আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

আজ তোমার পরীক্ষা, পরীক্ষা

শুভময় মৈত্র


মূল কথা হচ্ছে যে পরীক্ষা কেন? তার কারণ হল, একটা পরীক্ষার ফলাফলে যে নম্বর বা মান দেওয়া হয় তা পরবর্তীকালে অন্যান্য মূল্যায়নে কাজে লাগে। এবার প্রশ্ন হল নম্বরটা দিচ্ছে কে? সেখানে এমন হতেই পারে যে আমি নিজেই নিজের একটা রেজাল্ট বানিয়ে নিলাম, আর তাতে অংক, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরিজিতে নব্বই বা একশো ধরনের নম্বর বসিয়ে ফেললাম। তবে সেই যে রেজাল্ট নম্বর সেটা অন্য কেউ খুব একটা বিশ্বাস করবে না। জনগণ বিশ্বাস করবে কোনটা? যেটা কোনো এক পরিচিত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রস্তুত ফলাফল। অর্থাৎ তেমন একটা মার্কশিট বা শংসাপত্র প্রয়োজন যা অন্য লোকে মেনে নেয় অথবা বিশ্বাস করে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক, কেন্দ্রের সিবিএসসি - যা কিনা সরকারি বোর্ড, আইসিএসসি - যেটা একটা বেসরকারি সংস্থা যাকে সবাই বিশ্বাস করে। একইরকমভাবে মহারাষ্ট্র বোর্ড বা ত্রিপুরা বোর্ড এই জায়গাগুলোর ছাপানো ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য। অন্যদিকে আবার এমন অনেক বোর্ড আছে যেগুলো সরকারিভাবে মেনে নেওয়া হলেও, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। আরও গভীরে এমন অনেক ছাপাখানা আছে, যার ফলাফলকে সরকার একেবারেই স্বীকৃতি দেয় না। অর্থাৎ আমাদের গোটা দেশের পড়াশোনার যে নিয়মকানুন, তাতে বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় কিছু কিছু জায়গা থেকে শংসাপত্র পাওয়া যায় যেগুলোতে অন্যেরা মূল্য দেয়। সেই যে মূল্য সেটা নিয়ামক সংস্থা অর্জন করে বহু বছর ধরে কোনো একটা পরীক্ষিত ব্যবস্থার মাধ্যমে। সেই ব্যবস্থার যে সবটা সঠিক এমনটা নয়। তার মধ্যেও প্রচুর ভুল আছে। সেখানেও অনেক রকমের গন্ডগোল হতে পারে এবং সেই গন্ডগোল নিয়ে কাগজে খবরও হয়। যেমন অনেক বোর্ডের পরীক্ষায় কোনো সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়, তাই নিয়ে বিভিন্ন গোলমাল হয়, কোর্টে কেস চলে, পুলিশ তদন্ত করে। কিন্তু তার ফলেই যে সেই নিয়ামক সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় এমনটা নয়। এই প্রেক্ষিতে এবারের অতিমারী পরিস্থিতিতে যে বিভিন্ন পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল এবং তার বিকল্প হিসেবে অন্যান্য কয়েকটি নিয়ম-এর মাধ্যমে নম্বর বসানো হচ্ছে, তার ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা চলবেই। এই যে মূল্যায়ন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা, এবং তার ফল পরবর্তীকালে কি হবে, সেই নিয়ে সংশয় থাকবেই। তাই এবারের সমস্যা ভগবানের পরীক্ষা নেওয়ার থেকেও জটিল। এ একেবারে পরীক্ষার পরীক্ষা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মূল্যায়ন পদ্ধতির মূল্যায়ন।

কেরালা ব্যতিক্রম, তবে মোটের ওপর দু-একটি রাজ্য ছাড়া ভারতবর্ষে এবার কোথাও স্কুল স্তরের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের অর্থাৎ দশ বা বারো ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে বলে নির্ধারিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই এই ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি চলে, যেখানে সারা বছর ধরে একটি ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগের ভিত্তিতে নম্বর বা মান নির্ধারিত হয়। পদ্ধতির ধারাবাহিকতাই সেখানে মূল প্রক্রিয়া। অবশ্যই শেষের দিকে একটা পরীক্ষা হয়, কিন্তু তার ওপর সম্পূর্ণ মূল্যায়ন নির্ভর করে না। অন্যদিকে আমাদের দেশে বোর্ডের যে পরীক্ষাগুলো এতদিন চালু ছিল, তাতেও স্কুল থেকে একটা নম্বর পাঠানো হতো। কখনও বা মৌখিক পরীক্ষার নম্বর, কখনও বা হয়ত ব্যবহারিক পরীক্ষার মূল্যমান। কিন্তু বেশিরভাগটাই ছিল স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। মূল্যায়ন করতেন একেবারে অন্য কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা। সেই নম্বরগুলো যেত একটি কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থায়, যেখান থেকে সার্বিক ফলাফল ঘোষণা করা হত। এবার কিন্তু সেই নিয়ম বদলে যাচ্ছে। তাহলে কোন জায়গাটা পরীক্ষা করা হচ্ছে না? এক হল স্মৃতিশক্তি, আর দুই হল স্বাধীনভাবে অন্যের সহায়তা ছাড়া বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। বদলে বিশ্বাস করা হচ্ছে স্কুলের মূল্যায়ন, পড়ুয়ার আগের প্রাপ্ত নম্বর এবং বিদ্যালয়ের গত কয়েক বছরের ফলাফলের ওপর। বেশ যুক্তিপূর্ণভাবে ভেবেছেন আইসিএসই বোর্ড, তবে তাদের পদ্ধতি বেশ জটিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা দুরূহ। তুলনায় একটু সহজে বোঝা যায় সিবিএসই বা পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের নিয়মকানুন। তবে তাতে যুক্তির জোর সামান্য কম। এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষিকাদের মুশকিল বেশি। কারণ পড়ুয়া এবং অভিভাবকেরা নম্বর বাড়ানোর জন্যে চাপ দিলে তাঁদের ঝামেলা বাড়বে।

আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি যুক্তি অবশ্যই সরকারের হাতে থাকবে যে এই ধরনের পরীক্ষা চালাতে গেলে হয়তো আবার কোভিড সংক্রমণ বাড়বে। স্বভাবতই এর উলটো যুক্তি হল যে আরও বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম তো হচ্ছে। বিশেষ করে যে কথাটা বারবার ফিরে আসছে, ধর্মীয় সম্মেলন অথবা রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল এসব তো আর বন্ধ হচ্ছে না। এই যুক্তি এবং পালটা যুক্তির মধ্যে দিয়েই আমাদের এগোতে হচ্ছিল। তবে এখানে আরও একটি গুরুতর সমস্যা উপস্থিত। এতক্ষণ আমরা পরীক্ষা না হওয়ার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতির কথা বলছিলাম। এবার আসবে পরীক্ষার অন্য এক ধরনের মূল্যায়নের কথা, যা পদ্ধতির নয়, একেবারে পরীক্ষার। অর্থাৎ একটি পরীক্ষার দাম কতটা? কোনো একটি পরীক্ষার মূল্য নির্ভর করে সেই পরীক্ষাটি দিয়ে সফল হলে কি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে সেই নিরিখে। আজকের দিনে একথা একেবারে পরিষ্কার যে ভারতবর্ষে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পর বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত যে সমস্ত পড়াশোনার সুযোগ সুবিধা আছে সেই জায়গাগুলোতেই প্রতিযোগিতা তীব্র। আনুমানিক একটা হিসেবে বলা যেতে পারে যে শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান মিলিয়ে ভারতের সবচেয়ে নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন অন্তত কুড়ি লক্ষ অত্যন্ত মেধাবী পড়ুয়া, যেখানে আসন সংখ্যা খুব বেশি হলে দু'লক্ষ। এই যে দশে এক হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা, তার একটা বাজার আছে। ধরুন কুড়ি লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে এক লক্ষ টাকা করে খরচ করে। গুণফল খুব সহজে দাঁড়ায় কুড়ি হাজার কোটি ভারতীয় মুদ্রা। এই হিসেব প্রতি বছরের এবং এই চালু কাঁচা টাকার বাজার বন্ধ করা শক্ত। সেই কারণেই বোর্ডের পরীক্ষা বন্ধ হলেও, যেভাবে হোক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলি করতেই হবে, কারণ এখানকার নম্বর বা মেধাতালিকার মূল্য অধিক। তাই জেইই মেইনস, বঙ্গ জয়েন্ট, দেশজুড়ে এনইইটি, এইসব পরীক্ষা চলবে জুলাই অগাস্ট ধরে। অর্থাৎ যুক্তিটা কি দাঁড়ালো? বিভিন্ন বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিকে ফিজিকস পরীক্ষা নেওয়া গেল না, কিন্তু প্রযুক্তি প্রবেশিকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সেই ফিজিক্স-এরই প্রশ্নপত্র হানা দিল। এই হল পরীক্ষার সঠিক মূল্যায়ন। সেখানে পরীক্ষার্থীর মূল্যায়ন গৌণ, মুখ্য পরীক্ষা।

অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে কোনো একটি পণ্যের মধ্যেই পড়ে পরীক্ষা। ভাবনাটা হয়ত কিছুটা বিমূর্ত, তবে এর অর্থনৈতিক অনুসিদ্ধান্তে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। পরীক্ষার মূল্যায়ন নিয়ে আমাদের দেশে এর আগে খুব বেশি হয়ত ভাবা হয়নি। তবে অতিমারী পরিস্থিতি এই বিষয়টিকে স্বচ্ছতার সঙ্গে বোঝার সময় এবং সুযোগ করে দিয়েছে। যেভাবে সুবিধাভোগের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মাধ্যমিক বোর্ড থেকে দিল্লী বোর্ডে উত্তরণ সমানুপাতিক, সেইভাবেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর করার স্বপ্ন-প্রবেশিকার তীব্র প্রতিযোগিতায় উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্ক প্রশ্নপত্র দুয়োরাণী। এর মধ্যে কোভিড বাড়াবাড়ি না করে অন্তত সুয়োরাণীর ঘর বাঁচাক। একটু স্বস্তি দিক সুবিধাভোগী তথাপি অসহায় পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবককুলকে। কোন পরীক্ষা দামী তা বোঝা হয়ে গেছে। এখন সেই বোঝা ঘাড় থেকে নামলে হয়।