আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

সুভাষ, ফুল ও বসন্ত

পল্লববরন পাল


বই অথচ বই না।
ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে কবিতার বই - নাম - ‘ফুল ফুটুক’।

“কখনই আলাদা বই হয়ে বেরোয়নি। ‘নিউ এজ’-এর ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ সংকলনে আলাদা গুচ্ছাকারে ছিল।”
- কবি সুভাষের নিজের স্বীকারোক্তি।

‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ শিরোনামের এই প্রথমসংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় জুলাই ১৯৫৭ - কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তদবধি লিখিত পাঁচটি বই, যথাক্রমে‘পদাতিক’(১৯৩৮-৪০)-এর তেইশটি কবিতা, ‘চিরকুট’(১৯৪১-৪৬)-এর পঁচিশটি কবিতা, ‘অগ্নিকোণ’(১৯৪৮)-এর পাঁচটি, ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’(১৯৫২)-র চব্বিশটি আর ‘ফুল ফুটুক’(১৯৫১-৫৭)-এর ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে এই সংকলন - লক্ষ্য করুন, ‘ফুল ফুটুক’ ওই পাঁচটির মধ্যে একটি বই হিসেবে স্বীকৃত - পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাণী বা দে'জ থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’তেও পরিষ্কার তার পৃথক পরিচিতি - যদিও সে বই আলাদা করে তখনও বেরোয়ইনি!

কী আশ্চর্য! তাই না?
কিন্তু কেন?
আমি অন্তত জানি না।

১৯৫১ থেকে ’৫৭ অবধি লেখা ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে ‘ফুল ফুটুক’, এই অসংকলিতকবিতাগুচ্ছ - ধরে নেওয়া যাক, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ বইটি প্রকাশ পাওয়ার ঠিক আগে আগেই সম্ভবত এই বইটি প্রকাশের কথা ছিলো, তাই সংকলনের কাজের সময়ে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে - কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, ‘ফুল ফুটুক’ তখন প্রকাশ পায়নি, সংকলন থেকে সেটা আর বাদ দেওয়াও হয়নি, সেখানে বই হিসেবে তার সাড়ম্বর উপস্থিতি ঐতিহাসিক। তাই বললাম - বই অথচ বই না।

কী আশ্চর্য! তাই না?
আচ্ছা, বিশ্বসাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত আর আছে কি?
আমি অন্তত জানি না।

এটুকু বোঝা গেলো যে, ফুল সময়মতো ফোটেনি।

আচ্ছা, ‘ফুল ফুটুক’ বললেই কি ফুল ফোটে? ফুল কি চাকরবাকর, নাকি বকলসে গলাবন্ধ প্রভুভক্ত চতুষ্পদী? তার ওপর লক্ষ্য করুন, কে বলছেন ‘ফুল ফুটুক’? না, এমন এক কবি, যিনি তাঁর জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় লিখেছেন -

‘কুঁজো হয়ে যারা ফুলের মূর্ছা দেখে
পৌঁছোয় না কি হাতুড়ি তাদের পিঠে?...’ [সকলের গান]

আর তার ঠিক পরের কবিতা ‘মে-দিনের কবিতা’য় তো আপামর বাঙলাকে ঘাড় ধরে মুখস্থ ও বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছেন -

‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’

[যদিও ‘পদাতিক’ প্রথম প্রকাশিত সংস্করণেকবিতাক্রম ছিলো উলটো, অর্থাৎ প্রথম কবিতা ছিলো ‘মে-দিনের কবিতা’ এবং দ্বিতীয়টি ‘সকলের গান’, পরে এই ক্রম বদল হলো কবে বা কেন, জানিনা] - আচ্ছা বলুন তো, ফুলকে নিয়ে এমন কেচ্ছা-হেনস্থার পরে কেউ যদি বলে ‘ফুল ফুটুক’ - ফুটবে ফুল? বা ফোটা উচিৎ তার? আপনি ফুল হলে ফুটতেন? ফুল বলে কি সে মানুষ নয়? তার কি অভিমান-আত্মশ্লাঘা বলে কিছু থাকতে নেই? অবশ্য বিস্তরঅভিমান আছে বলেই না ফুলের দেহে-মনে অত অত রঙের ফুলঝুরি - পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালীর ব্যাঙ্কে লকারে বা আলমারিতেও অত সম্পদ নেই।

একটা বই প্রকাশই হলো না, অথচ সেই বইয়ের একটি কবিতার পংক্তি তার কবির নামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে-মড়িয়েকিংবদন্তী হয়ে গেলো, সেই কবির নাম করলেই যেমন তাঁর কাক-বাসা ঝোড়ো চুল, চশমা ঢাকা স্বপ্নের নীল মদ্যহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর কাঠফাটা রোদে সেঁকা ঋজু টানটান শিরদাঁড়াওলা চেহারার কথা মনে পড়ে, ঠিক তেমনি ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত’ এই পংক্তিটিও কবি সুভাষের সাদা পাঞ্জাবিটির মতো তাঁর সঙ্গে পুরোদস্তুর সম্পৃক্ত।

‘ফুল ফুটুক’ বইয়ের এই কবিতার নাম ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’। কবিতাটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন শঙ্খ ঘোষ ‘কবিতা পরিচয়’ পত্রিকার তৃতীয় সংকলনে(আষাঢ় ১৩৭৩)। সেখানে ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতাটির এই প্রথম পংক্তিটি প্রবাদে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বিশ্লেষণ করছেন -

“আটপৌরে-শব্দে-ভরা ছন্দোমুক্ত সমস্ত কবিতাটির এই একটিমাত্র অংশে সহসা এসে গেছে (হয়তো সচেতনভাবেও নয়) অন্তর্লীন ছন্দের দুলকি, যা পাঠকের শ্রুতিতে মুহূর্তমধ্যে নিবিষ্ট হয়ে যায়। ধরা যাক, এই একটি কথাঃ ফুটুক্‌ / ফুটুক্‌ / বসন্‌ / -তো, তিনটি অংশেই থাকে একটি স্বরান্ত একটি হসন্ত সিলেবল্‌, ফলে বেশ একটা নিয়মিত ধরণে স্বরাঘাত (অ্যাক্‌সেন্ট) পড়ছে, শব্দগুলির মধ্যে চলে আসছে কুচকাওয়াজের ভঙ্গি। প্রতি অংশে এখন জুড়ে দেওয়া যাক একটি করে অতিরিক্ত সিলেবল ‌- (ফুল) ফুটুক / (না) ফুটুক / (আজ) বসন্‌ / -তো। এবার যদি দ্রুত পড়ি সবটা ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ - তাহলে রক্তের তালে স্পর্ধিত পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে শেষ ‘তো’ ধ্বনিটিতে মাথা উঁচু করে তুলতে ইচ্ছে হয় এবং তখন বোঝা যায়, বাণীতে-বিন্যাসে মিলিয়ে কথাটি যে এ যুগের কবিতা-পাঠকের মনে গেঁথে যাবে, তা খুব স্বাভাবিক।”

তো কেমন ছিলো সম্পর্ক - কবি সুভাষের সঙ্গে ফুলের আর বসন্তের? একান্নবর্তী সংসারে এঁটোকাটা হয়ে পড়ে থাকা খুড়তুতো পিসতুতো দুই বিধবা পিসিমা? নাকি ‘দেখ আমি বাড়ছি মাম্মি’ আর 'আয়্যামে কমপ্ল্যান গার্ল’ বলে ঠোঁট চেটে নেওয়া গাবলুগুবলু আলুসেদ্ধমার্কা পুত্রকন্যা? সুভাষের কবিতায় ‘ছেঁড়া জুতোটায় ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে / বেঁধে নিই মন কাব্যের প্রতিপক্ষে’ - চোখকান খুলে তবে উত্তরসন্ধানে ‘পদাতিক’থেকেই পরিক্রমা শুরু করুক পদাতিক।

বুদ্ধদেব বসুর মতে - সম্ভবত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতায় হাত মকশো করে লেখা শুরু করেননি। এমনকি তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয়। যদিও আমার কাছে কথাটা সমর্থনযোগ্য নয় - কাশীরাম দাস মাইকেল মধুসূদনের মতো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে। আমার মনে হয়, বুদ্ধদেব বসু কথাটা গাণিতিক সত্যতা মেনে বলেননি।যাই হোক, কাজেই ফুল বা বসন্তের সঙ্গে কবি সুভাষেরসেই শুরুর দিনেও আহামরি কিছু ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি’ মার্কা গলায় গলায় গোল গোল সম্পর্ক ছিলো না - এ কথা ভরসা করে বোধহয় বলা যায়। মেহনতী মানুষের সংগ্রাম যাঁর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, লাল উল্কিতে পরস্পরকে চিনতে চিনতে সম্মিলিত মানুষের পদক্ষেপে উদাসীন ঈশ্বরকে কাঁপিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়ে লিখতে বসা এক কবির থেকে সে আশাও পাঠক করেনা, কিন্তু যেহেতু প্রশ্নটা ফুল সম্পর্কিত, কৌতূহল তো থেকেই যায়। তাই এই পরিক্রমা।

‘পদাতিক’এর শুরুতেই তো কবি সুভাষ ফুলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যাচ্ছেতাই অপমান করে বসলেন, যার উল্লেখ আগেই করেছি। পাঁচ অধ্যায়ের দীর্ঘ ‘পদাতিক’ কবিতায় লিখলেন -

‘বিশ শতকেও ফুলের বেসাতি করি’ -

‘বেসাতি’ শব্দের উচ্চারণেও ফুল সম্বন্ধে শুধুই তাঁর অপছন্দ বা নিরাসক্তি নয়, বরং তিনি তির্যক অসম্ভ্রম প্রকাশ করতে দ্বিধা করলেন না। যদিও এই কবিতারই দ্বিতীয় অধ্যায়েমহাকালের স্কন্ধে কঙ্কাল বহনের হতাশায় পিরীতিকে (এও কি তির্যক তাচ্ছিল্যের উচ্চারণ নয়?) পিরামিডের কফিনে ঢেকে চাইছেন -

‘প্রগল্‌ভ যুঁই মেলুক বন্ধ্যা শাখা’-

ফুলের প্রগলভতাকে অস্বীকার না করেও সেই গাছেরবন্ধ্যাত্বের দাবিতে শ্লোগান শানাচ্ছেন। পঞ্চম তথা শেষ অধ্যায়ে যুদ্ধ ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত জয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন -

‘অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায়
এক দ্বিতীয় বসন্ত।...’।

সুভাষের কবিতায় তথা ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থে এই প্রথম অন্যরকম এক ‘বসন্ত’ এলো - সুভাষিত বসন্ত - অভিনব প্রাকৃতিক ঋতুবিকল্প, যা মানুষেরই সংগ্রামের রঙে উজ্জ্বল - সে মোটেই রবীন্দ্রনাথের ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে / মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে...’ অথবা কাজী নজরুলের ‘আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী; চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি...’ নয়, সে অগ্নিবর্ণ পত্রপুষ্পে প্রাণবন্ত - তারই জন্য তো প্রতীক্ষা - হোক না সে ‘দ্বিতীয় বসন্ত’- যে বসন্তে কবি গলিতনখ পৃথিবীতে সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস রেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। পরের স্তবকেই অবশ্য কবি জানাচ্ছেন -

‘অরণ্যকে ছেঁটে দেবার দিন এসেছে আজ’।

বলা বাহুল্য, এ ‘অরণ্য’ মানে আগাছা, আদিমমহাদ্রুমের সালোক সংশ্লিষ্ট সবুজায়ন নয়। বসন্ত তাঁর কবিতায় এর আগে আসেনি, তা নয়। যেমন, ‘নির্বাচনিক’ কবিতার শুরুতেই বলছেন -

‘ফাল্গুন অথবা চৈত্রে বাতাসেরা দিক বদলাবে’ -

কিন্তু সে দিক বদলের সুরে বিকৃতমস্তিষ্ক চাঁদের উল্লাঙুল অশরীরী স্বপ্নের দুর্ভিক্ষ-আর্তনাদ - তাই কবিতার শেষে তাঁর প্রশ্ন -

‘সদলে বসন্ত তাও পদত্যাগপত্র পাঠাবে না?’

তির্যক ব্যঙ্গ ছুঁড়ছেন পরের কবিতা ‘নারদের ডায়রি’তে -

‘বসন্ত কী আর্য, আহা! এসপ্ল্যানেডে আশ্চর্য জনতা।’

প্রথম প্রকাশনের তেরো নম্বর কবিতা ‘আলাপ’এ আর কোনো তির্যক বক্রোক্তি নয়, বরং সপাট ও সরাসরি -

‘তবে কি নাছোড়বান্দা ফাল্গুন, কমরেড?
বসন্ত বিজ্ঞপ্তি আঁটে ঘূর্ণিফল গাছে;’

এবং অভিমান ক্রোধ হতাশায় ক্লিষ্ট কবির কলম-মুখে ধ্বনিত হয় হাহাকার-প্রশ্ন -

‘বসন্ত সত্যিই আসবে? কী দরকার এসে?’

পদাতিকের কবিতাগুলি লেখা সুভাষের আঠেরো থেকে একুশ বছর বয়সে, যে বয়স প্রকৃত অর্থেই ‘ফুল খেলবার’ - কিন্তু এখানেও কবি সুভাষ অনন্য,কারণ তিনি ইতিমধ্যেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনাপুষ্ট ও সাম্যবাদে দীক্ষিত। তাই তাঁর প্রথম কবিতাতেই ধ্বংসের মুখোমুখি ফুল খেলবারসে সম্ভাবনার মূলোচ্ছেদ করেছেন নির্মম হাতে।

এরপর ‘চিরকুট’। রচনাকাল ১৯৪১ থেকে ‘৪৬। কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়েছেন। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও‘হৃদয়বিহীন সময়ের দুর্বৃত্ত’র হাতে বিধ্বস্ত লড়াকু কবি প্রথম কবিতা ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’র ষষ্ঠ অধ্যায়ে শোনাচ্ছেন আশাবাণী -

‘আমরা দেব বোবাকে ধ্বনি
খোঁড়াকে দ্রুত ছন্দ
লক্ষ বুকে রয়েছে খনি,
কুঁড়িতে ঢাকা গন্ধ।
আমরা নই প্রলয়-ঝড়ে অন্ধ।।’

‘পদাতিক’এ যুঁইয়ের প্রগলভতার আংশিক স্বীকৃতির পরে এই প্রথম সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা নিয়ে তাকালেন ফুলের দিকে, মানে ফুলের কুঁড়ির দিকে, তার গন্ধের দিকে। পরের কবিতা ‘রোমন্থন’-এসময়ের দুর্বৃত্তায়ণের অভিশাপকে বিঁধছেন -

‘দ্বারে বসন্ত, অন্দরে দাবদাহের ছাই’

যেখানে

‘অখ্যাত ফুলে রাস্তা ঢেকেছে কাঁটার বন।’

সময়টা এমনই,

‘অগ্নিবর্ণ বনের সবুজ’

অথবা

‘অবরুদ্ধ তরুশাখা
চঞ্চল হাওয়ায় মাথা কোটে’

কবি সুভাষ তখন গর্জনে গলা ফাটাচ্ছেন ‘রক্তের ধার রক্তে শুধব কসম ভাই’ - তাঁর চোখে তখন কোথায় ফুল, কোথায় বসন্ত? শুধু অসহায় মানুষের গোঙানি আর চোখের জলে ভিজে উঠছে কলম ও খাতার পাতা। সুকান্তের মৃত্যুতে গভীর মর্মাহত হয়ে লেখা ‘উজ্জীবন’ কবিতায় শেষ অবধি আর একবারই বসন্ত উচ্চারিত হলো তীব্র যন্ত্রণায়, আচ্ছন্ন আক্ষেপে -

‘বসন্তকে পুড়িয়ে মারে
দাউদাউ দাবাগ্নি শিখায়...’

‘অগ্নিকোণ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮এ। বইটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘সিঙ্গাপুরের যে তিনজন শহীদ বৃটিশের ফাঁসিকাঠে ‘আন্তর্জাতিক’ গাইতে গাইতে প্রাণ দিয়েছেন’ তাদের। সুতরাং পাঁচটি কবিতার সংক্ষিপ্ত এই সংকলনে ফুলের কোনো অস্তিত্ব থাকার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। আর বসন্ত? নাম কবিতায় যখন অগ্নিকোণের তল্লাট জুড়ে মানুষ অন্ধকারকে দু’টুকরো করে সূর্য ছিঁড়ে আনে, কোটি কন্ঠের হুঙ্কারে বজ্রের কানে তালা লাগে, ঠিক তখনই - কবিতার শেষ লাইনে -

‘পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত জেগে ওঠে’-
গোটা বইয়ে ঐ মাত্র একবারই।

পার্টি নিষিদ্ধ হলো। কবি জেলে। জেল থেকে বেরিয়ে চব্বিশ গুন সাত পার্টির কাজ। সুতরাং, কবিতা-টবিতা উধাও। ১৯৫২তে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ - ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’। মূল তুর্কী ভাষা থেকে ইংরেজি ও ফরাসী হয়ে বাঙলা। ফুল বা বসন্তের প্রতি মূল কবি ও তৎসহ অনুবাদক কবির দৃষ্টিভঙ্গির কি কিছু পরিবর্তন হলো? প্রথম কবিতা ‘প্রমিথিয়ুসের ডাক’-এর পঞ্চম লাইনেই শুনলাম ইতিমধ্যেই পরিচিত সেই সুভাষ-স্বর- একটু অন্যভাবে -

‘পেটে আমাদের জায়গা নেই -
না গোলাপের,না বুলবুলের, না আত্মার, না চাঁদের আলোর।’

ভাষা বদলালো, অনুষঙ্গ বদলালো, বদল ঘটলো বাচনভঙ্গিরও। কিন্তু ফুল সম্পর্কে অবস্থান বদলালো না। ‘জেলখানার চিঠি’তে লিখছেন -

‘মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
যে, ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে’...
‘চেরীর একই ডাল একই ঝড়ে
দু’বার দোলে না’

অথবা

‘উজ্জ্বল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা,
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে’।

‘আমি জেলে যাবার পর’ কবিতায় আনন্দের খবর পেলেন -

‘কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।’

বলা বাহুল্য, এখানে ‘ছেলে’ শব্দটির অর্থ সন্তান। শেষ কবিতা ‘এখন প্রশ্ন’তে শেষবারের মতো ফুলকে উচ্চারণ করেই তর্জনি শানিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ছেন তাদের দিকে, যারা

‘মিথ্যাকে ফুলবাবুটি সাজিয়ে বড় রাস্তায় ঘোরায়’।

এই সময়ে বহুদিন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে কবিতার সম্পর্ক প্রায় অহি-নকুলের, মূলত বজবজে থাকাকালীন রাজনৈতিক ব্যস্ততায়। তখন ঝড় মাথায় নিয়ে

‘মাঠের কাদা-লাগা ফাটা পায়ে
শানবাঁধানো পাথরে
আগুনের ফুল তুলে’

অনর্গল হেঁটে চলেছেন কবি। সেই মাঠের কাদা-লাগা ফাটা পায়ের পদাতিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই ‘কমরেড স্তালিন’কে স্মরণ করছেন

‘মরুতে ফুটিয়ে ফুল,
নদীতে মিলিয়ে নদী
আমাদের হাতে তুমি রেখে গেলে
নতুন জীবন।’

তখন

‘শিয়রে দাঁড়িয়ে থাবা তুলে আছে
গলিতনখ এ রাত্রি। তবু যদি দুটি একটি করেও পাঁপড়ি
খুলে যায়,’ -

এই ভাবতে ভাবতেই ‘ফুল ফুটুক’এর ফুল ফুটতে শুরু করলো -

‘ক্রমাগত চোখ রাঙিয়ে রাঙিয়ে
যারা হয়ে গেছে অন্ধ
তাদের নাকের কাছে ধ’রে দিও
ফুলের একটু গন্ধ।’

‘আগুনের ফুল’ আর ‘শুধু ভাঙা নয়’-এর পরেও স্বগতোক্তি করছেন কবি সুভাষ ‘সন্ধ্যামণি’ কবিতায় -

‘ততক্ষণ
আমিই বা বসে থাকি কেন?
উঠোনে সন্ধ্যামণি ফুল ফুটিয়ে তুলবার
এই তো সময়।’

বইয়ের নাম দিলেন ‘ফুল ফুটুক’। বুঝলাম - প্রস্ফুটনেই আশাবাদী কবির বিশ্বাস ও প্রত্যয়। কবিতার নামে ফুল ফুটুক-এর পরে আরো দু’টি শব্দ যুক্ত হলো - ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’। সে কি!ফুল ফোটায় বিভ্রান্তি কেন? দ্বিধা কিসের? পাঠক বিহ্বলতা নিয়ে পাঠ শুরু করতেই আবার ঠোক্কর।শুরুর লাইনেই আবার নতন দু’টি শব্দ বাড়লো -

‘ফুল ফুটুক না ফুটুক
          আজ বসন্ত’

অর্থাৎ, ফুলের ওপর কবির ভরসা বেমালুম উধাও, ফুলকে আর তোয়াক্কা না করেই বসন্তের আগমন ঘোষণা করছেন। বলি, ব্যাপারটা কী? এতো দোলাচল কেন? যদিও যেভাবে বললাম, ব্যাপারটা ঘটে সাধারণত ঠিক উলটো - প্রথম লেখা হয় কবিতা, তারপর কবিতার শিরোনাম, সব শেষে বইয়ের নাম। কিন্তু যাই হোক, পাঠকের বিহ্বলতা কাটে কই?

একটু বিশদে যাই। এমন এক প্রবাদপ্রতিম কবিতা, জনপ্রিয়তম কবিতা, রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙলা কবিতা, যার প্রত্যেকটা শব্দ যেন আমারই পাড়ার চেনা প্রিয় টাটকা বয়সী ছেলেমেয়ে, যাদের ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করে, প্রতি দু’টি শব্দের মধ্যেকার ফাঁক-উঠোনে দাঁড়িয়ে ‘লাল কালিতে ছাপা হল্‌দে চিঠির মতো’ আকাশে মাথা তুলে নিঃশ্বাস নিতে ভালো লাগে - তাই বিশদ ভ্রমণে যেতেই হয়, নইলে পাপ লাগে যে। অনুজপ্রতিম বন্ধু কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে লেখা চিঠিতে কবি সুভাষ লিখছেন -

‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ লিখেছিলাম সম্ভবত ’৫৬ সালে। দিনতারিখ রাখা দূরের কথা, লেখার কপি রাখারও আমার অভ্যেস নেই। লিখেছিলামকলকাতায় হয় বাড়িতে ব’সে, নয় চাখানায় কিংবা ছাপাখানায়। তবে এটা মনে আছে যে, গোড়ার ৬ লাইন অগোছালোভাবে কয়েকটা টুকরো কাগজে বছর তিন-চার আগে অসম্পূর্ণ অবস্থায় খসড়া করা ছিল। অর্থাৎ শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ করতে পারিনি।

...সত্যি বলতে কি, এ কবিতার একাংশ আরও পুরনো। ১৯৪৮ সালে প্রথমবার জেল থেকে বেরিয়ে যে কয়েকমাস বাইরে ছিলাম, কলকাতার গাছপালা, আকাশ, রাস্তার রোদ্দুর আমার মনে অসম্ভব ছাপ ফেলত।ময়দানের পাশ দিয়ে দোতলা বাসে করে যেতে যেতে দূরে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখেছিলাম। ...হকার্স কর্ণারের সামনের চত্বরটা যখন পার হচ্ছি, তখন আমার মনে একটা বিষণ্ণ আইবুড়ো উদ্বাস্তু মেয়ের ছবি ফুটে উঠছিল। আইবুড়ো মেয়েদের (বিশেষ ক’রে, দেখতে যাদের ভালো নয়) গায়ে প্রজাপতি উড়ে এসে বসলে যে হর্ষবিষাদের শিহরণ জাগে, আমার ছেলেবেলায় তার বিলক্ষণ পরিচয় পেয়েছি। তাই আমার মানসচিত্রে তৎক্ষণাৎ একটা প্রজাপতি জুড়ে দিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এই নিয়ে একটা কবিতা ফাঁদব। ...পরের আট বছরের মাঝে মাঝেই মনের মধ্যে ছবিটা ভেসে উঠেছে।

‘শানবাঁধানো ফুটপাথে’ কাঠখোট্টা গাছ কলকাতায় আকৈশোর দেখছি। কিন্তু ‘কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে’ হাসতে দেখেছিলাম যে গাছটাকে - সেটা ছিল ময়দানে। ট্রামে যেতে যেতে দেখেছিলাম। সম্ভবত ’৫২ সালে। প্রথম ৬ লাইন মোটামুটি সেই সময়ের লেখা। বছর চারেক পরে ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায় লেখার তাগাদায়... ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিভিন্ন কাগজ থেকে ৬টি লাইন উদ্ধার করলাম। ...শেষ পর্যন্ত কোনরকমে তো শেষ করলাম। ...কবিতাটি ‘দেশ’ অফিসে পৌঁছে দিলাম।

...এখন মনে হচ্ছে, যা লিখেছি তার সবটাই কি সত্যি? সত্যি বলতে গেলে, শেষ যখন লিখেছি তখন এত কিছুর হুঁশ ছিল না। ...সবই তো টুকরো টুকরো পরস্পরবিচ্ছিন্ন ছবি। কেনই বা তাদের এই কবিতায় উড়ে এসে জুড়ে বসা? লিখেছি বেহুঁশ হয়ে। কবে কখন কেন কোথায় - এ সব কোনো সওয়াল তখন ছিল না। আজ যেটা মনে করতে চেষ্টা করছি, তার খানিকটা কি মনগড়া, অনুচিন্তা নয়?’

ছবি বুনতে বরাবরই ওস্তাদ কবি সুভাষ। কারণ তিনি বহুমাত্রিক জীবন দেখেছেন চশমায়িত চার চোখের সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ফুটপাথের পাথরে পা ডোবানো গাছ কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসতে হাসতে এই হতোদ্যম কংক্রিট সমুদ্রের ভিতর থেকে স্পর্ধার মাথা তুলে ঘোষণা করছে - আজ বসন্ত।যেন চলমান দোতলা বাসেরজানলার ফ্রেমে নাগরিক চালচিত্রে একের পর এক ছবি - আলো আর অন্ধকারের যাতায়াত, মানুষের শব, কোকিল ডাকা হরবোলা ছেলেটি - সবাইকে ডেকে নিয়ে চলে যাওয়া দিন - এই সব পেরিয়ে ফ্রেমে আটকে থাকলো এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে, যার গায়ে উড়ে এসে বসলো পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া এক প্রজাপতি।

‘আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে
তারপর খুলে -
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে -’

এই অসমাপিকা ক্রিয়াপদের মিছিল যেন ঐ বাসের জানলায় গতিচিত্রের একঘেয়ে ক্লান্তিকর দিন -

‘যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।’

শঙ্খ ঘোষ লিখছেন -

‘কিন্তু ফিরে যে আসবে না তার শর্ত কী? তার জন্য প্রস্তুতি কী? দরজা বন্ধ হবার শব্দে যখন মুখ চাপা দিয়ে হাসতে থাকে দড়ি পাকানো গাছ, তখন এ-দুটি উচ্চারণে প্রতিবিন্যস্ত সম্পর্কের মধ্যেই পেয়ে যাই আমাদের উত্তর। বহির্জীবন থেকে নিজেকে খণ্ডিত ক’রে নয়, তার মধ্যে সরে এসেই হতে হবে প্রস্তুত। আপন অসম্পূর্ণতার বেদনার ধিক্‌কৃত হয়ে নয়, সেই বেদনা আত্মসাৎ করেও নামতে হবে পৃথিবীর কেন্দ্রে, কেননাঃ ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। কিন্তু ও লাইনটিও আর ফিরে আসে নি, সংগত সংযমে।’

এরপর ‘দিন আসবে’ ১৯৬১ সালে। বুলগেরিয়ার কমিউনিষ্ট কবি নিকোলা ভাপ্‌ৎসারভের কবিতার অনুবাদ। বুলগারি (সুভাষ বইয়ের মুখবন্ধে অবশ্য ‘বুলগার’ লিখেছেন) থেকে ইংরেজি হয়ে বাঙলা। নিকোলার জন্ম ১৯০৯ সালে। ১৯৪২ সালের ২৩শে জুলাই বুলগেরিয়ার ফ্যাশিস্ট সরকারের হাতে ফাঁসি হয় মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে। মুখবন্ধে কবি সুভাষ লিখছেন -

‘নিকোলা ভাপ্‌ৎসারভ লিখেছেন সংগ্রামের কবিতা - যা তাঁর জীবন থেকে উঠেছে। তাঁর কবিতায় তাই নীরক্ত পাণ্ডুরতা নেই, প্রগলভ চিৎকার নেই। আছে যন্ত্রণার কথা, ভালবাসার কথা। আছে দাঁতে দাঁত দিয়ে সংগ্রামের কথা। আছে মানুষের অনিবার্য জয়ের কথা। অফুরন্ত আশার কথা।’

অর্থাৎ সুভাষপন্থী। কবি সুভাষের ফুল ও বসন্তের আলোচনায় অনুবাদ কবিতাগুলির অন্তর্ভুক্তির ঔচিত্য নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিঞ্চিৎ সংশয় ছিলো। কিন্তু নাজিম, ভাপ্‌ৎসারভ, নেরুদা বা অন্য যাদের কবিতা সুভাষ অনুবাদ করেছেন, তাদের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মূল কবি ও অনুবাদকের জীবন ও কবিতা যাপনের দর্শন প্রায় অভিন্ন। তফাৎ সেই শব্দানুসঙ্গ ও তার প্রকাশভঙ্গিতে। তাই সংশয় উধাও। ভাপ্‌ৎসারভের ‘দিন আসবে’ বইয়ের মোট চোদ্দটি কবিতার মধ্যে দ্বিতীয় কবিতা ‘কারখানা’র অন্ধকার ঘুপচির মধ্যেবয়লারি কলকব্জার অনর্গল ধাতব ঘর্ঘরে আক্রান্ত কবি নিজেকেই প্রাণপণ বলছেন -

‘বাইরে তাকিয়ে দেখ,
বসন্তের হাওয়া
দোলায় মাঠের ধান,
হাতছানি দিয়ে ডাকে রোদ’।

বারো নম্বর কবিতা ‘স্মৃতি’। এও কারখানার এক সঙ্গী শ্রমিকের কথা, যার দৈনিক বারো ঘন্টা কাজের রুটিনে ছিলো বয়লারে আগুন দেওয়া, ঘাড়ে করে বস্তা বস্তা কয়লা নিয়ে আসা ও পোড়া ছাই ফেলে আসা, এবং সর্বোপরি ক্রমাগত কাশতে কাশতে নীল হয়ে যাওয়া।

‘যখন বসন্ত আসত
দূর থেকে
ভেসে আসত পাতার মর্মর।’

সেই শ্রমিকের অবসন্ন চোখের ভাষায় নিরুচ্চার লেখা থাকতো করুণ মিনতি -

‘বসন্ত আবার যেন ফিরে আসে
আরেকটি বসন্ত যেন দেখে যেতে পারি।’

তারপর

‘একদা বসন্ত এল
রূপ যেন ফেটে পড়ছে,
সঙ্গে সূর্য।
স্নিগ্ধ হাওয়া,
ফুটন্ত গোলাপ।’

এরপর চাঁপার সৌরভও এলো। খুব নাটকীয় ঘটনার শেষে

‘সেই ছেলেটি?
মারা গেছে।
বাইরে বাড়াও মুখ, দেখ -
বসন্ত এসেছে।’

এরপর ‘যত দূরেই যাই’। রচনাকাল ১৯৫৭ থেকে ‘৬০। প্রথম প্রকাশ ১৯৬২।

এই বইয়ে এসে অবশেষে কবি সুভাষ তাঁর ‘ফুল’ সম্পর্কে অবস্থান স্পষ্ট করলেন। তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার কলমে নতুন সংজ্ঞা লিখলেন ফুলের। “পোড়া শহরে”র আশ্চর্য সকালের রং যেখানে‘ঠিক চাঁপাফুলের মতো’ - সেখানে দাঁড়িয়ে কবি বললেন -

‘আমাকে একটা ফুলের নাম বলো - ...

রক্তের মতো লাল
আগুনের মতো উদ্‌গ্রীব
নিশানের মতো অশান্ত

মুষ্ঠিবদ্ধ
যার পাঁপড়িতে ঢাকা
এক ভয়ঙ্কর সুন্দর ক্ষুধিত শপথ’ -

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে এই শপথের নামই ফুল, মানুষের দুঃসময় থেকে সুসময়ে পৌঁছনোর সংগ্রামের নামই ফুল, ফুল তাঁর চোখে মানুষের শুভত্ব আর মহৎ চেতনা - যা “গণনা” করে কবি বলে দেবেন ‘ওদের’ কপালে কী লেখা আছে।

একটু অন্য ঢঙের কবিতা ‘ছাপ’। শান্ত অবসন্ন আটপৌরে ঘরোয়া কবিতা। এখানে লিখছেন -

‘কিছু মুখ কিছু ফুল / দিয়েছিল পিছুডাক।’

মাটিতে রঙিন আশায় পাতা সংসারে অবশেষে চল্লিশোর্ধ জীবনে এসে স্বীকার করলেন সনাতনী ফুলের ডাককে - পিছনে ফেরার ডাক। ‘পা রাখার জায়গা’ খুঁজতে খুঁজতে পদাতিক হঠাৎ দেখলো - নাগরিক ফুটপাথে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে উবু হয়ে বসে একটা উনুন লোহার কড়াইয়ে হাওয়ার মুখে খই ফুটিয়ে ভুট্টা পোড়াচ্ছে আর

‘মাটিতে চাপ-চাপ রক্তের মতো ফুল;
ভুট্টার রং মানুষের গায়ের মতো।’

কিন্তু এ বইয়ে সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শবদেহ নিয়ে শোভাযাত্রার পথের পাঁচালি ‘পাথরের ফুল’ কবিতায়। শুরু করছেন -

‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।

ফুল কীভাবে কোন দৈববলে বা দানবীয় ষড়যন্ত্রে আস্তে আস্তে পাথর হয়ে ওঠে - এই বিবর্তন বা রূপান্তরের কাহিনী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন জুড়ে, এই যাত্রাপথের বর্ণনায়অসহ্য সেই নির্মমতা সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ রেখায় এঁকেছেন কবি সুভাষ এই কবিতায়, এমনকি গাড়ির মাথায় শোয়ানো শবদেহের ওপর মালার পাহাড়ে ‘ফুলের গলা-জড়ানো-কাগজে লেখা নামগুলো’ সমেত। এবং এই কবিতাতেই রয়েছে সেই দুর্জয় শপথের অঞ্জলি মন্ত্র, আমি ও আমার আশেপাশের একাধিক প্রজন্মের শিরদাঁড়া টানটান করে দিয়েছিলো যে অমোঘ ঋজু স্পষ্ট উচ্চারণ -

‘ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি -
যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।’

ফুল থেকে জগদ্দল পাথর নয়, ফুল থেকে আগুনের ফুলকিতে বিবর্তনের সহজ ও প্রত্যয়ী শপথবাক্য পাঠ করালেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৪ সালে আকাদেমি পুরষ্কার পাওয়া এই বই নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতো ছড়িয়ে পড়লো দশকের পর দশকে। ফলস্বরূপ আজও আমার মতো বহু মানুষ ফুল আর ফুলকি দ্বন্দ্বে সটান সুভাষপন্থী।

আগেই বলেছি, ফুল বা বসন্তের সাথে মানুষ সহবাস করে মূলত কৈশোর ও যৌবনে। ‘যত দূরেই যাই’ লিখতে লিখতেই কবি সুভাষ তাঁর চল্লিশ বসন্ত পেরিয়ে গেলেন।বিশুদ্ধ গাণিতিক বা জৈবিক মতে, সুভাষের যৌবন শেষ। অর্থাৎ ফুল ও বসন্তেরও সুভাষিত অধ্যায়ের শেষ। আপাতত এই ‘পাথরের ফুল’ কবিতায়চুপচাপ বুঁদ হয়ে ধ্যানমগ্ন থাকা ছাড়া গতি নেই যে।

‘কাঁধ বদল করো
এবার
স্তুপাকার কাঠ আমাকে নিক।
আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি
আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা
ভুলিয়ে দিক’।

মানিক বাঁড়ুজ্যে পুড়ছেন
সুভাষ মুখুজ্যেও পুড়ছেন
পুড়ছে
দিনবদলের আদর্শ, স্বপ্ন ও সংগ্রামের ইতিহাস

আসুন আমরা সবাই উঠে দাঁড়াই
শ্রদ্ধায়
আবেগে

আমাদের অগ্নিশুদ্ধি হোক...