএব তাদের গুরুত্ব কিছু কম নয়। দ্বিতীয়ত, যতদিন না তা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন টিভিতে বা রেডিওতে ক্লাস চালানো, এলাকায় এলাকায় শিক্ষিত বেকারদের মাসোহারা দিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে ছাত্র পড়ানোর ব্যবস্থা করা, একাধিক শিফটে স্কুল-কলেজ খোলা রাখা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে শাসক দল, বিরোধী দল, ছাত্র বা শিক্ষক সংগঠন কারো কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। শিক্ষার এহেন উপেক্ষা আগামীদিনে আমাদের বিপদে ফেলবে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে।

বিশেষ করে শিক্ষান্তে চাকরির যে দাবি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যে তথা দেশে সোচ্চারে তোলা হয়েছে অতিমারির কবলে তার ভবিষ্যৎ আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি নীলরতন সরকার হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে ছ'টি অস্থায়ী পদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২০০০-এর বেশি। এই চাকরির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ। অথচ দেখা যাচ্ছে যে এই পদে চাকরি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাওয়া ব্যক্তিরাও। অর্থাৎ রাজ্যে শিক্ষা পেলেই যে চাকরি পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম শিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তিদের তুলনায় রাজ্যে চাকরির জোগান কম থাকছে। এই প্রবণতা বহু বছর ধরেই বিদ্যমান। কিন্তু অতিমারি ও লকডাউনের ফলে তা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

বেসরকারী সংস্থা সিএমআইই-র সমীক্ষা জানাচ্ছে যে এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৬ শতাংশ, যা মে মাসে বেড়ে হয় ১৯.৩ শতাংশ এবং যা জুন মাসে আরো বেড়ে হয়েছে ২২.১ শতাংশ। একই সময় ভারতে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যেক পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে একাধিক ব্যক্তি বর্তমানে বেকার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রেক্ষিতে রাজ্যে যে লকডাউনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

এমতাবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অন্তত তিন ধরনের প্রভাব পড়ছে। প্রথমত, আগেই যা উল্লেখিত হয়েছে, বাবা-মায়েরা বাচ্চাদেরও বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছেন। অনুসন্ধিৎসু নিষ্ঠাবান সাংবাদিকদের প্রকাশিত প্রতিবেদন এই প্রক্রিয়ার বহু উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু চাকরির বাজার, বিশেষ করে শিক্ষিতদের জন্য, বেশ খারাপ অবস্থায় রয়েছে, সেহেতু শিক্ষালাভ করার স্পৃহা পড়ুয়াদের মধ্যে কমতে বাধ্য। শেক্সপীয়ার-রবীন্দ্রনাথের মহান কাব্য, নিউটন-আইন্সটাইনের অসাধারণ তত্ত্ব অথবা অমর্ত্য সেনের উন্নয়নের অর্থনীতি সম্পর্কে সূক্ষ্ণ আলোচনায় মন বসানো যায় না, যদি না পড়ুয়া জানে যে এই শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের পরে তার জন্য একটি উন্নত জীবন অপেক্ষা করছে। তাই কলেজে কলেজে প্রথম বর্ষ থেকেই ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কমতে থাকে। খোঁজ নিলে জানা যায় যে তারা কাজের সন্ধানে পড়া ছেড়ে দিয়েছে, অথবা ছোটখাট কিছু কাজ জুটিয়ে সেই কাজের ফাঁকে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছে। তৃতীয়ত, ছাত্রীদের ক্ষেত্রে আসছে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেওয়ার চাপ। স্কুল-কলেজ বন্ধ, চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই এমতাবস্থায় আমাদের মতন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের চটজলদি বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাই ছাত্রীদের সমস্যা আরো বাড়ছে।

কিন্তু খবরের কাগজ খুলুন অথবা টিভির সুইচ অন করুন। মাধ্যমিকে বা উচ্চ মাধ্যমিকে কে কত নম্বর পেল, যিনি প্রথম হলেন তাঁর ধর্ম কী? এইসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে পাকাচুল ও পাকা চাকরির অধিকারী পণ্ডিতের দল দিনের পর দিন জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিরল কিছু মানুষ ও সাংবাদিক ব্যতিরেকে, চাকরি ও শিক্ষার যে সংকট আমাদের তরুণ সমাজ প্রত্যহ মোকাবিলা করছে, তা নিয়ে আমাদের গণপরিসরে রয়েছে উদাসীনতা ও উপেক্ষা। আসলে আমরা দেশের ভবিষ্যৎ-কে চোখের সামনে শেষ হতে দেখেও তার অভিঘাত বুঝছি না, তাই কিছু করছিও না। দিদি ও দাদার লাইভ তরজার পরিবর্তে শিক্ষা ও চাকরি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় আমাদের?